মায়া ১
লিখেছেন লিখেছেন ডাঃ নোমান ১০ জুন, ২০১৩, ১০:২৯:০২ রাত
শীতের কুয়াশা ভেদ করে বসন্তের আগমনবার্তা শিহরিত করে তুলছে প্রকৃতিকে । এই ঋতু পরিবর্তনের সময়টাতে মানুষের মন বেশ সজীব থাকে ঠিক যেন শীতের রুক্ষতাকে দুই পা দিয়ে সরিয়ে নতুন জীবনের উত্ফুল্লতাকে উপলব্ধি করার জন্য ।
একটি বাগান ছোটখাট বনও বলা যায় গাছ বলতে মেহগনি গাছের দীর্ঘ সারি । নগ্ন গাছগুলোতে কেবল দুই একটা করে পাতা গজিয়েছে । বাগান দিয়ে ঘেরা প্রশস্ত বাড়িটির বারান্দায় ঈজি চেয়ারে আধাশোয়া হয়ে চোখ বুজে বসে আছে বাড়ির মালিক মনসুর সাহেব । স্পষ্ট চিন্তার বলিরেখায় কুন্চিত ললাটের উপর একগুচ্ছ সাদা চুল । মাঝে মাঝে চেয়ার থেকে উঠে পায়চারী করছেন বারান্দার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত । সুনসান এক নীরব পরিবেশ , মাঝে মাঝে কুকিলের ডাক পরিবেশকে আরো বিষন্ন করে তুলছে । আরো একজন আছে বাড়িতে সে হাসি মনসুর সাহেবের মেয়ে । বাবার ভয়ে জোর গলায় পড়ার সাহস পর্যন্ত নেই অথচ তিনি যে কোনদিন হাসির উপর রাগ হয়েছেন তাও কেউ বলতে পারবে না । বাবা মেয়ের মধ্যে কথা হয় খুব কম কদাচিত দুই একটা ।
বাগানে মেহগনির শুকনো পাতার খসখস শব্দে হরিনের মত কান খাড়া করে কে আসছে বোঝার চেষ্টা করছেন মনসুর সাহেব । কুন্চিত ভ্রূ একটু পরে আবার স্বাভাবিক হয়ে এল , কার বাড়ি থেকে যেন একটি গরুর বাছুর বাগানে ঢুকে খেলা করছে। অবলা জীব ছাড়া এই বাড়ির ছায়া মাড়ানো মানুষের সংখ্যা খুবই কম ।
যে কয়জন মানুষের আনাগোনা তাদের একজন কাজের বুয়া সালেহা বেগম । কাজকর্মে ফাকি দেয়া ছোটখাট চুরি করা এগুলো অনেক গৃহকর্মীর সাধারন বৈশিষ্ট্য হলেও এক্ষেত্রে সালেহা বেগম ব্যতিক্রম । গৃহকর্ত্রী বিহীন বাড়িটাকে নিজের মত করে আগলে রেখেছেন । বাইরের কেউ দেখলে বিশ্বাস করা সত্যি কষ্টকর হবে এই মহিলাটি বাড়ির কর্ত্রী নয় ।
সালেহা বেগম আজ দেরী করে কাজে এসেছে । এখন সকাল নয়টা বাজে অথচ আটটার মধ্যে চা না পেলে মনসুর সাহেবের কাছে পৃথিবীর সবকিছুই বিরক্তিকর মনে হয় । একটু আগেই বাড়ির টিয়া পাখিটা খাঁচার ভিতর ছটফট করতেছিল দেখে খাঁচা সমেত আঙ্গিনার এক কোনায় যেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে সেখানে রেখে এসেছে অথচ ঐ পাখিটার সাথে অনেক স্মৃতি অনেক আবেগ অতীতের অনেক গল্প জড়িয়ে আছে ঠিক শীতের চাদরের মত গরম কালে অযত্নে তুলে রাখলেও শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে । নিঃসঙ্গ জীবনে এই বুড়ো পাখিটাকে অনেক যত্ন করে মনসুর সাহেব । ছেলে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে বাবার কাছে আবদার করে পাখিটি নিয়েছিল । সেই ছেলে সেই পরিবেশ সেই আনন্দমুখর দিন কোন কিছুই আর আগের মত নাই । তবে কালের স্বাক্ষি আর পরিবারের ভগ্নাবশেষ হয়ে টিকে আছে হাসি । তার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করে মনসুর সাহেবের আগের মত কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে কেমন আছিছ মা ?
একটা অদৃশ্য জড়তা সবসময় দূরে রাখে দুজনকেই । হাসির কাছে গেলেই মনে হয় সে ভয় পায় বাবাকে ঘৃনা করে তার বাবার কৃতকর্মকে , অতীতকে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসে মনসুর সাহেব জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক জখমী সৈনিক । শুধু জোর করে চিল্লায়ে বলতে ইচ্ছে করে আমি দোষী কোন অজুহাত দিচ্ছি না আমাকে শাস্তি দাও তবু আমাকে ঘৃনা করিও না ।
পুরানা আমলের লোহার গেটের কাছে বসে থাকা কুকুড়টি লেজ নাড়িয়ে বাড়িতে কারো আগমনবার্তা জানান দিচ্ছে ।
সালেহা বেগম বাড়িতে ঢুকলো
হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন মনসুর সাহেব
কিছু বলবেন ?
এখন কয়টা বাজে ?
নয়টার কাছাকাছি
কাছাকাছি নয় পুরো নয়টাই বাজে
আজ কি বার ?
রবিবার
গত রবিবারে কয়টায় এসেছিলে ?
নয়টার পরে
আর কিছু না বলে পাখিটাকে আনতে যায় মনসুর সাহেব ।
প্রতিদিনই সকাল আটটার মধ্যে আসলেও প্রত্যেক রবিবারে দেরী করে আসে সালেহা । কারন জিজ্ঞাস করলে শুধু চুপ করে থাকে কিছু বলে না ।
চা করতে রান্না ঘরে ঢুকে সালেহা । তার আগে সুন্দর করে একটা পান বেঁধে মুখে পুরে চিবাতে থাকে আর কিছুক্ষন পর পর পানের পিক ফেলে রান্নাঘরের মেঝেতে বলতে গেলে এই একটা দোষ সালেহার ।
বিষয়: বিবিধ
১৯৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন