জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিবার্য ঐতিহাসিক দাবীকে দাবিয়ে রাখার জায়নবাদি চক্রান্তের জালে বন্দি হয়ে পড়েছে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা। জামালউদ্দিন বারী :
লিখেছেন লিখেছেন মনসুর আহামেদ ২৬ জুন, ২০১৭, ০৯:০০:১৮ রাত
ফিলিস্তিনের জেরুজালেম শহর বিগত তিন হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম অনুঘটক হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। ইহুদি, খৃষ্টান ও ইসলাম এই তিনটি আব্রাহামিক ধর্মের আবির্ভাব ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মুৃতিবহ জেরুজালেম নগরীর কৃর্তত্ব সভাতার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। খৃষ্টপূর্ব কাল থেকে অদ্যাবধি জেরুজালেমের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শহরটি অন্তত দুইবার ধ্বংস হয়েছে, ২৩ বার অবরুদ্ধ হয়েছে, ৫২ বার আক্রান্ত হয়েছে এবং ৪৪বার দখল ও পুর্নদখল হয়েছে। খৃষ্টপূর্ব দশম শতকে কিং ডেভিড প্রথম জেরুজালেম দখল করে সেখানে ইহুদি রাজ্য স্থাপন করেন। ডেভিডের পুত্র কিং সলোমনের নির্মিত প্রথম ইহুদি টেম্পল নির্মিত হয় খৃষ্টপূর্ব নবম শতকে। এর দেড়শ বছর পর সামারিয়ানদের হাতে জেরুজালেম দখল হওয়ার পর সেখানকার ইহুদিরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে(৫৮৬) বেবিলনীয়রা জেরুজালেম দখল করে ইহুদিদের প্রথম টেম্পলটি ধ্বংস করে দেয়। এর মাত্র অর্ধশত বছর পর খৃষ্টপূর্ব ৫৩৯ সালে পারস্য সম্রাট সাইরাস বেবিলনীয়দের হাত থেকে জেরুজালেমের কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বিতাড়িত করেন। এরপর খৃষ্টপূর্ব ৩৩২ খৃষ্টাব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট জেরুজালেম দখল করে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকে কিং হেরোড নামক এক ইহুদি রাজা জেরুজালেম দখল করে দ্বিতীয় টেম্পল নির্মান করার মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই রোমানরা জেরুজালেম দখল করে দ্বিতীয় টেম্পল ধ্বংস করে দেয়। প্রথমে বাইজান্টাইন ও পরে মুসলমানদের হাতে রোম সা¤্রাজ্যের পতনের পর খৃষ্টীয় ৬৩৮ সালে ইসলামের খলিফা ওমর (রা প্রথম জেরুজালেম সফর করেন এবং ৬৬১ থেকে ৭৫০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত উমাইয়া এবং ৯৭৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনামলে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইহুদি টেম্পলের স্থানে ডোম অব রক ও মসজিদুল আকসা পুন:নির্মান করা হয়। ১০৯৯ সালে শুরু হওয়া প্রথম ক্রুসেডের শেষদিকে খৃষ্টানদের জেরুজালেম অবরোধ ও দখলের চেষ্টা সুলতান সালাদিন নস্যাৎ করে দেন। খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক থেকে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত জেরুজালেম প্রথমে মামলুক এবং উসমানীয় খলিফাদের কর্তৃত্বাধীণ ছিল। এ সুদীর্ঘ সময়ে জেরুজালেমসহ উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় অংশে মুসলমান, খৃষ্টান এবং ইহুদিদের মধ্যে যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নজির সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্ব সভ্যতার আগের ইতিহাসে এমন শান্তিপূর্ন সহাবস্থানের নজির নেই। আন্দালুসিয়ায় আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় কর্ডোভা খিলাফতের যুগকে ইহুদিদের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়। সে সময় মুসলমান শাসকরা ইহুদিদের জন্য তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা উন্মুক্ত করে দেন। মুসলমান শাসকরা ইহুদি পন্ডিত, শিক্ষাবিদ, ধর্মতত্ববিদ ও জ্ঞানসাধকদের যথাযথ মূল্যায়নসহ সমাজে অবদান রাখার পথ সৃষ্টি করে দেন। তিন হাজার বছরের ইহুদি ইতিহাসে এটিই ছিল তাদের স্বর্ণযুগ। মিশরীয় ফারাও, গ্রীক ও রোমানরা তাদের সবকিছু ধ্বংস করে দিলেও মুসলমান শাসকরা তাদের সভ্যতা ও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে ইহুদি পুনর্গঠনের সুযোগ এনে দেন।
রোমানদের সময় ইহুদিদের হাতে যিশুখৃষ্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। আর ইহুদিরা মুসলমানদের আগে সব সভ্যতায় বিতাড়িত ও নিগৃহিত হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর পরিবল্পিতভাবে উসমানীয় খিলাফতের ভাঙ্গন ও পতন নিশ্চিত করে তা ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদিরা যে নতুন বিশ্বব্যবস্থা কায়েমের পরিকল্পনা করেছিল তা বাস্তবায়ন করতে তাদেরকে আরেকটি মহাযুদ্ধের অজুহাত খুঁজতে হয়েছে। বলাবাহুল্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলই হচ্ছে আজকের পশ্চিমা পুঁজিবাদি সাম্রাজ্যবাদের মূল ভিত্তি। অর্থাৎ মুসলমানরা যেখানে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার একটি অধ:পতিত ও বিশৃঙ্খল সমাজকে শৃঙ্খৃলা, ঐক্য ও সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ঔপনিবেশিক লুন্ঠন ও আধুনিক মারনাস্ত্রের বলে বলিয়ান পশ্চিমা পুঁজিবাদি সাম্রাজ্যবাদ একটি স্থিতিশীল ও অভিভাজ্য মুসলমান সমাজকে ভেঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নানা মত ও পথে বিভাজিত করে একটি দীর্ঘমেয়াদি অশান্ত-জ্বালাময়ী জনপদে পরিনত করেছে। হাজার বছর আগে ক্রুসেড যেমন শুরু করেছিল খৃষ্টানরা, ঠিক একইভাবে বিংশ শতকে প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধও শুরু এবং লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, সব সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংসের মহাযজ্ঞ সংঘটিত করেছিল পশ্চিমারাই। তবে এসব যুদ্ধের চরম ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে বিশ্বের মুসলমানদের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের ইহুদি নিধন বা হলোকস্টের দায়ও যেন মুসলমানদের। খৃষ্টান পোপদের শাসন ইহুদি ব্যাংকার ও সুদি মহাজনদের স্বার্থের অনুকুল ছিলনা। রোমানদের হাতে গ্রীকদের পতনের পর অর্ধশহ স্রহরাব্দের মধ্যে ক্ষয়িষ্ণু রোম সাম্রাজ্যের স্থলাভিষিক্ত হতে খৃষ্টান বা ইহুদি আইডেন্টিক্যাল শাসকদের কোন অস্তিত্ব ছিলনা। বিশেষত: প্রধান বাণিজ্যপথ ভ’-মধ্যসাগরের উপর মুসলমানদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা মুসলমান দিগি¦জয়ী শাসকরা রোমান সাম্রাজ্যকে গ্রাস করার পাশাপাশি তা’ আরো সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিল। মুসলমানদের এই অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ইউরোপের খন্ড বিখন্ড পোপতন্ত্রের ব্যর্থতার উপর দাড়িয়ে খৃষ্টীয় নবম শতকের শুরুতে ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের সম্রাট চার্সস বা শার্লমেন ব্যাপক জনসমর্থন ও ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রতি হিসেবে আবিভর্’ত হন। মূলত: তিনিই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড সংঘটনের গোড়াপত্তন করেছিলেন বলে ঐতিহাসিককরা মনে করেন। ইসলামের মহানবী হযতে মুহম্মদ(স ষষ্ঠ শতকে রোমান ও জেরুজালেমে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তাঁর দেখানো পথে পরবর্তি যুগে মুসলমানরা আন্দালুসিয়া, পারস্য ও রোমান সা¤্রাজ্যকে ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে এসেছিলেন। বেলজীয় ঐতিহাসিক পিরেনের মতে, মুহাম্মদই শার্লমেনের সৃষ্টি করেছিল। অর্থাৎ ইসলামের শিক্ষা যেভাবে মুসলমানদের সব ভোদাভেদ ভুলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সব সভ্যতার উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম করেছিল। শার্লমেন এবং ক্রুসেডাররাও সে ধারায় বিজয় অর্জনে সচেষ্ঠ হয়েছিল। ক্রুসেড এবং পরবর্তি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাদের সে প্রয়াস সফল হয়নি। তবে আপাত:দৃষ্টিতে লক্ষ্যনীয় না হলেও সভ্যতার দ্বন্দ ও মুসলমানদের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দেয়ার পশ্চিমা প্রয়াস কখনো থেমে থাকেনি। ক্রুসেডারদের হাত থেকে সুলতান সালাদিনের জেরুজালেম বিজয়ের পর থেকে আটশ বছর তা নিরবচ্ছিন্নভাবে মুসলমানদের কর্তৃত্বেই ছিল। দুইটি সাম্রাজ্যবাদি মহাযুদ্ধের ছত্রছায়ায় পশ্চিমারা মুসলমানদের বিভক্ত ও দুর্বল করার সুযোগটিই গ্রহন করেছিল। তবে সম্পদ লুণ্ঠন ও কুক্ষিগতকরণের কর্মতৎপরতার বাইরে পশ্চিমা পুঁিজবাদি সাম্রাজ্যবাদের হাতে শান্তি ও সাম্যের আদর্শগত দর্শন না থাকায় তারা মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তবে মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বহুধাবিভক্ত মুসলিম বিশ্বকে বিভাজিত রাখার পাশাপাশি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখার মধ্যেই এখন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ শেষ আশ্রম হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওয়ান অন টেররিজম হচ্ছে সেই সাম্রাজ্যবাদি ষড়যন্ত্রের শেষ অধ্যায়।
২০০১ সালের এগার সেপ্টেম্বরে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ও পেন্টাগনে বিমান হামলা চালিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের তদন্ত রিপোর্ট সারাবিশ্বের কাছেই অস্বচ্ছ ও ধোঁয়াশাপূর্ন। তবে হামলায় টুইন টাওয়ার ধ্বংসের একঘন্টার মধ্যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এই হামলার দায় ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদার উপর চাপিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধ(ক্রুসেড) শুরুর ঘোষনা দিয়েছিলেন। এর তিন সপ্তাহের মধ্যেই মার্কিন ও ন্যাটোর সামরিক হামলায় হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ হত্যা করে, সব সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংস করে আফগানিস্তান দখল করে নেয় মার্কিনীরা। তবে আফগান তালেবান বা কথিত আল কায়েদার নেটওয়ার্ক ধ্বংস বা তাদের শক্তি সামর্থ্যে চিড় ধরাতেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি নিয়োগ করেও যখন আফগানিস্তানে রাজনৈতিক বা সামরিক বিজয়লাভের কোন সম্ভাবনা দেখা গেলনা, তখন মিথ্যা অজুহাতে ন্যাটোর যুদ্ধ ইরাকে বিস্তৃত করা হল, সেক্যুলার রাষ্ট্রনায়ক সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করে ইরাক দখল করে তার মানচিত্র বদলে ফেলার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা এখনো সক্রিয় রয়েছে। গত এক দশকে আফগানিস্তান ও ইরাকের পর লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবগুলো দেশকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে গৃহযুদ্ধ ও সামরিক আগ্রাসনের বিভীষিকার মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। আমেরিকা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষনা দিয়ে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে দেড় দশকে আলকায়েদার নেটওয়ার্ক ধ্বংস করতে পারেনি, উপরন্তু দায়েশ বা আইএস’র মত নতুন নতুন জিহাদি গ্রুপের উত্থান ঘটেছে। এবং এসব গ্রæপের সংগঠন, রিক্রুটমেন্ট, অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্রকরনের সাথে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরাসরি জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া যায়। অন্যদিকে ওসামা বিন লাদেনের পরিবারিক ব্যবসায়-বাণিজ্যের সাথে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের পরিবার, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারসহ আরো অনেকেই জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। এমন অভিযোগে নাইন-ইলেভেন বিমান হামলা ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হেনরি কিসিঞ্জারসহ আরো একাধিক ব্যক্তি কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। পরিবর্তিতে যারা এই কমিশনে নিয়োগ পেয়েছিলেন তাদের কেউই বিতর্ক ও ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্টতার বাইরে ছিলেননা। ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়েদাকে নাইন ইলেভেন হামলার জন্য দায়ী করে প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্টে সন্দেহাতত বা কোন সুস্পষ্ট তথ্য প্রমান পাওয়া না গেলেও পশ্চিমা মিডিয়ার একচ্ছত্র প্রচারে নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার ঘটনায় আল কায়েদাকেই দায়ী করা হয়েছে। কমিশন বা তদন্তের আগেই যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হামলার জন্য সরাসরি আল কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করা হয়েছিল এবং আল কায়েদার নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়া এবং ওসামা বিন লাদেনকে ধরার জন্য আফগানিস্তানে সামরিক হামলা ও দখলদারিত্বের ১০ বছর পর ২০১১ সালের ২ রা মে মার্কিন সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা সন্ত্রাস বিরোধি যুদ্ধে মার্কিনীদের অন্যতম শরিক পাকিস্তানকে না জানিয়ে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ এলাকার একটি বাড়িতে শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে গুলি করে হত্যার নাটকীয় ঘটনার টেলিকাস্ট দেখানো হয়েছে। এ ঘটনা যদি সত্য হয়, তবে যে ওসামা বিন লাদেনকে ধরলে নাইন ইলেভেন ঘটনা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক, সন্দেহ ও অজানা প্রশ্নের জবাব পাওয়া সম্ভব ছিল, সেই লাদেনকে জীবিত ধরার চেষ্টা না করা, লোকচক্ষুর অন্তরালে সমুদ্রে সমাহিত করার কথিত মার্কিনী দাবীর প্রেক্ষাপটে এ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের সন্দেহ আরো বেড়ে গেছে।
আফগানিস্তানে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেখানকার তালেবান মুজাহিদদের সমর্থনে মার্কিন গোয়েন্দা মিশনগুলো সম্ভাব্য সবকিছুই করেছিল। সৌদি বহুজাতিক কনস্ট্রাকশন কোম্পানী বিন লাদেন গ্রুপের অন্যতম উত্তরাধিকারি, ভিন্নমতাবলম্বি ওসামা বিন লাদেনকে দিয়ে আল কায়েদা গঠন করা হয়েছিল রুশ বিরোধি যুদ্ধে তালেবানদের সহায়তা করার জন্য। একইভাবে কথিত আইএস খলিফা আবুবকর আল বাগদাদিও ইরাক যুদ্ধের শুরুতে মার্কিন সেনাদের হাতে গ্রেফতার হয়ে আবুগারিব কারাগারে বন্দি ছিল। সেখানে তাকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে আইএস গঠন ও নেতৃত্ব দেয়ার উপযোগি করে গড়ে তোলা হয়। বাগদাদি ছাড়ও আইএস’র নেতৃত্বে থাকা আরো একাধিক ব্যক্তিকেও মার্কিন ও ইসরাইলী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়। তবে এসব সংগঠন গড়ে ওঠার পেছনে পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে যে সব যুক্তি উপস্থাপন করা হোক না কেন, প্রকারাস্তরে এসব জিহাদি সংগঠনের কর্মকান্ডের একতরফতা অপপ্রচার পশ্চিমাদের ইসলাম বিদ্বেষ বা ইসলামোফোবিক প্রকল্পের মূল ফোকাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে মুজাহিদ সংগঠন হিসেবে আল কায়েদার কর্মকান্ডের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা’ই বলা হোক না কেন, ওসামা বিন লাদেনের সমাজ দর্শন সম্পর্কে অনেকটা স্বচ্ছ ধারনা পাওয়া যায় আমেরিকার শাসক ও জনগনের উদ্দেশ্যে লেখা একটি চিঠিতে । মার্কিনীদের উদ্দেশ্যে প্রায় চার হাজার শব্দের এ চিঠি ঠিক কবে লেখা হয়েছিল তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও নাইন ইলেভেন হামলার এক বছর পর ২০০২ সালের নভেম্বরে এটি ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে অবজারবার পত্রিকাসহ বিভিন্ন অনলাইনে প্রচারিত হয়। চিঠির শুরুতেই আল কোরআনের সূরা হাজ্জ-এর ৩৯ নম্বর আয়াত এবং সূরা নিসার ৭৬ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি তুলে দেয়া হয়েছে। এসব আয়াতে আল্লাহর রাস্তায় শয়তান ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলা হয়েছে। এবং সত্য মিথ্যার এই যুদ্ধে বিশ্বাসীদের বিজয়ী করার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে। তবে মার্কিনীদের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠির মূল অংশ দু’টি প্রশ্নের জবাবকে অনুসরণ করে বিধৃত হয়েছে। এর প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে- আমরা কেন তোমাদের বিরুদ্ধাচারণ করছি এবং লড়াই করছি? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা তোমাদের কাছে কি চাই এবং কি দাবী করছি। এই ছোট্ট দুটি প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অসংখ্য অকাট্য তথ্য প্রমান ও অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে প্রথমেই বলা হয়েছে- তোমাদের বিরুদ্ধে কেন লড়াই করছি তার জবাব খুবই সিম্পল। তোমরা আমাদেরকে আক্রমন করেছ এবং ক্রমাগত আক্রমন করে চলেছ। তোমরা আমাদেরকে আক্রমন করেছ ফিলিস্তিনে, যে ফিলিস্তিন ৮০ বছর ধরে প্রথমে বৃটিশ প্রটেরেট এবং ইহুদিদের সামরিক দখলদারিত্বে রয়েছে। তোমাদের সহায়তা নিয়ে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর থেকেই ইজরাইলীরা ফিলিস্তিনী আরবদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন, ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। মূলত: ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনই হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে সবচে বড় ক্রাইম। একমাত্র ইসলামই পূর্ববর্তি সকল ঐশিগ্রন্থ এবং ধর্মের নবি রাসূলদের সমান মর্যাদা দিয়েছে। সকলের উপর বিশ্বাস স্থাপনের নিশ্চয়তা দিয়েছে। যেহেতু মুসলমানরাই রোমানদের হটিয়ে জেরুজালেমে ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেখানে (পূর্ববর্তি সকল নবী রাসুলের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারি( ইসলামিক উম্মাহ’য় বিশ্বাসী) মুসলমানদের ঐতিহাসিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যায়ভাবে রক্ত ঝরিয়ে ফিলিস্তিনকে রক্তাক্ত করেছে তার প্রতিশোধ নিতেই হবে। একইভাবে সোমালিয়া. চেচনিয়া, কাশ্মীর ও লেবাননের মুসলমানদের উপর আক্রমন হচ্ছে তোমাদের মদদে। তোমাদের এজেন্ট হিসেবে, তোমাদের নির্দেশে, সমর্থনে ও সহযোগিতায় আমাদের সরকারগুলো প্রতিদিনই জনগনের উপর আক্রমন চালাচ্ছে। এসব সরকার দেশে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠায় জনগনকে বিরত রাখতে ভায়োলেন্স করছে এবং ভায়োলেন্স করতে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। এসব সরকার দেশগুলোকে চরম অবমাননাকর জেলখানায় পরিনত করেছে। তারা জনগনের তেলসম্পদ তোমাদের কাছে নামমাত্র মূলে তুলে দিচ্ছে এবং উম্মাহ্র সম্পদ লুটে নিচ্ছে। তারা ইহুদিদের কাছে আত্ম সমর্পন করেছে, বিশেষত ফিলিস্তিনী জনগনের জীবন ও স্বাধীনতার মূল্যে নিজেদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এভাবে চিঠির বিস্তৃতি অনেক দীর্ঘ- যার সবটা এই নিবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। প্রথম প্রশ্নের জবাবের শেষ স্তবকে বলা হয়েছে, যদি বুশের চোখে শ্যারন শান্তির দূত হয়, তবে আমরাও শান্তির দূত। আমেরিকাপ কখনো নীতি-নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের ভাষা বোঝেনা, সুতরাং আমরা এমন ভাষা প্রয়োগ করতে চাই, যা আমেরিকা সহজে বুঝতে পারে। দ্বিতীয় প্রশ্নের প্রথম সহজ সরল জবাব হচ্ছে, আমরা তোমাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে চাই। এই প্রশ্নে জবাব ও যুক্তিসমুহ তুলে ধরতে গিয়ে ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও জীবন দর্শন হিসেবে ইসলামে ন্যায্যতা প্রমানের পাশাপাশি সমকালীন বিশ্ববাস্তবতা ও সমস্যাসমুহের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে পবিত্র কোরানের অনেকগুলো উদ্ধৃতির আলোকে। এবং আল্লাহর ইচ্ছায় মুসলমানদের বিজয়ী শক্তি হিসেবে আবিভর্’ত হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
মার্কিনীদের কাছে ওসামা বিন লাদেনের নামে প্রচারিত এই পত্রের মূল প্রচারক কারা আমরা তা জানিনা। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সন্ত্রাস ও আত্মঘাতি হত্যাকান্ডের ঘটনায় কথিত আইএস দায় স্বীকার করছে, ভিকটিমদের বেশীরভাগই মুসলমান। এই কথিত আইএস কারা তা’ও আমরা জানিনা। আমরা জানি মার্কিন সেনা অভিযানে ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেন নিহত হয়েছেন। তবে সম্প্রতি সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী উইকিলিক্স নায়ক এডোয়ার্ড ¯েøাডেনের ফাঁস করা এক তথ্যে জানা গেছে- ওসামা বিন লাদেন এখনো বেঁচে আছেন। তিনি সিআইএ’র পে-রোলে আছেন বাহামায় বসবাস করছেন। তাহলে কি আমরা ধরে নেব ওসামা বিন লাদেনের লেখা এই চিঠিও সিআইএ’র কারসাজি? তেমনটি নাও হতে পারে, তবে প্রোপাগান্ডা ও ফল্স ফ্লাগের যুদ্ধে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিবার্য ঐতিহাসিক দাবীকে দাবিয়ে রাখার জায়নবাদি চক্রান্তের জালে বন্দি হয়ে পড়েছে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা। এ থেকে বিশ্বকে মুক্ত করতে মুসলমানদের ঐক্যই যথেষ্ট।
বিষয়: বিবিধ
১২০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন