কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি

লিখেছেন লিখেছেন মনসুর আহামেদ ২৪ মে, ২০১৬, ১১:৪০:০৩ রাত

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি।এটি এক বিরল সন্মান। তবে এটি শুধু সন্মানের বিষয়ই নয়,তাঁর সাহিত্য থেকে প্রত্যাশের বিষয়ও। সাধারণ কবি ও জাতীয় কবির মধ্যে পার্থক্য বিশাল। কাউকে জাতীয় কবি, জাতির নেতা বা জাতির পিতা রূপে আসীন করার অর্থ, জাতির সামনে তাঁকে মডেল বা আদর্শ রূপে খাড়া করা। মডেল বিভ্রান্তু বা পথভ্রষ্ট হলে যারা তাঁর অনুকরণে জীবন গড়ে তারাও বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়। তখন মহা বিপদে পড়ে সমগ্র জাতি। একজন বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট মানুষকে জাতির পিতা, জাতির নেতা বা জাতীয় কবির আসনে বসানোর বিপদ তাই ভয়ানক। ইতিহাসের বড় শিক্ষা হল,নিজ গুণে বা নিজ সামর্থে নির্ভূল হওয়াটি যে কোন ব্যক্তির পক্ষেই অসম্ভব –সে ব্যক্তিটি যত প্রতিভাবানই হোক। তেমনি আদর্শনীয় হওয়ার বিষয়টিও।

মানুষ সঠিক পথ পায় বা সত্যকে চিনে একমাত্র মহান আল্লাহর অনুগ্রহে। পথ দেখানোর দায়িত্বটিও একমাত্র তাঁর।পবিত্র কোরআনের ঘোষণা,“ইন্না আলাইনাল হুদা” অর্থঃ নিশ্চয়ই পথ দেখানোর দায়িত্বটি আমার।–সুরা লাইল।তাই মানুষের সামনে সে পথের মডেল বা পথপ্রদর্শক রূপে কাউকে পেশ করার দায়িত্বও একমাত্র তাঁর। তিনি সে কাজটি সমাধা করেছেন নবী-রাসূলদের প্রেরণ করে। কোরআনের ভাষায় হযরত মহম্মদ (সাঃ) হলেন সেই উসওয়াতুন হাসানা তথা উত্তম আদর্শ। মুসলিম হওয়ার অর্থই হল সে আদর্শকে মডেল রূপে গ্রহণ করা। অনুসরণের সে দায়িত্বটি যেমন প্রজার,তেমনি শাসকেরও। তাই যারা ইসলামের অনুসারি তাদের কাছে নতুন মডেলের প্রয়োজন পড়ে না। এজন্যই ইসলামের চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে শত শত মহামানব জন্ম নিলেও জাতির পিতা, জাতীয় নেতা বা কবির ধারণা নেই। হাফিজ শিরাজী,শেখ সাদী,মাওলানা রুমী,আল্লামা ইকবাল মুসলিম ইতিহাসে বিখ্যাত কবি। কিন্তু তারা কোন মুসলিম দেশেরই জাতীয় কবি নন। যদিও তাদের কবিতার মধ্য দিয়ে প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছে ইসলামী চেতনা,এবং ধ্বনিত হয়েছে মুসলিম উম্মাহর স্বপ্ন ও আকুতির কথা। মুসলিম বিশ্বে জাতীয় নেতা ও কবির ধারণাটি এসেছে মূলতঃ সেক্যুলারিষ্টদের পক্ষ থেকে। ইসলামে অঙ্গিকার ও নবীকে আদর্শ বা মডেল রূপে গ্রহণ করা তাদের কাছে সাম্প্রদায়িক কুসংস্কার। ফলে তারা অনুকরণীয় আদর্শ খুঁজে সে আদর্শ থেকে দূরে থাকা লোকদের মধ্য থেকে। এখানে কাজ করে রাজনৈতিক মতলব। নিজেদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক ধারণাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে জাতীয় কবির মর্যাদাকে তারা বাহন রূপে ব্যবহার করে। কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে তুলে নিয় বাংলাদেশের জাতীয় কবির আসনে বসানোর মধ্যে তেমন একটি রাজনৈতিক মতলব কাজ করেছে কিনা সেটি গবেষণার বিষয়। বাংলাদেশের জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁর মন ও মনন,সাহিত্যকর্ম ও রাজনৈতিক আদর্শের মূল্যায়নের বিষয়টিও তাই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সাহিত্য, দর্শন ও চেতনা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের জন্য কতটা উপকারি বা ক্ষতিকর সেটিও বিবেচনার বিষয়। এ প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে তেমনি এক প্রেক্ষাপটে।

জাতীয় কবির সবচেয়ে বড় দায়ভারটি হল,তাঁর সাহিত্যকে সমগ্র জাতির পক্ষ হয়ে কথা বলতে হয়। তাঁর সাহিত্যে বিমূর্ত হতে হয় সে জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস,চেতনা,আশা-আকাঙ্খা,স্বপ্ন,চাওয়া-পাওয়া,হাঁসী-বেদনা ও ইতিহাস। সর্বোপরি তাঁকে মুক্ত হতে হয় সকল ভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতি থেকে। এবং ভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির পরিমাপে যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধ দেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের মাঝে কাজ করে সেগুলোকেও তাঁকে মেনে নিতে হয়। একমাত্র তখনই সে সাহিত্য থেকে দেশবাসী পায় বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টি,পায় দর্শন এবং পায় নির্দেশনা। জাতীয় কবির চিন্তা-চেতনা,বিশ্বাস ও দর্শনকে আপন করে নিয়ে নতুন প্রজন্ম পায় বেড়ে উঠার প্রেরণা। কোন দেশবাসীই নিছক ভূগোল ও পানাহারে বাঁচে না। সভ্যরূপে বাঁচবার প্রয়োজনে তাহজিব ও তমুদ্দনও গড়ে তুলতে হয়। সে লক্ষ্যে দর্শনও লাগে। দর্শনের বলেই বহু মরুর দেশ মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ে তুলেছে। সে দর্শনটি দুর্বল হলে নিঃশেষ হয় স্বাধীন ও সভ্য জাতি রূপে বাঁচবার শক্তি ও প্রেরণা। আজকের মুসলিম দেশগুলি বর্তমান দুরাবস্থায় পৌঁছেছে তো এপথেই। মূলতঃ দর্শনই দেয় স্বাধীন ভাবে বাঁচবার পক্ষে যুক্তি ও শক্তি। দেয় একতা। দেয় সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। ভাষার বলের চেয়ে এখানে প্রবল ভাবে কাজ করে দর্শনের বল। পাকিস্তুানের সৃষ্টিতে সে দর্শনের বলটি জুগিয়েছিল ইসলাম। আর সে দর্শনকে জনগনের মাঝে বলবান করেছিলেন শত শত লেখক, কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। আল্লামা ইকবাল তাঁদেরই অন্যতম। তিনি শুধু পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না,আদর্শনীয় এবং অনুকরণীয়ও ছিলেন।তাঁর সে মহান আদর্শটি হল,ভাষা,বর্ণ,আঞ্চিলকতার উর্দ্ধে উঠে প্যান-ইসলামিক চেতনায় বেড়ে উঠা। তিনি নিজে দৃষ্টান্ত গড়েছেন ভাষা ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে। মাতৃভাষা পাঞ্জাবী হওয়া সত্বেও তিনি কবিতা লিখেছেন উর্দু ও ফার্সীতে। তাঁর সমগ্র চেতনা জুড়ে ছিল মুসলিমের কল্যাণচিন্তা। ছিল উম্মাহর একতার চেতনা। ১৯৪৭ য়ে সেটিই ছিল উপমহাদেশের মুসলিমদের সবচেয়ে প্রবলতম চেতনা। এ চেতনার বলটি না থাকলে বাঙালী, বিহারী, পাঞ্জাবী, গুজরাতি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান –এরূপ নানা ভাষায় বিভক্ত মুসলমানের পক্ষে প্রতিপক্ষের প্রবল বিবোধীতার মুখে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই কি সম্ভব হত? পাকিস্তান আজও যে বেঁচে আছে সেটি সেদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে তেমন এক প্যান-ইসলামি চেতনা বেঁচে থাকার কারণেই, নইলে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায় আরো ৫টি স্বাধীন দেশের জন্ম হত। দেশটির প্রতিটি প্রদেশেরই সে সামর্থ জর্দান, কাতার, কুয়েত বা ওমানের ন্যায় দেশগুলির চেয়ে বেশী ছিল।

প্রশ্ন হল,এক্ষেত্রে বাংলাদেশে নজরুল অবস্থান কোথায়? ইকবাল যেমন পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছেন, নজরুলও কি বাংলাদেশের ন্যায় কোন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন? সেটি কি ভারত ভেঙ্গে? এবং সে স্বপ্ন দেখে থাকলে সেটি তাঁর কোন কবিতায় বা কোন গানে? আরো প্রশ্ন হল,স্বাধীন ভাবে বাঁচবার লক্ষ্যেই বাংলাদেশীদের চেতনা ও দর্শনে কতটা বল জোগাচ্ছে নজরুল সাহিত্য? প্রশ্ন হল,আজকের বাংলাদেশে কি নজরুলের বাংলা? নজরুল যে বাংলায় বাস করতেন সে বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা শতকরা ৫৫ ভাগের বেশী ছিল না। আজকের বাংলাদেশে শতকরা ৯১ ভাগ জনগণ মুসলমান। তিন দিক দিয়ে ভারত ঘেরা বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব ও তার বিচিত্র ভূগোল নিজেই একটি দর্শন ও একটি চেতনার ঘোষণা দেয়। সেটি যেমন ভারতের নয়,তেমনি ভারতভূক্ত বাঙালীর পশ্চিম বাংলারও নয়। নজরুল যে বাংলায় কবিতা চর্চা করেছেন সে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ময়দান ছিল রবীন্দ্রনাথ,বংকিম এবং তাদের ভক্ত ও সতীর্থ সাহিত্যিকদের দ্বারা অধিকৃত। রাজনীতিতে আধিপত্য ছিল ভারতীয় কংগ্রেস,হিন্দু মহাসভা ও কম্যুনিষ্ট পার্টির ন্যায় ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গিকারহীন দলের। কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ-হিন্দুদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়ার প্রেরণাতেই বেরিয়ে আসে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা। সেটি অখণ্ড বাংলাকে খণ্ডিত করে। ১৯৪৭ সালের সে খণ্ডিত পূর্ব-বাংলাটিই হয় পূর্ব-পাকিস্তান। বাংলার মুসলমানগণ তখন একাত্ম হয়েছিল জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব ও ইকবালের প্যান-ইসলামি দর্শনের সাথে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরাজয় হলেও বাংলাদেশ আজও যে পশ্চিম বাংলার সাথে একাত্ম হয়নি সেটি এই ভিন্ন দর্শনের বলেই। ভাষা,জলবায়ু বা ভূ-মৃত্তিকার কোন বৈশিষ্ঠের কারণে নয়।

প্রশ্ন হল,নজরুল-সাহিত্য কতটা সম্পৃক্ত বাঙলার এ নতুন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক ভূগোলের সাথে? নজরুল তার মানসিক সুস্থ্যতা হারান ১৯৪২ সালে। এবং স্বাধীন পাকিস্তানের ধারণাটি আসে ১৯৩০ সালে। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তানে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ১৯৪০ সালে। অতএব নজরুলের কাছে পাকিস্তানের ধারণাটি অজানা বা অপরিচিত ছিল না। প্রশ্ন হল, সে সময় নজরুলের প্রতিক্রিয়াটি কি ছিল? তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসটিই বা কি ছিল? হিন্দুদের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসা বা ভারত-বিভক্তির ধারণাটি কি তিনি সমর্থণ করতেন? নজরুল শুধু কবি ছিলেন না,তিনি অতি সক্রীয় ছিলেন রাজনীতেও। নিজে যেমন রাজনৈতিক দলও গড়েছেন, তেমনি নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন। পত্রিকায় রাজনৈতিক কলাম লিখে তিনি জেলে গেছেন। রাজনৈতীক দলের মুখপত্র ‘লাঙ্গল’ ও ‘নবযুগ’র সম্পাদকও ছিলেন। তাই নজরুলকে চিনতে হলে শুধু তাঁর ব্যক্তি ও পরিবারিক জীবন এবং সাহিত্য-কর্মকে নয়,তাঁর রাজনীতিকেও চিনতে হবে। তাছাড়া কোন ব্যক্তির সবচেয়ে সুক্ষতম পরিচয়টি ধরা পড়ে তার রাজনীতিতে, কারণ কি তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কি তাঁর দর্শন, এবং কারা তাঁর শত্রু ও মিত্র সেটি রাজনীতিতে লুকানো যায় না।

তবে নজরুলকে চিনতে হলে তার শিক্ষা ও বেড়ে উঠার পরিবেশকেও জানতে হবে। মানুষ যা খায় বা পান করে তারই প্রকাশ ঘটে তার স্বাস্থ্যে। তেমনি সে যেরূপ শিক্ষা পায় বা যেভাবে বেড়ে উঠে সেটাই বিমূর্ত হয় তার সাহিত্যে। শিক্ষার মাধ্যমে চেতনায় যে বীজটি রোপন করা হয় সেটিই বিকশিত হয় সাহিত্যকর্মে। ইকবাল ও রবীন্দ্র সাহিত্যের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য সেটি তো শিশুকাল থেকে দু’জনের শিক্ষা ও বেড়ে উঠায় প্রচণ্ড ভিন্নতার কারণেই্। ইকবাল তার শিক্ষার হাতে খড়িটি পেয়েছেন মক্তবে,আরবী-ফারসী জানা একজন প্রসিদ্ধ আলেমের কাছে।পড়েছেন সমৃদ্ধ ফার্সি কবিতা। শিক্ষালাভ করেছেন পাঞ্জাব,কেমব্রিজ ও মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় পৃথিবীর নামকরা তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দর্শনে পিএইডি নিয়েছেন জার্মান থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্য শিক্ষাটি পেয়েছেন বাহ্মণ ঠাকুরের কাছে।পড়েছেন বেদ,পুরান,উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারত ও কালিদাসের সাহিত্য। পড়েছেন আধুনিক ইংরাজী সাহিত্য। অপরদিকে শিক্ষালাভ ও ইসলামী চেতনায় বেড়ে উঠার সুযোগটি নজরুলের জীবনে তেমন আসেনি। ছোট বলায় তিনি তাঁর পিতার কাছে কোরআন পাঠ শিখেছেন, কিন্তু শিক্ষার সে ধারা বেশী দিন চলেনি। ৯ বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান। দশ বয়সে মসজিদের মোয়াজ্জিন হয়েছেন,মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন এবং সেবক হয়েছেন মাজারের। কিছুদিন চাচার সাথে লেটো’র দলে কাটিয়েছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাটক করেছেন ও গান গেয়েছেন। লেটো’র দলে নজরুলের চাচা আরবী,ফারসী ও উর্দু ভাষায় মিশ্রিত গান লিখতেন। নজরুলও তখন এ ভাষাগুলির সাথে পরিচিত হন এবং সবক পান মিশ্রিত ভাষায় গান লেখার। ১১ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন,ষষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত পড়ে আবার কর্ম জীবনে ফিরে যান। চা-রুটির দোকানে কাজ,গৃহে খানসামা -এরূপ নানা কাজ করে আবার স্কুলে ফিরে আসেন। কিন্তু দশম শ্রেণীও তিনি শেষ করতে পারেননি। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২০ অবধি কাটিয়েছেন সেনাবাহিনীতে, বেশীর ভাগ সময় থেকেছেন করাচীতে। এরপর সামরিক জীবন শেষে যোগ দেন সাংবাদিকতায়। প্রবন্ধ,গান ও কবিতা লেখা শুরু করেন। নজরুলের জীবনে এভাবে নান পেশার নানা বৈচিত্রতা আসলেও,নিরবিচ্ছিন্ন জ্ঞানার্জনের সুযোগ আসেনি। অথচ সাহিত্যচর্চায় এ প্রস্তুতিটুকু অতি গুরুত্বপূর্ণ। জমি-বীজ ছাড়া যেমন চাষাবাদ হয় না,তেমনি জ্ঞানার্জন ছাড়া যথাযথ সাহিত্যকর্মও হয়না।

নজরুলের যখন সাহিত্য চর্চার শুরু তখন বাংলা সাহিত্যে বইছে প্রবল জোয়ার। সে জোয়ারটি গড়ে তুলেছিলেন কোলকাতা কেন্দ্রীক বর্ণ-হিন্দু সাহিত্যিকগণ। বঙ্কিমচন্দ্র,রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র এবং আরো বহু হিন্দু কবি-সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের গগনে তখন উজ্বল তারাকা। সাহিত্যে জোয়ার সৃষ্টির পাশাপাশি শুরু হয় বাঙালী হিন্দুদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ। মুসলিমদের তখন দারুন দুরাবস্থা।তাদের সাহিত্যের আকাশে যেমন ঘন অন্ধকার,তেমনি দুরাবস্থা তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও। রাজনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সাহিত্য ইঞ্জিনের কাজ করে। কিন্তু মুসলিমগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের হাতে সে ইঞ্জিনটাই ছিল না। বাঙলায় ইসলামের আগমনের পর এদেশে হিন্দু সংস্কৃতির পাশাপাশি মুসলিম সংস্কৃতির যে ধারাটি গড়ে উঠেছিল তখন সেটির বিপন্ন দশা। উপমহাদেশ জুড়ে ইতিমধ্যে শুরু হয় হিন্দু-মুসলিমের রাজনৈতিক লড়াই।এবং সে লড়াইটি তীব্র ভাবে হচ্ছিল বাঙলায়।ইংরেজদের তখন বিদায়ের দিন, কিন্তু তাদের বিদায়ের পর কারা নিবে দখলদারি? হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসানামলকে ব্যবহার করেছে প্রস্তুতিকাল রূপে, সেটি সমগ্র ভারত জুড়ে রামরাজ্য স্থাপন কল্পে। সে দূর্দীনে রাজনৈতিক লড়ায়ে লোক পাওয়া গেলেও সাহিত্যের ময়দানে শক্তিমান যোদ্ধার ছিল প্রচণ্ড অভাব। বাঙালী মুসলিমগণ সে সংকটে নজরুলকে সহযোদ্ধা রূপে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু নজরুল ইসলাম থেকে তাদের আশা পুরণ হয়নি। তিনি রাজনীতির যুদ্ধটি লড়েছেন সাম্যবাদ ও সমাজবাদীদের দলে মিশে। নিবিড় সম্পর্ক গড়েছেন কম্যুনিষ্ট নেতা কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদের। তিন তখন ভেবেছেন,হিন্দুমুসলমানের মিলন নিয়ে। সে মিলনের স্বপ্ন নিয়েই বিয়ে করলেন হিন্দু পরিবারের প্রমিলাকে। তার কাছে ইসলাম, খেলাফত, ইসলামের জাগরণ এসব চিহ্নিত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা।

নজরুলের প্রতি বাঙালী মুসলিমদের আব্দারটি কি ছিল? সে আব্দারের প্রতি নজরুলের জবাবটিই বা কি ছিল? নজরুলের দর্শন ও তার সাহিত্যের মূল সুরটি ধরতে হলে সেটি জানা জরুরী। বাঙলার মুসলিমগণ কীরূপ আশা নিয়ে নজরুলকে আহবান জানিয়েছিল সেটি ফুটে উঠে নজরুলকে লেখা প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর একটি চিঠি থেকে। প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ কবি নজরুল ইসলামকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। নজরুলের যে প্রতিভা ছিল,সেটি ইব্রাহিম খাঁ জানতেন। তিনি এটাও লক্ষ্য করছিলেন,প্রচণ্ড অপচয় হচ্ছে সে প্রতিভার। কিছু হামদ-নাত ও কিছু গজল লিখলেও,তখন প্রচুর লিখে চলেছেন হিন্দু দেব-দেবীর প্রতি ভক্তিমূলক ভজন,কীর্তন এবং শ্যামা-সঙ্গিত। এতে হিন্দুরা তাকে দাদা বলে হাততালি দিচ্ছে। অপর দিকে নজরুলের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হচ্ছে আলেম সমাজ। গভীর আবেগ আর দরদ দিয়ে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ বিষয়টি নজরুলের দৃষ্টিতে আনতে চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য জগতের লড়াইয়ে তিনি নজরুলকে মুসলমানদের পক্ষে যোগ দেয়ার জোড়ালো আব্দার রেখেছিলেন। চিঠিটির কিছু অংশ থেকে উদাহরণ দেয়া যাকঃ “আজ তোমায় কয়টি কথা বলব, গুরুরূপে নয়,ভাই রূপে,ভক্ত রূপে।.. কথাগুলি বুকের তলে অনুদিন তোলপাড় করছে। ..সমাজ মরতে বসেছে; তাকে বাঁচাতে হলে চাই সঞ্জীবনী সুধা, কে সেই সুধা হাতে এনে এই মরণোন্মুখ সমাজের সামনে দাঁড়াবে, কোন সুসন্তান আপন তপোবন গঙ্গা আনয়ন করে, এ অগণ্য সাগর গোষ্ঠিকে পুনর্জ্জীবন দান করবে, কাঙ্গাল সমাজ উৎকণ্ঠিত চিত্তে করুণ নয়নে সেই প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে। কে জানিনা; কিন্তু মনে হয়, তোমায় বুঝি সে সাধনার বীজ জমা আছে। হাত বাড়াবে কি? একবার সাহসে বুক বেধে সে তপশ্চারণে মনোনিবেশ করবে কি?

..বাঙ্গালীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী দরিদ্র, সবচেয়ে বেশী অজ্ঞ, সবচেয়ে বেশী আত্মভোলা তোমারই ভাই এই মুসলিমগণ। আর বাঙ্গালা সাহিত্যে সবচেয়ে অবহেলিত, সবচেয়ে কলঙ্কিত, সবচেয়ে নিন্দিত, কুলিখিত বিষয় ইসলাম। ইসলামী শাস্ত্র, সাহিত্য, সভ্যতা, ইতিহাস বাঙ্গলা সাহিত্যে হয় নাই, না হয় বিকৃতরুপে আছে। যিনি বাঙ্গলা সাহিত্যে ইসলামের সত্য সনাতন নিষ্কলঙ্ক চিত্র দান করবেন,যিনি ‘এই সব মুক ম্লান মুখে’ ভাষা দিবেন, ‘এই সব ভগ্ন শ্রান্ত বুকে’ আশা ধ্বনিয়ে তুলবেন,যিনি ইসলামের সত্য স্বরূপ দেশের সম্মুখে ধরে মুসলিমের বুকে বল দেবেন, অমুসলিমের বুক হতে ইসলাম অশ্রদ্ধা দূর করতঃ হিন্দু-মুসলমান মিলনের সত্য ভিত্তির পত্তন করবেন,তিনিই হবেন বর্তমানের শ্রেষ্ঠতম দেশ-হিতৈষী,তিনিই হবেন বাঙ্গালা মুসলিমের মুক্তির অগ্রদূত।তুমি চেষ্টা করলে তাই হতে পার; তুমি সেই মহাগৌরবের আসন দখল করতে পার,তুমি এইরূপে তোমার কবি,তোমার জীবনকে,তোমার মানবতাকে সহজতম রূপে সার্থক করতে পার।

..তাই আজ বড় আশায়, বড় ভরসায়,বড় সাহসে, বড় মিনতির স্বরে তোমায় বলছি,ভাই, কাঙ্গাল মুসলিমের বড় আদরের ধন তুমি,তুমি এই দিকে, পতিত।মুসলিম সমাজের দিকে,এই অবহেলিত ইসলামের দিকে একবার চাও; তাদের ব্যথিত চিত্তের করুণরাগিনী তোমার কণ্ঠে ভাষা লাভ করে আকাশ-বাতাশ কাঁপিয়ে তুলুক, তাদের সুপ্ত প্রাণের জড়তা তোমার আকুল আবেগের উন্মাদনায় চেতনাময়ী হউক, ইসলামের মহান উদার উচ্চ আদর্শ তোমার কবিতায় মুক্তি লাভ করুক, তোমার কাব্য সাধনা ইসলামের মহাগীতিতে চরম সার্থকতার ধন্য হোক। আমিন।–ইব্রাহীম খাঁ।” -াই (সুত্রঃ সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, ২০০২; ইতিহাসের নিরিখে নজরুল চরিত, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ১২৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা ১০০০)।

নজরুল সে চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। সে উত্তর থেকেও কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যাক। “বাঙলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানিনে, মনে যে কাঙাল এবং অতি মাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহু দিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবে যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনদিন অভিযোগ করেছি বলে তা মনে পড়ে না। … হিন্দুরা লেখক-অলেখক জনসাধরণ মিলে যে স্নেহে যে নিবিড় প্রীতি-ভালবাসা দিয়ে আমায় এত বড় করে তুলেছেন, তাঁদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি, তা হলে আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশ্য, কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমায় কিছুদিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া ‘হিন্দু সভা’ওয়ালা আমার নামে মিথ্যা কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এঁদের আঙ্গুল দিয়ে গোণা যায়।...আপনার ‘মুসলিম সাহিত্য’ কথাটির মানে নিয়ে অনেক মুসলমান সাহিত্যিকই কথা তুলবেন হয়ত। ওর মানে কি মুসলমানের সৃষ্ট সাহিত্য,না মুসলিম ভাবাপন্ন সাহিত্য? সাহিত্য যদি সত্যিকার সাহিত্য হয় তবে তা সকল জাতিরই হবে।... আমার বিশ্বাস, কাব্যকে ছাপিয়ে উদ্দেশ্য বড় হয়ে উঠলে কাব্যের হানি হয়। আপনি কি চান,তা আমি বুঝতে পারি- কিন্তু সমাজ যা চায়,তা সৃষ্টি করতে আমি অপরাগ।...জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক,আনন্দের গান-বেদনার গান গেয়ে যাব আমি, দিয়ে যাব আমি নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে,সকলের বাঁচার মাঝে থাকব আমি বেঁচে।এই আমার ব্রত,এই আমার সাধনা,এই আমার তপস্যা।... -নজরুল ইসলাম।” (সুত্রঃ সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, ২০০২; ইতিহাসের নিরিখে নজরুল চরিত, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ১২৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা ১০০০)।

ইব্রাহীম খাঁর সে আব্দারে নজরুল সাড়া দেননি। নজরুলের বড় অক্ষমতা এখানেই। এ অক্ষমতার মূলে হল,ইসলাম ও মুসলিমের বিজয়ে তাঁর অঙ্গিকারহীনতা।এখানেই নজরুল সাহিত্যের সবচেয়ে বড় বিভ্রাট,-যা এসেছে চেতনার ভ্রষ্টতা থেকে। নজরুলের বিশ্বাস,সাহিত্য রচনায় কোন রূপ উদ্দেশ্য থাকলে সাহিত্যের শ্রী হানি হয়,-যা তিনি এ চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। কোন মুসলিম কি এমনটি ভাবতে পারে? তাকে তো জীবনের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহুর্ত বাঁচতে হয় একটি উদ্দেশ্যকে অবলম্বন করে। সেটি হল মহান আল্লাহকে খুশি করা ও তাঁর প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। সে হুকুমের বিরুদ্ধে এক মুহুর্তের বিদ্রোহও তার সমগ্র বাঁচাটাই ব্যর্থ করে দেয়।পণ্ড করে দেয় তার সারা জীবনের মেহনত। আল্লাহর বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ তাঁকে জাহান্নামের আগুনে নিয়ে পৌছায়। তাই মোমেনের জীবনে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রমযানের রোযা ও হজ-যাকাতে নয়,সেটি থাকে প্রতি মুহুর্তের ভাবনায়,কথায় ও কর্মে। সেটি যেমন তার রাজনীতিতে, তেমনি সাহিত্যে ও শিল্পে। প্রকৃত ঈমানদার তাই দেব-দেবীর প্রতি ভক্তি ভরে কোন ভজন লেখে না, কীর্তনও লেখে না, একটি বাক্য দূরে থাক একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। সাহিত্যিক খ্যাতি লাভ তাই মোমেনের জীবনের মূল লক্ষ্য নয়,বরং সেটি হল আল্লাহয় আত্মসমর্পিত পরিপূর্ণ মুসলমান হ্ওয়া। সাহিত্যকে সে ব্যবহার করে সত্যকে মূর্তমান করতে, অন্যায়-অসত্যকে প্রতিহত করতে। তাই দেব-দেবীর সন্মানে ভজন বা কীর্তন লেখা কোন সাহিত্য নয়, সেটি জঘন্য পাপকর্ম। ইসলামে এটি হারাম। উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষ এক কদমও পা বাড়ায় না,সাহিত্য তাই উদ্দেশ্যহীন হয় কি করে? ‘সাহিত্যে কাব্যকে ছাপিয়ে উদ্দেশ্য বড় হয়ে উঠলে কাব্যের হানি হয়’ নজরুল এ বিশ্বাসটি কোত্থেকে পেলেন? ইকবালের কবিতার ছত্রে ছত্রে একটি প্রবল উদ্দেশ্য মূর্তমান। তাতে কি তার কবিতার শ্রীহানী হয়েছে? সাহিত্য-হানি নিয়ে নয়, মুসলিমকে সদা সতর্ক থাকতে হয় ঈমান-হানি নিয়ে। কিন্তু নজরুলের কাছে কাব্যের যাতে হানি না হয় সে বিষয়টি বেশী গুরুত্বপূর্ণ পেয়েছে। কবিতার খাতিরে কবিতা লিখতে গিয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নজরুলের কাছে সাহিত্যের অলংকার গণ্য হয়েছে। তার লেখা ভজন ও কীর্তনে তো সেটিই হয়েছে।‘হিন্দুরা লেখক-অলেখক জনসাধরণ মিলে যে স্নেহে যে নিবিড় প্রীতি-ভালবাসা দিয়েছে’ নজরুলের কাছে সেটি জীবনের অতি মূলবান অর্জন মনে হয়েছে। এ নিয়েই যেন তাঁর প্রচুর আনন্দ। জীবনের এটাই যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জণ। এখানেই নজরুলের বিশাল বিভ্রাট বা বিচ্যুতি। হিন্দুর কাছে বা অন্য কোন ব্যক্তির কাছে কতটুকু গ্রহনযোগ্যতা বাড়লো -সেটি ঈমানদারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে তো প্রতি মুহুর্তে বাঁচে,কর্মে বা লেখনিতে আত্মনিয়োগ করে,এমনকি জিহাদে প্রাণ দেয়,মহান আল্লাহর কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে। আল্লাহর হুকুমের প্রতি এমন নিষ্ঠা ও আত্মনিয়োগের কারণে এমন কি নবী-রাসূলদের মত মহৎ গুণের মহা-মানুষগণও দেবদবীর উপাসকদের কাছে প্রিয় হতে পারেননি। তাদের ভালবাসা লাভ কোন মুসলমানের কাম্য হলে সে কি আল্লাহ ও তার দ্বীনের প্রতি অঙ্গিকার নিয়ে বাঁচতে পারে?। ইসলাম তো ব্যক্তির জীবনে তার বাঁচা মরার সুস্পষ্ট লক্ষ্য বেঁধে দেয়। এখানে কোন আপোষ চলে না, কোন বিচ্যুতি বা বিরতিও চলে। কিন্তু নজরুল সে বিধানকে মানতে রাজী ছিলেন না। এক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্যের বদলে স্বেচ্ছাচারি হওয়াকে তিনি সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতা ভেবেছেন। ইসলামের পক্ষে নয়, সকলের মাঝে বাঁচাটিই তাঁর কাছে জীবনের ব্রত, সাধনা ও তপস্যা গন্য হয়েছে।

নজরুল সাহিত্যে বিভ্রাট ও চেতনার ভ্রষ্টতার আরো কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। ‘বাঙালীর বাঙলা’ প্রবন্ধে নজরুল লিখলেন,“বাংলার শিয়রে প্রহরীর মত জেগে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গিরি হিমালয়। এই হিমালয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুণি-ঋষি যোগিরা সাধনা করেছেন। এই হিমালয়কে তারা সর্ব দৈব শক্তির লীলা নিকেতন বলেছেন।এই হিমালয়ের গভীর হৃদয়-গুহার অনন্ত স্নেহধারা বাংলার শত শত নদ-নদী রূপে আমাদের মাঠে মাঠে ঝরে পড়েছে।” এখানে নজরুল হিমালয়কে বড় করে দেখলেন,মুণি-ঋষি-যোগির সাধনাও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। পৌত্তলিকতা যে তার চেতনায় কতটা প্রবল ভাবে বাসা বেধেছিল এ হল তার প্রমাণ। বাংলার নদনদীর জন্ম হিমালয়ের হৃদয় গুহা থেকে সেটি তার কবি মনকে আন্দোলিত করেছে। কিন্তু উল্লেখ নাই সেই মহান আল্লাহর যিনি হিমালয়ের স্রষ্টা। নদনদীও তারই সৃষ্টি, হিমালয়ের নয়।

নজরুল লিখেছেন,

“এই পবিত্র বাংলাদেশ

বাঙালীর-আমাদের।

দিয়া ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’

তাড়াবো আমরা, করি না ভয়

যত পরদেশী দস্যু ডাকাত

‘রামা’দের ‘গামা’দের।”

বাংলা বাঙালীর হোক! বাংলার জয় হোক! বাঙালীর জয় হোক।

এ কবিতায় নজরুল কট্টর বাঙালী জাতীয়তাবাদী রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। সকল পরদেশীরা তাঁর কাছে শত্রু রূপে গণ্য হয়েছে। রামাদের সাথে তিনি গামাদেরকে তাড়ানোর শপথ জাহির করেছেন।এখানে ‘গামা’ বলে বুঝাতে চেয়ে অবাঙালী মুসলমানকে। নজরুল যে সময় এ কথাগুলো বলেছেন যখন বাংলার মুসলমানগণ অবাঙালী বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ¸গুজরাটি মুসলমানদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াই করছে।অর্থাৎ উপমহাদেশের মুসলমানগণ তখন চলেছে প্যান-ইসলামী চেতনার দিকে। আর এটিই তো ইসলাম। অথচ নজরুল চলেছেন উল্টোদিকে তথা ভাষাভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে যা নিছক প্রাক-ইসলাম জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা।

নজরুল আরো লিখেছেন,

“একবৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু মুসলমান

মুসলিম তার নয়ন মনি হিন্দু তাহার প্রাণ।”

“মুসলিম আর হিন্দু মোরা দুই সহোদর ভাই

একবৃন্তে দুইটি কুসুম এক ভারতে ঠাঁই।”

“ভারতের দুই নয়ন তারা হিন্দু মুসলমান,

দেশ জননীর সমান প্রিয় যুগল সন্তান।

এ কবিতার মতলবটি কি? ‘দেশ জননী’র এ ধারণা নজরুল কোত্থেকে পেলেন। হিন্দু-মুসলমান যে দেশ জননীর প্রিয় যুগল সন্তান সে ধারণাটিই বা তিনি কোত্থেকে পেলেন? মুসলিম ও হিন্দু - উভয়কে তিনি দুই সহোদর ভাই বলেছেন। কথা হল, সহোদর ভাই হলে মুসলমানদের পক্ষে আলাদা সাহিত্য, আলাদা সংস্কৃতি ও আলাদা দেশ গড়ার আর কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে কি?

নজরুল লিখেছেন,

“গাহি সাম্যের গান

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই.

নহে কিছু মহীয়ান

নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ

অভেদ ধর্ম জাতি।”

‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ এ কথাই বা তিনি কোথা থেকে পেলেন? এখানে তিনি বেমালুম ভূলে গেছেন মহান আল্লাহর অস্তিত্বের কথা।এটি কি সৃষ্টিশীল কবিত্ব, না সৃষ্টিশীল মিথ্যাচার? মানুষকে বড় করে দেখাতে গিয়ে তিনি এখানে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহর অস্তিত্বই ভূলে গেলেন।ব্যক্তির ঈমান বা বেঈমানী তার জিহবাতে। এ জিহবার পিছনে কাজ করে তার অন্তর বা বিবেক। জিহবা বস্তুত সে বিবেকেরই প্রকাশ ঘটায়। কালেমা পাঠের মধ্য দিয়ে এ জিহবাই মহান আল্লাহর অস্তিত্বের ঘোষণা দেয়।তেমনি তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে কাফের রূপেও গণ্য হতে পারে। প্রতিটি ব্যক্তির ন্যায় কবিকেও তাই কবিতার প্রতিটি চরণ লিখতে হয় আল্লাহতায়ালাকে তার স্মরণের মধ্যে রেখে। তাঁকে বাদ দেয়ার অর্থ তাঁকে অস্বীকার করা। ‘অভেদ ধর্ম জাতি’র যে ধারণাটি তিনি পেশ করেছেন সেটিই বা তিনি কোত্থেকে পেলেন? এ ধারণাটি কি কোরআন সম্মত? ইতিহাসের কোন কালেও মানুষ কি অভেদ ধর্ম জাতি ছিল? কোরআনের ভাষায় মানুষ তো দ্বিজাতিতে বিভক্ত -একটি অনুসারি মহান আল্লাহর, অপরটি শয়তানের। নজরুল লিখেছেন,“মানুষ যে ধর্মের,যে বর্ণের,যে গোত্রের হোক,মানুষের একমাত্র পরিচয় সে মানুষ।” মানুষের একমাত্র পরিচয় সে মানুষ – এ ধারণাটাই বা তিনি কোত্থেকে পেলেন? মানুষের একমাত্র পরিচয় নিছক মানুষ নয়,সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি হল তার ঈমানের পরিচয়। মহান আল্লাহর কাছে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। মৃত্যুর পর সে পরিচয়টি নির্ধারণ করবে সে জান্নাতে যাবে না জাহান্নামের আগুণে যাবে। অথচ সে পরিচয়টি নজরুলের কবিতায় ফুটে উঠেনি।

নজরুলের দর্শন,চেতনা ও মনের পরিচয় সবচেয়ে প্রবলতর ও স্পষ্টতর প্রকাশ ঘটেছে তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। নজরুল ভক্তদের কাছে এটিই নজরুলের শ্রেষ্ট কবিতা। নজরুলকে বুঝতে হলে তাই এ কবিতাটি বুঝতে হবে। এ কবিতার কিছু চরণ তুলে ধরা যাকঃ

“আমি চির বিদ্রোহী –

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি এক চির উন্নত শির



আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,

আমি দলে যাই যত বন্ধন,যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল

আমি মানি নাকো কোন আইন

আমি উম্মাদ!



আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।

আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া

ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া

..

আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।



আমি অজয় অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়

আমি মানব দানব দেবতার ভয়

জগদীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য

আমি বিদ্রোহী ভুগু,ভগবান বুকে

একে দিই পদচিহ্ন;

আমি স্রষ্টা সুদন; শোক তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।”

মহান আল্লাহর কাছে বান্দাহর সবচেয়ে বদ গুণটি হল তার তাকাব্বুরি তথা অহংকার। তাকাব্বুরি তথা নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ দাবী করার অধিকার একমাত্র মহান রাব্বুল আলামীনের। হাদীসে বলা হয়েছে, সামান্যতম অহংকার থাকলে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ঈমানাদারের বড় গুণ হল তাঁর বিনয় বা অহংকারশূন্যতা। নজরুলের মন ও মননের সুস্পষ্ট পরিচয় মেলে তাঁর বিদ্রোহী কবিতায়। এ কবিতায় যেটির প্রবল প্রকাশ ঘটেছে সেটি যেমন বিদ্রোহের,তেমনি অবাধ্যতা ও অহংকারের। সে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা স্রষ্টার আইনের বিরুদ্ধে।অথচ মুসলমান হওয়ার মূল কথা বিদ্রোহী হওয়া নয়,আইনের অবাধ্য হওয়াও নয়। বরং প্রতি কর্মে ও প্রতি উচ্চারনে তাঁকে অনুগত হতে হয় মহান আল্লাহ ও তাঁর শরিয়তের। আল্লাহর বিরুদ্ধে যে কোন বিদ্রোহ ও তাঁর আইনের বিরুদ্ধে যে কোন অবাধ্যতা তাকে কাফেরে পরিণত করে। এজন্য মুর্তি পুঁজারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কাজী নজরুল কি তা জানতেন বা বুঝতেন না? তিনি লিখেছেনঃ

“আমি মানব দানব দেবতার ভয়

জগদীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য

আমি বিদ্রোহী ভুগু,ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন”

এ চরণে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন? তিনি নিজেকে “জগদীশ্বর ঈশ্বর” দাবী করেছেন,“ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন” বলেই বা কি বুঝতে চেয়েছেন? ভগবান বলতে তিনি যদি পৌত্তলিকদের ভগবান বুঝিয়ে থাকেন তবুও কি তার বুকে পদচিহ্ন আঁকার অধিকার রাখেন? পবিত্র কোরআনে পৌত্তলিকদের উপাস্যদের গালি দিতে নিষেধ করেছেন মহান আল্লাহতায়ালা। কারণ,এতে তারাও মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে কটু কথা বলবে। তিনি নিজেকে ঈশ্বর দাবী করেন কি করে? যেমন ইচ্ছা তেমন কথা বলায় কোন কৃতিত্ব নেই, মুখ ও জিহবা থাকলে সেটি যে কেউ করতে পারে। বিবেকের সুস্থ্যতা হল,কথাবার্তায় সংযত ও সুশৃঙ্খল হওয়া। এতেই ব্যক্তিত্ব। হযরত আলী (রাঃ) এজন্যই বলেছেন, ব্যক্তিত্ব হল জিহবাতে। অর্থাৎ যা মুখে বলা হয় তাতে। প্রচণ্ড উম্মাদও চমক লাগানোর মত বহু কথা বলতে পারে। তবে অসংলগ্ন কথার সে চমকই বলে দেয় মানসিক দিক দিয়ে সে কতটা অসুস্থ্য।প্রশ্ন হল, বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল যা বলেছেন তাতে সুর ও চ্ছন্দ বা ভাষার যতই চমৎকারিত্ব থাক, সেগুলিকে কি সুস্থ্য চেতনার প্রতিফলন বলা যায়?

মানুষ মানুষকে চেনে শুধু দেহের গুণে নয়। মনের গুণেও। অন্য জীব থেকে এখানেই পার্থক্য। আর গুণের সে প্রকাশটি ঘটে শুধু কর্মে নয়,তার নাম ও নাম করণের পদ্ধতি,পোষাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা ও আচরনের মধ্য দিয়েও। সে পরিচয়ের ভিত্তিতেই মানুষে মানুষে পরস্পরে জানাজানি হয়,সে জানাজানির ভিত্তিতেই গড়ে উঠে মানুষের মাঝে ভাতৃত্ব ও বন্ধন। গড়ে উঠে সমাজ। ইসলামে সন্তানদের নাম করণের নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। তাই কে মুসলমান আর কে অমুসলমান,সেটি দেখার জন্য কারো অন্তরের গভীরে ঢুকার প্রয়োজন নেই। মানুষের সে সামর্থও নেই।কিন্তু ব্যক্তি ও তার সন্তানদের নাম শুনেও তার ধর্ম, দর্শন, জীবনচেতনার একটি পরিচয় জানা যায়। নামই জানিয়ে দেয় সে কোন ধর্মের ও কোন সমাজের। নাম তাই ঝাণ্ডার কাজ করে।কিন্তু যে ব্যক্তিটি মুসলিম নাম-ধারন করতেই রাজী নন, তার কি আগ্রহ থাকে মুসলিম সমাজের অংশীদার হওয়ায়? সে কি আগ্রহী হয় ইসলামের শিক্ষা বা গুণ নিয়ে বেড়ে উঠায়? হয় কি মুসলিমের সাথে সমাজবদ্ধ? নজরুলের সমস্যা এক্ষেত্রে বিশাল। তিনি নিজ জীবনে ও নিজ সংসারে ইসলামের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেননি। গ্রহণ করেননি ইসলামের নাম করণের পদ্ধতিকেও। তাঁর পুত্রদের নাম ছিলঃ কৃষ্ণ মহম্মদ,অরিন্দম খালেদ, সব্যসাচী, অনিরুদ্ধ (ডাক নাম লেলিন)। সন্তানদের এরূপ নামকরণের মধ্য দিয়ে তিনি অন্যদের জানিয়ে দিয়েছেন ইসলামের রীতিনীতি ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি কতটা বিদ্রোহী।

নজরুল লিখেছেন, ‘বলরে জবা বল, কোন সাধনায় পেলি ও তুই মায়ের তরণ তল।’ নজরুল এখানে মা বলতে পৌত্তলিকদের দেবী বুঝিয়েছেন। দেবীর পায়ের কাছে পেশ করা জবা ফুলের মর্যাদা মহামান্বিত করতে তিনি এ চরণটি লিখেছেন। ক’জন হিন্দু লিখেছে এমন ভক্তিমূলক গান? এমন গানে বহু মুর্তি-পুঁজারী হিন্দুও অবাক হয়েছে। নজরুলকে তাদের নিজেদের লোক ভেবে দাদা বলে আনন্দধ্বনি দিয়েছে। এমনকি হিন্দু মহাসভার নেতা ড.শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীও নজরুলের সাথে সুসম্পর্ক রাখতেন। দেবদেবীর প্রতি এরূপ ভক্তি ভরে কবি নজরুল বহু ভজন, বহু কীর্তন, বহু শ্যামা সঙ্গিত লিখেছেন। তাঁর বাসায় থাকতেন,এবং সে বাসায় মুর্তিপুজা করতেন তার শাশুড়ি গিরিবালা। নজরুলের স্ত্রী প্রমিলা পক্ষাঘাত রোগে শয্যাশায়ী হলে শাশুড়ি গিরিবালাই তাঁর গৃহকত্রী হন। হিন্দু ধর্মে গিরিবালা ছিলেন অতি নিষ্ঠাবান। তিনি ঘরে মুর্তিপুঁজা করতেন এবং মাঝে মাঝে তীর্থযাত্রায় বেড়িয়ে পড়তেন। নজরুলের গৃহের পরিবেশটি কেমন ছিল সেটি প্রকাশ পায় কবি নজরুলের বন্ধু খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনের স্মৃতী চারণে। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন তাঁর এক সাথীকে নিয়ে রোযার মাসে কোলকাতায় কবি নজরুলের বাসায় গিয়েছিলেন।তিনি লিখেছেন,“বল্লামঃ আর একদিন সময় হাতে নিয়ে আসবো। আজ যাই, বিশেষ দরকার আছে।”

কবি বল্লেনঃ “তা কিছুতেই হয় না। তা ছাড়া তুই রোযা আছিস। ইফতারের সময়ও হয়ে এসেছে। অন্ততঃ ইফতার তো করে যা।”

তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ীর ভিতর চলে গেলেন। একটু পরে বাড়ীর ভিতর থেকে কবির ভীষণ রাগারাগির শব্দ কানে এলো। অন্দরের দরওয়াজায় কান পেতে আমরা দু’জনে কারণ অনুসন্ধান করতে লাগলাম। বুঝলামঃ আমাদের নিয়েই কবি তাঁর শাশুড়ির সাথে ঝগড়া করছেন। তার প্রতিপাদ্য বিষয় হলোঃ “যখন তিনি জানেন যে আমরা রোযা আছি, তখন কেন ইফতারী তৈরী করে রাখা হয় নাই?” তাঁর শাশুড়ী বলেছেনঃ আমি কি জানি বাপু ইফতারী কাকে বলে, আর তাতে কি কি দরকার হয়।”

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, নজরুলের স্ত্রী প্রমিলা তখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং শয্যাশায়ী। নজরুলের গৃহের কত্রী তখন তার শাশুড়ী গিরিবালা। আর সে গিরিবালা মুর্তিপুজারী। রোযা কি, ইফতারী কি সে খবর কি তার ছিল? কীরূপ সংস্কৃতির মাঝে নজরুল ও তাঁর সন্তানদের বসবাস ছিল এ হল তার নমুনা। তাঁর দুই পুত্র বিয়ে করে হিন্দু ঘরে। ছোট মেয়েও মিষ্টি কাজী বিয়ে করে হিন্দু ঘরে।

সারা ভারতের ন্যায় বাঙলাতেও সংস্কৃতির দুটি ভিন্ন ধারা। একটি মুসলমানের, অপরটি হিন্দুর। এ সংস্কৃতি দুটির পরস্পরের লড়াই নিছক বাঁচার নয়,অপরটিকে প্রভাবিত করারও। হিন্দুদের লক্ষ্য, মুসলমানদের হিন্দুত্বে দীক্ষা দেয়া নয়। বরং হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব বলয়ে আনা। সেটির নমুনা হল আজকের পশ্চিম বাংলা। হিন্দুর সংস্কৃতির জোয়ারে সেদেশের মুসলমানেরা যে কতটা ভাসছে তার একটি উদাহরণ দিয়েছেন জনাব সৈয়দ আলী আহসান। তিনি লিখেছেন, “বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করি পশ্চিমবঙ্গে বাঙ্গালীত্বের বা বাঙালীবোধের একটি অন্বেষণ চলছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু বন্দোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার একটি বাঙালী স্বরূপকে উন্মোচন করতে চাচ্ছেন যে স্বরূপটা মূলত হিন্দুদের। তাদের পরিকল্পিত জীবন-চর্চায় কোন মুসলমান নেই। কিছুদিন আগে আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখানে আমি দেখেছি একটি মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিচয় চতুর্দিকে প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও পশ্চিম বঙ্গের অধিবাশীদের শতকরা ৩০% ভাগ মুসলমান, কিন্তু শতকরা একজনও বাঙালী বিত্তের মধ্যে নেই। যারা আছেন তাদের অনেকেই হিন্দু মেয়ে বিবাহ করেছেন। অনেকেই ধুতি পরেন এবং দু-হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে মুসলমান পরিচয়টি গোপন করেন। হিন্দুদ্বের ওই আগ্রাসনের কথা বাংলাদেশের মুসলমানদের মনে রাখা দরকার।” (সুত্রঃ সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, ২০০২; ইতিহাসের নিরিখে নজরুল চরিত, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ১২৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা ১০০০)।

বাস্তবতা হল, কবি নজরুল হলেন তাঁদেরই একজন যারা সে আগ্রাসনের কাছে সর্বাগ্রে আত্মসমর্পন করেছিলেন। বুদ্ধিজীবী বা সাহিত্যিকদের বড় দায়িত্ব হল, দেশবাসীর চেতনা ও সাংস্কৃতিক মানচিত্রকে শত্রুর হামলা থেকে রক্ষা করা। এটি ভৌগলিক সীমান্তু রক্ষার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং সত্যতো এটাই, সাংস্কৃতিক মানচিত্র অরক্ষিত বা বেদখল হয় তখন ভৌগলিক মানচিত্রও বিনাযুদ্ধে শত্রুর দখলে যায়। ইসলামে মোজাহিদের কলমের কালির মর্যাদা তাই অতি উচ্চে। কিন্তু নজরুলের মত কবি-সাহিত্যিকের দ্বারা সে কাজটি হয়নি। ইসলামি চেতনা রক্ষার কাজটি না করে বরং নিজেরাই হিন্দু সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। যারা নিজেরা আত্মসমর্পণ করে তাদের দিয়ে কি প্রতিরক্ষার কাজ চলে? শত্রুরা তখন সে আত্মসমর্পণকারীদের বরং কোলে টেনে নেয়। নজরুল তাই প্রিয় ছিলেন অনেক মুসলিম বিদ্বেষীদের। চরম মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও ছিলেন তাদের একজন। নজরুলের বিদ্রোহটি মূলত ইসলামের অনুশাসনের বিরুদ্ধে, হিন্দু পৌত্তলিকতা বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নয়। বরং অসংখ্য ভজন,কীর্তন,শ্যামাসংগীত লিখে দেবদেবীর পদতলে নিজের আত্মসমর্পিত চেতনার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তে তিনি লিখেছেন, আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য। অমুর্ত সৃষ্টিকে মুর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কন্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বানী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বানী।” নজরুল এখানে নিজেকে ভগবানের অবতার রূপে জাহির করেছেন। প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব শব্দ,পরিভাষা এবং সেগুলির পিছনে একটি দর্শনও থাকে। শব্দ বা পরিভাষা তাই সাহিত্যে একাকী আসে না,সাথে আনে একটি ধর্মীয় বিশ্বাস,দর্শন,মূল্যবোধ ও ইতিহাস। তাই ভগবান,অবতার,দেবদেবী,মুর্তি,ভজন বা কীর্তনের সাথে সে ধর্ম ও দর্শন প্রকাশ পায় সেটি নিতান্তই হিন্দুর। তবে নজরুল আল্লাহ-রাসূল,হামদ, নাতের কথা যে বলেননি তা নয়। তবে যে ভাবে বলেছেন সেটি ইসলামের রীতি নয়। আল্লাহতে বিশ্বাস ও তাঁর অনুশাসনের আনুগত্য মুসলমানের জীবনে ক্ষণিকের বিষয় নয়। সেগুলি শুধু কবিতার বিষয়ও নয়। বরং সেটি প্রতিমুহুর্ত ও প্রতিদিনের। সেটি চলে আজীবন। মুসলমানের জীবনে তাই কখনও হামদ-নাত আবার কখনো ভজন, কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীত, -সেটির সুযোগ নাই। একবারে মুসলমান হওয়ার অর্থ আজীবনের জন্য মুসলমান হওয়া। নজরুলের জীবনে এখানেই চরম ব্যর্থতা। তিনি দুই নৌকায় পা রেখেছেন। এটি তাঁর নিজ-আবিস্কৃত চরম বিভ্রান্তির নীতি,কোরআন-সূন্নাহর নীতি নয়।ইসলাম হল এক নৌকায় পা রাখার ধর্ম। সে নৌকাটি হতে হবে একমাত্র ইসলামের। মুসলমান হওয়ার পূর্ব-শর্তটি হল,অন্য উপাস্য বা অন্য ধর্মের সাথে সম্পর্ক পুরাপুপি ছিন্ন করা। সে সম্পর্কটি ছিন্ন করার পরই অটুট সম্পর্ক গড়তে হয় মহান আল্লাহর সাথে। কোরআনের ভাষায় সেটি হল,‘ইয়াকফুর বিত্তাগুত ওয়া ইউমিম বিল্লাহ’। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ক্ষণিকের জন্য হলেও সেটি বিদ্রোহ। যেমনটি ইবলিসের ক্ষেত্রে হয়েছিল। ইসলামে এমন বিদ্রোহ ব্যক্তি কাফের বলা হয়। সে বিদ্রোহটি যেমন কর্মে হতে পারে, তেমনি চিন্তা-ভাবনা,কথা-বার্তা ও সাহিত্যেও হতে পারে।

নজরুল যখন সাহিত্যের ময়দানে তখন ভারতীয় রাজনীতির প্রচন্ড মেরুকরণ। কঠিন লড়াই চলছে বুদ্ধিজীবীর ময়দানে। কোলকাতা তখন সে লড়াইয়ের প্রাণকেন্দ্র। কোলকাতাতে বসেই মাওলানা মুহাম্মদ আলী কলমযুদ্ধ ইংরাজীতে চালাচ্ছিলেন তাঁর কমরেড পত্রিকার মাধ্যমে। তখন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সে যুদ্ধটি জোরে শোরে চালাচ্ছেন উর্দু ভাষাতে তাঁর আল হেলাল পত্রিকার মাধ্যমে। আর মাওলানা আকরাম খাঁ শুরু করেছেন তার মাসিক মোহাম্মদী ও পরবর্তীতে দৈনিক আজাদ পত্রিকার মাধ্যমে। ভারতের রাজনীতির তখন ক্রান্তিলগ্ন। মুসলমানদের তখন ভাগ্য নির্ধারিত হতে যাচ্ছে। মাওলানা মহম্মদ আলী ও তাঁর বড় ভাই মাওলানা শওকত আলী কোলকাতা থেকেই শুরু করেছেন খেলাফত আন্দোলন। সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদসহ বাংলার এবং সারা ভারতের আলেমগণ। অথচ লড়াইয়ের এ চরমদিনগুলিতে নজরুলের জীবন কেটেছে চরম আদর্শিক, রাজনৈতিক ও চেতনাগণ বিভ্রাটের মধ্যে। তখন শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তখন ওসমানিয়া খেলাফত টুকরো টুকরো করে সেখানে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা ও নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব। হামলা শুরু হয় ইরাকে। এবং সে হামলার দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতে অবস্থিত ব্রিটিশ বাহিনীর উপর। তখন সে হামলা জোরদার করতে ব্রিটিশ বাহিনী তখন ভারত থেকে সৈন্য সংগ্রহে ব্যস্ত। হিন্দু, শিখ ও গোর্খারা তখন দলে দলে যোগ দিচ্ছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের সে যুদ্ধে যোগ দেয়া যে হারাম, তা নিয়ে ভারতের কোন নিরক্ষর মুসলিমের মনেও সামান্যতম সন্দেহ ছিল না। সে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলিমগণ গড়ে তোলে খেলাফত আন্দোলন। ভারতীয় রাজনীতিতে সেটিই ছিল প্রথম গণআন্দোলন। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বহু সেকুলার ব্যক্তিও সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেনে। এমন কি গান্ধিও সে আন্দোলনকে সমর্থণ করেছিলেন। কিন্তু কাজী নজরুল সেদিন ইসলামী বিধানের প্রতি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ করেনি,বরং বিদ্রোহ করে বসেন সে শরিয়তী বিধানের বিরুদ্ধে। তখন তিনি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের রাইফেল কাঁধে নিয়ে ইরাকের মুসলিম হত্যায় যোগ দিতে দুই পায়ে খাড়া। ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সাল অবধি তিনি ঔপনিবেশিক ইংরেজদের সেনাদলে কাজ করেন। এই হল তাঁর বিবেক ও চেতনার মান! এরপর সেনা বাহিনী থেকে ফিরে এসে ব্যস্ত হন শ্যামাসঙ্গিত,ভজন,কীর্তন লেখা নিয়ে। প্রশ্ন হল,এসব তিনি লিখলেন কোন যুক্তিতে? নিছক অর্থের জন্য? অর্থের প্রয়োজন কার না থাকে? কিন্তু নজরুলের জীবনে অর্থই যেন মূল চালিকা শক্তি হয়ে পড়ে। অর্থ-উপার্জন বাড়াতে একদিকে যেমন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন,অন্যদিকে শ্যামাসঙ্গিত,ভজন ও কীর্তন লিখেছেন। লক্ষণীয় হল,অর্থের অভাব যখন দূর হয়েছিল তখনও তিনি ইসলামী আক্বীদা বিরোধী গান লেখার অভ্যাস ছাড়েননি। গান লিখে তিনি প্রচুর অর্থ কামাই করেছেন,সে অর্থে ক্রাইসলার মটর গাড়ী কিনে সে আমলে কোলকাতার শহরে বিলাসিতাও করেছেন। -াই (সুত্রঃ সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, ২০০২;ইতিহাসের নিরিখে নজরুল চরিত, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ১২৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা ১০০০)।

নজরুলের জীবনে স্বপ্ন ছিল। তাঁর জীবন ভিশন এবং মিশনও ছিল। নজরুল ভাষায় সেটি হল নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বাঁচার। এখানে ইসলামের পথে ও মুসলমান রূপে বাঁচাটির কোন উল্লেখ নাই। তার কবিতায়ও সেটি গুরুত্ব পায়নি। নজরুলের প্রচণ্ড ক্ষোভ মুসলিম আলেম-উলামাদের বিরুদ্ধে, কারণ তাঁরা তাঁকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছে। কিন্তু আলেমেরা তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন সে অভিযোগের জবাব তিনি দেননি। আলেমদের অভিযোগ, নজরুল তাঁর ব্যক্তি ও পারিবারীক জীবনে এবং সাহিত্যে ইসলামে একনিষ্ঠ থাকতে পারেননি। বরং বিদ্রোহী হয়েছেন। তার জীবনে প্রতিফলন ঘটেনি ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষার। ইসলামের উপর কিছু কবিতা-গজল লিখলেই মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্ম শেষ হয় না। তাঁকে জীবনের প্রতি ক্ষণে, প্রতি কর্মে এবং প্রতিটি কথা ও প্রতিটি আচরণে আল্লাহর হুকুমের অনুগত হতে হয়। এক্ষেত্রে সামান্য অবাধ্যতা বা বিদ্রোহ তাকে কাফেরে পরিণত করে। তাই মুসলমান কোন মুর্তি বা দেবতার প্রশংসায় কোন গান লেখা দূরে থাক একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। অন্তরে ঈমান থাকলে সেটির প্রতিফলন হতে হবে প্রতি কর্মে, প্রতি কথায় ও ভাবনায়। তাই সাহিত্যেও কোন মুসলিম ইসলামশূণ্য হতে পারে না। কর্মের খাতিরে কর্ম, কথার খাতিরে কথা বা সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্য,-তাই মুসলমানের সাজে না। মুসলমানকে প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে হয় আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে। কাফের হওয়ার জন্য বার বার বিদ্রোহের প্রয়োজন পড়ে না,একটি মাত্র বিদ্রোহই যথেষ্ট। আজীবন জিহাদের ময়দানে থেকেও কোন ব্যক্তি যদি দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে কোন গান লেখে বা একবার পুঁজা দেয় তবে কি তার ঈমান থাকে? সেটি তো আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কিছু হামদ-নাত লিখে সে বিদ্রোহের শাস্তি থেকে মুক্তি মেলে না। অথচ নজরুলের জীবনের এমন বিদ্রোহের সংখ্যা একটি নয়, বহু। যেমন তাঁর ব্যক্তি জীবনে,তেমনি সাহিত্যে।আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে মুর্তমান করেছেন হিন্দুদের দেব-দেবীর প্রশংসা গেয়ে,অসংখ্য শ্যামা সঙ্গিত, ভজন ও কীর্তন লিখে। শিল্প ও সাহিত্যের নামে ইসলামের মূল আক্বীদা থেকে বিচ্যুতি কি কোন মুসলমানের শোভা পায়? নজরুল কি করে ভাবলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে এমন লাগাতর বিদ্রোহের পর আলেমগণ তাঁকে আল্লাহর অনুগত বান্দাহ রূপে গ্রহণ করবেন? আলেমদের মোল্লা বলে গালি দিয়ে কি তিনি নিজের কর্মকে জায়েজ করতে পারেন?

নজরুলের জীবনে আধ্যাত্মিকতা ও নামায-রোযার কীরূপ স্থান ছিল সেটিও দেখা যাক। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন,“ইতিমধ্যে নজরুল ইসলামের মধ্যে একটু একটু মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিল। আগেই শুনিয়াছিলাম তিনি বরদাবাবু নামক জনৈক হিন্দু যোগীর নিকট তান্ত্রিক যোগ সাধনা শুরু করিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করিলে কাজী সাহেব মিষ্ট হাসি হাসিতেন। ..একদিন অফিসে আসিয়া তিনি আমাকে বলিলেনঃ একটা জায়নামায ও ওযুর জন্য একটা বদনা কিনাইয়া দিন। তাই করা হইল। অফিসে দুতলার পিছন দিকে একটি ছোট কামরাকে নামাযের ঘর করা হইল। কাযী সাহেব সপ্তাহে দু’চার দিন যা আসিতেন এবং দুই-তিন ঘন্টা যা থাকিতেন তার সবটুকুই তিনি ওযু ও নামাযে কাটাইতেন। ওযু করিতে লাগিত কমছে কম আধ ঘন্টা। আর নামাযে ঘন্টা দুই। এ নামাযের কোনও ওয়াক্ত-বেওয়াক্ত ছিল না। কেরাত রুকু-সেজদা ছিল না। জায়নামাযে বসিয়া হাত উঠাইয়া মোনাজাত করিতেন এবং তারপরই মাটিতে মাথা লাগাইতেন।সেজদার মত কোমর উঁচা করিয়া নয়, কোমর উরুর সাথে ও পেট জমির সাথে মিশাইয়া। এই ভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা এক সেজদায় কাটাইয়া দিতেন। আমি যতদূর দেখিয়াছি,তাতে তিনি সিজদা শেষ করিয়া একবারই মাথা উঠাইতেন।” সুত্রঃ আবুল মনসুর আহমদ, আত্মকথা, পৃঃ ৩৬০)।

আরেকটা শিক্ষাপ্রদ বিষয় হল তাদের জন্য যারা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নজরুলকে খাড়া করতে চান। বাংলাদেশে এমন একটি রবীন্দ্র-বিরোধী মহল চোখে পড়ার মত। এরা মুসলিম জাতিয়তাবাদী। তাদের কথা, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের কবি। রবীন্দ্র সাহিত্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সে আগ্রাসনের মোকাবেলা নজরুলকে খাড়া করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, নজরুলকে দিয়ে কি সেটি সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ একটি ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের প্রতীক। আর ধ্যান-ধারণার প্রতিরোধে শক্তিশালী ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস চাই। এজন্য কি কবি বা কবিতা জরুরী? কোন কবি যদি সে ধ্যান-ধারণার বাহক হিসাবে এগিয়ে আসেন তবে সেটি উত্তম। কিন্তু সেটি অপরিহার্য নয়। নবীজী (সাঃ)র আমলে কাফেরদের দলে ইমরুল কায়েসের মত বিখ্যাত কবি ছিল। কিন্তু তার মোকাবেলায় মুসলমানগণ আরেক ইমরুল কায়েসকেও খাড়া করেননি। বরং ইমরুল কায়েসের কবিতা ও ধ্যান-ধারনাকে মোকাবেলা করেছেন ইসলামি দর্শন দিয়ে। অথচ বাংলাদেশে সেটি হয়নি। এখানে এমন একজনকে খাড়া করা হয়েছে যিনি নিজেই রবীন্দ্র-সাহিত্য ও তাঁর ধ্যান-ধারণার কাছে আত্মসমর্পিত। নজরুলের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবটি কেমন ছিল সেটি কবি নজরুলের নিজের কথাই শোনা যাকঃ “বিশ্ব কবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে যেমন করে ভক্ত তার ইস্টদেবকে পূজা করে। ছেলে বেলা থেকে তার ছবি সামনে রেখে গন্-ধুপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক কত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে।” সুত্রঃ নজরুল রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২৪)।

ফলে নজরুলকে জাতীয় কবি রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়ার অর্থ শুধু নজরুলের প্রতিষ্ঠা নয়,তিনি যে রবীন্দ্রনাথ ও তার দর্শনের পূজারী তাঁকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। নজরুল­­-ভক্তদের দাবী তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশী ধর্মনিরপেক্ষ। তাদের যুক্তি, কাজী নজরুল ইসলাম হামদ,নাতের পাশাপাশি ভজন, কীর্তন,শ্যামাসঙ্গিতসহ শত শত সেক্যুউলার কবিতা লিখেছেন।ইসলামের পাশাপাশি হিন্দুধর্মের কথাও লিখেছেন। প্রশ্ন হল, কোন মুসলমান যখন হিন্দু দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে ভজন, কীর্তন ও শ্যামাসঙ্গিত লেখেন তাকে কি ইসলাম ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ বলা যায়? সেটি তো ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতা। বাস্তবতা হল, রবীন্দ্রনাথ যেমন ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না, তেমনি নজরুলও নয়। কাজী নজরুল সমগ্র ভারত জুড়ে যে তাহজিব,যে জীবন-বোধ এবং যে সংস্কৃতির প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও বিজয় চাইতেন সেটি কি ইসলামি সংস্কৃতি? সে ইসলামি সংস্কৃতি কি নজরুলের নিজ জীবন ও নিজ ঘরেও কি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? আর নিজ ঘরে বা নিজ পরিবারে তিনি যে সংস্কৃতির পরিচর্যা দিয়েছেন,ঘরের বাইরে তা থেকে ভিন্নতর সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা চাইবেন,সেটিই বা কীরূপে আশা করা যায়? বরং প্রকৃত সত্য হল, রবীন্দ্রভক্তরা যে সংস্কৃতিকে ভারতে বিজয়ী করেছে,তারা বাংলাদেশেও সেটিরই বিজয় চায়। দুই দেশের মাঝের রাজনৈতিক মানচিত্রকে বিলুপ্ত না করতে পারলেও বিলুপ্ত করতে চায় সাংস্কৃতিক মানচিত্র। তাদের বিচারে রবীন্দ্রনাথের ন্যায় নজরুলও সে অভিন্ন সংস্কৃতির ধারক। নজরুল নিজেও যে কতটা মনেপ্রাণে রবীন্দ্র­সাহিত্য ও রবীন্দ্র ধ্যান-ধারণার প্রসার ও প্রতিষ্ঠা চাইতেন সেটি ফুটে উঠেছে নজরুলের নিজের রচিত কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সন্মান দেখিয়ে তিনি লিখেছেনঃ

“রবির শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে

সে কর শুধু পশলো না মা অন্ধকারার বন্ধ ঘরে।

গগন-পথে রবি-রথের সাত সারথি হাঁকায় ঘোড়া,

মর্তে দানব মানব-পিঠে সওয়ার হয়ে মারছে কোঁড়া।”

কোন রবীন্দ্রভক্ত হিন্দুও কি রবীন্দ্রনাথের সন্মানে এমন কবিতা লিখেছে? নজরুল যে রবীন্দ্র-চেতনা ও রবীন্দ্র ধারায় মিশে গেছেন ও ভেসে গেছেন, সেটির প্রমাণ শুধু নজরুল সাহিত্য নয়। প্রমাণ মেলে নজরুলের প্রতি ভারতীয় হিন্দু এবং সে সাথে ভারত সরকারের স্বীকৃতির নমুনা দেখে। ভারত সরকার শুধু রবীন্দ্রনাথকে সন্মান দেখায়নি, সন্মান দিয়েছে নজরুলকেও। কবি নজরুলকে ১৯৬০ সালে ভারত সরকার দেয় ‘পদ্মভূষন’ পদক। ১৯৪৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছিল জগত্তারিণী পদক। ভারত সরকার বা কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এমন পুরস্কার কাউকে নিছক তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য দেয় না। দেয় সাহিত্যের মূল সুর ও দর্শনটির জন্য। কোন কবির সাহিত্য ভারতের জাতীয় দর্শন ও হিন্দু আধিপত্যের বিরোধী হলে তাঁকে এরূপ পুরস্কার দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। ১৯৭১ সালে ভারত সরকার বহু অর্থ ব্যয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্বে যুদ্ধ করেছে ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করেছে এ জন্য নয় যে পূর্ব সীমান্তে এক শক্তিশালী ইসলামী দেশ গড়ে উঠুক। বাংলাদেশের পৃথক ভূগোল মেনে নিতে রাজী হলেও রাজী নয় ইসলামী দর্শন ও মূল্যবোধ নিয়ে বাংলাদেশ বেড়ে উঠুক। বাংলাদেশীদের জীবন-চেতনা বা দর্শনটি কী হবে সে ক্ষেত্রে জাতির সামনে নির্দেশনা বা কম্পাস হল জাতীয় সঙ্গিত। এবং সেটি রবীন্দ্রনাথের। এ রবীন্দ্র-সঙ্গিতকে যেসব ভারতপন্থি নেতারা ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে তাদের মতলব একটাই। সেটি হল, এ সঙ্গিতের সুর,দর্শন ও ভাবনার সাথে বাংলাদেশীদের একাত্ম করা। বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনীতিও পরিচালিত হচ্ছে সে অভিন্ন লক্ষ্যে। তবে রবীন্দ্র-সঙ্গিতকে জাতীয় সঙ্গিত ও দেশে রবীন্দ্রচর্চা বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই ইসলামের বিপক্ষ শক্তির ডি-ইসলামাইজেশন প্রকল্প শেষ হয়নি। বরং সেটিকে বেগবান করার স্বার্থে সেক্যুউলারিস্টগণ জাতীয় কবির আসনে বসিয়েছে প্রচন্ড রবীন্দ্রপুঁজারী কাজী নজরুল ইসলামকে। নজরুলের নামের সাথে ইসলাম আছে বলে তাতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। এ নাম নিয়েই তিনি দেব-দেবীর নামে শত শত ভজন ও কীর্তন লিখেছেন,এবং রবীন্দ্রনাথের মুর্তিতে পুঁজা দিয়েছেন। শ্মশান ঘাটে গিয়ে সাধু-সন্নাসীদের সাথে জঁপও করেছেন।নিজ ঘরে দেবদেবীর মুর্তি ও নিজ সন্তানদের হিন্দু নামের পাশাপাশি হিন্দু-সংস্কৃতিরও আবাদ করেছেন। কথা হল,বাংলাদেশে যারা নজরুলভক্ত তারা কি বাংলাদেশেও সেটিই চায়? এজন্যই কি তাঁকে জাতীয় কবির আসনে বসানো হয়েছে? নজরুলের সাহিত্য বিভ্রাট এবং তাঁর চেতনাগত বিচ্যুতি এভাবেই বাংলাদেশীদের আদর্শিক,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভ্রাট ও বিচ্যুতির দিকে ধাবিত করছে

বিষয়: বিবিধ

২৭৯২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

370036
২৫ মে ২০১৬ সকাল ০৮:৫৯
হতভাগা লিখেছেন : প্রায় সাড়ে চার ফিট লম্বা পোস্ট ! এটা কি আপনার পিএইচডির থিসিস পেপার ?
370224
২৬ মে ২০১৬ রাত ১১:৪৩
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়া। আপনার মূল্যবান ও বলিষ্ঠ লিখনীটি অনেক ভালো লাগলো।

তথ্যবহুল, প্রাণবন্ত এবং অসাধারণ অনুভুতি ও শাণিত বিশ্লেষণে ভরপুর একটি লিখা মাশাআল্ললাহ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File