তাগুতের পরিচয়; অতঃপর তাগুতের সাথে কুফরী:আবু যারীফ

লিখেছেন লিখেছেন মনসুর আহামেদ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:১৭:৪২ রাত

আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন ঈমানদার হওয়ার জন্য মানব জাতির উপর সর্ব প্রথম যে শর্ত আরোপ করেছেন তা হচ্ছে, তাগুতের সাথে কুফরী অতঃপর আল্লাহ্’র প্রতি ঈমান। অর্থাৎ তাগুতকে অস্বীকার-অমান্য করে, তাগুতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আল্লাহ্’র প্রতি ঈমান আনতে হবে। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহ’র প্রতি ঈমানের ঘোষণা দেয় কিন্তু তাগুতকে অস্বীকার-অমান্য না করে, তাগুতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে, তাহলে আল্লাহ্ সে ঈমান গ্রহণ করবেন না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন ফরমান-

“দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। এখন যে কেউ তাগুতের সাথে কুফরী করবে অতঃপর আল্লাহ্’র প্রতি ঈমান আনবে, সে এমন এক মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরলো, যা কখনো ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ্ সব কিছু শুনেন এবং সব কিছু জানেন।” (সূরা আল বাকারা ২:২৫৬)

আল্লাহ আরও ফরমান-

“আমরা প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই একজন রাসূল পাঠিয়েছি এ নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহ্’র দাসত্ব, আনুগত্য (ইবাদাত) করো আর তাগুতকে বর্জন করো।” (সূরা আন নাহল ১৬:৩৬)

“কিন্তু যেসব লোক তাগুতের দাসত্ব বর্জন করেছে এবং আল্লাহ্’র দিকে রুজু হয়েছে, তাদের জন্য সু-সংবাদ। কাজেই [হে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] আমার সেসব বান্দাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও।” (সূরা যুমার ৩৯:১৭)

“তাগুতের সাথে কুফরী অতঃপর আল্লাহ্’র প্রতি ঈমান” এ কথার ব্যাখ্যা:

‘তাগুতের সাথে কুফরী’ অর্থাৎ তাগুতকে অস্বীকার/বর্জন করার ধরণ হলো: আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্ব অস্বীকার করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা (ইবাদাত) বাতিল বলে বিশ্বাস করা, তা ত্যাগ করা, ঘৃণা ও অপছন্দ করা, এবং যারা তা করবে তাদের অস্বীকার করা, তাদের সাথে আল্লাহ’র বিধানের ভিত্তিতে শত্র“তা পোষণ করা।

‘অতঃপর আল্লাহ্’র প্রতি ঈমান’-এ কথার অর্থ হচ্ছে- আল্লাহ্-ই আমাদের একমাত্র রব্ব- সার্বভৌম মালিক, সার্বভৌম আইন-বিধানদাতা ও নিরঙ্কুশ কর্তা, অন্য কেউ নয়। আল্লাহ্ কে একমাত্র রব্ব মেনে নেওয়ার নামই আল্লাহ্’র প্রতি ঈমান। সার্বভৌম মালিক হওয়ার কারণে আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনই একমাত্র হক্ব ইলাহ-ইবাদাত পাওয়ার অধিকারী, অন্য কেউ নয় এ-কথা বিশ্বাস করা, আর সবরকম ইবাদাতকে ইখলাছের সাথে আল্লাহ্’র জন্যই নির্দিষ্ট করা, যাতে এর কোন অংশ অন্য কোন মা’বুদের জন্য নির্দিষ্ট না হয়; আর মুখলেস বা নিষ্ঠাবানদের ভালবাসা, তাদের মাঝে আনুগত্যের সম্পর্ক স্থাপন করা, মুশরিকদের ঘৃণা ও অপছন্দ করা, তাদের সাথে বন্ধুত্ব না করা প্রভৃতি ঈমানের অংগ। তাগুতের সাথে শত্র“তা পোষণ করাটাই মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নাত বা আদর্শ। সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁর থেকে বিমুখ হবে, সে নিজকেই ধোঁকা দিবে। আর এটাই হলো সে আদর্শ যে সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ফরমান-

“তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাঁর সাথীদের মধ্যে একটি উত্তম আদর্শ বর্তমান। তিনি তাঁর জাতিকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন : আমরা তোমাদের প্রতি এবং আল্লাহকে ছেড়ে যাদের উপাসনা তোমরা করে থাক তাদের প্রতি সম্পূর্ণরূপে অসন্তুষ্ট। আমরা তোমাদের অস্বীকার করেছি। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরদিনের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে- যতদিন তোমরা এক আল্লাহ’র প্রতি ঈমান না আনবে।” (সূরা আল-মুমতাহিনা ৬০:৪)

যে তাগুতের সাথে কুফরী না করলে ঈমান হয় না, সে তাগুত আসলে কী? কী তার পরিচয়? কে বা কারা তাগুত? আসুন এবার তা জেনে নেই।

তাগুত আরবী طغيان (তুগইয়ান) শব্দ থেকে উৎসারিত। যার অর্থ সীমালংঘন করা। এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই “তাগুত”, যে আল্লাহ’র নির্ধারিত সীমা লংঘন করেছে। ব্যাপক অর্থে তাগুত বলতে বুঝায়, আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন ছাড়া অন্য যার সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্ব স্বীকার করা হয়, আল্লাহ ব্যতীত যার দাসত্ব ও উপাসনা করা হয় এবং সেই উপাস্য তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। তাগুত হচ্ছে আমাদের একমাত্র রব্ব আল্লাহ্ তা’য়ালার যে সকল গুণ, ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার যে কোন একটিকে আল্লাহ্ তা’য়ালার সৃষ্টি কোন মাখলুক কর্তৃক নিজের দিকে সম্পর্কযুক্ত করা এবং এমন বিষয়ে নিজেকে আল্লাহ্’র সাথে সমকক্ষ বানানো, যা একমাত্র আল্লাহ্’র জন্য খাস। আল্লাহ্ তা’য়ালার হুকুম-আইন ও বিধানের বিপরীত নির্দেশদানকারী সকল শক্তিই মূলতঃ তাগুত। সুষ্পষ্টভাবে তাগুতের অর্থ বুঝার জন্য তাগুতকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে:

শয়তান :

যে আল্লাহ্’র ইবাদাত থেকে মানুষকে অন্য কিছুর ইবাদাতের দিকে আহবান করে। এর প্রমাণ আল্লাহ’র বাণী:

“হে আদম-সন্তান, আমি কি তোমাদের থেকে শয়তানের ইবাদাত না করার অঙ্গীকার নিই নি? নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা ইয়াসিন ৩৬:৬০)

আল্লাহ্ ছাড়া যার দাসত্ব ও ইবাদাত-উপাসনা করা হয় এবং সেই উপাস্য তাতে সন্তুষ্ট:

যে কোন ধরনের দাসত্ব ও উপাসনা মাখলুক বা সৃষ্টি কর্তৃক অন্য কোন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা। যেমন- দোয়া, সাহায্য, মান্নত, নৈকট্য লাভের জন্য পশু জবাই অথবা বিচার ফায়সালা চাওয়া। যদি কোনো মাখলুক এসব উপাসনা নিজের জন্য স্বীকার করে নেয় বা মেনে নেয় অর্থাৎ কোন মানুষ তার উদ্দেশ্যে সিজদাহ করলো, তার উদ্দেশ্যে মান্নত করলো, পশু জবাই করলো, তার উদ্দেশ্যে বিপদ মুক্তির জন্য কিংবা যে কোন কিছু পাওয়ার আশায় দোয়া করল এবং সে মাখলুক এ সকল বিষয় নিজের জন্য মেনে নিলো, সন্তুষ্ট থাকলো, তাহলে সেই তাগুত। ব্যক্তির নীরবতা বা উপাসনা গ্রহনে অস্বীকার না করাও স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য হবে যদি না সে এ অবস্থা থেকে নিজেকে পবিত্র অথবা মুক্ত করে নেয়। অর্থাৎ যদি সে এ কথা না বলে যে এ অধিকারগুলি আল্লাহ্’র জন্য খাস সুতরাং এগুলি তোমরা আমাকে উদ্দেশ্য করে করতে পারো না।

এর প্রমাণ আল্লাহ্ তা’য়ালার বাণী:

“আর তাদের মধ্য থেকে যে বলবে, আল্লাহ্ ছাড়া আমিও একজন ইলাহ-দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার যোগ্য, তাকে আমি জাহান্নামের শাস্তি দান করবো, এভাবেই আমি জালিমদের প্রতিফল প্রদান করে থাকি।” (সূরা আল আম্বিয়া ২১:২৯)

সার্বভৌম ক্ষমতার দাবীদার, আল্লাহ্’র হুকুম পরিবর্তনকারী, আইন-বিধান (শরীয়াহ্) রচনাকারী শাসক:

অর্থাৎ রব্ব হিসেবে যেই কাজগুলি একমাত্র আল্লাহ্ তা’য়ালা সম্পন্ন করেন, আল্লাহ্’র যে কোন সৃষ্ট মাখলুক যদি দাবী করে যে, সেই কাজ সমূহের যে কোন একটি সে নিজে করতে সক্ষম। যেমন- হুকুম প্রদান করা, আইন-বিধান (শরীয়াহ্) রচনা করা। অর্থাৎ কেউ যদি বলে সার্বভৌমত্ব আমার বা আমাদের মতো মানুষের, আমি বা আমরা আল্লাহ্ প্রদত্ত কুরআন ও সুন্নাহ উৎসরিত আইনের পরিবর্তে নিজেরা আইন-বিধান প্রনয়ণ করবো এবং তা দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করবো তবে সে বা তারাই “তাগুত”।

এর প্রমাণ আল্লাহ্ তা’য়ালার বাণী:

“হে নবী! তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা এই মর্মে দাবী করে চলেছে যে, তারা ঈমান এনেছে সেই কিতাবের প্রতি যা তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং সেই সব কিতাবের প্রতি যেগুলো তোমরা পূর্বে নাযিল করা হয়েছিল কিন্তু তারা নিজেদের বিষয়সমূহ ফায়সালা করার জন্য তাগুত-এর দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে তাগুতকে অস্বীকার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সরল-সহজ পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।” (সূরা আন নিসা ৪:৬০)

“মূলতঃ আইন-বিধান দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ তা’য়ালারই।” (সূরা ইউসুফ ১২:৪০)

“তুমি বলো, আল্লাহ্ তাদের অবস্থানের মেয়াদ সম্পর্কে বেশী জানেন। আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় প্রচ্ছন্ন অবস্থা তিনিই জানেন, কেমন চমৎকার তিনি দ্রষ্টা ও শ্রোতা! পৃথিবী ও আকাশের সকল সৃষ্টির তত্ত্বাবধানকারী তিনি ছাড়া আর কেউ নেই এবং নিজের শাসন কর্তৃত্বে তিনি কাউকে শরীক করেন না।” (সূরা কাহাফ ১৮:২৬)

“তোমাদের মধ্যে যে ব্যাপারেই মতবিরোধ হোক না কেন, তার ফয়সালা করা আল্লাহ্’রই কাজ। সেই আল্লাহ’ই আমার রব্ব, তাঁর ওপরই আমি ভরসা করেছি এবং তাঁর দিকেই আমি রুজু করেছি।” (সূরা আশ-শুরা ৪২:১০)

“এসব লোক কি আল্লাহ্’র এমন কোন শরীকে বিশ্বাস করে যারা এদের জন্য একটি দ্বীন-জীবন বিধান প্রনয়ণ করে দিয়েছে যার অনুমোদন আল্লাহ দেননি? ফায়সালার বিষয়টি যদি পূর্ব হতেই নির্দিষ্ট করে দেয়া না হোত তাহলে তাদের বিবাদের ব্যাপারে কবেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া হতো। নিশ্চিতই এই যালিমদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে।” (সূরা আশ-শুরা ৪২:২১)

“আর যারা আল্লাহ্’র নাযিল করা আইন অনুসারে বিচার-ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫:৪৪)

আচরণগত দিক থেকে তাগুতকে র্শিককারীর ন্যায় মনে হলেও তাগুত ও মুশরিকের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে- তাগুত নিজেকে আল্লাহ্’র গুন ও ক্ষমতার সাথে শরীক করে আর মুশরিক নিজেকে আল্লাহ্ তা’য়ালার গুন ও ক্ষমতার সাথে শরীক করে না ঠিকই কিন্তু সে তাগুতকে আল্লাহ্ তা’য়ালার যে কোন একটি কাজের বা বৈশিষ্ট্যের সাথে শরীক করে। আবার কোন কোন সময় কার্যক্ষেত্রে তাগুতকে কাফিরের ন্যায় মনে হলেও তাগুত ও কাফির এক নয়। যারা আল্লাহ্’র সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্ব মানে না তারা কাফের। আর যারা আল্লাহ্’র সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্ব না মানার জন্য অন্যদেরকে বাধ্য করে তাদেরকে বলা হয় তাগুত। যারা সাধারণ মানুষ অন্যকে কুফরী করতে বাধ্য করে না তারা কাফির হতে পারে, কিন্তু তাগুত হতে পারে না। কিন্তু যারা শাসন ক্ষমতায় থাকে তারা কাফির এবং তাগুত দুই-ই হতে পারে। নিজে আল্লাহ্’র সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্ব অমান্য করা এটা তো নিঃসন্দেহে কুফরী কিন্তু যারা নিজেরা মিথ্যা সার্বভৌমত্বের দাবীদার হয়ে আইন-বিধান প্রনয়ণ করে অন্যদেরকে আল্লাহ্’র আইন-বিধানকে অমান্য করায়, তারা প্রকৃতপক্ষে মহান রব্বের রুবুবিয়্যাত নিয়ে টানা-টানি করে। কারণ যে ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্’র সেই ক্ষমতা তারা ব্যবহার করতে চায়। আমরা বহু তাগুতি আইনকে খুব হালকা নজরে দেখি। কিন্তু আল্লাহ্্ তা’য়ালা হালকা নজরে দেখেন না। যেমন আল্লাহ্ পাক চুরির শাস্তি হিসেবে হাত কাটার বিধান দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমরা যদি মনে করি সামান্য মালামাল চুরির অপরাধে চোরের হাত কাটাটা অমানবিক হয়ে যায়, এর পরিবর্তে চোরকে জেল দিলে এমন কি গুরুতর অপরাধ হয়! চোরকে তো চুরির শাস্তি দেয়াই হলো। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটা দাঁড়ায় ভিন্নরূপ, যা সাধারণ মানুষ চিন্তা করে না। তা হচ্ছে এই যে, চুরির জন্য চোরের হাত কাটা’র আইন হচ্ছে আল্লাহ্’র তৈরী ফৌজদারী আইন। সেটাকে বাতিল করে অন্য আইন তৈরী করার অর্থই হলো আইন করে আল্লাহ্’র আইনকে বাতিল করা। আর সুদী ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালুর লাইসেন্স, মদ উৎপাদন ও বিক্রির লাইসেন্স এবং হাউজি, লটারী, জুয়ার অনুমোদন দেয়ার অর্থই হলো আল্লাহ্’র আইনকে অমান্য করার লাইসেন্স দেয়া। এসব কাজ যারা করে তারাই হচ্ছে তাগুত। তারা যে শুধু নিজেরাই আল্লাহ্’র আইন অমান্য করে তাই নয়, বরং তারা আইন করে অন্যদেরকেও আল্লাহ্’র আইন অমান্য করতে বাধ্য করে। তবে হ্যাঁ, এমন কিছু নামধারী মুসলিম আছে যারা আল্লাহ্’কেও মানে তাগুতদেরকেও মানে। তারা মনে করে যে তারা বর্তমান সময়ানুযায়ী ঠিক কাজই করছে, কিন্তু আসলে যে তারা মহান রব্ব আল্লাহ্’র সাথে শরীক করে মুশরিকে পরিণত হচ্ছে যার ফলে তাদের জান্নাত হারাম হয়ে জাহান্নামে স্থায়ী আবাস হচ্ছে সেই বোধ তাদের নেই। তাদের কথা সূরা নিসার মধ্যে আল্লাহ্ এইভাবে ফরমান-

“হে নাবী! তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা এই মর্মে দাবী করে চলেছে যে, তারা ঈমান এনেছে সেই কিতাবের প্রতি যা তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং সেই সব কিতাবের প্রতি যেগুলো তোমরা পূর্বে নাযিল করা হয়েছিল কিন্তু তারা নিজেদের বিষয়সমূহ ফায়সালা করার জন্য “তাগুতে”র দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে তাগুতকে অস্বীকার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সরল-সহজ পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।” (সূরা আন নিসা ৪:৬০)

আমাদেরকে সর্বাবস্থায় স্মরণ রাখতে হবে যে, কোন মানুষ তাগুতের সাথে কুফরী ব্যতীত, তাগুতকে অস্বীকার-অমান্য করা ব্যতীত ঈমানদার হতে পারেনা। আভিধানিক অর্থে এমন প্রত্যেকটি ব্যক্তি/গোষ্ঠীকে ‘তাগুত’ বলা হবে, যে/যারা আল্লাহ্ নির্ধারিত নিজেদের বৈধ অধিকারের সীমানা লংঘন করেছে।

কুরআনের পরিভাষায় তাগুত এমন এক বান্দাহকে বলা হয়, যে সার্বভৌমত্ব, হুকুম-বিধান, কর্তৃত্ব, উপাসনা ও দাসত্বের সীমা অতিক্রম করে নিজেই রব্ব ও ইলাহ হওয়ার দাবীদার সাজে এবং আল্লাহ্’র বান্দাদেরকে নিজের আনুগত্য ও দাসত্বে নিযুক্ত করে। উদাহরণ হিসেবে নমরূদ, ফিরআঊনের নাম উল্লেখযোগ্য। অবশ্য মুসলিম নামধারী অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞতা ও দুনিয়াবী স্বার্থের কারণে তাগুতকে শয়তান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে চান। অথচ আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন তাঁর একক সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্বের মুকাবিলায় নিজ সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্ব দাবীকারী শাসককে তাগুত বলেছেন। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন নাবী মূসা (আলাইহিস সালাম)কে মিশরের শাসক ফিরাউনের নিকট পাঠিয়ে ছিলেন এই নির্দেশ দিয়ে যে,

(হে মূসা! তুমি) “ফিরাউনের কাছে যাও, সে তাগুত (আল্লাহর বিদ্রোহী) হয়ে গেছে। তাকে জিজ্ঞেস করো, তুমি কি পবিত্রতা অবলম্বন করতে ইচ্ছুক? এবং আমি কি তোমাকে তোমার রব্ব-এর দিকে পথ দেখাবো, যেন (এর ফলে) তুমি তাঁকে ভয় করতে থাকো?” (সূরা নাযিয়াত ৭৯:১৭-১৯)

“এখন তুমি ফিরাউনের নিকট যাও। সে তাগুত হয়ে গেছে।” (সূরা ত্ব-হা ২০:২৪)

“(হে মূসা ও হারুন!) তোমরা উভয়ে ফিরাউনের কাছে যাও সে তাগুত হয়ে গেছে।” (সূরা ত্ব-হা ২০:৪৩)

আয়াতসমূহে আমরা দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন মিশরের শাসক ফিরাউনের নিকট তাঁর নাবী মূসা (আলাইহিস সালাম)কে পাঠানোর প্রধান কারণ হচ্ছে ফিরাউন তাগুত হয়ে গিয়েছিল। এখন আমাদের জানা প্রয়োজন যে, এমন কী দাবী ফিরাঊন করেছিলো কিংবা এমন কী কাজ ফিরাঊনের দ্বারা সংঘঠিত হয়েছিলো যার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তাকে তাগুত সাব্যস্ত করে তার নিকট রাসুল প্রেরণ করলেন? দেখুন ফিরাঊনের দাবী সম্পক্যে কুরআনের ভাষ্য-

“সে (দেশবাসী) সকলকে সমবেত করলো এবং ভাষণ দিলো, অতঃপর সে বললো, আমিই তোমাদের সবচেয়ে বড় রব্ব।” (সূরা নাযিয়াত ৭৯:২৩-২৪)

“ফিরাউন বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন ইলাহ আছে বলে আমার জানা নাই।” (সূরা কাসাস ২৮:৩৮)

অর্থাৎ আয়াতসমূহ বলছে, ফিরাঊন নিজেকে সবচেয়ে বড় রব্ব ও ইলাহ দাবী করার কারণে আল্লাহ্ তাকে তাগুত বলেছেন। এতদ সংশ্লিষ্ট আয়াত এবং বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, ফিরাঊনের সবচেয়ে বড় রব্ব ও ইলাহ দাবীর অর্থ হচ্ছে তার রাজ্যের সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তত্বের মালিক হিসেবে সে রব্ব এবং রব্ব হবার কারণে তার ক্ষমতার দাসত্ব, প্রণীত আইনের আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী হিসেবে সে ইলাহ। এক কথায় ফিরাঊন তার নিজের রাজ্য মিশরে আল্লাহ’র একক সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্ব এবং দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা অস্বীকার অমান্য করে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় আইনের ক্ষেত্রে সবকিছু নিজের দাবী করে তাগুতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ পাকের ঘোষণা অনুযায়ী ফিরাঊন যদি শুধুমাত্র আইনদাতা-বিধানদাতা ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হিসেবে নিজেকে রব্ব ও ইলাহ দাবী করার কারণে তাগুত হয়ে থাকে, তাহলে ইসলামের পরিবর্তে আজকে যারা পুঁজিবাদী, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক, জাতিয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ বা মানব-রচিত সংবিধানের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তত্ব নিজেদের বা জনগণের দাবী করছে, সেসব শাসকবর্গও অবশ্যই তাগুত। যদিও তারা ফিরাঊনের মতো নিজেদেরকে রব্ব ও ইলাহ দাবী করার হিম্মত দেখায় না।

সুতরাং আসুন আমরা যারা প্রকৃত ঈমানদার মুসলিম হতে চাই তারা আল্লাহ প্রদত্ত নিজ নিজ জ্ঞান ও বুঝের ভিত্তিতে সার্বভৌমত্ত্ব, আইন-বিধান ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বকে একমাত্র আল্লাহ্’র জন্যই নির্দিষ্ট করি আর সকল প্রকার তাগুতের সার্বভৌমত্ত্ব, আইন-বিধান ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বকে অস্বীকার-অমান্য করে ‘রাব্বুনাল্লাহ্’ ঘোষণা করি এবং সকল প্রকার তাগুতের দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শুধুমাত্র লা-শরীক আল্লাহ্’র জন্য সকল প্রকার দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনাকে খাস করে ‘আশহাদু আল্লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ্’ অঙ্গীকার করি এবং সকল প্রকার তাগুতের ধারক-বাহক নেতা-নেত্রীর অনুসরণ-অনুকরণ ও আনুগত্য ত্যাগ করে একমাত্র মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শর্তহীন আনুগত্য ও পরিপূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণ করার মাধ্যমে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’ অঙ্গীকার করি।

আল্লাহ্ পাক আমাদের সবাইকে দৃঢ়ভাবে তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করার এবং নিজ বিবেক-বুদ্ধি, শক্তি-সামর্থ অনুযায়ী তাগুতকে নির্মূল করার মতো ঈমানী চেতনা এবং অন্তরের প্রশস্ততা দান করুন।

ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা-বিল্লাহ্

বিষয়: বিবিধ

১০৫৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

377724
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাত ০১:৩৩
আকবার১ লিখেছেন :
377725
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাত ০২:৩৯
আকবার১ লিখেছেন : চালিয় যান, সাথে আছি।
377747
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাত ১২:১০
আকবার১ লিখেছেন :

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File