সেকুলারিজম কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?
লিখেছেন লিখেছেন অন্তর্দৃষ্টি ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৬:৩৯:২৮ সন্ধ্যা
ইদানীং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি একটি বিশেষ মহলের জন্য রমরমা ব্যবসার কাঁচামালে পরিণত হয়েছে। চেতনার এসব ফেরীওয়ালাদের দাবী হল, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা-ই নাকি মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনা।
আসলে কী ছিল মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনা? বীর জনগণকে কিসে মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল? তাদের উদ্দেশ্য কি এই ছিল যে, “ইনশাল্লাহ,(৭ই মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবের উচ্চারিত শব্দ) আমরা যদি দেশকে মুক্ত করতে পারি তাহলে আল্লাহ প্রদত্ত আইন কানুনগুলোকে নির্বাসনে পাঠিয়ে সেক্যুলারিজম কায়েম করে আমরা নিজেরাই আইন প্রণয়নের সর্বময় ক্ষমতার মালিক-মোক্তার বনে যাবো”? এই প্রশ্নের উত্তর মুক্তিযুদ্ধের নয় নম্বর সেক্টর কমাণ্ডার মেজর জলিলের ভাষায় শুনুন,
“আর একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বিশেষ একটি মহলের ধারণা – ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা কি হবে তার মীমাংসা হয়ে গেছে। এ ধরণের উদ্ভট খেয়ালী মন্তব্য কেবল দুঃখজনকই নয়, বিবেক এবং জ্ঞান বিবর্জিতও বটে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং নেতৃত্বদানকারী একজন সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে আমি ঐ সকল বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ১৯৭১ সালে আমরা বাঙ্গালী জনগন পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক আকস্মিকভাবে চাপিয়ে দেয়া একটি অঘোষিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায় এবং রক্ষা করার জন্যই যুদ্ধ করেছি কেবল। এটা ছিল স্বাধীনতা আদায়ের যুদ্ধ, কোন ধর্মযুদ্ধ নয় যে, যুদ্ধ বিজয়ের পরবর্তীকালে বিশেষ কোন ধর্মকে পরাজিত বলে বিবেচনা এবং বর্জন করতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের আওতায় ধর্ম সংকুচিত কিংবা পরাভূত হতে যাবে কেন, কোন যুক্তিতে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মীয় অনুপ্রেরণা মোটেও অনুপস্থিত ছিলনা। প্রতিটি যোদ্ধার শ্বাসে-নিঃশ্বাসে, রণক্ষেত্রের প্রতিটি ইঞ্চিতে স্মরণ করা হয়েছে মহান স্রষ্টাকে – তার কাছে কামনা – প্রার্থনা করা হয়েছে বিজয়ের জন্য, নিরাপত্তার জন্য। অধিকাংশ যোদ্ধাই যেহেতু ছিল এদেশের সংখ্যাগুরু মসলিম জনগণেরই সন্তান, সেহেতু যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর বুলেট, মর্টারের সন্মুখে আল্লাহ এবং রসূলই ছিল তাদের ভরসাস্থল। সুতরাং ’৭১ –এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ইসলাম অনুপস্থিত ছিল বলে যারা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন, তারা কেবল বাস্তবতাকেই অস্বীকার করছেন।” (মেজর (অবঃ) এম এ জলিল, কৈফিয়ত ও কিছু কথা, পঞ্চম প্রকাশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২৫-২৬)
সেক্যুলারিজমকে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে প্রচার করে তাদের পরিচয় বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন,
“তবু যারা মুক্তিযুদ্ধে ধর্মীয় চেতনার অনুপস্থিতি আবিষ্কার করতে চান, তাদের অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের ধারে কাছেও ছিল না।” (প্রাগুক্ত ২৬)
মুক্তিযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রতত্ত্ব কতভাগ লোকের প্রেরণা যুগিয়েছিল সে প্রসঙ্গে মেজর জলিলের বিশ্লেষণ নিম্নরূপঃ
“‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’র নির্দিষ্ট রূপ যে ছিল না তা নয়, তবে সে চেতনা সীমাবদ্ধ ছিল একটা বিশেষ মহলের মধ্যে এবং তারা হচ্ছে তৎকালীন ছাত্র সমাজের সর্বাধিক সচেতন মহলেরও একটা ক্ষুদ্র অংশবিশেষ - বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সেই অংশটি যার নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ প্রমুখ। এই অংশটির চিন্তা-চেতনায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানী চক্র থেকে মুক্ত করে এই অঞ্চলকে বাঙালীর জন্যে একটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল।” (মেজর (অবঃ) এম এ জলিল, অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, সপ্তম প্রকাশ, পৃঃ ৩২)
অন্যান্য সংগঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
“এর বাইরে যে ছাত্র সমাজ বা রাজনৈতিক সংগঠন ছিল তাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছিল গতানুগতিক দেশপ্রেমিকদের দায়িত্বস্বরূপ, মুক্তিযুদ্ধের উপরিউক্ত নির্দিষ্ট চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়।” (প্রাগুক্ত)
অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার চেতনাবোধ প্রসংগে তিনি লিখেছেন,
“মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের সেই সুনির্দিষ্ট চেতনার ধারাবাহিক বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়নি বলেই অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই জানত না তারা কোন লক্ষ্য অর্জনেরে স্বার্থে ঐ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কেবল একটা কথাই জানতো – পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীসহ সকল অবাঙ্গালীকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাড়িয়ে দেশকে মুক্ত করতে হবে। পুনরায় বাপ-দাদার ভিটায় স্বাধীনভাবে ফিরে যেতে হবে। এর অধিক তারা আর কিছুই জানতনা বা বুঝত না।” (অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, সপ্তম প্রকাশ, পৃঃ ৩৩)
বিষয়: বিবিধ
১৭৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন