মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধীতাকারীরা কি রাষ্ট্রদ্রোহী?

লিখেছেন লিখেছেন অন্তর্দৃষ্টি ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১১:২৮:৫৪ রাত

মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধীতাকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা যায় কি না – ইদানীং মধ্যরাতের টকশোগুলোতে এ আলোচনা বেশ জমে উঠেছে। এর সহজ উত্তর হল, মামলা তো করা যাবেই, তবে তা ধোপে টিকবে কি না – তা-ই আসল প্রশ্ন। ‘হুজুগে বাঙ্গালী’ প্রকৃতির লোকদের নিকট এ প্রশ্নের কোন গুরুত্ব না থাকলেও, দেশের প্রত্যেকটি সচেতন নাগরিকের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নঃ

কোন নাগরিকের উপর একই সময় দু’টি পৃথক সার্বভৌম শক্তির নির্দেশ বাধ্যকরী হতে পারে কি? আইনগতভাবে এর উত্তর সবসময়ই নেতিবাচক হতে বাধ্য। একটি উদাহরন দিলে বিষয়টি পরিস্কার বুঝা যাবে।

ধরি, ‘ক’ এবং ‘খ’ দু’টি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আপনি ‘ক’ রাষ্ট্রের নাগরিক। ‘ক’ এবং ‘খ’ দু’টি পরস্পর বিরোধী নির্দেশ জারী করে আইনটি মেনে চলার জন্য আপনাকে আদেশ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ‘ক’ এবং ‘খ’ উভয়ের পরস্পর বিরোধী নির্দেশ মেনে নেয়া আপনার পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয়। এর কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, কোন ব্যক্তির পক্ষে দু’টি পরস্পর বিরোধী নির্দেশ একই সময়ে কার্যকর করা অসম্ভব। আর দ্বিতীয়ত, আপনি যে সার্বভৌম শক্তির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রনাধীন (directly controlled) এলাকায় বসবাস করছেন আইনগতভাবে আপনি কেবল তারই নির্দেশ মেনে নিতে বাধ্য। তবে হ্যাঁ, আপনি যে এলাকায় বসবাস করছেন ‘খ’ যদি তার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রন (direct control) নিয়ে সফলতার সাথে প্রশাসন পরিচালনা করতে সক্ষম হয় সেই দিন থেকে আপনি আগের সার্বভৌম শক্তি ‘ক’ কে বাদ দিয়ে ‘খ’ কে আপনার এলাকার কার্যত সার্বভৌম শক্তি (de facto sovereign) হিসেবে মেনে নিতে পারেন। অন্যান্য দেশ কর্তৃক ‘খ’ এর এই দখলকে স্বীকৃতি দেয়া হলে তা হয়ে যাবে আইনগত সার্বভৌম শক্তি (de jure sovereign)। তখন থেকে আপনি তার নির্দেশ মেনে নিতে আইনগতভাবে বাধ্য। তবে কোন অবস্থাতেই এই নয়া সার্বভৌম শক্তি ‘খ’এর কোন অধিকার নেই যে, এই এলাকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রন গ্রহন করার পূর্বে আপনি এই নয়া শক্তির যে ‘বিরোধিতা’ করেছিলেন সেজন্য সে আপনাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (waging war against the state) কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহ (sedition and high treason) ইত্যাদি দায়ে আপনাকে অভিযুক্ত করবে। কারণ, আপনি এমন একটি সময়ে ‘খ’এর বিরোধিতা করেছিলেন যখন সে এই এলাকার কার্যত সার্বভৌম শক্তি (de facto sovereign) কিংবা আইনগত সার্বভৌম শক্তি (de jure sovereign)-কোনটিই ছিল না। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, রাষ্ট্র বিরোধিতা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহ ইত্যাদি অভিযোগে আপনাকে অভিযুক্ত করতে চাইলে ঐ নয়া সার্বভোম শক্তিকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, সে কার্যত বা আইনগত সার্বভৌমত্ব অর্জন করার পরে আপনি তার বিরুদ্ধে সেসমস্ত অপরাধের কোন একটি সম্পাদন করেছেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ কেবল একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্রের (full-fledged state) বিরুদ্ধেই হওয়া সম্ভব। পরিপূর্ণ রাষ্ট্রসত্তা (full-fledged statehood) অর্জন করার পূর্বের কর্মকাণ্ডকে রাষ্ট্রদ্রোহের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টি আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান - উভয় দিক থেকেই ভ্রান্ত।

১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রকৃতিঃ

আইনবিজ্ঞানের এই মূলনীতিটি সামনে রেখে ১৯৭১ সালের যুদ্ধটিকে দেখা প্রয়োজন। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান একটি একক সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়ে সমগ্র পাকিস্তানে একক সার্বভৌমত্বের বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সাধ্য কারো নেই। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে চট্টগ্রাম থেকে এ অঞ্চলকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার মধ্য দিয়ে এ এলাকায় দ্বৈত সার্বভৌমত্বের পরস্পর বিরোধী দাবী শোনা গেল। একদিকে পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম শক্তি ‘পাকিস্তান’ দাবী করছে যে, এই অঞ্চলে তার সার্বভৌমত্ব কার্যকর; অতএব জনগনের উচিত নয়া সার্বভৌমত্বের দাবীদারদের কবল থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীকে সহযোগীতা করা। শুধু তাই নয়, যদি কেউ নয়া শক্তিকে সহযোগীতা করে, তাহলে তাকে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১ ধারা অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগীতার’ দায়ে মৃত্যুদণ্ড অথবা জরিমানাসহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। অন্যদিকে নয়া শক্তি এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রের সীমান্ত এলাকা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় নিজেরাই সরকার গঠন করে জনগনকে এই মর্মে আহ্বান জানায়, “যেহেতু ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় লাভ করা সত্ত্বেও আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি, সেহেতু আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদেরকে এই এলাকার সার্বভৌম শক্তি হিসেবে ঘোষণা করছি। অতএব জনগনের উচিত আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম শক্তি (পাকিস্তান)কে প্রত্যাখ্যান করে আমাদেরকে এই এলাকার সার্বভৌম শক্তি হিসেবে মেনে নেয়া।”

এই হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জনগনকে উদ্দেশ্য করে দু’টি পৃথক সার্বভৌম শক্তির দাবীদারদের পরস্পর বিরোধী নির্দেশ। জনগন এখন কী করবে? পূর্বেই দেখে এসেছি নির্দেশ দু’টি যেহেতু পরস্পর বিরোধী, সেহেতু একই সময়ে উভয়টি মেনে চলা অসম্ভব। তাহলে নির্দেশ দু’টির যে কোন একটিকে বেছে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। [কেউ বলতে পারেন, উপরোক্ত নির্দেশদ্বয়ের কোনটিকে মেনে না নিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে থাকার সুযোগও তো ছিল। এর জবাবে বলা যেতে পারে যে, প্রস্তাবটি আপাতত নির্জঞ্জাল ও নিরাপদ মনে হলেও তা মূলত মাত্রাতিরিক্ত ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তা প্রসূত। রাষ্ট্রের চরম ক্রান্তিলগ্নে এহেন নির্লিপ্ততা ভীরু কাপুরুষদের কাছে খুবই পছন্দনীয় হলেও খোদ রাষ্ট্রের জন্য এমন জনগোষ্ঠী এক ধরনের দুঃসহ বোঝাস্বরূপ। কারণ, এ প্রকৃতির লোকেরা রাষ্ট্রযন্ত্রের তাবৎ সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে অতিশয় সচেতন; অথচ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তাদের অবস্থা অনেকটা ‘আমরা কী জানি?’ অথবা ‘তাতে আমাদের কী?’ কিংবা ‘বাপু আমরা রাজনীতি বুঝি না; ওসব রাজনৈতিক ব্যাপার রাজনীতিবিদরাই এর সমাধান করবেন’ - ধরনের। এমন নির্লিপ্ত ও মাত্রাতিরিক্ত স্বার্থতাড়িত লোক আর যাই হোক অন্তত রাষ্ট্রের চরম ক্রান্তিলগ্নে অনুসরনীয় আদর্শ স্থানীয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না] কোনটিকে বেছে নিবে তারা? একদল বেছে নিল আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম শক্তি পাকিস্তানকে। এর কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, তারা যদি নয়া শক্তিকে ‘সহযোগীতা’ দেয় তাহলে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১ ধারা অনুযায়ী তাদের জন্য শাস্তি অবধারিত। দ্বিতীয়ত, তারা তখনো নয়া শক্তি ‘বাংলাদেশ’কে কার্যত কিংবা আইনগত (de facto or de jure) – কোন দিক থেকেই সার্বভৌম মনে করতে পারছে না। কার্যত সার্বভোম মনে না করার কারণ হল, এই নয়া শক্তি এখনো এ এলাকার বাস্তব নিয়ন্ত্রন (practical control) নিতে পারে নি। প্রশাসনিক সমস্ত কার্যক্রম এখনো পর্যন্ত পরিচালিত হচ্ছে আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম শক্তির নির্দেশে। আর আইনগত সার্বভৌম (de jure sovereign) নয় এ কারণে যে, তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম শক্তির কাছ থেকে ক্ষমতা লাভ করে নি। আর এমন মনে করারও কোন সুযোগ নেই যে, তারা সার্বভোমত্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। কারণ, সার্বভৌমত্ব অবিভাজ্য। এক বনে দুই বাঘের রাজত্ব কদাচ চললেও চলতে পারে; কিন্তু একই রাষ্ট্রে পরস্পর বিরোধী দুই সার্বভৌমত্বের উপস্থিতি অকল্পনীয়। তাছাড়া, দেশের সীমান্ত এলাকায় শপথ নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের একটি প্রাদেশিক রাজধানীতে নিজেদের প্রবাসী সরকারের দফতর প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও নয়া সার্বভোমত্বের পতাকাবাহীরা নিজেদের আশ্রয়দাতা রাষ্ট্র কর্তৃকও স্বীকৃত (recognized)হয়নি। [এখানে উল্লেখ্য যে, মার্চ মাসের ২৬ তারিখে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলেও ভারত নয়া সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে ডিসেম্বরের ৬ তারিখে অর্থাৎ, যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে।] অন্যদিকে তাদের দৃষ্টিতে আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম শক্তিটি আইনগত ও কার্যত (de facto and de jure) – উভয় দিক থেকেই সার্বভৌম। কারণ, এ এলাকা পুরোপুরি তার দখলে এবং তার সার্বভৌমত্ব গোটা বিশ্বের অপরাপর প্রায় সকল সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক স্বীকৃত (recognized)।

জনতার আরেকটি গ্রুপ বেছে নিল নয়া সার্বভৌম শক্তির দাবীদারকে। তাদের যুক্তির সারবত্তা হল, যেহেতু আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম শক্তি আমাদেরকে অন্যায়ভাবে আমাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে, সেহেতু জাতিসংঘ সনদ (The Charter of the United Nations) সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনে বিঘোষিত ‘জনতার আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার’ (People’s right to self determination) –‘র ভিত্তিতে বর্তমান রাষ্ট্রকে ভেংগে আমরা আমাদের নতুন রাষ্ট্র গড়ে নেওয়ার পূর্ণ অধিকারী। বিপরীত দিকে আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম শক্তিও আন্তর্জাতিক আইনের আরো সুস্পষ্ট নীতি অর্থাৎ, ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার অলংঘনীয়তা’ নীতি (Inviolability of national sovereignty and territorial integrity) প্রয়োগ করে নয়া সার্বভৌমত্বের দাবীদারকে দমন করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহন করল।

উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের লোকদেরকে আমরা নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করতে পারিঃ

• অখণ্ড রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী

• অখণ্ড রাষ্ট্রের সমর্থক জনগোষ্ঠী

• নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকামী সশস্ত্র বাহিনী

• নতুন রাষ্ট্রের সমর্থক জনগোষ্ঠী

• নির্লিপ্ত জনগোষ্ঠী

• ভারতীয় ইষ্টার্ন কমাণ্ডভুক্ত সেনাবাহিনী

ব্যাপক সংঘাতের একটি পর্যায়ে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইষ্টার্ন কমাণ্ডের জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার নিকট অখণ্ড রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর পক্ষে লেঃ জেঃ আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে এই এলাকায় এতদিনকার প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম শক্তির অবসান ঘটল। তার স্থান দখল করল নতুন সার্বভৌম শক্তি ‘বাংলাদেশ’।

মোদ্দা কথা, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলেও ১৬ই ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নি। শুনতে অপছন্দনীয় হলেও এ কথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্ব দরবারে এ অঞ্চলের পরিচিতি ছিল পাকিস্তান হিসেবেই। অতএব, কোন ব্যক্তিকে বাংলাদেশের আইনে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র অপরাধে অভিযুক্ত করতে চাইলে প্রমাণ করতে হবে যে, সে ১৬ই ডিসেম্বরের পর দেশের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী কোন কাজে অংশগ্রহণ করেছিল। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রসঙ্গ একেবারে অবান্তর।

বিষয়: বিবিধ

১০৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File