মৃত্যু সম্পর্কে আমার উপলব্ধি ও বোধদয়
লিখেছেন লিখেছেন মাই নেম ইজ খান ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৭:৩২:০৯ সকাল
একটা সময় মৃত্যুকে আমার খুবই ভয় হতো। আমার কাছে মৃত্যু মানেই ভয়ংকর আতঙ্কের বিষয় মনে হতো। আমি জানি এমনটিই সাধারণত প্রায় সকল মানুষেরই হয়ে থাকে। মৃত্যু, পরকাল সম্পর্কে আমাদের অপর্যাপ্ত জ্ঞান, তথ্য-উপাত্ত আর উপলব্ধিই মূলত: এর পেছনের প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। অথচ প্রকৃত মুসলিম এবং মুমিনের জীবনে এমনটি হওয়ার কথা নয়। অন্তত: আমার বর্তমান উপলব্ধি তাই বলে।
আলহামদুলিল্লাহ মৃত্যু সম্পর্কে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য, ইলম ও বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে এ সম্পর্কে আমার মাঝে বিরাজমান ভয়, আতঙ্ক আর অস্বস্তিকর অবস্থা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। বিশেষত: বর্তমানে আমি যে বইটির কাজ করছি, শায়খ আনওয়ার আল আওলাকী রহ. এর লেকচার ‘পরকালের প্রস্তুতি’ এই বইতে এমন এমন বিষয় আসছে পর্যায়ক্রমে যা পড়ে আমার আগেকার মৃত্যু ভীতি ও আতঙ্কের বিষয়টিকে শিশুদের অপরিণত টেনশনের মতো মনে হচ্ছে।
কারণ, মৃত্যু একটি অত্যাবশ্যকীয় বাস্তবতা। এটি আসবেই। মৃত্যুকে এড়াবার কোনো উপায় নেই। যদি ঈমান আর ইসলামের উপর মৃত্যু আসে তাহলে টেনশনের কিছু নেই। টেনশন, ভয় আর আতঙ্ক তো কাফির ও মুনাফিকদের জন্য। মুমিন বরং মৃত্যুকে এনজয় করে। তার প্রেমাস্পদ মহান প্রভুর সাথে সাক্ষাতের পথে একমাত্র প্রতিবন্ধক মৃত্যুর আগমনে উল্লসিত হয়। আনন্দিত হয়। মৃত্যুর ফিরিশতা আজরাঈল আ. সম্পর্কে তখন আর তার মনে কোনো আলাদা ভীতিকর ইমেজ সৃষ্টি হয় না। বরং অন্যান্য ফিরিশতাদের মতো তাঁকেও একজন সম্মানিত ও স্বাভাবিক ফিরিশতা হিসেবেই বিবেচনা বোধ সৃষ্টি হয়।
সারা জীবন আমরা আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রে, পরিবার পরিজন ও
সন্তানদের ক্ষেত্রে সব সময় যে ভুলটি করে থাকি তাহলো আমরা কখনোই আমাদের জীবন ও দৈনন্দিক কাজ-কর্মে মৃত্যুর বিষয়টি কোনো মতেই আনতে চাই না। সবাই যেনো এটিকে যেভাবেই দূরে সরিয়ে রাখতেই সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট। যেনো কোনোভাবেই মৃত্যুর কথা কারো স্মরণ না হয় সেজন্য আমরা সক্রিয়। ছেলে-মেয়ে বা কেউ কখনো যদি বলে, ‘আমি মারা যাবো’ -সাথে সাথে আমরা রিএ্যাক্ট করি, “ছিছি কি সব অলক্ষুণে কথা বলে। এমন কথা কখনো মুখে আনতে নেই।”
এরপর তাকে আচ্ছা মতো সবাই মিলে বকা দেয়া হয়। যেনো সে এবং তারা সকলেই অনাদি, অনন্তকাল বেঁচে থাকবে এই পৃথিবীতে। যেনো তাদের কেউই মৃত্যুবরণ করবে না।
বরং উল্টো এক্ষেত্রে উচিত ছিলো মৃত্যুর আলোচনা আসলে তাকে পজিটিভলি গ্রহণ করা এবং বলা, “হ্যাঁ। মৃত্যু তো অবশ্যই আসবে। মৃত্যু তার নির্দিষ্ট সময়েই আসবে। এক মুহূর্ত আগেও না পরেও না। কিন্তু তুমি কি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত? তোমার মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সকল প্রস্তুতি কি সম্পন্ন হয়ে গেছে? যদি না হয়ে থাকে তাহলে যতোদিন বেঁচে আছো সেই প্রস্তুতি নাও।”
একইভাবে আমরা যখন কারো অসুস্থতা কিংবা মৃত্যুর সংবাদ শুনি তখনও আমরা এমনভাবে সব কথা বলি বা মন্তব্য করি যে, আসলে তার মারা যাওয়াটা উচিত হয়নি, এখনও তার মৃত্যুর সময় হয়নি আগেই চলে গেলো। কিংবা সকল অসুস্থই ভালো হয়ে যাবে। কিছুই হবে না। মারা যাবে না।
অথচ এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান এমন না হয়ে আসলে হওয়া দরকার ছিলো এমন। যে সুস্থ্যতা ও হায়াত তো মহান আল্লাহর হাতে। তিনি যদি আমাদেরকে আরো কিছুদিন হায়াত বৃদ্ধি করে দেন তাহলে যেনো আমরা সেই বর্ধিত সময়ে আরো বেশি ভালো কিছু কাজ করে যেতে পারি। আর যদি তিনি হায়াত শেষ হওয়া ফেরার ডাক দেন, তাহলে যেনো আমরা স্বাচ্ছন্দে ফেরার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকি।
একজন দাড়োয়ান বা চাকুরীজীবিকে যখন আমরা নিয়োগ দেই তখন তার দৈনন্দিন সময় সাপেক্ষে তার জন্য বেতন-বোনাস নির্ধারণ করা হয়। সকাল থেকে রাত। একটানা নিয়োগদাতার কথা অনুসারে সব কাজ করাই তার চাকরী। এখন তার কাজের দ্বারা নিয়োগদাতা লাভবান হলো কি না সেটি এক্ষেত্রে খুব বেশি মূখ্য নয় বরং মূখ্য হলো সে নিয়োগদাতার নির্দেশনাকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও সচেতনতার সাথে পালন করেছে কি না।
একইভাবে সেই চাকুরীজীবি তার অফিস টাইমে কি করলো না করলো সেটা তার জন্যও তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজটি তার মন মতো হলো কি না তাও তার দেখার দরকার নেই। কারণ এক্ষেত্রে নির্দেশনা তার নিজের নয় বরং তার নিয়োগদাতার কথাই স্মরণ রাখতে হবে সব সময় ও সেই অনুযায়ী নিজের ইচ্ছার অনুযায়ী হোক বা বিরুদ্ধ হোক কাজ করে যেতে হবে। নিয়োগদাতা যদি তাকে বলে তোমার কাজ শেষ বাসায় চলে যাও। তখন তার বাসায় চলে যাওয়াই কর্তব্য। নিয়োগদাতা যদি বলে আগামী মাস থেকে আর আসতে হবে না। তাহলে এই চাকরী তার শেষ -এটাই চূড়ান্ত।
একইভাবে আমরা যারা মহান আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে এই পৃথিবীতে দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছি তাদের কেনো কষ্ট হবে সেই মহান সত্ত্বার দিক-নির্দেশনা অনুসারে চলা চলে যাওয়ার ব্যাপারে যিনি আমাদের শুধু নিয়োগদাতাই নন, বরং সৃষ্টিকর্তা, রিযকদাতা ও পালনকর্তাও। তাই মহান আল্লাহ আমাদের যতোদিন এই দুনিয়ায় থাকাকে পছন্দ করেছেন ততোদিন এখানে থাকা এবং আমাদের ‘অফিস ওয়ার্ক’ করে যাওয়াই কর্তব্য। যখন তিনি আমাদেরকে এই অফিস ক্লোজ করে তার সাথে সাক্ষাত করতে ডাক পাঠাবেন তখন মনোযোগী, সচেতনভাবে যথাযথ কাজ আঞ্জাম দেয়া ব্যক্তির আনন্দিত হওয়ার মতো আমাদেরও আনন্দিত হওয়া উচিত, কারণ এখন তো বেতন, বোনাস আর উপহার প্রাপ্তির সময়।
এ বিষয়ে রাসূলের একটি হাদীস উদ্ধৃত করে আলোচনা শেষ করতে চাচ্ছি। عن عائشة قالت: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من أحب لقاء الله أحب الله لقاءه، ومن كره لقاء الله كره الله لقاءه.
فقلت: يا نبي الله أكراهية الموت؟ فكلنا نكره الموت.
فقال: ليس كذلك، ولكن المؤمن إذا بشر برحمة الله ورضوانه وجنته أحب لقاء الله فأحب الله لقاءه،
وإن الكافر إذا بشر بعذاب الله وسخطه كره لقاء الله وكره الله لقاءه.
অর্থ: “হযরত আয়শা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে, আল্লাহ তার সাথে সাক্ষাৎ করতে ভালবাসেন এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে দেখা করতে অপছন্দ করবে, আল্লাহও তার সাথে দেখা করতে অপছন্দ করবেন”।
একথা শুনে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এর দ্বারা কি আপনি মৃত্যুকে অপছন্দ করার বিষয়টি বোঝাচ্ছেন (তাহেল তো বিপদ, কারণ) আমরা কেউই তো মৃত্যুকে পছন্দ করি না।” (অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চাইলেন যে, কেউ যখন মৃত্যুকে ভালবাসেই না তার মানে কেউই তো আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইবে না। আমরা মৃত্যুকে অপছন্দ করি, এর মানে কি এই যে আমরা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকেও অপছন্দ করি?)
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাকে শুধরে দিয়ে বললেন, “আমি তো এটা বুঝাই নি। বরং আমার কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে মু’মিন ব্যক্তি যখন মৃত্যুর সন্নিকটে পৌঁছে যাবে, তখন তার কাছে এই খবরটা পৌছে দেয়া হবে যে আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন। এটা শুনে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হবে এই যে সে সামনের দিকে অর্থাৎ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকে সে ভালবাসবে এবং আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাৎকে ভালবাসবেন।
কিন্তু যখন কাফিররা মৃত্যুর কাছাকাছি এসে উপস্থিত হবে, তখন তাকে বলা হবে আল্লাহ তোমার উপর রাগান্বিত এবং আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন। এটা শোনার পর তার মরতে ইচ্ছা করবে না এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকে সে ভয় পেতে শুরু করবে এবং অপছন্দ করবে। আর তাই আল্লাহ তা’আলাও তার সাথে দেখা করতে চাইবেন না।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে মৃত্যুর জন্য, পরকালের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার তাওফীক দিন। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৭৭২ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ভালো লাগলো লেখাটি!
এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। আসলেই আপনার লিখাগুলো খুবই সাবলীল, পাঠককে ধরে রাখে অনায়াসে। আজকের বিষয়টি এমনই যে, সহজে সাধারণ মানুষ এর গভীরে যেতে চাইবে না; কিন্তু তারপরও পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি- এটি লেখকের লিখনীর দক্ষতায় সম্ভব হয়েছে। তবে
" তাই মহান আল্লাহ আমাদের যতোদিন এই দুনিয়ায় থাকাকে পছন্দ করেছেন ততোদিন এখানে থাকা এবং আমাদের ‘অফিস ওয়ার্ক’ করে যাওয়াই কর্তব্য। যখন তিনি আমাদেরকে এই অফিস ক্লোজ করে তার সাথে সাক্ষাত করতে ডাক পাঠাবেন তখন মনোযোগী, সচেতনভাবে যথাযথ কাজ আঞ্জাম দেয়া ব্যক্তির আনন্দিত হওয়ার মতো আমাদেরও আনন্দিত হওয়া উচিত, কারণ এখন তো বেতন, বোনাস আর উপহার প্রাপ্তির সময়। "- এই লাইনগুলো অনেক কিছু চিন্তা করার খোরাক যুগালো মনে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
জাজাকাল্লাহু খাইর
গুরুত্বপুর্ণ এমন বিষয়ে সাবলিল নান্দনিক উপস্হাপনার জন্যে জাযাকাল্লাহু খাইরান.....।
তাই ভয়টা যেন থেকেই যায়।
ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন