‘সেক্যুলারিজম’: ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মহীনতা
লিখেছেন লিখেছেন অন্তর্দৃষ্টি ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০২:৩১:৫৬ দুপুর
আমাদের দেশে ‘সেক্যুলারিজমের’ অনুবাদ ও তাৎপর্য নিয়ে সেক্যুলারদের পক্ষ থেকে প্রায়শঃ বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। সাধারণত শব্দটির বাংলা অনুবাদ করা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। আর তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘সেক্যুলারিজমের’ তাৎপর্য হল, “প্রত্যকে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার সুযোগ পাবে; একজনের ধর্ম আরেকজনের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া যাবে না”।
অনুদিত শব্দটি মূল শব্দের তাৎপর্য তুলে ধরতে কতটুকু সক্ষম – তার উপর নির্ভর করে কোন বিদেশী শব্দ অনুবাদের স্বার্থকতা। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি secularism এর স্বার্থক অনুবাদ নয়। কারণ, এ অনুবাদটি সেক্যুলারিজমের সঠিক তাৎপর্যের পরিবর্তে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দ থেকে মনে হয় যে, এই দর্শন ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে, অর্থাৎ, প্রতিটি ধর্মকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়। আসলে তা নয়। সেক্যুলারিজমের সঠিক তাৎপর্য হচ্ছে, সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষা ব্যবস্থার বৃহত্তর পরিমন্ডলে ধর্মের প্রভাব (আগে থেকে থাকলে তা ) উৎখাত করা এবং (আগে থেকা না থাকলে) নতুন করে উপরোক্ত পরিমণ্ডলে ধর্মের নির্দেশাবলী যাতে কিছুতেই ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সংস্থাসমূহকে ব্যবহার করা। অর্থাৎ, সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে উৎখাত (eviction) ও প্রতিরোধ (prevention) করা ই সেক্যুলারিজমের মূল উদ্দেশ্য। এ দৃষ্টিকোণ থেকে “ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত সমাজ/রাষ্ট্র তত্ত্ব” হতে পারে secularism এর সঠিক উদ্দেশ্য জ্ঞাপক অনুবাদ।
বাংলাদেশের বাস্তব উদাহরণঃ
সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে উৎখাত (eviction) ও প্রতিরোধ (prevention) করা ই যে সেক্যুলারিজমের মূল উদ্দেশ্য তা বুঝার জন্য ইউরোপের কোন ইতিহাস গ্রন্থ পড়তে হবে না; খোদ বাংলাদেশের ইতিহাসেই তার বাস্তব উদাহরণ রয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭২ সালে গণপরিষদ কর্তৃক যে সংবিধান গৃহীত হয় তাতে ‘সেক্যুলারিজম’ (তাদের ভাষায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’) কে মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ঘোষণা করে তাকে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হল। [“আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল – জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে” – (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা) ]
সেক্যুলারিজমকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণার পর তা বাস্তবায়নের জন্য ধর্ম উৎখাত ও প্রতিরোধ (eviction and prevention) – উভয়বিধ পদক্ষেপই নেয়া হল। ঐতিহ্যবাহী কবি নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে ‘ইসলাম’ শব্দ কেটে কবি নজরুল কলেজ করা হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে ‘রাব্বি যিদনী ইলমা’ [অর্থাৎ, হে প্রভু, আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও – (আল কুরআন, সূরা ত্বা-হা, আয়াত ১১৪)] কেটে দেয়া হল। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেয়া হল। [সম্প্রতি অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ‘মুসলিম’ শব্দটি ফিরে এসেছে]। অথচ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল থেকে ‘জগন্নাথ’ (যা হিন্দুদের ঈশ্বরের নাম) শব্দটি কাটা হল না। [আমরা বলছি না যে, এ শব্দটি কেটে দেয়া উচিত ছিল। আমরা শুধু এটুকুই বুঝাতে চাচ্ছি যে, এদেশের ইতিহাসে সেক্যুলারিজম মানেই শুধু ইসলামের প্রতি একতরফা উগ্র বিদ্বেষ পোষণ এবং অপর দিকে বাঙ্গালী সংস্কৃতির নাম দিয়ে হিন্দু ধর্মের রীতি-নীতির অনুসরণ।] রেডিও টেলিভিশনে সালাম – কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে দেয়া হল। আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও অখণ্ড পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ সে সময়ের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে ‘অতি প্রগতিবাদী নেতৃত্ব’ শিরোনামে লিখেছেন,
“প্রবাসী সরকার ঢাকায় ফিরার সঙ্গে – সঙ্গে প্রমাণিত হইল যে এটা (অর্থাৎ, যুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশ একটি সেকিউলার রাষ্ট্র, মুসলিম রাষ্ট্র নয়) সরকারী অভিমত। দেশে ফিরিয়াই তাঁরা যা দেখাইলেন, তাতে রেডিও-টেলিভিশনে কোরান-তেলাওয়াত, ‘খোদা হাফেয’, ‘সালামালেকুম’ বন্ধ হইয়া গেল। তার বদলে ‘সুপ্রভাত’, ‘শুভ সন্ধ্যা’ ও ‘শুভ রাত্রি’ ইত্যাদি সম্বোধন প্রথা চালু হইল।” [আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, বাংলা একাডেমী ২০০১, পৃষ্ঠা ৪৫৯]
এগুলো ছিল উৎখাত নীতি (eviction policy) বাস্তবায়নের কিছু দিক। আর ভবিষ্যতে যাতে ইসলামের নির্দেশাবলী সমাজ ও রাষ্ট্রে কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সে উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হল প্রতিরোধ নীতি (prevention policy)। এ নীতি বাস্তবায়নের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যই হল সংগঠনের স্বাধীনতা। অর্থাৎ, কোন উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য যে কোন ব্যক্তিরই সংগঠন তৈরী করার অধিকার রয়েছে। জনগনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সেই সংগঠনের উদ্দেশ্যের সাথে একমত পোষণ করলেই কেবল তা রাষ্ট্র ও সমাজে কার্যকর হবে। গণতন্ত্রের এই স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজন স্বীকৃত নীতিকে লংঘন করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন গ্রুপ ইসলামী আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার যে কোন আন্দোলনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। ’৭২ এর সংবিধানে ৩৮ অনুচ্ছেদটি ছিল নিম্নরূপঃ
“জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে;
তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সঙ্ঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।”
অর্থাৎ, রাষ্ট্র ও সমাজে কার্যকর করার জন্য যে কোন দর্শন (চাই তা উগ্র নাস্তিক্যবাদ, শোষণমূলক পুঁজিবাদ কিংবা সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্রের নামে চরম একদেশদর্শী গুণ্ডা রাষ্ট্রতত্ত্বই হোক না কেন) নিয়ে রাজনীতি ও সংগঠন করা যাবে; কিন্তু কিছুতেই ধর্মীয় নির্দেশাবলী বাস্তবায়নের জন্য সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানো যাবে না। এখন প্রশ্ন হল, যে দেশের সিংহভাগ মানুষ আল্লাহকে নিজেদের ইলাহ (সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী) হিসেবে স্বীকার করে ও আল্লাহর নির্দেশ সর্বাগ্রে শিরোধার্য মনে করে সে দেশে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া যাবে না অথচ আল্লাহর নির্দেশাবলীকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে মানুষ নিজেরাই আইন প্রণয়নের পূর্ণ অধিকারী এমন দর্শন প্রতিষ্ঠা করার জন্য অসংখ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্থা তৈরী করার উন্মুক্ত লাইসেন্স থাকবে – এহেন নীতি কার কারা, কেন এবং কার স্বার্থে প্রণয়ন করেছিল?
বিষয়: বিবিধ
১৪৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন