হায় বাংলাদেশ! হায় বাঙ্গালী!!
লিখেছেন লিখেছেন জিনাত ২৫ মার্চ, ২০১৩, ০৭:১৬:১৪ সকাল
কবি আবদুল হাই শিকদার, কেন জানি আমার নিজের অজান্তেই এই লোকটির প্রতি একটা ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল। ভালো লাগার এই লোকটির সাথে প্রথম সরাসরি সাক্ষাত হয়েছিল গাজীপুর জেলা কারাগার এর মূল ফটকে আর এক অসম্ভব প্রিয় ব্যক্তি আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির পূর্ব মূহুর্তে। সেদিন তার পাশাপাশি ফরহাদ মাজহার, চাষী নজরুল ইসলাম সাহেবদের মত আর ও অনেক বরেণ্য ব্যক্তিরা ও উপস্থিত ছিলেন জেল গেট এ । আমি তাদের পাশেই এক জায়গায় দাড়িয়ে ওনাদের জ্ঞানগর্ভ আলাপচারিতা শুনছিলাম। সেদিন দেখেছিলাম তাদের লেখনির মতই বাস্তবে ও তারা সাদাসিধে আর স্পষ্টবাদি। সেই সাদাসিধে আর স্পষ্টবাদিতার মুকুট এর আর একটি পালক আবদুল হাই শিকদার এর এই লেখাটি। আমি জানি অনেকই ইতোমধ্যেই অনেকবার পড়েছেন লেখাটি তারপর বাঙ্গালী-বাংলাদেশীদের বর্তমান অবস্থা অনুধাবনে ছোট এই লেখাটি আর একবার পড়ার অনুরোধ করতে নিজের লোভ সামলাতে পারলাম না। প্লিজ লেখাটি একবাবের জন্য হলেও মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। প্লিজ....
ডাকাতের রাজ্য’ থেকে ‘রিমান্ডের রানী
আবদুল হাই শিকদার
23 March 2013, Saturday
শেখ মুজিবের শাসনামলে সৃষ্ট ১৯৭৪-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭৪ ডেইলি মেইলে জন পিলজার লিখেছিলেন, ‘এ ধরনের দৃশ্য আমি আর কখনও দেখিনি। প্রকৃতি আর মানুষ মিলে যদি কখনও বেলসেন আর অশউেসর অসংখ্য কবর নতুন করে রচনা করার চেষ্টা করে থাকে, তাহলে তারা এই গোরস্তানে সফল হয়েছে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু কঙ্কাল আর কঙ্কাল—বোধ করি হাজার হাজার। প্রথমে লক্ষ্য করিনি। পরে বুঝতে পারলাম অধিকাংশ কঙ্কালই শিশুদের।’
জন পিলজারের কাছে ’৭৪-এর বাংলাদেশকে মনে হয়েছিল একটা গোরস্তান। প্রকৃতি ও শাসকদের সম্মিলিত পাপের গোরস্তান। যার অসহায় শিকার হয়েছিল সাধারণ মানুষ।—সেই সাধারণ মানুষ, যারা স্বপ্ন দেখেছিল সুখ ও সমৃদ্ধির।
নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্টার পিটার আর. কান ২১ নভেম্বর ১৯৭৪-এ ঢাকা থেকে তার পত্রিকায় যে প্রতিবেদন পাঠান তাতে তুলে ধরেন এই সঙ্কটের একটা বিশ্লেষণ। তিনি লেখেন, ‘এদেশের ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়, দুঃখ-কষ্ট, বহুমুখী আর্থিক দৈন্য, সম্পদ ও জমির অভাব, জনসংখ্যার বিরামহীন বৃদ্ধি, সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার রাজনীতি এবং নৈরাশ্যব্যঞ্জক মানসিকতা—সবকিছু মিলে বাংলাদেশকে দুনিয়ার সবচেয়ে হতাশ জাতিতে পরিণত করছে। ... শেখ মুজিব যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন তখন দেশবাসীর কাছে তিনি ছিলেন একজন অতিমানব। এতদিনে তাকে দোষে-দুর্বলতায় মিলে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তার তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে, কারণ তিনি সবসময় দালাল ও চাটুকারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। তার চারপাশের কঠোর বাস্তবতার চেয়ে বরং নিজের বাগাড়ম্বরে বিশ্বাস করেন এবং কঠিন সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করেন।’
বাংলাদেশের ঊষালগ্নের কথা এগুলো। তখন রাজাকার বলি আর যুদ্ধাপরাধী বলি, সবাই জেলে আটক। শেখ মুজিবের কথাই তখন আইন। বলতে গেলে তার কথায়ই তখন এদেশে সূর্য ওঠে এবং ডোবে। তিনি যা চাচ্ছেন তাই হচ্ছে। দেশের মানুষ তার হাতে সব অর্পণ করে, তারই মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর সব সম্ভাবনাকে আওয়ামী দুর্বৃত্তায়নের কবলে ছেড়ে দিয়ে রক্তকরবীর আত্মবিমোহিত রাজার মতো ঢুকে গেছেন নিজস্ব ঘোরের মধ্যে। ফলে মাত্র তিন বছরের মাথায় জাতি হিসেবে বাংলাদেশীরা নিপতিত হয় ভয়াল হতাশায়।
বাংলাদেশের এই অবস্থাটাকে জনাথন ডিম্বলবি দেখেছিলেন ‘বাংলাদেশ ট্র্যাজেডি’ হিসেবে।
লন্ডনের নিউ স্টেটস্ম্যান পত্রিকায় ২৭ নভেম্বর ১৯৭৪ তারিখে প্রকাশিত তার প্রতিবেদনে তিনি তুলে ধরেছিলেন সঙ্কটের স্বরূপ—‘এমন একদিন ছিল যখন শেখ মুজিব ঢাকার রাস্তায় বের হলে জনসাধারণ হাত তুলে ‘জয় বাংলা’—বাংলাদেশের জয় ধ্বনিতে মেতে উঠতো। আর আজ যখন স্বীয় বাসভবন থেকে তিনি অফিসের দিকে যান, তখন দু’দিকে থাকে পুলিশের কড়া পাহারা। পথচারীরা সজ্ঞানে তার যাতায়াত উপেক্ষা করে।... বাংলাদেশ আজ বিপজ্জনক অরাজকতার মুখোমুখি। লাখ লাখ লোক ক্ষুধার্ত।... ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়ে ঢাকায় দম বন্ধ হয়ে আসে।... বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া।
... বাইরের দুনিয়া বাংলাদেশের দুর্নীতির কথা ফলাও করে বলে থাকে।... তবে এমন লোকও আছে, যাদের দুর্নীতিবাজ হওয়ার কোনো অজুহাত নেই। সদ্য ফুলে-ফেঁপে ওঠা তরুণ বাঙালিরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শরাবখানায় ভিড় জমায়। তারা বেশ ভালোই আছে। এরাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা—বাংলাদেশের বীর বাহিনী। গেরিলা যুদ্ধে এরা পাকিস্তানকে হারিয়েছে। তাদের প্রাধান্য আজ অপরিমেয়। রাজনৈতিক দালালি করে ও ব্যবসায়ীদের পারমিট জোগাড় করে তারা আজ ধনাঢ্য জীবনযাপন করছে। সরকারি কর্মচারীদের ভয় দেখাচ্ছে। নেতাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে এবং প্রয়োজন হলে অস্ত্র প্রয়োগ করছে। এরাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বাছাই করা পোষ্য।
আওয়ামী লীগের ওপরতলায় যারা আছেন, তারা আরও জঘন্য। যাদের মুক্ত করেছেন সেই জনসাধারণের মেরুদণ্ড ভেঙে তারা আজ ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন।’
উপরে যে উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করলাম, এরকম ডজন ডজন উদ্ধৃতি তুলে ধরা যায়। আমি শুধু সেই জাতিগঠনের সূচনা সময়গুলো সম্পর্কে কিঞ্চিত্ আলোকপাত করলাম মাত্র। তো এরকম হতাশা, দুর্নীতি ও দুঃশাসনপীড়িত সময়ে বাংলাদেশের কপালে জুটেছিল অনেক উপাধি। যেগুলোর কোনোটাই প্রাপ্য ছিল না দেশটির। এর মধ্যে বেশি জনপ্রিয়তা পায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার প্রদত্ত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ খেতাবটি।
১৯৭৫ সালের ৬ জানুয়ারি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় পিটার গিল যখন লেখেন ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বোঝা’ তারও ৪ মাস আগে সুইজারল্যান্ডের টাজেস আর্জগার (২১ আগস্ট ১৯৭৪) বাংলাদেশকে ‘এশিয়ার পর্ণকুটীর’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে সবচেয়ে বড় বোমাটি ফাটায় ভারতের আলোচিত সংবাদপত্র ফ্রন্টিয়ার। তারা শেখ মুজিব সরকারের বাংলাদেশকে ‘ডাকাতদের রাজ্য’ বলে আখ্যায়িত করে। সে দিক থেকে বিচার করলে ‘বাংলাদেশ কি ডাকাতদের গ্রাম’ বলে যে লেখাটি কদিন আগে লিখেছিলাম তা বেঠিক ছিল না।
কিসিঞ্জার অতি বিখ্যাত বলেই বোধ করি তার কথাটিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। অন্যরা অতটা উল্লেখিত হয়নি।
শেখ মুজিব যদিও আওয়ামী লীগকে বধ করে তার কবরের ওপর গড়ে তুলেছিলেন তার ‘বাকশাল’-এর প্রাসাদ, তবুও একথা ঠিক, সেই ‘ডাকাতদের রাজ্য’ থেকেই উঠে এসেছে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সালতানাত। এই সরকারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তলাবিহীন ঝুড়ি-ফুড়ি কিংবা এশিয়ার পর্ণকুটীর এগুলো আর মানানসই হয় না। বরং ‘ডাকাতদের রাজ্য’ কথাটি অধিক প্রযুক্ত। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকার অনেক নজির স্থাপন করেছে। গত এক মাসে এই সরকার হত্যা করেছে দেড় শতাধিক মানুষ। গত এক মাসে ৩৬০টি মামলা লাগিয়ে বিরোধী দলের তিন লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করে একটা বিশ্ব রেকর্ড করেছে। ১১ মার্চ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যে চেঙ্গীসীয় তাণ্ডব চালিয়েছে সরকার, তাও নজিরবিহীন। আবার একদিনে ১৫১ জন নেতাকর্মীকে পুলিশের চাহিদা মোতাবেক ৮ দিনের রিমান্ডে দিয়ে স্থাপন করেছে আরেকটি বিশ্ব রেকর্ড। শুধু রেকর্ড আর রেকর্ড! আবার এসব নেতাকর্মীর অনেককেই ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করে স্থাপন করেছে আরও একটি অনন্যসাধারণ বিশ্ব রেকর্ড! এটা এমন একটা রেকর্ড যা আমাদের দেশে তো বটেই, আফ্রিকার জঙ্গলেও কোনোদিন ঘটেনি। ফলে এটা বিশ্ব ছাড়িয়ে যাওয়া রেকর্ড। সে হিসেবে একে বলা যেতে পারে ‘সৌর রেকর্ড’। এই রেকর্ড স্থাপন করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই পরিতৃপ্তির হাসি হেসেছেন। আর পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম. খা. আলমগীরের।
অন্যদিকে, গণগ্রেফতারের আতঙ্ক ছড়িয়ে যাকে তাকে যখন তখন গ্রেফতার, খুন, ল্যাংড়া করে দেয়ার অধিকার অর্পণ করে, পুলিশকে অবাধ ঘুষ খাওয়ার মুক্ত মৃগয়া দান করে এই সরকার অর্জন করেছে অপরিসীম সাফল্য।
যে দু’জনের আদালতে এই ১৫১ জন নেতাকর্মীকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় তোলা হয় তারা হলেন—অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী হোসেন ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কেশব রায় চৌধুরী এবং এই দু’জন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ডাণ্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় বিএনপির নেতাকর্মীদের দেখেছেন। এসব নেতাকর্মী আজ সরকারের রোষানলে পড়েছেন শুধু ভিন্নমত পোষণের কারণে। বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা এই জালিম সরকারকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। শুধু এটুকু কারণে ফৌজদারি কার্যবিধিতে ডাণ্ডাবেড়ির কোনো বিধান না থাকলেও মোস্ট ওয়ানটেড ক্রিমিনালদের মতো, দুর্ধর্ষ খুনি, ভয়ঙ্কর, পেশাদার অভ্যাসগত অপরাধীর মতো এসব রাজবন্দীকে পরিয়ে দেয়া হয়েছে ডাণ্ডাবেড়ি।
আমাদের এই দু’জন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট নিশ্চয়ই জানেন, এরা কেউই সাধারণ মানুষ নন। খুনি, ডাকাত, দুর্বৃত্ত নন। এরা সমাজের সম্মানিত মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা জাতীয়ভাবে সুপরিচিত, জাতীয় নেতা। তারপরও এসব নেতাকর্মীর প্রতি এই অন্যায় আচরণের প্রতিবিধান না করে, তারা পুলিশের দাবি মোতাবেক তাদের ৮ দিন ধরে নির্যাতন চালানোর ঢালাও অধিকার প্রদান করে পুলিশের হাতেই তুলে দিয়েছেন। বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটাও একটা বিশ্ব রেকর্ড। এই বিশ্ব রেকর্ড স্থাপনের জন্য এই দুই বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটকে একদিন যথোপযুক্ত পুরস্কার দেয়ার অগ্রিম আবেদন জানিয়ে রাখছি পরবর্তী সরকারের কাছে।
বেগম খালেদা জিয়ার এক দফার আন্দোলনের প্রতি এই গণরিমান্ড ও ডাণ্ডাবেড়ি উপহার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
হামলা, মামলা, দখল, গুলি, খুন, নির্যাতন, নিপীড়ন, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এই সরকার তার কীর্তিগাথা রচনা করেনি। কিন্তু গণরিমান্ড ও গণডাণ্ডাবেড়ির মাধ্যমে যে মধ্যযুগীয় বর্বরতা, অসভ্যতা, নিচুতা, হিংস্রতা আমাদের মহামহিম সরকার স্থাপন করেছে, তার সঙ্গে তুলনা করার মতো আর কোনো উপকরণ আমাদের হাতে নেই। তাদের চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস সব এর কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। জাতিকে, বিশ্বকে স্তম্ভিত করার ক্ষেত্রেও এই কর্মটি তাদের শীর্ষবিন্দু। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষ এই রিমান্ড ও ডাণ্ডাবেড়ির কথা মনে রাখবে। শিউরে উঠবে। আতঙ্কিত হবে। দিশেহারা হবে। সেজন্যই শেখ হাসিনার শাসনামলকে ইতিহাস হয়তো বলবে রিমান্ড ও ডাণ্ডাবেড়ির রাজ্য। যদি তাই হয় তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসে খ্যাত হবেন রিমান্ডের রানী বা ডাণ্ডাবেড়ির ভাণ্ডারী হিসেবে। অবশ্য এটাই প্রথম নয়। ডাণ্ডাবেড়ির ক্ষেত্রে এই সরকার প্রথম হাত পাকায় ২০১১ সালে জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলাম ও অধ্যাপক তাসনিম আলমকে পরিয়ে।
পদ্মা সেতু, হলমার্ক, শেয়ারবাজার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু থেকে সরিয়ে শাহবাগি থেরাপি দিয়ে জাতিকে আধা-পাগল বানানোর যে প্রক্রিয়া সরকার শুরু করেছিল, ডাণ্ডাবেড়ি ও রিমান্ডের তাণ্ডবের কাছে তাও পানসে হয়ে গেছে।
গত ২০ মার্চ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের ইন্তেকালের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যথার্থ দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের মতো রাষ্ট্রঘোষিত তিন দিনের শোক যথাযথ গাম্ভীর্যের সঙ্গেই পালন করে। বুকে ধারণ করে শোক ব্যাজ। বাতিল করে নিজেদের পূর্বঘোষিত সব কর্মসূচি। প্রত্যাহার করে ২১ মার্চের হরতাল। বেগম খালেদা জিয়া পিছিয়ে দেন তার বগুড়া সফরও।
আশা করা গিয়েছিল, আমাদের সরকার ও আওয়ামী লীগ এই দায়িত্বশীলতা, ভদ্রতা, সৌজন্য, উদারতা, সম্মানবোধ ও শিষ্টাচারের বিনিময়ে তাদের রোষ কষায়িত চোখকে শান্ত করে, সহিংসতার পথ পরিহার করে বাড়িয়ে দেবে কাণ্ডজ্ঞান ও সম্প্রীতির হাত।
কিন্তু পোড়া কপাল আমাদের। জাতির সেই প্রত্যাশার মাথায় গরম ছাই আর ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অপমানে অপমানে জর্জরিত করতে চেয়েছে দেশের রাজনীতিকে।
তারা বিএনপির সংযম ও শ্রদ্ধা প্রকাশের জায়গাটিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ৮ দিনের রিমান্ডে। পরিয়েছে ইতর ও কুিসত ডাণ্ডাবেড়ি। পুলিশ এখন মহা উল্লাসে নৃশংস হুঙ্কারে ৮ দিন ধরে বিএনপির সেই শ্রদ্ধা, সংযম, ভদ্রতা, রুচিশীলতা ও শিষ্টাচারের জায়গাটিতে চালাচ্ছে পাশবিক নির্যাতন।
আমাদের মঙ্গল, শুভবোধ ও শ্রেয় চিন্তাগুলোকে এভাবেই শাসকরা প্রতিনিয়ত পদপিষ্ট করছে।
বিএনপি কিংবা জামায়াত নির্যাতিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের কী লাভ হলো এতে? সরকার তো সম্প্রীতি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার শেষ সুযোগটাও ছুড়ে মেরেছে পথের ধূলিতে। অর্থাত্ আমাদের সরকারই চায় না দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক। নাগরিক ও রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক।
প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মিলনের জায়গাটি একটু প্রসারিত হয়েছিল। কিন্তু অবিবেচক গোঁয়ার শাসকরা তা হতে দিল না। তারা প্রেসিডেন্টের লাশের সঙ্গেই কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে সব সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য। ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করতে চেয়েছে দেশের মানুষকে।
তবে এতে দেশের মানুষ ঠাণ্ডা হয়নি। ঠাণ্ডা হয়েছে সম্প্রীতির জায়গাটি। ঐক্য ও সংহতির জায়গাটি। ফলে জেগে উঠেছে বিরক্তি, ক্রোধ ও ঘৃণা। কারণ বিএনপির নেতাকর্মীদের নয়, আসলে ওইদিন ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে, জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে, মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ শহীদকে। বাংলাদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে করা হয়েছে লাঞ্ছিত।
দুই.
নিপাট ভদ্রলোক প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের কাছে জাতির আশা ছিল অনেক। কিন্তু প্রবীণ এই রাজনীতিবিদও বৃত্তের বাইরে আসতে পারেননি। তা তিনি না পারুন, কিন্তু আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবারের প্রতি তিনি ছিলেন অতি বিশ্বস্ত। আমৃত্যু তিনি এই বিশ্বাসের মূল্য দিয়ে গেছেন। এই মূল্য দিতে গিয়েই হয়তো তিনি ন্যায়বিচার, মানবতা ও আইনের শাসনের কথা ভুলে, সব সুস্থ বিবেককে স্তম্ভিত করে মাফ করে দিয়েছিলেন ২২ জন ফাঁসির আসামিকে। যারা সবাই ছিল নৃশংস খুনি। জানোয়ারের চাইতেও নিকৃষ্ট।
গত টার্মে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আকাশপথে ৬,৫০,০০০ কিলোমিটার আকাশে উড়ে, ২৪৮ দিন বিদেশে কাটিয়ে, ১০টি ডক্টরেট ডিগ্রি এনে দেশে বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন, সেসময় তার বড় সহায় ছিলেন আজকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম. খা. আলমগীর। এখন যেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঠেঙ্গানো ও মানুষ খুন করার ক্ষেত্রে ম. খাই তার বড় অবলম্বন। তো সেই সময় দেশ ও বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়ে সেদিনের আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী (পরে প্রেসিডেন্ট) মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, ‘অল্প সময়ে শেখ হাসিনা যে পদক ও ডিগ্রি পেয়েছেন, এর আগে এত অল্প সময়ে বিশ্বের আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধান এত সম্মান পাননি।... শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য শেখ হাসিনার যে অবদান তাতে তার নাম মাদার তেরেসা, সক্রেটিস, আব্রাহাম লিঙ্কন ও মহাত্মা গান্ধীর পাশে খোদাই করে রাখা উচিত।
’
জিল্লুর রহমানের এই কথা শুনে অনেকের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল। অনেকের জিহ্বা লেগে গিয়েছিল তালুতে। স্তাবকতার বিশাল ব্যবহার দেখে অনেকের চক্ষু চড়কগাছও হয়ে গিয়েছিল। তবে তাতে অবশ্য নেতানেত্রীদের কিছু যায় আসে না। কারণ এটাই আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
এসব অর্থহীন অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রির বহর আনা দেখে ড. ওয়াজেদ মিয়া অবশ্য ঠিকই বলেছিলেন, ‘এসব ডক্টরেট ডিগ্রি প্রধানমন্ত্রী তাবিজ বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ছাড়া কোনো কাজে লাগাতে পারবে না।’
যাই হোক, ১/১১-এর কাণ্ডারিকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে শেখ হাসিনা হয়তো ঋণ শোধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার চিকিত্সা ও মৃত্যুর পর যে অবহেলা দৃশ্যমান হলো, তা দেখে বিরোধী দল নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পর্যন্ত মর্মাহত হয়েছেন। মর্মাহত হয়েছে দেশের মানুষও। এমনকি শোক বইয়ের পাশেও ছিল না শোকের কালো রিবন। যেটা বেগম খালেদা জিয়া শোক বইতে স্বাক্ষরের সময় করিতকর্মা কর্তাদের দেখিয়ে দেন।
বেগম জিয়া যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দায়িত্বরত অবস্থায় রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর সংবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়নি। তার চিকিত্সা তদারকির জন্য বিদেশে কোনো দায়িত্বশীল মন্ত্রীকে পাঠানো হয়নি। সরকার তার অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত বুলেটিন প্রচারের মাধ্যমে জাতিকে অবহিত করেনি। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে সাংবিধানিক পদে থাকা সত্ত্বেও সরকারের তরফ থেকে তার মৃত্যু সংবাদ না জানানোয় তিনি যুগপত্ দুঃখিত ও মর্মাহত হয়েছেন।
তারপরও বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রেসিডেন্ট ও একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বিন্দু পরিমাণ কার্পণ্য করেননি। বঙ্গভবনে কে তাকে রিসিভ করলো কে করলো না—তিনি কেয়ার করেননি। এক্ষেত্রে তিনি যে ঔদার্য ও মহানুভবতা দেখিয়েছেন, তা থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। কারণ উল্টো পিঠে যারা দাঁড়িয়ে তারা তো অন্ধকারের কালিঝুলি।
সরকার এসব অভিযোগের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারে না কোনোভাবেই। এর জবাব সরকারকেই দিতে হবে। তবে সবশেষে যে দুটি কাণ্ড হয়েছে তাও অবাক হওয়ার মতো। রাষ্ট্রপতি ইন্তেকাল করেছেন ২০ মার্চ। সেদিনই সন্ধ্যা বা রাতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা উচিত ছিল। যখন তারা তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দেয় তখনই ছুটির বিষয়টাও চলে আসতে পারতো। কিন্তু তা না করে ২১ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে হঠাত্ করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ফলে হৈ চৈ পড়ে যায় সবখানে। দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। কারণ ওই সময় স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমার কাজ চলছিল পুরো দমে। ফলে সর্বত্র শুরু হয় হুলুস্থুল-ছোটাছুটি। দেখা দেয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। তাও আবার ভূতাপেক্ষ ছুটি। ফলে সমস্যাও দেখা দেয় অনেক। যেসব আদেশ এরই মধ্যে জারি হয়েছে, আদালতে যাদের দণ্ড দেয়া হয়েছে বা জামিন দেয়া হয়েছে, তাদের এখন কী হবে—এসব ভেবে সংশ্লিষ্টরা পড়ে যান পেরেশানিতে।
দ্বিতীয় কীর্তি হলো ইনু সাহেবের বাংলাদেশ টেলিভিশন। প্রেসিডেন্টের লাশ বিমানবন্দরে আনা থেকে শুরু করে বঙ্গ ভবন কাভার করাসহ পুরো ঘটনাক্রম সরাসরি সম্প্রচারের কথা ছিল বিটিভির। এ নিয়ে রণপ্রস্তুতিও ছিল দেখার মতো। তারপরও তারা যথারীতি ফেল মারে। এ ব্যর্থতার দায় জামায়াত-শিবিরের ঘাড়ে ইনু সাহেব চাপিয়েছেন কিনা, তা অবশ্য আমরা এখনও জানতে পারিনি।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সরকার চলছে না। সর্বত্র বিরাজ করছে বিশৃঙ্খলা। সর্বত্র দেখা দিয়েছে সমন্বয়হীনতা। সত্যি সত্যি সরকার বেসামাল ও দিশেহারা, হারিয়ে ফেলেছে নিয়ন্ত্রণ।
তিন.
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব মোটামুটি বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন আমাদের শিক্ষা জগতের। তিনি যেমন শিক্ষাঙ্গনগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেন, তেমনই পাঠ্যবইয়ের সর্বনাশ সাধন করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের সব বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি যেন ক্রুসেড শুরু করে দিয়েছেন। এই ‘অযোগ্য অথর্ব তথাকথিত সত্’ মতলবি শিক্ষামন্ত্রী সাহেবের জমানায় তার মন্ত্রণালয়ের সচিব কামাল চৌধুরী সাহেব স্থাপন করেছেন আরেক ‘বিজয় স্তম্ভ’। তিনি ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর বাংলা বই থেকে ষোড়শ শতাব্দীর কবি আবদুল হাকিমের মাতৃভাষা প্রীতির অনন্য স্বাক্ষর ‘বঙ্গবাণী’ ও একুশের অমর কবিতা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতা দুটি ক্ষমতা বলে বাতিল করে পাঠ্যবইয়ে কেরদানি করে ঢুকিয়েছেন নিজের কবিতা! — হে মোর দুর্ভাগা দেশ!
কোথায় আবদুল হাকিম আর আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আর কোথায় আমাদের নাহিদ সাহেবের কামাল মিয়া। কোথায় লিয়াকত আলী আর কোথায় হলো জুতার কালি!
এসব অপগণ্ডের অত্যাচার থেকে জাতি যে কবে রক্ষা পাবে কে জানে? জাতির দুর্ভাগ্যের রাত যে কবে ভোর হবে কে জানে? রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
http://www.bdtomorrow.net/columndetail/detail/114/1892
বিষয়: বিবিধ
১৪৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন