দেশভাগ কিংবা স্বাধীনতার বিরোধীতা করে রাজনীতি করা যায় কি?
লিখেছেন লিখেছেন অন্তর্দৃষ্টি ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১২:৩১:০২ দুপুর
দেশভাগ কিংবা স্বাধীনতার বিরোধীতা করে রাজনীতি করা যায় কিনা – সম্প্রতি এ বিতর্ক বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, “স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কেউ রাজনীতি করতে পেরেছে, এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে একটিও নেই” (দৈনিক সমকাল, ১২-০২-২০১৩)।
আমাদের অতিবিজ্ঞ এটর্নি জেনারেল যেভাবে দাবী করেছেন তাতে মনে হচ্ছে তিনি সারা দুনিয়ার তাবত ইতিহাস সম্পর্কে খুবই ওয়াকিফহাল। কিন্তু, সারা দুনিয়ার ইতিহাস অধ্যয়ন করার কোন প্রয়োজন নেই, নিছক ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসই অতিবিজ্ঞ এটর্নি জেনারেলের দাবির ভ্রান্তি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
প্রথম উদাহরণঃ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর উপস্থাপিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য স্বাধীন পাকিস্তান তৈরীর আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। শেরে বাংলা নামে খ্যাত এ কে ফজলুল হক প্রথম দিকে স্বাধীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিলেও ১৯৪২ সাল থেকে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের তীব্র বিরোধীতা শুরু করেন। শুধু বিরোধীতা করেই ক্ষান্ত থাকেন নি, বরং মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র স্বাধীন পাকিস্তান যাতে জন্ম নিতে না পারে সে লক্ষ্যে তিনি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন – তাতে তিনি স্বাধীন পাকিস্তানের দিকে না গিয়ে অবিলম্বে ভারতীয়দের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানান। তার এ দাবী যদি সেদিন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মেনে নিতেন তাহলে ভারতীয় উপমহাদেশে কিছুতেই স্বাধীন পাকিস্তান জন্ম লাভ করতে পারতো না। শেরে বাংলার ন্যাক্কারজনক বিরোধীতা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ স্বাধীন পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের পতাকাবাহী মুসলিম লীগের বিরোধীতায় আত্মনিয়োগ করেন।(দেখুনঃ বাংলাপিডিয়া, একে ফজলুল হক)
আওয়ামী লীগের রাজনীতিক প্রয়াত আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রস্তাবক হইয়াও তিনি শেষ পর্যায়ে জিন্না সাহেবের সাথে ঝগড়া করিয়া মুসলিম লীগ হইতে বাহির হইয়া যান। পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধী আখ্যায়িত হন”। (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, বাংলা একাডেমী ২০০১, পৃষ্ঠা ১৭১)।
অথচ, এই শেরে বাংলা ফজলুল হকই স্বাধীন পাকিস্তানে আজীবন বীরদর্পে রাজনীতি করেছেন।
দ্বিতীয় উদাহরণঃ হিন্দু সম্প্রদায়
ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাংঘাতিক বিরোধীতা করেছে। আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় শুনুন, “সকল এলাকা ও অঞ্চলের হিন্দুরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধতা করিয়াছিল নীতি হিসাবে। পাকিস্তান স্থাপিত হওয়ার পর কাজেই হিন্দুরা সাধারণভাবে সন্দেহের পাত্র হইয়া পড়ে। ওরা কি পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকিবে? এমন সন্দেহ স্বাভাবিক”।(আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, বাংলা একাডেমী ২০০১, পৃষ্ঠা ১৬৬-৭)
পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধীতা করে হিন্দুরা স্বাধীন পাকিস্তানে কেবল নিরাপদই থাকে নি; বরং স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি এসব স্বাধীনতা বিরোধীদের জন্য পার্লামেন্টে সংরক্ষিত আসনও রাখা হয়েছিল।
তৃতীয় উদাহরণঃ কংগ্রেস পার্টি
পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত ছিল মুসলিম লীগ। কংগ্রেস পার্টি ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোর বিরোধী। তা সত্ত্বেও কংগ্রেস পার্টির হিন্দু নেতারা স্বাধীন পাকিস্তানে কংগ্রেস পার্টির নাম অক্ষত রেখেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে এবং জয় লাভ করেছে। “সব দেশের স্বাধীনতা লাভের ফল তাই। ভারতের স্বাধীনতা আনিয়াছিলেন কংগ্রেস; অনেকেই তার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা আনিয়াছিলেন মুসলিম লীগ। অনেকেই তার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর সবাই সে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করিতেছেন। স্বাধীনতার বিরোধিতা করার অপরাধে কাউকে শাস্তি ভোগ করিতে হয় নাই। কোন দেশেই তা হয় না। কারণ, স্বাধীনতার আগে ওটা থাকে রাজনৈতিক মতভেদ। শুধু স্বাধীনতা লাভের পরেই হয় ওটা দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহিতার প্রশ্ন। সব স্বাধীনতা সংগ্রামের বেলাই এটা সত্য। বাংলাদেশের ব্যাপারে এটা আরো বেশী সত্য”। (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, বাংলা একাডেমী ২০০১, পৃষ্ঠা ৪৬৮-৪৬৯)
এখানে সবক’টি উদাহরণ দেয়া হয়েছে সাবেক ঐ আওয়ামী নেতার বই থেকেই। কারণ, আওয়ামী বুদ্ধিজীবিরা ইদানীং নির্লজ্জভাবে দাবী করতে শুরু করেছে যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধীতা কারী কোন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের স্বাধীন দেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকে না। তাদের দাবী যে সর্বৈব মিথ্যা – উপরোক্ত তিনটি উদাহরণ তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
বিষয়: বিবিধ
১১৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন