ঐশীদের অভিভাবকগণ একটু ভেবে দেখবেন কি?

লিখেছেন লিখেছেন মাই নেম ইজ খান ২৭ আগস্ট, ২০১৩, ০৯:২০:০৩ সকাল



মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,

الرَّحْمَنُ (1) عَلَّمَ الْقُرْآَنَ (2) خَلَقَ الْإِنْسَانَ (3) عَلَّمَهُ الْبَيَانَ (4)

“পরম করুণাময়, দয়ালু আল্লাহ। তিনি (মানুষকে) শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।” (সূরা আর রাহমান ৫৫ : ১-৪)

পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত চারটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত বা বাক্যের মধ্যে মহান রাব্বুল আলামীন একটি বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন। তিনি প্রথমে ‘আর রাহমান(পরম করুণাময়)’ বলে তাঁর নিজের পরিচয় দিয়েছেন। এরপর বলেছেন, মানুষদেরকে কুরআন শিক্ষা দেয়ার কথা। এরপর বলেছেন তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন ও তাকে ভাষা শিখিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে আমরা দেখি যে, মানুষ পৃথিবীতে আগে আসে, তারপর সে ধীরে ধীরে ভাষা ও কথা-বার্তার সক্ষমতা লাভ করে, এরপর হয়তো সে কুরআনের শিক্ষা অর্জন করে। এই হিসেবে পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াতে আগে মানুষ সৃষ্টি, তারপর মানুষকে কুরআন শিক্ষাদান ও ভাষার যোগ্যতা প্রদান করার বিষয়টি বলা উচিত ছিলো। কিন্তু আমরা দেখি যে, মহান আল্লাহ এখানে এর বিপরীত আগে কুরআন শিক্ষা দেয়া, এরপর মানুষ সৃষ্টির কথা বলেছেন।

মুফাসসিরীনে কিরাম এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন যে, এখানে আমাদের স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মানুষ সৃষ্টির কথা আগে উল্লেখ করে তারপর তাকে কুরআন শিক্ষা দেয়ার কথা বলাটা ক্রমানুসারে অগ্রগণ্য হওয়া উচিত ছিলো বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে মানুষ যতক্ষণ না সে তার সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহকে চিনবে এবং কুরআনের ইলম অর্জন করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেবলমাত্র জন্মগ্রহণ আর রক্ত-মাংসে সুস্থ-সবলভাবে গড়ে উঠার কারণেই সে প্রকৃত মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। অর্থাৎ একজন মানুষ আর একটি প্রাণীর মাঝে ব্যবধান এখানেই যে, একজন কুরআনের জ্ঞান অর্জন করে শিক্ষিত হবে, মহান আল্লাহকে চিনবে, তার সম্পর্কে জানবে। আর অপরটি কেবল জন্মসূত্রে প্রাপ্ত তার দেহ বড় করা আর কিছু জৈবিক চাহিদার পেছনেই সারা জীবন ব্যয় করা। একজনের মাঝে কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করার মতো যোগ্যতা ও সামর্থ দেয়া হয়েছে, অপরটির মাঝে তা দেয়া হয়নি। তাই একটি চতুস্পদ প্রাণীর চেয়ে

একজন মানুষ তখনই শ্রেষ্ঠ ও আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে, যখন সে কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। মহান আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করবে। শিরক ও বিদআতমুক্ত হয়ে একনিষ্ঠ ঈমান ও তাওহীদী বিশ্বাসে বলিয়ান হবে।

একটি আদম সন্তান বা সৃষ্টির সেরা জীব একজন সম্মানিত মানুষ যখন ঈমান-আক্বীদা সংক্রান্ত ইসলামের মূল বুনিয়াদী বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করবে, তখনই সে আসলে মহান আল্লাহর কাছে একজন মানুষ হিসেবে পরিগণিত হবে। কুরআনে বর্ণিত ইসলামের এই মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া একজন ব্যক্তি মানুষের আকৃতিতে জন্মগ্রহণ করতে পারে, কিন্তু সে চতুস্পদ প্রাণীর চাইতে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। (অবশ্য ইসলামের মৌলিক বিষয়ের অপরিহার্য জ্ঞান অর্জনের পর জাগতিক যে কোনো উচ্চশিক্ষা গ্রহণে শরীয়তের পক্ষ থেকে কোন বাঁধা নেই।)

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের বর্তমান সমাজে কুরআন ও ইসলামের মৌলিক শিক্ষা তথা ঈমান-তাওহীদ, শিরক-বিদআত এবং দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের অপরিহার্য নির্দেশনার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। বিশেষত: শিশু-কিশোরদেরকে তাদের বাল্যকাল থেকেই এ ব্যাপারে একটি বুনিয়াদী শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত করে ফেলার কারণে ভবিষ্যত প্রজন্মের অবস্থা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভাবতেই গা শিউরে উঠে। এক সময় এদেশে মুসলিম সন্তানরা তাদের অভিভাবকদের সাথে ভোরে উঠে নামাজ পড়ে কুরআন পড়া শিখতো। প্রতিদিন সকালে ভোরের পাখিদের কলতানের সাথে প্রতিটি ঘরের জানালা দিয়ে কুরআন তিলাওয়াতের সুমধুর আওয়াজ ভেসে আসতো।

কিন্তু বর্তমানে এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর আগের মতো মসজিদে ফজরের নামাজে পিতার হাত ধরে শিশুদের আগমন লক্ষ্য করা যায় না। ঘুম থেকে উঠে কুরআন পাঠের অভ্যাসের পরিবর্তে এখন আমরা প্রতিদিন ছোট-ছোট মুসলিম শিশুদেরকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠিয়ে তাদেরকে স্কুলে, কিন্ডারগার্টেনে বা কোচিংয়ে পাঠিয়ে দেই। মুসলিম ঘরগুলো থেকে কুরআনের তিলাওয়াত ভেসে আসার পরিবর্তে হারমোনিয়ামের সুর শোনা যায়।

বাচ্চারা ঘুমের রেশ নিয়ে চোখ ডলতে ডলতে স্কুল ভ্যানে করে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায়। তারা আর কুরআনের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায় না। এই যে তাদের জীবনের চাকা ঘোরা শুরু হলো, ব্যাস এভাবেই চলতে থাকে। তার সামনে পুরো জীবনের একটি মাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারিত করে দেয়া হচ্ছে। আর তা হলো ভালো রেজাল্ট করে ভালো একটি চাকরী বা ব্যবসা করতে হবে। অনেক টাকা ইনকাম করতে হবে। সুন্দরী একটি মেয়েকে বিয়ে করে সুখের জীবন কাটাতে হবে। এটিই সর্বোচ্চ সফলতা। অথচ নিজ স্রষ্টা মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন, কুরআনের শিক্ষা বঞ্চিত এবং ইসলামের মূল বুনিয়াদী বিষয় সম্পর্কে অচেতন হয়ে রক্ত-মাংসের মানুষ হলেও প্রকৃত মানুষ কখনোই হওয়া যায় না। কেবল জৈবিক চাহিদা পূরণের এমন জীবনাচরণই যদি সব হয় তাহলে চতুস্পদ প্রাণীর থেকে আমাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রইলো কোথায়?

আজকের শিশুটিই আগামী দিনের নবীন-যুবক-অভিভাবক। এরপর সে-ই এক সময় সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে। আজ যদি এই শিশুটিকে ঈমান ও তাওহীদের মৌলিক শিক্ষা না দেয়া হয়, তার সাথে তার প্রতিপালকের সম্পর্ক জুড়ে দেয়া না যায়, তবে কিয়ামতের দিন কিন্তু এজন্য আমাদেরকেই সবার আগে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

আজ আমরা যারা অনেক কষ্টে উপার্জন করে, খুবই আদর আর যতেœর সাথে নিজ নিজ আপন সন্তানদেরকে লালন-পালন করছি। তাদেরকে উত্তমরূপে গড়ে তুলতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছি। প্রিয় সন্তান ও সজনদের শারীরিক সুস্বাস্থ্য আর সুঠাম দেহের জন্য বিভিন্ন উপাদেয় খাদ্য-খাবার এবং ভিটামিন এনে দিচ্ছি, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছি যে, আমাদের সন্তানদের নৈতিক ও আদর্শিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে কি? তাদের আত্মিক উন্নতি ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ার জন্য ঈমান ও ইসলামের মূল বুনিয়াদী সঠিক শিক্ষা কি তারা পাচ্ছে?

সন্তানদেরকে মহান আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণে বড় হয়ে এখন আর তারা নিজ অভিভাবকদের কথাই শুনে না। অনেক সন্তান আজ নিজ পিতা-মাতাকেই সম্মান করে না। এর মূল কারণ হলো, আমরা তাদেরকে ঈমান ও তাওহীদের শিক্ষা দেই নি। তাদের নৈতিকতাকে মজবুত করিনি। যার কারণে তারাও আজ নীতিহীন চতুস্পদ প্রাণী আর জড়পদার্থের মতোই আচরণ করছে। আমরাও যেন দিন দিন এতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। এখন তো বৃদ্ধ মাতা-পিতাদের জন্য পাশ্চাত্যের ধাঁচে ‘ওল্ডহোম’ও তৈরী করা হয়েছে। যেনো তাঁদেরকে অপ্রয়োজনীয় ও বিরক্তিকর হিসেবে সেখানে নির্বাসন দেয়া যায়।

আমাদের দেশের বর্তমান সরকারী, বেসরকারী, ইংলিশ মিডিয়াম, ক্যাডেট স্কুল এবং বিভিন্ন মাদ্রাসার শিশু শিক্ষা বিষয়ক সিলেবাসগুলোর দিকে তাকালে এক বিরাট হতাশা ছাড়া আর কিছুই বলার থাকে না। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, এই সকল প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশের সিলেবাসেই একটি ছাত্রের জন্য বিশেষ করে একজন শিশু ও কিশোরের জন্য অপরিহার্য নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা নেই বললেই চলে। ইসলামের মৌলিক ও বুনিয়াদী বিষয়ের অভাবও বলে শেষ করার মতো নয়। আর ইসলামের নামে যা কিছু সামান্য পাঠ্যও আছে তার অধিকাংশই ইসলামের বিকৃতি ও অপব্যখ্যা।

প্রকাশনার জগতেও মুসলিম সন্তানদের ঈমান, আকীদা, নৈতিকতা বিনির্মাণের মতো ভালো বই নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে সংকট যে কি পরিমাণ প্রকট, তা ভুক্তভোগীদের জন্য বলার অপেক্ষা রাখে না। মুসলিম সন্তান বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের সহীহ ঈমান-আকীদা বিনির্মাণের লক্ষ্যে এবং সমাজে চলমান দূরাবস্থা নিরসনের জন্য আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত। অন্যথায় কিয়ামতের দিন আমাদের এই আদরের সন্তানরাই কিন্তু আমাদের জাহান্নামের কারণ হবে। তারা সেদিন মহান আল্লাহর দরবারে আমাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উত্থাপন করবে। তাদের যখন জাহান্নামে দেয়া হবে তখন তারা আমাদেরকে আগে শাস্তি দেয়ার দাবী জানাবে। আমাদেরকে তাদের দ্বিগুণ আযাব দিতে মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করবে। তারা বলবে,

يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولا (66) وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلا (67) رَبَّنَا آَتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا (68)

“যেদিন তাদের (জাহান্নামীদের) চেহারাগুলো আগুনের উপর উপুড় করে দেয়া হবে, তখন তারা বলবে, ‘হায়, আমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতাম! তারা আরো বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নেতৃবর্গ ও অভিভাবকদের আনুগত্য করেছিলাম, তখন তারা আমাদেরকে (সঠিক শিক্ষা না দিয়ে) পথভ্রষ্ট করেছে। ‘হে আমাদের রব! আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ আযাব দিন এবং তাদেরকে বেশী করে লা‘নত করুন।” (সূরা আহযাব ৩৩, আয়াত ৬৬-৬৮)

অনাগত ভবিষ্যতের এই বিভীষিকাময় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, মুসলিম শিশু-কিশোরদের জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আশা করি আমাদের এই সিরিজ প্রকাশনা মুসলিম সন্তানদের ঈমান-আকীদা বিনির্মাণে সামান্য হলেও কাজে আসবে। আল্লাহ আমাদেরকে এখনই এ ব্যাপরে উদ্যোগী হওয়ার তাওফীক দিন। আল্লাহ আমাদের সকলকে তার দীনের জন্য কবূল করুন। আমীন।

বিষয়: বিবিধ

২৩৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File