একটি সুন্দর বায়োডাটার জন্য...
লিখেছেন লিখেছেন মাই নেম ইজ খান ০৪ মার্চ, ২০১৪, ০৭:৪৯:১১ সকাল
বায়োডাটা বা জীবন বৃত্তান্ত। একটু সচেতন যে কোনো মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। উচ্চতর কোনো শিক্ষার জন্য হোক কিংবা চাকরীর আবেদনে। সরকারী-বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো বিষয়ে নিজের একটি অবস্থান তৈরী করা কিংবা নূন্যতম বিবাহের জন্য হলেও আজকাল একটি সুন্দর বায়োডাটা না হলে আর চলেই না।
বাস্তবে অবস্থা যাই হোক না কেনো, সবাই চায় তাদের বায়োডাটা হোক সবার চাইতে সুন্দর। তাই কেউ কেউ নিজ বায়োডাটায় নিজ সম্পর্কে অনেক বিষয় একটু বাড়িয়েও লেখার চেষ্টা করে থাকেন। ক্ষেত্র বিশেষে যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলেও তা উল্লেখ না করে অবলীলায় লিখে দেন বিশেষজ্ঞ। বায়োডাটায় প্রত্যেকে নিজের যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার প্রায় সব উল্লেখ করলেও কেউ কিন্তু ভুলেও নিজ ব্যর্থতা কিংবা দূর্বলতা সম্পর্কে নূন্যতম ধারণাও দেন না। বরং সম্পূর্ণ বিষয়টি নিজ বায়োডাটা থেকে স্বযতনে আড়াল করে রাখেন। কারণ কেউই চান না তার সম্পর্কে মন্দ কিছু অন্যরা জানুক। তার জীবনের লুকায়িত অন্যায় আর গুনাহ সম্পর্কে কেউ অবগত হোক। আর যে অফিসে বা যার কাছে বায়োডাটা জমা দেয়া হচ্ছে তারা তো আর অদৃশ্যের খবর রাখেন না। সুতরাং তাদের কাছে কিছু বাড়িয়ে-কমিয়ে বললেই বা বিশেষ ক্ষতি কি!
আমাদের জন্ম থেকে নিয়ে একটি সুন্দর বায়োডাটা বিনির্মাণের এই যে চেষ্টা প্রচেষ্টা তার সাথে তুলনীয় আর কিছুই এ মুহূর্তে স্মরণ আসছে না। কতো চেষ্টাই না আমরা করি নিজ নিজ বায়োডাটাটিকে সমৃদ্ধ করার জন্য!
সন্তানের বায়োডাটা সমৃদ্ধ করতে জন্মের পূর্বেই অনেক পিতা-মাতা এ নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কোথায় পড়াশোনা করবে, কেমন হবে, তার বায়োডাটায় নিজ নিজ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কতোটা পূর্ণ হবে সে নিয়ে মহা টেনশনে কাটে অভিভাবকদের দিন-রাত। আদরের সন্তানের ভবিষ্যত গন্তব্য সুন্দর করতে তার শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে সে যে কি অক্লান্ত পরিশ্রম আর প্রচেষ্টা মা-বাবার। সাত সকালে ঘুম থেকে ঢুলু ঢুলু চোখে সন্তানকে উঠিয়ে কোনোমতে ছোট ছোট রিকসাকোচ কিংবা প্রাইভেট গাড়িতে করে একেবারে ফার্মের মুরগীর বাচ্চার মতো দিয়ে আসা হয় স্কুলে। বাচ্চার ওজনের চাইতেও অনেক সময় বেশি ওজনের হয়ে যায় তার পিঠে ও কাঁধে করে বহন করে নেয়া পাঠ্যবইয়ের আকার-অবয়ব আর ভার। এই যে শুরু হলো। এরপর এই গাড়ি চলতে থাকে অবিরাম। লক্ষ্য একটাই, একটি সুন্দর ক্যারিয়ার। একটি সুন্দর বায়োডাটা। যেনো জব বা ভবিষ্যতের যে কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্ডিডেট হিসেবে দাঁড়ালে এই বায়োডাটাটাই তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অন্যদের চাইতে উচ্চতর সম্মান ও মর্যাদার আসনে তাকে অধিষ্ঠিত করায়।
আমাদের সমাজের চলমান 'বায়োডাটা' সম্পর্কে এই সচেতনতা এক হিসেবে খুবই প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু এই প্রশংসা পরক্ষণেই মিলিয়ে যেতে বাধ্য হয় যখন মানুষ তার এই সকল চেষ্টা প্রচেষ্টা কেবলমাত্র দুনিয়ার এই সামান্য কিছু সময়ে একটু সুখ, ভোগ আর বিলাসের জন্যই বিভোর হয়ে থাকে। এতো কষ্ট করে, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ৩০-৩৫টি বছর যেই বায়োডাটা তৈরীর পেছনে মহাযত্নে ব্যয় করা হলো এই জীবনের পরে এই বায়োডাটার আর কি কোনো মূল্য থাকবে?
মানব হিসেবে বর্তমান গড় আয়ূ ৬৫ বছরের মধ্যে যদি ঠুনকো এক বায়োডাটা তৈরী করতেই ৩০-৪০ বছর পার হয়ে যায় তাহলে এরপর এই বায়োডাটা দিয়ে কতটুকুই আর সুখ ভোগ করা সম্ভব? কয়দিন? কয় বছর?
এই সামান্য সময় পর বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পূর্বে যে কারো ইহজীবন সাঙ্গ হবে না তাও তো কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না।
স্বাভাবিক আয়ুস্কাল কিংবা অস্বাভাবিক দ্রুততায় মৃত্যু পরবর্তী এক অনাদি অনন্ত জীবনের শুরুতে, একেবারে প্রারম্ভে এই জীবন, জগত ও মহাবিশ্বের যেই মহাপ্রভূর সামনে উপস্থিত হতে হবে সেদিন আমি কি একেবারে খালি হাতেই যাবো? সেদিনের জন্য আমার বায়োডাটাটে কেমন হবে, তা কি একটু ভেবে দেখেছি?
পরকালের সেই কঠিন দিনে যেই বায়োডাটা প্রতিটি মানুষের অনাদি অনন্ত জীবনের মূল মানদন্ড হিসেবে নির্দিষ্ট হবে সেই বায়োডাটায় আমার সম্পর্কে প্রতিনিয়ত কি তথ্য যুক্ত হচ্ছে তা কি একবারও ভেবে দেখেছি?
দুনিয়ার বায়োডাটায় যাচ্ছে তাই লিখে রাখলেও তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না অনেক সময়ই। কারণ যারা বায়োডাটা দেখেন ও যাচাই করেন তাদের পক্ষে বায়োডাটার অনেক তথ্যই বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখা সম্ভব হয় না -অদৃশ্যের উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে। কিন্তু মহান প্রভূর সামনে যখন আমার বায়োডাটা উন্মুক্ত করা হবে তখন তো আর সেখানে কোনো লুকোচুরির সুযোগ থাকবে না। কারণ তিনি তো মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।
সেদিন সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে প্রত্যেকের বায়োডাটাই উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। প্রত্যেকের ভালো মন্দ, যোগ্যতা, ব্যর্থতা, ভালো-মন্দ সবই উন্মুক্ত হয়ে যাবে। সবার বায়োডাটা সবাই দেখতে পারবে। আধুনিক কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন আমরা যেমন পৃথিবীর অসংখ্য প্রান্তে বসেও একই সময়ে একই ব্যক্তি ও তার কর্মকে সবাই একসাথে নিখুঁতভাবে দেখতে পারি, কিয়ামতের সেই কঠিন দিনের অবস্থা হবে এর চাইতেও আরো আধূনিকতম। সেদিনের সেই বিচার দিবসে আমার বায়োডাটা আমাকে হাসাবে না কাঁদাবে? -একবারও কি ভেবে দেখেছি?
নি:শ্বাসটি বন্ধ হয়ে যাওয়া বা শ্বাস-প্রশ্বাসে সামান্য ব্যতিক্রম হওয়ার সাথে সাথেই কিন্তু আমাদের দেহঘড়ি আর সার্ভিস দিবে না। হার্টের সংযোগটি যদি তার স্রষ্টার পক্ষ থেকে কাটা পড়ে যায় তখন কিন্তু আর যতো বড় আর বিশাল আকৃতির দেহসৌষ্ঠবই হোক না কেন, এগুলো কোনো কাজে আসবে না।
আর এভাবে এই দুনিয়ার জীবন থেকে বিদায়ের সূচনা আসলে এক অনাদি অনন্ত মহাজীবনের প্রবেশ দ্বার উন্মুক্ত করবে মাত্র। দুনিয়ার একটি স্তর অতিক্রম করে পরবর্তী অনন্ত -অসীম স্তরে প্রবেশ করবে সবাই। আর সেই প্রবেশ দ্বারেই সবার আগে চেক করা হবে সকলের বায়োডাটা। প্রতিটি মানুষের এই পার্থিব জীবনের প্রতি মুহূর্তের কাজ-কর্ম।
কিন্তু তখন আর সেই বায়োডাটায় কোনো তথ্য যুক্ত করা বা মুছে ফেলার অপশন থাকবে না। দম বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথেই বায়োডাটায় সিল-ছাপ্পর মারা হয়ে গেলো। এবার এটি মলাটবদ্ধ হয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে চলে যাবে অটোমেটিক। এরপর মহান রব্বে কায়েনাত, মহান বিচারপতি রাব্বুল আলামীন প্রত্যেকের বায়োডাটা তাদেরকেই পড়তে বলবেন। একই সাথে তাদেরকে নিজ নিজ ব্যাপারে কি সাজার উপযুক্ত তারা সেটিও তাদেরকেই নির্ধারণ করতে বলবেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন-
وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا (13) اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا (14) مَنِ اهْتَدَى فَإِنَّمَا يَهْتَدِي لِنَفْسِهِ وَمَنْ ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا وَلا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولًا (15)
অর্থ: "আর আমি প্রত্যেক মানুষের বায়োডাটাকে (কর্মকে) তার ঘাড়ে সংযুক্ত করে দিয়েছি এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য আমি বের করব একটি পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটা, যা সে পাবে উন্মুক্ত।
(তাকে সেদিন বলা হবে) পাঠ করো তোমার কিতাব, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশকারী হিসেবে যথেষ্ট।
যে হিদায়াত গ্রহণ করে, সে তো নিজের জন্যই হিদায়াত গ্রহণ করে এবং যে পথভ্রষ্ট হয় সে নিজের (স্বার্থের) বিরুদ্ধেই পথভ্রষ্ট হয়। আর কোন বহনকারী অপরের (পাপের) বোঝা বহন করবে না। আর আমি কোনো জাতিকে আমার রাসূল প্রেরণ করে সতর্ক না করে আমি আযাব দেই না।" (সূরা ইসরা, আয়াত ১৩-১৫)
কি কঠিন সময় হবে সেটি!
কি ভয়ংকর হবে সেই দিন।
তার জন্য যে আজই ভাবা দরকার আমাদের। সেদিনের সেই মহা বিপদ থেকে মুক্তি পেতে, চিরস্থায়ী সুখের আবাস নিশ্চিত করতে আজ থেকেই নিজ নিজ বায়োডাটা সমৃদ্ধ করতে হবে আমাদের।
আমাদের প্রতি দিনের নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, কুরবানী, নফল সাদাকা, অপরের সাথে হাস্যমুখে কথা বলা, কারো সামান্য উপকার করা, কিংবা কারো জন্য দোয়া করা সবই কিন্তু এই বায়োডাটায় পজেটিভ হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। একইভাবে আমাদের প্রতিটি মন্দ, গর্হিত ও অন্যায়কাজও কিন্তু বাদ যাচ্ছে না।
তাই আজকেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এখনই।
আমরা আমাদের প্রকৃত 'বায়োডাটা' কি রকম দেখতে চাই!
মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন। যেনো আমরা নিজ নিজ বায়োডাটায় ভালো ভালো তথ্য সংযুক্ত করতে পারি। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৫৪৪ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দুনিয়ার বায়োডাটাতে কেউ কখনই নিজের খারাপ দিকটার কথা বলে না ।
কোন ছেলে বা মেয়ে কি তার বায়ো ডাটাতে লেখে যে তার একজনের সাথে অ্যাফেয়ার ছিল/আছে ?
বা এটাও কি কোন ছেলে বা মেয়ে লিখে যে সে কতটা ছেলে বা মেয়েকে ছ্যাকা দিয়েছে ?
বা আপনি যে প্রতিষ্ঠান হতে চলে আসছেন আরেক প্রতিষ্ঠানে সেখানে কি লিখেন যে ভাল স্যালারীর জন্যই আসা বা আপনার কোন ত্রুটির কারনে যদি আপনাকে আপনার আগের প্রতিষ্ঠান যদি আপনাকে রিজাইন দেওয়ায় তা কি নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি বায়ো ডাটাতে লিখেন ?
মহান আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ বায়োডাটা সংশোধনের দিকে মনোযোগ দেয়ার তাওফীক দিন, আমীন।
আন্তরিক ধন্যবাদ।
অনেক সুন্দর বলেছেন। সব মিলিয়ে আপনার এই ব্লগটি অত্যন্ত চমৎকার। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের সকলের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বায়োডাটা তার রহমতের ফিল্টারে পরিশুদ্ধ করে ভাল কাজগুলোকে সেইভ এবং মন্দ কাজগুলো ডিলিট করে দেন।
এই বোধ বা চেতনাই পারে একটি সুখি সমৃদ্ধ সমাজ তৈরী করতে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন