ইসলাম সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা একটি বড় সমস্যা : (পরকালের প্রস্তুতি : ২য় পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মাই নেম ইজ খান ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০২:৪৫:৫৪ দুপুর
পরকালের প্রস্তুতি
সংকলন ও সম্পাদনা:
মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক খান
(শীঘ্রই বই আকারে প্রকাশ হতে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ।)
পূর্বের লেখা: পরকালের প্রস্তুতি http://lighthouse24.org/blog/post/viewPost/?postid=1495
পূর্ব প্রকাশের পর:
কিন্তু এটিই যে আমাদের একমাত্র সমস্যা, ব্যাপারটা তা না, কারণ আপনি দেখবেন, সবাই জানে মদপান হারাম, কিন্তু তবু মানুষ সেটা খায়। সবাই জানে সুদ খাওয়া হারাম, তবু কিছু মানুষ সুদের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। সবাই জানে জামাতে সালাত আদায় করার গুরুত্বের কথা, পাচঁ ওয়াক্ত সালাত এবং রমযান মাসে সিয়াম পালনের কথা, কিন্তু তবু অনেকে এসবের ব্যাপারে উদাসীন! সবাই জানে, এমনকি একটা শিশুও জানে যে, হজ্জ হচ্ছে ইসলামের একটি স্তম্ভ, তবু এটা কি করে হতে পারে যে মুসলিমরা হজ্জ পালন করছে না? এখানে একটা বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের বিশ্বাস বা ঈমানের অপর্যাপ্ততা, দূর্বলতা।
আমাদের মনটা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে। কোন জিনিষ পারে আমাদের এই কঠিন মনটাকে নরম-কোমল করে তুলতে? পারে “আল-আখিরাহ” বা পরকালের জীবনের প্রতি ভয় ও ভালোবাসার আলোচনা। “আল-গায়েব” বা অদৃশ্যের আলোচনা।
কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
عن أبي هريرة - رضي الله عنه - أن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قال: لوتعلمون ما أعلم لضحكتم قليلاً ولبكيتم كثيرًا) رواه البخاري.
অর্থ: “হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা যদি জানতে যা আমি জানি, তাহলে তোমরা বেশি বেশি কাদঁতে আর অল্পই হাসি-ঠাট্টা করতে।” (বুখারী, মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাযা)
আখিরাহ এর বাস্তবতা আমাদেরকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারা উচিত যেমনটা পারতেন হযরত আলী রা.। তিনি বলেছিলেন, “আমি যদি আমার চোখের সামনে এখন জান্নাত দেখতে পাই তাহলে আমি জান্নাতকে ততটাই ভালবাসব যতটা জান্নাতকে নিজের চোখে না দেখে আমি ভালবাসি, কিংবা জাহান্নামকে যদি আমার চোখের সামনে আনা হয় তাহলেও আমি ততটাই ভয় পাবো যতটা আমি জাহান্নামের আগুন না দেখেও ভয় করি।”
অর্থাৎ আলী রা. জান্নাত এবং জাহান্নামের অর্থ আর বাস্তবতা খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন। তিনি এই দুনিয়ায় এমনভাবে বেঁচে ছিলেন, যেন তিনি চোখের সামনে জান্নাত এবং জাহান্নামকে দেখতেন এবং অনুভব করতেন, এটাই হচ্ছে ঈমান। যখন আমরা ঈমানের এই স্তর ও গভীরতা অর্জন করতে পারবো তখন আমরা আমাদের আভ্যন্তরীণ ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করবো।
আমরা ব্যক্তি এবং সমাজ পরিবর্তনের সেই আলোচনায় আবার ফিরে যাই। ১৯৩০ সালে আমেরিকান কংগ্রেস মদ নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাশ করল। সুবহানাল্লাহ, মদ খাওয়া যে প্রাকৃতিকভাবেই শরীরের জন্য ক্ষতিকর তা মুসলিম-অমুসলিম সকলেই বুঝতে পারে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে আমেরিকান সরকার এই আইনটি
বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিল। এই ঘটনার পর প্রায় ৫ লক্ষ লোক জেলে গেল, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় হল এই আইন বাস্তবায়নে। খুন হল হাজার হাজার লোক। মজার ব্যাপার হল, মদ খাওয়ার পরিমাণে কম-বেশ তো হলই না, উপরন্তু লোকজন নিজের ঘরে মদ তৈরি করতে শুরু করল। মদ উৎপাদনের প্রক্রিয়া বেশ অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় অসুখ-বিসুখ ছড়িয়ে পড়ল। চার বছরের দূর্বিষহ সময়ের পর আমেরিকার সরকার এই আইন বাতিল করল। তথাকথিত পরাক্রমশালী আমেরিকা এই আইন প্রয়োগ করতে পারল না, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি মদ নিষিদ্ধ করতে ব্যর্থ হল।
এবার আসুন আমরা ১৪০০ বছর আগে ফিরে যাই। জিবরীল (আঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আয়াত নিয়ে হাজির হলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (৯০)
অর্থ: “হে মুমিনগণ! এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।” (সূরা মায়িদা, আয়াত ৯০)
মদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এই আয়াতটি আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে নাযিল হল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহনী কিংবা ন্যাশনাল গার্ডের সাহায্য ছাড়া সাহাবাদের কাছে এই আয়াতটি পড়ে শুনালেন। সাহাবারা এটা শোনামাত্র রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে ঘোষণা করলেন, মদ খাওয়ার আর কোন বৈধতা ইসলামে নেই।
আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, “আমি কয়েকজন সাহাবাকে মদ পরিবেশন করছিলাম এবং আমরা তখন শুনলাম রাস্তায় ঘোষণা দেয়া হচ্ছে ‘মদ খাওয়া এখন থেকে হারাম’, তৎক্ষণাৎ আমি হাত থেকে মদের জগ ছুড়ে ফেললাম এবং সাহাবারা সকলে হাত থেকে মদের গ্লাস ফেলে দিলেন। যাদের মুখে মদ লেগে ছিল, তারা সেটা মুখ থেকে থু থু দিয়ে ফেলে দিলেন। তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যারা মদ গিলে ফেলেছেন বিধায় বমি করে পেট থেকে মদটুকু উগলে দিতে চেষ্টা করলেন। বলা হয়ে থাকে, মদীনার রাস্তায় মদের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। মদ হারাম এই খবর শোনামাত্র সাথে সাথেই সকলে তৎক্ষণাৎভাবে সে আদেশ পালন করল, কোন পুলিশের ভয় ছাড়া, কংগ্রেস কিংবা ন্যাশনাল গার্ডের হস্তক্ষেপ ছাড়া। প্রয়োজন হল না কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা লক্ষ ডলারের। কাউকে জেলে দেয়ার প্রয়োজনও পড়ল না। বাস্তবায়িত হল আল্লাহর হুকুম। কেন? কিভাবে একই আদেশ মদীনায় কাজ করল কিন্তু আমেরিকায় নয়? এখানে পার্থক্যটি হচ্ছে ঈমানের, পার্থক্যটি তাক্বওয়া ও খোদাভীতির।
সাহাবায়ে কিরাম রা. নিজেদেরকে এভাবেই আল্লাহর দেয়া আদেশগুলো মানতে নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন, আমাদেরকেও তা করতে হবে। আর এটা সম্ভব হবে তখনই যখন আমরা আখিরাতের ব্যাপারে চিন্তা করব, আখিরাত সম্পর্কে জানব এবং কথা বলব।
তো আমাদের পরকালের দিকে মহাযাত্রার এই আলোচনায়, পর্যায়ক্রমে অনেকগুলো বিষয় আসবে। আমরা প্রথমে আল-ক্বিয়ামাহ আস-সুগুরা বা গৌণ বিচার দিবস নিয়ে আলোচনা করব। এই আলোচনার আওতায় ১ নম্বরে আছে মৃত্যু। তারপর হচ্ছে (২) কবরের জীবন, এরপর থাকবে (৩) আর-রুহ বা মৃত ব্যক্তির আত্মা। এরপরে আসবে (৪) ‘আশরাতুস শা’আ’ অর্থাৎ আল ক্বিয়ামাহ এর আলামতগুলো, যেগুলোর মধ্যে ছোট বড় সব আলামত নিয়েই আলোচনা করা হবে। এরপর আসবে বিচার দিবস, যার মধ্যে প্রথমে আসবে, ১. পুনরুত্থান, ২. বিচার দিবসের ভয়ংকর পরিস্থিতি, ৩. এরপর পর্যায়ক্রমে আসবে জবাবদিহিতা, হিসাব-নিকাশ এবং প্রতিফল প্রদানের বর্ণনা। আর সবশেষে আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য, জান্নাত বা জাহান্নাম। এই রুপরেখা মেনেই আমরা আমাদের আখিরাতের দিকের মহাযাত্রার কাহিনী শুনব, এমন এক মহাযাত্রা, যাতে আমাদের সবাইকেই অংশ নিতে হবে।
আখিরাতের শুরু হয় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, যেটাকে বলা হয় ছোট বা গৌণ বিচার দিবস। বুখারীতে বর্ণিত আছে,
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الأَعْرَابِ جُفَاةً يَأْتُونَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَيَسْأَلُونَهُ مَتَى السَّاعَةُ، فَكَانَ يَنْظُرُ إِلَى أَصْغَرِهِمْ فَيَقُولُ " إِنْ يَعِشْ هَذَا لاَ يُدْرِكْهُ الْهَرَمُ حَتَّى تَقُومَ عَلَيْكُمْ سَاعَتُكُمْ.
অর্থ: “হযরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে কিছু বেদুইন এসে জানতে চাইল, “আস-সা’আ (কিয়ামত ও বিচার দিবস) কখন হবে?”।
তিনি তাদেরকে ভাল করে দেখলেন এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়স্ক যে ছিল তার দিকে নির্দেশ করে বললেন, “এ বালকটি বৃদ্ধ হবার আগেই, তোমাদের বাকি সকলের বিচার দিবস বা তোমাদের মৃত্যু ও জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ হয়ে যাবে।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৫৯০)
অর্থাৎ, মৃত্যুর পরপরই মানুষের বিচার দিবসের সূচনা হয়। তাই মৃত্যুকে বলা হয় ছোট বিচার দিবস। মৃত্যু, যেটাকে আসলে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই, সবাই মৃত্যুবরণ করবে।
ইনশাআল্লাহ চলবে...
বিষয়: বিবিধ
১২১৩ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার বইয়ের জন্য শুভকামনা রইল।
১ম কমেন্টকারী হওয়ায় আপনার জন্য বিশেষ এই জ্যুস
আচ্ছা - মন - ক্বলব - নাফস > কী একই জিনিষ? নাকি কোন পার্থক্য আছে?
আপনি বল্লেনঃ- আমাদের মনটা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে। >> এখানে ‘মন’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে?
মাঝেমধ্যে দেখা যায়, ধর্মিয় কিছু পালন করার ক্ষেত্রে মন শক্ত - ঠিক সে সময়েও অন্য কোন আবেগী বিষয়ে ‘মন’ খুবি কোমল-নরম ও অশ্রু-শিক্ত! তাহলে কি বলতে পারি একই ‘মন’ এক সাথে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের জন্য একাধিক রুপ ধারন করতে পারে?
ঈমানের অভাবই মানুষ কে অপরাধে উৎসাহিত করে। সুদ,ঘুষ হারাম জেনেও অনেকে বলেন যে যেহেতু জিবন রক্ষা ফরজ তাই তারা চাকরির খাতিরে এই কাজ গুলি করছেন। অথচ চাকরি থাকলেই যে তাদের জিবন রক্ষা হবে সেই নিশ্চয়তা কেউ দেয়না।
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন