সাভার ট্র্যাজেডীর পুনরাবৃত্তি রোধে আপনার করনীয় ।
লিখেছেন লিখেছেন বিবেকের কান্না ২৭ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:১৮:৩২ সকাল
সাভারের মর্মান্তিক দূর্ঘটনা নিয়ে একদিকে আমাদের সবার মাঝে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। আরেক দিকে ভূক্তভোগী পোষাক শ্রমিকদের যেন কষ্ট আর আহাজাারির শেষ হবে না বলেই আপতত মনে হচ্ছে। আমাদেরকে অদূর ভবিষ্যতে আরো এ ধরনের দূর্ঘটনা আলোচনা সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যে হজম করতে হবে না তারই বা গ্যারান্টি কি ? বর্তমানে শত শত ত্রুটিপূর্ন বিদ্যমান ভবন নিয়ে যেমন সরকারের কোন পদক্ষেপ নাই, ঠিক তেমনি নতুনভাবে নির্মিতব্য ভবনকে ত্রুটিমুক্ত করার ব্যাপারেও কার্যকরী কোন উদ্যোগ নাই। এ অবস্থায় আমাদের সাধারন মানুষের জন্য সচেতন হবার বিকল্প কোন পথ খোলা নাই। সবার মাঝে যেন এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাই সে লক্ষ্যেই সংক্ষেপে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় উপস্থাপন করব।
মাটি পরীক্ষা/সয়েল টেস্ট ঃ ভবন ধসে পড়ার যতগুলো মৌলিক কারন আছে তার মধ্যে সঠিকভাবে মাটি পরীক্ষা না করা অথবা আদৌ পরীক্ষা না করা একটি কারন। কেননা সয়েল টেস্টের রিপোর্টের উপর নির্ভর করেই ভবনের ফাউন্ডেশন ডিজাইন করা হয় এবং এই ফাউন্ডেশনের উপরই ভবনটি দাঁড়িয়ে থাকে। এই পরীক্ষার কাজটি করতে তেমন কোন খরচ হয় না। কিন্তু যারা বাড়ী বানান তাদের প্রচন্ড অনীহা থাকে এই কাজটি করতে। ধরুন, ৫ কাঠা জমির উপর যদি আপনি একটি সুন্দর ভবন নির্মান করতে চান তাহলে আপনার আনুমানিক খরচ পড়বে ৩ কোটি টাকা । কিন্তু ভাল মানের একটি কোম্পানীর মাধ্যমে সয়েল টেস্ট করাতে সর্বোচ্চ খরচ পড়বে মাত্র ২৫ হাজার টাকা । দেখুন মোট ব্যায়ের তুলনায় সয়েল টেস্টের ব্যয় খুবই নগন্য ! অথচ এই ২৫ হাজার টাকার জন্য আপনার ৩ কোটি টাকাসহ অসংখ্য জান মাল সম্পূর্ন ঝুকিতে !! সুতরাং এ ঝুকি এড়ানোর জন্য আপনাকে নির্ভরযোগ্য একটি কোম্পানী দ্বারা সয়েল টেস্ট করাতে হবে।
বিল্ডিং ডিজাইন ঃ একটি বিল্ডিং ডিজাইনে মূলত ২টি দিক জড়িত । একটি দিক হলো আর্কিটেকচারাল ডিজাইন এবং অপরটি হলো স্ট্রাকচারাল (কাঠামো) ডিজাইন । আমরা যারা সাধারন মানুষ তারা বিল্ডিং ডিজাইন করানোর ক্ষেত্রে সঠিক ধারনা রাখিনা বলে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছি।
আর্কিটেকচারাল ডিজাইন ঃ ভবনের বাহ্যিক আকৃতি কেমন হবে বা ফ্লোরের ভিতরের রুমগুলোর বিন্যাস কেমন হবে তা নির্ধারন করাই হলো আর্কিটেকচারাল ডিজাইন । এই ডিজাইনের কাজটি সাধারনত করে থাকে একজন আর্কিটেক্ট। তবে আর্কিটেকচারাল ডিজাইন যতই ভালো হোক বা খারাপ হোক তার সাথে একটি ভবন ভেঙ্গে পড়ার কোন সম্পর্ক নাই। সুতারাং এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার এখানে প্রয়োজন নাই।
ভবনের কাঠামো ডিজাইন বা স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ঃ সম্ভবত স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে মারাত্বক ত্রুটি থাকার কারনেই সাভারের নির্মম ঘটনার শিকার দেশবাসী। সয়েল টেস্ট করানোর পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন কাজটি হলো সঠিক প্রফেশনাল ডিজাইনার খুঁজে বের করা এবং তাঁকে দিয়ে ডিজাইন করানো। এ বিষয়ে আমরা নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ে নজর রাখবো।
# স্ট্রাকচারাল ডিজাইনার অবশ্যই একজন ডিগ্রি প্রকৌশলী/ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) হবে এবং তাঁকে প্রফেশনাল ডিজাইনার হতে হবে। প্রফেশনাল বলতে বুঝাচ্ছি স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে সব বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারই স্ট্রাকচারাল ডিজাইনার নয়।
# আমরা অনেকেই একটা ভূল করে থাকি তা হলো কোন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী দ্বারা স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কাজটি করিয়ে নিই। এ কাজ কখনোই করা যাবে না। কারন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদেরকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হতে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করার মত শিক্ষাগত জ্ঞান দেয়া হয় না।
# কোন আর্কিটেক্টের কাছে যখন আর্কিটেকচারাল ডিজাইনের জন্য যাবেন, অনেক ক্ষেত্রে তখন হয়ত সে আপনাকে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করার কাজটিও করার জন্য প্রস্তাব দেবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কাজটি আসলে কে করছে ।
# অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় রাজমিস্ত্রী বা ঠিকাদারের সাথে আলোচনা করেই ৪/৫ তলা একটি ভবন নির্মান করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভবন মালিকের খামখেয়ালী আর অজ্ঞতাই দায়ী। গ্রাম বা মফস্বল শহরে এ সমস্যা বেশী দেখা যায়। এ ধরনের খামখেয়ালীপনা থেকে আমাদেরকে মুক্ত থাকতে হবে।
আপনার কঠিন কোন অসুখ হলে যেমন হন্যে হয়ে ঘুরেন ভাল ও সঠিক ডাক্তারের জন্য, ঠিক তার চেয়েও হাজারগুন বেশী গুরুত্ব দিয়ে সঠিক ডিজাইনার খুজে বের করা আপনারই দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আপনিই হতে পারেন আরেক সাভার ট্রাজেডীর মহা নায়ক !
কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট ঃ তৃতীয় ও সর্বশেষ কাজটি হলো নির্মান কাজের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত কাজের সঠিক তদারকি। আপনার ভবনের সব ড্রয়িং ডিজাইন সঠিক ভাবে সম্পন্ন করে যদি নির্মান কাজ সঠিক লোক দ্বারা সঠিকভাবে মনিটরিং করাতে না পারেন তাহলে সব কিছুই ভন্ডুল হয়ে যাবে। নির্মানকাজ তদারকির জন্য কয়েকটি বিষয় আপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
# সার্বক্ষনিক কাজ তদারকির জন্য একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে নিয়োগ দিতে হবে। সে একজন অভিজ্ঞ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীও হতে পারে।
# সম্ভব হলে যে প্রকৌশলী স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করেছেন তাকে দিয়ে প্রতি সপ্তাহে একবার অথবা প্রয়োজন অনুসারে তাকে দিয়ে সাইট ভিজিট করানো।
# কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্টে পারদর্শী এমন একজন প্রকৌশলীর সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখা এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী সম্পূর্ন কাজ পরিচালিত করা। এ ধরনের একজন প্রকৌশলীর সরাসরি তত্বাবধান থাকলে বিশেষ কারণ ছাড়া স্ট্রাকচারাল ডিজাইনারের সাইট ভিজিট করার প্রয়োজন হবে না।
# নির্মান কাজে ব্যবহৃত মৌলিক মালামাল সমূহের গুনগতমান নিশ্চিত হওয়া। এ কাজটি নিশ্চিত করবেন এ কাজে অভিজ্ঞ সাইট ইঞ্জিনিয়ার।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ঃ আপনার ভবন নির্মানের পূর্বে অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহন করবেন। তবে অনুমোদন নেয়া বা না নেয়ার সাথে ভবন ভেঙ্গে পড়ার খুব একটা সম্পর্ক নাই। কারন স্ট্রাকচারাল ডিজাইন কে করেছে বা সঠিকভাবে হয়েছে কিনা সে বিষয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা থাকে না। ভবন নির্মানের অনুমতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ! আর নির্মান কাজ সঠিক ভাবে হচ্ছে কিনা সেক্ষেত্রেও তাদের কোন তদারকি থাকে না।
সংক্ষেপে মৌলিক কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা যদি সবাই সচেতন না হয় তাহলে সাভার ট্রাজেডীর মত এ ধরনের ঘটনা সামনে যে আরো অনেক ঘটবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
বিষয়: বিবিধ
২৫৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন