জ্ঞান ও বিশ্ব শাসন

লিখেছেন লিখেছেন অন্তর্দৃষ্টি ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১২:৪৩:২৫ দুপুর

জ্ঞানের যে বিশাল ভাণ্ডার আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছি তা কোন জাতির একক কৃতিত্ব নয়; নয় কোন জাতির চিরস্থায়ী সম্পদ। যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে মানবজাতির এই জ্ঞানও বিকশিত হয়েছে; বহুগুণে বেড়ে গেছে তার পরিধিও। যে জাতি হালনাগাদ জ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে পড়েছে, পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া জ্ঞানভাণ্ডার তাদের বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কোন কাজে লাগে নি। সময়ের সাথে সাথে জ্ঞানের স্থানিক আবর্তন সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে ইতিহাসবিদ পি.কে. হিট্টির বর্ণনায়ঃ “This culture, it should be remembered, was fed by a single stream, a stream with sources in ancient Egypt, Babylonia, Phoenicia and Judaea, all flowing to Greece and now returning to the East in the form of Hellenism. We shall later see how this same stream was re-diverted into Europe by the Arabs in Spain and Sicily, whence it helped create the Renaissance of Europe.” [History of the Arabs; Philip K. Hitti, Sixth Edition, London, Macmillan & Co. Ltd. Reprinted 1958, p. 307]

ইতিহাসের যে পর্যায়ে যে জাতি জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, স্বাভাবিক নিয়মে রাজনৈতিক নেতৃত্বও তার কাছে থেকেছে। জ্ঞানের এই স্থানিক আবর্তনকে আমরা নিম্নোক্ত চিত্রসমূহের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারিঃ



চিত্র ১: প্রাচীন মিশর, এহুদা, ফিনিশিয়া ও ব্যাবিলনের জ্ঞান আত্মস্ত করে নেয় গ্রীক জাতি। এই প্রক্রিয়ায় গ্রীসে জন্ম নেয় সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটলের মত ইতিহাসখ্যাত পণ্ডিতবর্গ যাদের দার্শনিক চিন্তাধারার উপর দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা।



চিত্র ২: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে গ্রীক জাতি দক্ষিনে সুদান ও পূর্বে ভারত পর্যন্ত বিশাল এলাকা দখল করে নেয়।



চিত্র ৩: খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতকে এসে জ্ঞানচর্চায় দুর্বল হয়ে গ্রীক জাতি। ফলে এদেরকে পরাজিত করে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয় রোমানরা। ভূ-মধ্যসাগরের চারপাশ জুড়ে সাম্রাজ্য গাড়ে এরা। পশ্চিমে পর্তুগাল, উত্তরে বৃটেন, দক্ষিনে মরক্কো-মিশর ও পূর্বে পারস্য সাম্রাজ্যের দোরগোড়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয় তাদের সাম্রাজ্য। আইনশাস্ত্রে বিস্ময়কার অবদান রাখে এই জাতি। আধুনিক ইউরোপের আইন মূলত রোমান আইনেরই (বিশেষত জাস্টিনিয়ান কোড) সন্তান। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির জোরে চাপিয়ে দেয়া এই আইন আজও কার্যকর রয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশে ।



চিত্র ৪: সপ্তম শতকে উত্থান ঘটে মুসলিম জাতির। গ্রীস, পারস্য ও ভারতের কয়েক শতাব্দীর পুঞ্জীভূত জ্ঞান মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে আয়ত্ব করে নেয় মুসলিম আরব। [In only a few decades Arab scholars assimilated what had taken the Greeks centuries to develop.” [History of the Arabs; Philip K. Hitti, Sixth Edition, London, Macmillan & Co. Ltd. Reprinted 1958, pp. 306-307] আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব কয়টি শাখার সূচনা করে মানবেতিহাসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই জাতিটি। আরবদের এই বিস্ময়কর অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে জর্জ সার্টন সোৎসাহে লিখেছেন, “The main task of mankind was accomplished by Muslims. The greatest philosopher, al Farabi, was a Muslim; the greatest mathematicians, Abu Kamil (who at the beginning of the tenth century perfected al-Khawarizmi’s algebra) and Ibrahim ibn Sinan (whose quadrature of the parabola was the simplest ever made before the invention of integral calculus), were Muslims; the greatest geographer and encyclopædist, al Masudi, was a Muslim; the greatest historian, al Tabari, was still a Muslim” (George Sarton; Introduction to the History of Science, vol. I (Baltimore, 1927), p. 624)



চিত্র ৫: সপ্তম শতকে মোহাম্মদ (সাঃ) এর নেতৃত্বে শুরু হয় মুসলিম আরবদের অগ্রাভিযান। সিকি শতাব্দীর মধ্যেই এরা বিজয়ী হয়ে উঠে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী ভূ-খণ্ডের উপর। একক প্রতাপে পৃথিবী শাসন করে প্রায় বারো শ’ বছর। আজও বৈশ্বিক রাজনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বের অধিকারী এই জাতিটি। আদর্শগত দিক দিয়ে বস্তুবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার সামনে অলংঘনীয় বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ সভ্যতা। সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বের প্রবক্তাদের দৃষ্টিতেও এ সভ্যতার পুনরায় বিজয়ী হবার সম্ভাবনা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।



চিত্র ৬: তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি শহর বিশেষ করে সোনারগাঁ, দিল্লী, বোখারা-সমরকন্দ, বাগদাদ, দামেস্ক, ইস্তাম্বুল, কায়রো, সিসিলি ও গ্রানাডাহয়ে উঠে জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র । সেখান থেকে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপ জুড়ে । জন্ম নেয় রেনেসাঁ।



চিত্র ৭: ইউরোপ হয়ে উঠে জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র। জ্ঞানের দ্যুতি ছড়ানোর পাশাপাশি রেনেসাঁ, আলোকিত যুগ (Enlightenment) প্রভৃতি নাম দিয়ে ভৌত বিজ্ঞান ও নাস্তিক্যবাদী দর্শনে বিপ্লব সাধন করে এই মহাদেশের পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ। নাস্তিক্যবাদী দর্শনভিত্তিক এই সভ্যতার অপর নাম “পাশ্চাত্য সভ্যতা (The Western Civilisation)”।



চিত্র ৮: ইউরোপীয় তরবারির ঝিলিক লাগে প্রায় সবক’টি মহাদেশেই। গত শতকের ষাটের দশকের পর থেকে উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করলেও উপনিবেশবাদের মাধ্যমে ইউরোপীয় নাস্তিক্যবাদ ও সেকুলারিজমের বিস্তার ঘটে বিশ্বজুড়ে; যার প্রভাব আজও বিদ্যমান পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশে। উপরের মানচিত্রে কেবল বৃটিশ উপনিবেশগুলোকে দেখানো হল।

এ হচ্ছে গত আড়াই হাজার বছরে জ্ঞানের সাথে বিশ্ব শাসনের সম্পর্কের একটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ান। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, ভবিষ্যতের বিশ্ব শাসনের মসনদ কোন সভ্যতার জন্য অপেক্ষমান? ভবিষ্যতের ব্যাপারে সুনিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও সম্ভাব্য বিকল্পের প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, গ্রীক ও রোমানদের ফিরে আসার আর কোন সম্ভাবনাই নেই। কারণ, প্রথমতঃ এই দু’ সভ্যতার আলোচনা এখন ইতিহাসের পাতাতেই সীমাবদ্ধ; কোন জাতি বা গোষ্ঠী এ দু’ সভ্যতার পুনর্জাগরণ প্রয়াসী নয়। দ্বিতীয়তঃ আধুনিক বিশ্বের জটিল সমস্যাদির কোন যুৎসই সমাধান তাদের কাছে নেই। রয়ে গেল পাশ্চাত্য ও ইসলামী সভ্যতা। পাশ্চাত্য সভ্যতার নাস্তিক্যবাদী দর্শন আধুনিক মানুষের সমস্যাদি সমাধানের পরিবর্তে তা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সভ্যতা এখন নিজেই আত্মহত্যার রাস্তা খুঁজছে। কেউ কেউ আবার চৈনিক সভ্যতার সম্ভাবনার কথা ভাবছে (দেখুন হান্টিংটনের The Clash of Civilisations)। কিন্তু, প্রথমেই মনে রাখতে হবে চৈনিক সভ্যতা মৌলিক অর্থে পাশ্চাত্য সভ্যতার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। তাছাড়া, পাশ্চাত্য সভ্যতা যেসব সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছে চায়নার কাছে তার কোন সমাধানই নেই। অবশিষ্ট থাকছে কেবল ইসলামী সভ্যতা। ভবিষ্যতের বিশ্ব শাসনে এ সভ্যতারই রয়েছে পূর্ণ যোগ্যতা। গত তিনশো বছর এ সভ্যতার পিছিয়ে থাকার কারণ তার তাত্ত্বিক দুর্বলতা নয়; বরং নিবেদিতপ্রাণ অনুসারীর সংকট। বিংশ শতকে শুরু হওয়া পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনগুলো নিষ্ঠার সাথে কাজ চালিয়ে নিলে এ সভ্যতার বিজয় ঠেকাবার সাধ্য পৃথিবীর কোন আদর্শ কিংবা সভ্যতারই নেই।

বিষয়: বিবিধ

১৭৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File