হাসান আল বান্নার স্ত্রী লাতীফা
লিখেছেন লিখেছেন আইনজিবি ৩০ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:৫৮:০২ সন্ধ্যা
বিংশ শতাব্দীর ইসলামী চিন্তাবিদ ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদে আ’ম হাসান আল বান্নার সহধর্মিণী লাতীফার জন্ম ১৯১৪ কি ১৫তে। বাবা ছিলেন আলহাজ হুসায়ন আলসূলী; পূর্ব মিসরের সুয়েজখাল এরিয়ার ইসমাঈলিয়্যাতে খুব আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন সবার কাছে। এবং এই জেলা শহরে তিনি খুব খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। হাসান আল বান্নাকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। এমন কি তিনি ছিলেন ‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন’ বা মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। তারই পরামর্শে হাসান আল বান্না ১৯২৮-২৯ ইসমাঈলিয়্যাতে এক খণ্ড যায়গা কিনেন, তার বাড়ির একেবারেই কাছে ছিল জমিটা। এখানেই তৈরি হয় ইখওয়ানের প্রথম হেড কোয়ার্টার এবং সার্বিক সুযোগ-সুবিধাসহ একটা পরিপূর্ণ মসজিদ। লাতীফা এখানে লেখা পড়া করতেন, ইসলামী জীবন যাপনের যাবতীয় জ্ঞান এখান থেকেই তিনি লাভ করেন। পিতার তত্ত্বাবধানে তার ইসলামী জ্ঞানের কোনো কমতি যেন না থাকে সে ব্যাপারে খুবই খেয়াল রাখা হতো এবং খাঁটি ইসলামী জীবন যাপনে পুরোপুরি প্রশিক্ষণ দেয়া হত।
ইমাম হাসান আল বান্নার বয়স যখন ২৬ বছর, আম্মা উম্মু সা’আদ পাত্রী খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু অমন পরহেজগার ছেলের জন্য উপযুক্ত পাত্রী পাওয়া খুব সহজ সাধ্য ছিল না। একবার তিনি সুলক্ষ্মী পরিবারে যেয়ে গল্প সল্প করছেন। এমন সময় কানে এলো কুরআন তিলাওয়াতের এক মিহি শব্দ। যেমন সুন্দর গলার সুর, তেমন শুদ্ধ তিলাওয়াত। তিনি বিমোহিত হয়ে গেলেন। আলহাজ্ব আলসূলী সাহেবের স্ত্রী তার পাশে বসা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বোন এত সুন্দর তিলাওয়াত করছে কে? ‘আমার মেয়ে, লাতীফা’- জবাব দিলেন লাতীফার মা। তিনি বললেন : ‘আমি কি তাকে একটু দেখতে পারি’? লাতীফার মা বিস্মিত হয়ে গেলেন। হাসান আল বান্নার মা আমার মেয়েকে দেখতে চাচ্ছে, এতে কি আবার অনুমতি লাগে? তিনি উঠে দাঁড়িয়ে উম্মু সা’আদের হাত ধরে নিয়ে গেলেন লাতীফার ঘরে। দু’জনে দেখতে পেলেন লাতীফা তখনো সালাত আদায় করছেন। উম্মু সা’আদ খুব তীক্ষè নজরে লাতীফার সালাত আদায়ের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। কী সুন্দর তিলাওয়াত! ইবাদাতে কী একাগ্রতা!! তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সালাত আদায় শেষ হওয়া মাত্রই উম্মু সা’আদ দৌঁড়ে যেয়ে লাতীফাকে জড়িয়ে ধরলেন। তাকে বারবার দেখলেন। চোখ যেন ফিরানো যায় না এমন রূপ মেয়েটার। হাসান আল বান্নার বড় ছেলে আহমাদ সাইফুল ইসলাম তার মা সম্পর্কে বলেছেন : “আমার আম্মাকে দেখে অনেকেই ইউরোপিয়ান মনে করত, দেখতে খুবই সাদা ও সুন্দরী ছিলেন, খুব শৌখিন ও রুচির মানুষ ছিলেন তিনি”। হাসান আল বান্নার আম্মা উম্মু সা’আদ যেন তার আকাক্সিক্ষত মেয়ের সাক্ষাৎ পেয়ে গেলেন। তিনি পড়িমরি করে বাসায় ফিরে গেলেন, মুখে এক গাল হাসি, আর অন্তরে একরাশ আনন্দ তার। ইমাম আল বান্না রাতে বাসায় আসলেন। মা একান্তে নিয়ে লাতীফা সম্পর্কে তার মতামত জানিয়ে দিলেন। হাসান আল বান্না কয়েকটি প্রশ্ন করলেন আম্মাকে। তিনিও খুশি হলেন মায়ের আনন্দ দেখে। বাবা-মাসহ সবাইকে ডেকে হাসান আল-বান্নার মেয়ে দেখা সম্পর্কে পাকাপাকি হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত হলো হাসান আল বান্না লাতীফাদের বাসায় যাবেন, চাইলে তাকে দেখবেন, পছন্দ হলে ঐখানে বসেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসবেন।
পরদিন সকালে হাসান আল বান্না আলহাজ্ব আলসূলী সাহেবের বাসায় গেলেন। হাজি সাহেবকে ডেকে কম্পিত ও লজ্জিত স্বরে লাতীফাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আনন্দিত হাজি সাহেব যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। লাতীফাকে দেখতে চাইলেন না, মায়ের দেখায় যথেষ্ঠ মনে করলেন, এ যেন, হাজি সাহেব ভাবলেন, আজকের যুগের কোনো ছেলে না। তিনি ধড়পড় করে উঠে গেলেন মেয়ের কাছে। স্ত্রীকে ডাকলেন সেখানে, অন্যান্য ছেলেমেয়েরাও চলে এলো পাশে। মেয়েকে এই দুর্লভ মানুষের বিয়ের প্রস্তাব শুনিয়ে দিলেন। লাতীফাও আল বান্নার মতো এর জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়ভার বাবা মার উপর ছেড়ে দিলেন। মানে এখন বিয়ে বসতে কোনো বাঁধা রইলো না আর। এমন ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে কোনো চিন্তা ভাবনা করা লাগেনা। তিনি হাসান আল বান্নাকে সবার রাজি হবার কথা শুনিয়ে দিলেন এবং যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি করার জন্য অনুরোধ করলেন।
ইমাম বিয়ে করতে চাইলেন একদম সুন্নাতি কায়দায়। মসজিদে বিয়ে হতে হবে, বিয়েতে বাহুল্য ব্যয় সংকোচন করতে হবে এবং কোনো যৌতুক আদান প্রদান থেকে উভয় পক্ষ বিরত থাকতে হবে। সবই মেনে নেয়া হলো।
মসজিদের ইমাম সাহেব বিয়ে পড়ালেন। ১৩৫০ হিজরী মুতাবেক ১৯৩২ সালের রমাদানের প্রথমে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়, বিয়ে হয় রমাদানের ২৭ তারিখ এবং উঠায়ে নেয়া হয় ঐ বছরের ১০ জিলহজ্জ। বিয়ে নিয়ে হাসান আল বান্না বলেছেন : “আল্লাহর ইচ্ছায় আমার মন হালকা হয়ে গেল। যে বয়সে বিভিন্ন কারণে ফিৎনায় পড়ে যাওয়ার ভয় হয় খুব বেশি, সেই বয়সেই আল্লাহ তাআলা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। খুব সহজে এবং সাদামাটাভাবে আমার বিয়ে সম্পন্ন হয়।” হাসান আল বান্নার ভাই আব্দুর রাহমান বলেন : “ভায়ের বিয়ের সমস্ত আয়োজন মসজিদে করা হয়। সংগঠনের ভায়েরা কয়েক ডালা খেজুর নিয়ে আসলেন। সবাই আনন্দ চিত্তে তা খেয়ে নিলেন। সবার মনের মাঝে এক অনাবিল ভালোবাসার উষ্ণতা, আর এক জান্নাতি চেতনার উচ্ছ্বাস সেদিন আমরা লক্ষ্য করলাম”।
লাতীফার দাম্পত্য জীবন ছিলো ইসলামের এক জ্বাজল্যমান নমুনা। তিনি এক স্মৃতি চারণায় বলেছেন আবূ সায়ফ (হাসান আল বান্না) মনে করতেন নারীরা কখনোই পুরুষের অধীন নয়। আল্লাহ পুরুষকে ‘ক্বাওয়াম’ (নিসা : ৩৪) বা দায়িত্বশীলের যে পদমর্যাদা দিয়েছেন সে সম্পর্কে তিনি প্রায় বলতেন “ওয়া লাইসায যাকারু কাল উনথা” মেয়েদের মতো পুরুষ নয়। তিনি বলতেন : ‘ক্বাওয়ামের’ অর্থ হলো আল্লাহ যে বায়োলোজিক্যাল পার্থক্য দিয়ে নারী পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন তার স্বীকৃতি দিয়ে নারী আর পুরুষের কাজের যে ক্ষেত্র করে দিয়েছেন সেখানে পৃথক করা। একজন আরেকজনের উপর প্রাধান্য বা প্রভুত্য এখানে বুঝানো হয়নি। তিনি এটার নাম দিয়েছেন মাতৃত্ব এবং পিতৃত্ব। তিনি এ বিষয়টাকে তিন ভাবে দেখতেন :
এক. স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক পার্থক্য একেবারেই ন্যাচারাল। পুরুষ এক ধরনের সৃষ্টি, বেশ কিছু পার্থক্য সহ নারী অন্য ধরনের। পুরুষের যেমন দায়িত্ব ও কর্মক্ষেত্র আছে, নারীরও ভিন্ন কর্মক্ষেত্র আছে, আছে ভিন্ন দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা এই প্রসঙ্গেই বলেছেন : মেয়েরা পুরুষের কাছে তেমনই পাওয়ার অধিকার রাখে, যেমন ভাবে পুরুষ এক মেয়ের কাছে অধিকার রাখে। তবে মেয়েদের উপরে পুরুষের আছে একটা অতিরিক্ত মর্যাদা”। (সূরা বাকারা : ২২৮) এখানে দেখানো হয়েছে একটা সংসারের আধিপত্য নারী পুরুষ দুইজনের মাঝে সমভাবে বণ্টিত। দুইজনের মাধ্যমেই সংসার সৃষ্টি হবে। তবে দায়িত্ব থাকবে পুরুষের কাছে। কারণ সেই শারীরিকভাবে বেশি পারংগম। আর মায়ের কাছে থাকবে সংসারের চাবিকাঠি, ফলে সম্মান ভোগ করবেন তিনিই বেশি।
দুই. হাসান আল বান্না মনে করতেন যেহেতু দুইজনের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক পার্থক্য আছে, কাজেই তার রিফ্লেকশান তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পড়া উচিৎ। দাম্পত্য জীবনে ইসলাম একজন নারীকে দিকনির্দেশনা দেয়, তাকে গর্ভধারণ, বাচ্চা পালন, তাদের প্রাথমিক জ্ঞান ও ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করার মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করা। আর পুরুষ অনেকগুলো সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দ্বায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পরিবারের সুন্দর অর্থনৈতিক অবস্থা তৈরি করবেন এবং এর সাথে সাথে আর দশটা মানুষের সাথে চলার মতো সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন করে পরিবারকে এগিয়ে নিবেন।
তিন. তিনি মনে করতেন স্বামী স্ত্রীর একে অন্যের প্রতি দৈহিক আকর্ষণ একেবারেই প্রাকৃতিক। এই সম্পর্ক তৈরি করতে ইসলাম আসেনি। কারণ এই সম্পর্ক তৈরি যে কেউ করতে পারে। এমন কি পশুদের মাঝেও এই সম্পর্ক অটোমেটিক ভাবে আসে। আর স্বামী স্ত্রীর ক্ষেত্রে শুধু দৈহিক সম্পর্ক হলে টিকবে কম। কারণ এমন এক পর্যায় স্ত্রীর আসতে পারে, যখন তার প্রতি দৈহিক আকর্ষণ অনেক কমে যায়। স্বামীরও এমন দৈহিক অবস্থা হতে পারে, যার পরে নিজের স্ত্রী অন্যের দিকে যেতে পারে। কাজেই ইসলাম স্বামী স্ত্রীর মাঝে আত্মার সম্পর্কটাই বড় করে দেখেছে। ইসলাম বলে দিয়েছে : “আল্লাহর অস্তিত্বের নমুনা হলো তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে তোমাদেরই জোড় তৈরি করে দিয়েছেন, যাতে করে তার কাছে যেয়ে মনে শান্তি পেতে পার। এবং তিনি তোমাদের মধ্যে প্রেম ও অনুগ্রহ দিয়ে দিয়েছেন”। (সূরা রূম : ২১)। কাজেই প্রেম ভালোবাসাটাই এখানে মুখ্য।
তাদের দাম্পত্য জীবন এই তিন দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। লাতীফা বলেছেন : ‘আবূ সায়ফ’ তার পরিবারের আনন্দ বেদনার সাথে শরিক থাকতেন। তিনি দায়িত্ব পালন করতেন এমন ভাবে, সবাই বুঝতো অন্যরা একেক জন পরিবারের সদস্য আর তিনি একাই এই পরিবারের ছায়া দানকারী বিশাল মহিরুহ’। ছেলে আহমাদ সায়ফ বলেছেন : “আমার মারহুম আব্বাকে দেখতাম সব সময় আম্মার দিকের সমস্ত আত্মীয়দের কে কেমন আছেন, তা নাম নিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন; তাদের খবর নিতেন এবং তাদের যে কোনো সমস্যার সমাধানে মগ্ন হতেন। তাদের বাসায় বেড়াতে যেতেন, বাসায় দাওয়াত দিতেন”। মেয়ে ড. সানা’ বলেন : “আব্বা আম্মার সাথে খুব শান্ত ভাবে কথা বলতেন; অনেক উদারতা দেখাতেন; খুব কোমলতার পরিচয় দিতেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই। যাই ঘটুক না কেন, আমরা কোনোদিন তাকে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি। সাংগঠনিক কাজের শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও আম্মাকে তিনি বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতেন। আম্মার সাথে তার আচরণে খুবই শৌখিনতার পরিচয় মিলতো। ঘরে যে সব জিনিস লাগবে, তিনি প্রায়ই তার লিস্ট তৈরি করতেন। পারলে নিজে, না পারলে অন্যের সহযোগিতায় সওদা করে বাসায় নিয়ে আসা ছিল তার দৈনন্দিন কাজের রুটিন। আমরা মাঝে মাঝে দেখতাম তিনি বলে দিচ্ছেন কখন ঘি, বা পেঁয়াজ বা রসুন গোছায়ে রাখতে হবে এবং খুবই বিস্মিত হতাম”।
দাম্পত্য জীবনে লাতীফার সুখের উৎস ছিলেন হাসান আল বান্না। তিনি আজীবন সে সুখের আস্বাদন না করে গেলেও হৃদয়-মন ভরা ছিল সুখের আবেশে। তার জীবনের সবচেয়ে গর্বের বিষয় ছিল ইমাম আল বান্না কখনোই তার ব্যবহারে রুষ্ট হননি। অত্যন্ত কঠিন মুহূর্তেও তার ধৈর্য আর আস্থা দেখে ইমাম আল বান্না নিজেও হতেন খুব আনন্দিত। তার চরিত্রের আরেকটা জিনিস ছিল তিনি অসম্ভব রকমের স্বল্পে তুষ্ট থাকতেন। মুখে তুলে কোনো দিন স্বামীর দেয়া উপঢৌকনকে সমালোচনা করেননি। এমনকি কোনো দিন কোনো দাবি মুখ ফুটে বলেন নি। আমার মনে হয় তার পরিবারের সমস্ত সন্তানকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারার পিছনে এই সব গুণাবলী মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ইমামের অবর্তমানেও তার সন্তানদের তিনজনই হলেন মেডিক্যাল, বিজনেস স্টাডিজ এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে ডক্টর এবং প্রফেসর। ছেলে আহমাদ সাইফুল ইসলাম পিতার যোগ্য উত্তরসূরিই বলা যায়।
স্বামীর কাজে তিনি কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়াননি, বরং প্রতিটি কাজেই তাকে সাহায্য করেছেন। ইমাম ঘরে ঢুকলেই তিনি তৎপর হয়ে যেতেন। ব্যগ্র হয়ে যেতেন তার সেবা শুশ্রƒসায়। সারাদিনের শতকষ্টও তাকে বুঝতে দিতেন না। রাতে স্বামীর সাথেই তাহাজ্জুদ পড়তেন তিনি। তিনি বলেন : “আমি আমার স্বামীকে আমার প্রতি পূর্ণ খুশি আছে- না দেখে কখনোই ঘুমানো ভালো মনে করতাম না। কারণ মনে করতাম যদি আমি স্বামীকে কষ্ট দিয়ে মরে যাই তা হলে জান্নাতে তাকে হয়ত আর পাবনা”। তিনি বলতেন : “আমার স্বামী এবং তার আত্মীয় স্বজন সব সময় আমাকে দামী দামী গিফট কিনে দিতেন। তাদের ঋণ কখনোই শোধ হবার না”।
তিনি কখনোই মেহমান দেখে ভয় পেতেন না, বিরক্ত হতেন না। ছেলে আহমাদ আল বান্না বলেন : আমাদের বাসায় মেহমান লেগেই থাকত। কমপক্ষে দশজন লোক খায়নি এমন দিন আমাদের খুব কম গেছে। আম্মা কখনোই তাদেরকে সাধারণ মেহমান মনে করতেন না। যে কেউ এলে যা আছে তাই তিনি খাইতে দিতেন”। সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে দায়িত্বভার নিজের কাঁধেই নিয়ে নিতেন। সাতটি সন্তানের জননী তিনি। ছেলে আহমাদ সাইফুল ইসলাম আলবান্না কে তিনি আইনজ্ঞ হিসাবে বড় করে তুলেছেন। দ্বিতীয় ছেলে মুহাম্মাদ হুসামুদ্দীন বাবার জীবদ্দশাতেই ইন্তিকাল করেন। যে রাতে মুহাম্মাদ ইন্তিকাল করেন, ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা শিবির (কাতীবাহ) ছিল সে সময়। সাধারণতঃ রাতের প্রথম ভাগে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিছু ঘুমায়ে শেষ ভাগে তাহাজ্জুদ এবং ব্যক্তিগত জিকিরে রাত কাটায়ে ফজর সালাত আদায় করে রেস্ট নেয়া ছিল দৈনন্দিন কাজ। শুক্রবার রাত। সবাই ঘুমের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। ইমাম আল বান্না বাসায় এলেন। দেখলেন স্ত্রী হাত তুলে শিশু মুহাম্মাদকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন আল্লাহর কাছে। তিনি মুহাম্মাদকে কোলে নিলেন। আদর যতœ করলেন। রুকইয়া (কুরআনের আয়াত পড়ে গায়ে ফুঁক) দিলেন। সময় চলে যেতে থাকলো ছেলের অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপ হতেই আছে। তাহাজ্জুদের সময় ঘনিয়ে এলো। শত শত লোক অপেক্ষায়। তিনি মুরশিদে আম। স্ত্রী লাতীফাকে বললেন, তুমি ছেলেকে দেখ, আমি যাই। তানা হলে ভাইয়েরা অপেক্ষা করবেন। আল্লাহর উপর ভরসা করে মূমূর্ষ ছেলেকে অসহায় মায়ের হাতে রেখে চলে গেলেন। ফজরের আজান হয়ে গেল। ছেলেও চলে গেলেন আল্লাহর ডাকে। একজন আত্মীয় দৌঁড়ে এসে মুরশিদে ‘আম এর কানে কানে খবর দিয়ে দিলেন। তিনি ইন্না লিল্লাহ পড়ে সালাত আদায়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। সালাতের পরে ছেলের ইন্তিকালের খবর দিলেন সবাইকে, সবাই প্রাণ খুলে দুয়া করলো মুহাম্মাদের জন্য। পৃথিবীও অবাক বিস্ময়ে দেখলো সংগঠন ও ইসলামী আন্দোলনের কাজের জন্য ইমামের ত্যাগ ও কুরবানি। এদিকে লাতীফা মৃত ছেলে খাটের উপর রেখে সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। ইমাম আল বান্না যখন শত শত লোক নিয়ে হাজির তখনো ‘মা’ আল্লাহর কাছে দুয়া করেই যাচ্ছেন। আর সবরের পরীক্ষায় পদে পদে উত্তীর্ণ হতে লাগলেন। আন্দোলন সংগঠনের জন্য এমন সবর ও ত্যাগের কিছু উদাহরণ আমরা রাসূলের (সা.) যুগে দেখেছি। আর এই বিশ শতকের মিসরেও দেখলাম।
মেয়ে ওয়াফা ছিলেন প্রখ্যাত স্কলার সাঈদ রামাদানের স্ত্রী, অধুনা কালের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ প্রফেসর ড. তারিক রমাদানের আম্মা। তিনি ছিলেন অনেক উচ্চ শিক্ষিতা। ড. সানা ছিলেন মিসরের প্রখ্যাত কুল্লিয়াতুল বানাতের প্রফেসর। আরেক মেয়ে হালাহ ছিলেন মেডিক্যাল ডক্টর এবং কলেজ অব মেডিসিনের প্রফেসর। ছোট মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন স্বামী হাসান আল বান্নার শাহাদাতের পর। তার শ্বশুর মেয়ের নাম রাখলেন দিমা ইস্তিশহাদ (শাহাদাতের রক্ত)। কিন্তু নাম রেজিস্ট্রেশান করতে গেলে অফিসার এই নাম দেবেন না বলে দিলেন। অনেক জোরাজুরির পর শুধু ইস্তিশহাদ রেখে দিমা বাদ দিল অফিসার। এই মেয়ে বিজনেস স্টাডিজে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হয়েছিলেন। তাকে ‘রজা’ বলেও ডাকা হত। আরেক মেয়ে সাফা ইমাম জীবিত থাকতেই ইন্তিকাল করেছেন। এই বাচ্চাদের উচ্চ শিক্ষায় উন্নীত করতে লাতীফাকে দারুণ কষ্ট করতে হয়েছে। অর্থের অভাব, সুযোগের অভাব, হাসান আল বান্নার স্ত্রী হওয়ার চাপ তার জীবনকে খুব সংগ্রামের মুখোমুখি করেছে। কিন্তু এক জান্নাতি রমনীর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ দেখিয়ে তিনি আমাদের জন্য হয়ে রইলেন এক পূত পবিত্র রোল মডেল।
বাচ্চাদের লালন পালনে তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অনুসরণ করার মতো। তিনি বাচ্চাদের আদেশ নিষেধের ক্ষেত্রে তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে কনভিন্সড করাটাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতেন। ড. সানা বলেন : “আমরা বড় হতে যেয়ে কোনো রূঢ? আচরণের মুখোমুখি হইনি কখনো, বরং ভালোবাসা, দয়া ও করুণা দ্বারা আমরা সিক্ত হতাম সব সময়। খুব সুন্দর সুন্দর নামে আম্মা আমাদের ডাকতেন”। তিনি সন্তানদেরকে আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। সাথে করে আত্মীয় স্বজনদের বাসায় নিয়ে যেতেন, তাদের কেও এনে আদর যতœ করতেন, ফলে সন্তানদের মধ্যে একটা ‘সবাইকে নিয়ে গড়ে উঠার’ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তিনি প্রতিটি সন্তানের জন্য আলাদা এক ফাইল সংরক্ষণ করতেন। প্রতিটি ফাইলে জন্ম নিবন্ধন, মেডিক্যাল হিস্ট্রি, প্রতিটি ক্লাশ উত্তীর্ণের সনদ, নাম্বারপত্র ও রিপোর্ট ইত্যাদি তারিখসহ সংরক্ষণ করে রাখতেন।
তিনি সন্তানদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দিতেন। বড় মেয়ে ওয়াফা ছিল তার প্রাইভেট সেক্রেটারি। ঘরগুছানো, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, মেহমানদের সেবা, মা বাবাকে সাহায্য করা এইসবই ছিল রুটিন বাঁধা। সবাইকে সমান ভাবে কাজ বণ্টন করে দিতেন। কাজের মেয়েকে কখনো নিজের মেয়ের বাইরে মনে করতেন না। ফলে তার বাসায় কাজ করতে আসার জন্য মেয়েদের লাইন লাগানো ছিল। তাদের জামা কাপড়, থাকার যায়গা, চাল চলন সবগুলোই হত আপন মেয়েদের মতই। ওয়াফাকে তিনি অতিরিক্ত একটা দায়িত্ব দিতেন, তাহলো বাসার কাজের মেয়েদেরকে শিক্ষিত করা। তাদের কে প্রয়োজনীয় সূরা মুখস্ত করানো, ইসলামের অত্যাবশ্যক বিষয় সমূহের জ্ঞান দেয়া, এবং লেখা লেখি করতে শেখান সবই তিনি করাতেন। সমস্ত সন্তানদের তিনি ইখওয়ানের মূলধারার সাথে কাজ করতে বলতেন। ফলে প্রথম থেকেই তারা আন্দোলনের বাইরে থাকা পছন্দ করেনি কেউ।
শুধু হাসান আল বান্নার সহধর্মিনী হওয়ার জন্য না, তিনি বিয়ের আগ থেকেই ছিলেন একজন দা’য়ীয়াহ ইলাল্লাহ। ফলে স্বামীর জীবনের সাথে একাত্ম হতে তার কোনো বেগই পেতে হয়নি। বিয়ের কয়েক মাস পরেই ইমাম কায়রোতে চলে এলেন। বাবা মা, আত্মীয় স্বজনের মায়া ছেড়ে লাতীফাও চলে এলেন কায়রোতে। শুরু হলো ঘর সংসার গুছানোর পাশাপাশি দ্বীনের দা’ওয়াতের কাজ। হাসান আল বান্নাকেই বলা যায় গেল শতাব্দীর প্রথম মুজাদ্দিদ যিনি মহিলাদেরকে সঠিক মর্যাদা দিয়ে তাদের ইসলাম প্রচারের সহায়ক শক্তি হিসেবে গণ্য করেছেন। তার ‘রিসালাতুল মার’আহ আল মুসলিমাহ’ পুস্তিকায় মহিলাদেরকে সাংগঠনিক কাজে লাগিয়ে তাদের দিয়ে মুসলিম সমাজের বিরাট একটা অংশকে কাজে লাগিয়েছেন। বিশেষ করে বিয়ে করার পর তিনি এই দিকটা আরো সুন্দর করার সুযোগ পেয়েছিলেন। নিজের স্ত্রীকে বানায়ে দিলেন কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলা। ১৯৩৩ সনের ২৬ এপ্রিলেই ইখওয়ানের মহিলা শাখার পয়লা উদ্বোধন হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিনি অনেক সুন্দরভাবে ইখওয়ানের মহিলা শাখাকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাথে পেয়েছিলেন যায়নাব আলাগাযযালী, লাবীবাহ আহমাদ, ফাতিমাহ আব্দুল হাদী, নাঈমাহ আলহুদায়বি ও আ’মাল আল’আশ্মাওয়ির মতো জ্ঞানবতী, শিক্ষিতা এবং আত্মোৎসর্গী কিছু বোন, যাদের ত্যাগ ও কুরবানী এবং দ্বীনের জন্য অত্যাচার সহ্য করার ধরন দেখে মহিলা সাহাবীদের জীবন চোখের সামনে ভেসে উঠতো।
মুর্শিদে ‘আম এর স্ত্রী হওয়ার কারণে তাকে নিজ দায়িত্বের উপরে আরো অনেক ঝামেলা দেখতে হত। সংগঠনের ভাই বোনদের বিয়ে, সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ের ফায়সালা, কোনো অযাচিত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সমাধান এই সব তাকেই করতে হত। ড. সানা আল বান্না বলেন, “আমার আম্মা সব সময় নিজের বা পরিবারের চেয়ে সংগঠনের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন। তার পরেও আমাদের দেখাশুনা করা, সারাদিন পর নানা ব্যস্ততা থেকে ফিরে আসা আব্বার খিদমাৎ করা ইত্যাদিতে কোনো সময় তার নির্ধারিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটতোনা। আব্বা যখন কায়রোতে ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় অফিস ভাড়া নিলেন, আম্মার কাছে ঘরের কিছু ফার্নিচার চাইলেন। খুবই সামান্য ফার্নিচার ছিল আমাদের বাসায়, এর পরো আম্মা তার ভালো ভালো জিনিসগুলো অফিসের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। দেখলাম আমাদের বাসার কার্পেট, কার্টেইন, লাইব্রেরীর নামিদামি বই এবং আলমিরা ও ভালো ভালো চেয়ার একেবারেই উধাও হয়ে গেল। সেদিন আম্মার মন ছিল অবিশ্বাস্য রকমের ভালো। আমরা তা দেখে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
আম্মার কাছে ইখওয়ানের ভাই বোনদের পারিবারিক ঝামেলা মিটানোর জন্য প্রায় লোকজন আসত। আম্মা তাদেরকে নিজের ছেলে ‘বুনায়্যা’ বা নিজের মেয়ে ‘বুনাইয়্যাতি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমি গভীরভাবে লক্ষ্য করতাম তিনি এক সঙ্গে শাশুড়ি বা মায়ের ভূমিকা পালন করতেন। তার কথায় ও বিচারে সবাই খুশি হয়ে কখনো আনন্দে অশ্রু ঝরিয়ে, কখনো হাসতে হাসতে চলে যেত। আর আম্মা কেমন এক সুন্দর হাসি দিয়ে বলতেন : যাক, শয়তান শেষ পর্যন্ত কাবু হয়ে গেল। ওদের সংসারে ভাঙ্গন ধরাতে পারলো না”।
ড. সানা’ আরো বলেন : “আম্মা ইখওয়ান পরিবারের সুখে দুঃখে সমভাগী থাকতেন। কারো ঘরে কোনো আনন্দের কিছু হলে আম্মাও সে সাথে আনন্দিত থাকতেন, কারো ঘরে শোকের মাতম হলে, তা ছড়িয়ে পড়তো আমাদের ঘরেও।” কারো বিপদ হলে প্রথমে স্বামীর কাছে হাত পাততেন, কিছু পেলেন তো ভালো, না পেলে বন্ধুদের বা আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা পয়সা উঠাতেন। ১৯৪৮ সনে যখন ইখওয়ানিদের বিরুদ্ধে ধর পাকড় শুরু হয়ে গেল তিনি সাধ্যমত জেল হাজতে বন্দীদের পরিবারের সাহায্যে পাগলপারা হয়ে যেতেন। ঐ সময় থেকে তিন বেলা খেতেন না তিনি। সকালে সামান্য কিছু মুখে দিতেন। দুপুরে একটা রুটি ও সামান্য কিছু ব্যঞ্জন তিনি খেতেন। রাতে তার পেটে পড়তো বড় এক গ্লাসের সম্পূর্ণ পানিটাই। তার দেখাদেখি সন্তানদের মধ্যেও এলো পরিবর্তন। ইমাম আল বান্না এ দৃশ্য দেখে খুবই খুশি হলেন। তিনি পরিবারের সবার মত নিয়ে তার যৎসামান্য বেতনের একভাগ সংসারে ব্যয় করা শুরু করলেন, একভাগ দিতে লাগলেন দাওয়াতী কাজ চালাতে, বাকী একভাগ বণ্টন করতে থাকলেন বিপদে পড়া আত্মীয় স্বজন ও আটকে পড়া ইখওয়ান নেতৃবৃন্দের পরিবারগুলোতে।
আল্লাহর পরীক্ষা লাতীফার ভাগ্যে কম ছিল না। ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ করে ইমাম হাসান আল বান্নাকে শহীদ করা হলো। সরকারের দাম্ভিকতা তখন এমন আকারে ছিল যে, এমন মুজাদ্দিদকে মেরে ফেলতে সরকার কোনো রাখঢাক রাখেনি। যে গাড়ি করে আততায়ী এসে ইমামকে গুলি করে মেরেছিল তা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামে ভাড়া করা; যে পাষণ্ড তাকে মেরেছিলে, কায়রোর রাস্তায় রাস্তায় সে সদম্ভে তা প্রচার করেছে।
ইমামের শরীর দিয়ে রক্ত চুয়ে চুয়ে ঝরে পড়ছে। তাকে শেষবারের জন্য চিকিৎসাসেবার দাবিতে ইখওয়ান নেতাদের হৃদয় ভাঙ্গা কান্নার জবাবে সরকার একজন ডাক্তারকেও তার রক্ত ঝরা বন্ধ করতে অনুমতি দেয়নি। একজন ডাক্তার জোর করে চিকিৎসা করতে চাইলে তাকেও মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হলো। এমন কি ইমাম যখন শাহাদাত বরণ করলেন সরকার তার প্রকাশ্য জানাজার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিল। সকালে খুব ভোরে হাসান আলবান্নার আব্বা আহমাদ আসসাআতী ধরলেন লাশের খাটিয়ার একপাশ, আর স্ত্রী লাতীফা ও দুই জন মেয়ে ধরলেন আর দুই পাশ। এভাবে শায়খ আহমাদের ইমামতিতে কয়েকজন মহিলার ইক্তিদায় জানাজার শেষে চিরজনমের মতো সমাহিত হলেন শতাব্দীর সবচেয়ে ভালো মানুষটি। সরকারি ঘোষণায় বলা হলো পরিবারের কেউ হাসান আলবান্নার কবর জিয়ারাত করতে পারবেনা। ওখানে কেউ গেলেই তাকে এরেস্ট করা হবে। লাতীফার জীবনে শুরু হলো এমন এক কষ্টের অধ্যায়, যে অধ্যায় আর কোনো মহিলার জীবনে এসেছে বলে মনে করতে পারছিনা।
এতগুলো বাচ্চার লালন পালনের দায়িত্ব, কোথায় পাবেন টাকা কড়ি কে দেবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে? ইখওয়ানের প্রথম সারির নেতারা জেলে, যারাই এই পরিবার কে স্বেচ্ছায় হেল্প করতে আসে তার মাথার উপর নেমে আসে সরকারের খড়গ। চাইলেও তাই কোনো হেল্প করতে পারেনা কেউ। বৃদ্ধ শ্বশুরকেও কষ্টে রেখে সরকার মরণের মুখোমুখি করে ফেলতে চাইলো। এমন কি পরিবারের সবাইকে গৃহবন্দী করে রাখলো কয়েক বছর। বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার সময় পুলিশ থাকত পেছনে পেছনে; স্কুলের শিক্ষকদের বলা ছিল ওরা যেন কোনো স্বাধীনতা না ভোগ করতে পারে; মাকে বলা হলো কোথায় কোথায় তিনি যাবেন তা যেন আগে থেকে বলে সরকারি অনুমতি নেয়া হয়, ফলে তার উপর সরকারি চোখ রাখা সম্ভব হবে। তাদের টেলিফোন লাইন কেটে দেয়া হলো; দুনিয়ার কারো সাথে যেন যোগাযোগ করা সম্ভব না হয়।
ইমাম হাসান আল বান্না পরিবার নিয়ে যে ঘরে ভাড়া থাকতেন তা ছিল মোটামুটিভাবে চলার মতো। তিনি ২১৬ ক্বিরশ (দুই গিনী ১৬ পয়সা বাংলাদেশী মুদ্রায় মনে হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা) করে মাসিক ভাড়া দিতেন। শাহাদাতের পর লাতীফা পরিবার নিয়ে ঐ ঘরেই কোনো মতে থাকতে লাগলেন। সরকারের চোখে এটাও ছিল আরেক অপরাধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই মর্মে এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো যে, হাসান আল বান্নার ভাড়া বাড়িটা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম, এখানে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে থাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কাজেই প্রজ্ঞাপন পাওয়ার একসপ্তাহের মধ্যেই বাসা ছেড়ে দিতে হবে তাদের। এবং সরকারের বেঁধে দেয়া সীমানার মধ্যেই একটা বাসায় থাকতে হবে। বাধ্য হয়ে ওই এলাকায় বাসা খুঁজতে লাগলেন লাতীফা। সে সময়ের সব চেয়ে কম দামে একটা বাসা তিনি পেলেন যার ভাড়া ছিল দশ গিনী। আগের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি ভাড়া গুণতে হবে তাকে। কোনো আয় নেই, দেখার মতো কোনো লোক নেই এমন এক পরিবারের জন্য এটা যে কত বড় বিপদ তা আল্লাহ ছাড়া কেউ সেদিন বুঝতে পারেননি। আর পারেননি বলেই আল্লাহ এই পরিবার কে শেষ হতে দেননি মনে হয়। লাতীফা নিজকে মোমবাতির মতো জ্বলে জ্বলে সন্তানদের আলোকিত করতে লাগলেন। প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজ তার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ফলে কিছু কিছু কাজ তাকে গোপনেই করতে হত।
রাজতন্ত্রের শেষ শিখাটি নিভে যাওয়ার পরে বিপ্লবী সরকারের হাতেও ইখওয়ান মার খেতে শুরু করলো। যে জামাল আব্দুন নাসেরকে ইখওয়ান ভালো মনে করে রাজার বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে সাহায্য করেছিল, এখন তারই হাত ইখওয়ানের রক্তে রঞ্জিত হতে লাগলো। তদকালীন মুরশিদে ‘আম আব্দুল কাদির আওদার ভাই ড. আব্দুল মালিক আওদাহকে জামাল সরকার ফাঁসি দেয়। আব্দুল কাদির ভায়ের শেষ ইচ্ছাটাকে লাতীফার কাছে একটা চিঠির মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। সেখানে লেখা ছিল : মুহতারামাহ, ড. আব্দুল মালিকের শেষ ইচ্ছা ছিল তাকে যেন ইমাম হাসান আল বান্নার পাশে কবরস্ত করা হয়। আমার অনুরোধ তার শেষ ইচ্ছাটা আপনি পূরণ করেন।” লাতীফাহ জানতেন এতে তার পরিবারে আবার কত বড় বিপদ আসতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি স্বামীর কবরের পাশে ড. আব্দুল মালিকের লাশ দাফন করার অনুমতি দেন। এর জন্য তার উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার।
এর মধ্যে ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন। ছেলে আহমাদ আইনে উচ্চ শিক্ষা নিলেন। হয়তো আশা করছিলেন ছেলের হাতে সংসার তুলে দিয়ে তিনি একবারে দুনিয়ার দায়িত্ব মুক্ত হয়ে আল্লাহর ইবাদাতে নিরত হবেন। কিন্তু জীবন সায়াহ্নের সেই আশাটাও তার মরীচীকার মতো হারায়ে গেল। আহমাদ ১৯৪৬ সাল থেকেই ইখওয়ানের সাথে জড়িত।
আব্বা শহীদ হওয়ার পর থেকে অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্যেও তিনি সংগঠনের বড় বড় দায়িত্ব পালন করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৬৫ সালে সরকার তাকে বিনা কারণে আটক করে। বৃদ্ধ মা লাতীফার তখন খুব খারাপ অবস্থা। দেখার মতো তার পাশে কেউ ছিল না। মানবিক কারণ দেখিয়ে তিনি সরকারের কাছে ছেলেকে মুক্ত করে দেয়ার আবেদন করেন। এদিকে আহমাদ সায়ফের বিরুদ্ধে সরকার কোনো মামলা দায়ের করতে পারেনি। ফলে মায়ের মানবিক সাহায্যের খাতিরে তাকে জেল থেকে মুক্ত করে দেয়া হয় বটে কিন্তু তাকে গৃহবন্দী হিসেবে রাখা হয়। এরপরে আসতে থাকে একের পর এক বিপদ। তিনি ধৈর্যের পারাকাষ্ঠা দেখাতে থাকলেন। জামাল সরকারের সমস্ত রাগ ছিল হাসান আল বান্নার সাথে সম্পর্কযুক্ত সবার উপর। ফলে তার পরিবারের উপর অত্যাচারের সাথে সাথে লাতীফার পরিবারেও হাত তুললো সরকার। তার ছেলে মেয়েদের মতো আপন ভাই-বোনদেরকেও সরকার আটক করলো বিনা অপরাধে। বহুদিন থেকে অসুখে ভুগছিলেন তিনি। এর মধ্যে ছেলেকে আটক করার জন্য সরকার মরিয়া হয়ে পড়েছে। কারণ ইখওয়ানের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল আকাশচুম্বি। আর সাধারণের মাঝে তার জনপ্রিয়তা ছিল খুবই ঈর্ষণীয়। তার হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিসর আইনজীবী সমিতি। তার জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সরকার তার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেয়া শুরু করে দেয়। এই অবস্থায় হয়ত শোকের ব্যথা সইতে না পেরে অথবা আল্লাহ আরেক শোক থেকে রক্ষা করতে তাকে ১৯৬৮ সালেই তাঁর কাছে উঠিয়ে নিলেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে লাতীফা আলসূলী (র.) ইসলামের পথে খিদমাত করে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি শেষ অসিয়্যাতে ছেলে আহমাদকে মরণের পর স্বামীর পায়ের কাছে কবরস্ত করার অনুরোধ করে যান। তার শেষ আশা পূরণ করতে দ্বিধা করেননি একমাত্র ছেলে আহমাদ। তবে যেদিন তিনি কবরস্ত হন তার ক’দিনের মধ্যেই আহমাদকে সরকার জেলে পুরে এবং এক কল্পিত অপরাধে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। (সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
২১৩৬ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহতায়লা আপনাকে এর জন্য উত্তম প্রতিদান দিন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন