ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লব কেন?

লিখেছেন লিখেছেন মনসুর আহামেদ ০৯ মার্চ, ২০১৩, ০৮:৪৬:১২ সকাল

ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লব কেন?

ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লবের ধারণাটি কোন ধর্মীয় নেতা, আলেম বা মুসলিম দার্শনিকের নয়। এর লক্ষ্য কোন ব্যক্তি বা দলকে ক্ষমতায় বসানোও নয়। ক্ষমতা দখলের এটি কোন রাজনৈতিক মতলবও নয়। বরং এ রাষ্ট্রবিপ্লবটি যিনি চান তিনি স্বয়ং মহান আল্লাহতায়ালা। ঈমানদার হওয়ার মূল দায়বদ্ধতা হলো, আল্লাহতায়ালার সে ইচ্ছার সাথে পুরাপুরি একাত্ম হওয়া। আল্লাহতায়ালার সে ইচ্ছাটি ঘোষিত হয়েছে এভাবেঃ “তিনিই সেই মহান সত্ত্বা যিনি হেদায়েত এবং সত্যদ্বীনসহ রাসূল পাঠিয়েছেন, যেন সেটি সকল ধর্ম ও সকল জীবন-দর্শনের উপর বিজয়ী হয়, যদিও সেটি মুশরিকদের কাছে অপছন্দনীয়।” -সুরা সাফ, আয়াত ৯। অবিকল অভিন্ন ভাষায় একই ইচ্ছার কথা ঘোষিত হয়েছে সুরা তাওবার ৩৩ নম্বর আয়াত ও সুরা ফাতাহ’র ২৮ নম্বর আয়াতে। সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে দ্বীনের প্রতিষ্ঠাই যে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাযিলের লক্ষ্য সে ঘোষণাটি এসেছে সূরা শূরার ১৩ নম্বর আয়াতেও। বলা হয়েছে, “তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি নাযিল করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা এবং ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না।”

উপরের আয়াতগুলীতে আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্ট করেছেন, কেন তিনি নবী পাঠিয়েছেন এবং কেনই বা কোরআন নাযিল করেছেন এবং ঈমানদারের জীবন-মিশনই বা কি? মুসলমান হওয়ার অর্থ শুধু আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলকে মৌখিক স্বীকার করা নয়, বরং আল্লাহর এ মিশনটির সাথে একাত্ম হওয়া। ঈমানদারির মূল পরীক্ষা তো এখানেই। মহান আল্লাহতায়ালা দেখতে চান, বিশ্ববাসীর মধ্যে কারা তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়নে জানমাল, শ্রম, সময় ও মেধার বিনিয়োগ করে। পবিত্র কোরআনে সে বিনিয়োগে উদাত্ত আহবান এসেছে এভাবেঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যাও।” -সুরা সাফ, আয়াত ১৪। ঈমান আনার মূল অর্থ তাই আল্লাহতায়ালার সাহায্যকারি হওয়া। মু’মিনের প্রকৃত ঈমানের প্রকাশ তো ঘটে এ ভাবেই। ইসলামে অঙ্গিকারহীন কোন ব্যক্তি, দল বা কোন সেকুলার শক্তির পক্ষে অর্থ, শ্রম, সময় বা ভোটদান কোন ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষে এ জন্যই অতি অচিন্তনীয় বিষয়। ইসলামে এটি হারাম। বরং সে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয় ইসলামের বিজয়ে। ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লবের কাজটি একারণেই আমৃত্যু মিশন ছিল মহান নবীজী (সাঃ)র ও তাঁর সাহাবাদের। এমন একটি রাষ্ট্রবিপ্লবের বিরোধীতার অর্থ, আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। আর এমন বিদ্রোহীকে কি ঈমানদার বলা যায়? নবীজী (সাঃ)র আমলে যারাই সে বিপ্লবে যোগ দেয়নি বা সামান্য বিরোধীতা করেছে তাদেরকে সেদিন কাফের বলা হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে একথাও বার বার ঘোষিত হয়েছে যে, যারা আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যায় তাদেরকে সাহায্য করাই মহান আল্লাহর সূন্নত। অপরদিকে জাতি, গোত্র, বর্ণ, দল বা কোন মতবাদের বিজয় আনতে যারা যুদ্ধ করে, তারা নামে মুসলমান হলেও তাদের পথ ইসলামের নয়। সে পথ গায়রুল্লাহর বা শয়তানের। তাদের এজেন্ডা আল্লাহর ইচ্ছার বিজয় নয়, মুসলমানের গৌরব বৃদ্ধিও নয়। তারা প্রতিপক্ষ মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের। অতীতের ন্যায় আজও মুসলমানদের বিপুল মেধা, শ্রম, অর্থ, রক্ত ও সময় ব্যয় হচ্ছে এরূপ গায়রুল্লাহর পথে। তাদের কারণেই আল্লাহর কোরআনী আইন তথা শরিয়ত মুসলিম দেশের আইন-আদালত থেকে অপসারিত হয়েছে এবং বিজয়ী হয়েছে কাফেরদের আইন। তাদের হাতে মুসলিম উম্মাহর মানচিত্র খন্ডিত হয়ে ৫০টির বেশী রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলীতে বিশাল বিশাল সামরিক বাহিনী রয়েছে ঠিকই এবং এসব সেনাবাহিনীর পিছনে বিস্তর অর্থ, শ্রম ও রক্তও বিনিয়োগ হচ্ছে, তবে সেটি আল্লাহর দ্বীন বা বিধানকে সমুন্নত রাখতে নয়। মুসলমানদের ইজ্জত বাড়াতেও নয়। বরং সেটি শরিয়তের পরাজয়, দেশগুলীর খন্ডিত ভূগোল এবং ভাষা ও ভূগোল-ভিত্তিক জাতীয় সরকার বা ট্রাইবাল আধিপত্যকে দীর্ঘজীবী করতে। ফলে বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়লেও বিজয় আসছে না ইসলামের।

মানবজাতির হেদায়েতের লক্ষ্যে মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশেষ গ্রন্থ হলো কোরআন। এ গ্রন্থে তিনি শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের বিধান দেননি, পথ দেখিয়েছেন রাষ্ট্র-পরিচালনা, বিচার-আচার, সম্পদ-বন্টন, অর্থনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে। তাই দ্বীনের পূর্ণ অনুসরণের অর্থ শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা গড়া নয়, নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত পালনও নয়। সেটি ইসলামকে বিজয়ী করা। মুসলমান হওয়ার শর্ত হলো, কোরআনে ঘোষিত প্রতিটি নির্দেশের পূর্ণ অনুসরণ। এজন্যই যে কোন মুসলিম দেশে যে কাজটি অনিবার্য হয়ে পড়ে তা হলো ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লব এবং রাষ্ট্রজুড়ে ইসলামের পূর্ণ প্রয়োগ। পবিত্র কোরআনের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এরূপ রাষ্ট্রবিপ্লবের অসংখ্য নির্দেশাবলী। তাই ইসলামের লক্ষ্য নিছক আধ্যাত্মীক বিপ্লব নয়,রাষ্ট্রব্যাপী বিপ্লবও। মুসলমানের কাজ, রাষ্ট্র-বিপ্লবের এ কাজে নিজেকে পুরাপুরি সম্পৃক্ত করা। এমন রাষ্ট্র-বিপ্লবের কাজ সমাধা করতেই নবীজী (সাঃ)ও তাঁর সাহাবাদের মসজিদের বাইরে আসতে হয়েছে। বার বার রক্তাক্ষয়ী লড়াইয়ে জানমালের বিশাল কোরবানী পেশ করতে হয়েছে। রক্তাত্ব লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল নিতে হয়েছে। মুসলমানদের বেশীর ভাগ অর্থ, শ্রম ও রক্ত ব্যয় হয়েছে তো একাজে। বিশ্বের বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে ইসলামের রাষ্ট্রবিপ্লব এসেছে তো এভাবেই। ইসলামের পূর্ণ অনুসারি ও পূর্ণ মুসলমান হওয়ার জন্য সর্বকালে ও সর্বস্থানে এটিই মহান নবী(সাঃ)র অনুকরণীয় আদর্শ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সেকুলারিষ্ট বা ইসলামে অঙ্গিকারহীন দুর্বৃত্তদের জিম্মায় রেখে নামায-রোযায় মনযোগী হওয়া ইসলাম নয়। নবীজী (সাঃ)র সূন্নত বা সাহাবাদেরও ঐতিহ্য নয়। ইসলাম শান্তির ধর্ম, শান্তির প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল এজেন্ডা। তবে সে শান্তি সুনিশ্চিত হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে অশান্তি সৃষ্টিকারী দুর্বৃত্তদের পরাজিত করার মধ্য দিয়ে। সে শান্তি আসে ইসলামের পূর্ণ অনুসরণে। অন্যধর্ম, অন্য দর্শন বা অন্য মতবাদের অনুসারীদের কাছে আত্মসমর্পণে সেটি অসম্ভব। তাছাড়া সেটি সম্ভব হলে ইসলামের প্রয়োজনীতাই বা কি? কোরআন-নায়িল ও নবী-প্রেরনেরই বা কি দরকার?

মানুষকে পথ দেখানোর দায়িত্ব একমাত্র মহান আল্লাহর। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেছেনঃ “ইন্না আলাইনাল হুদা।” অর্থঃ নিশ্চয়ই পথ দেখানোর দায়িত্ব আমার।-সুরা লাইল আয়াত ১২। মহান আল্লাহতায়ালা সে দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যেই লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। কিন্তু নবীদের সে শিক্ষা থেকে যুগে যুগে মানুষ বিচ্যুত হয়েছে। বিভ্রান্ত সে মানুষদের পথ দেখাতেই কোরআন হলো সর্বশেষ প্রেসক্রিপশন। এটি রোগমুক্তি ঘটায় সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্ববিধ রোগের। মুসলমানের কাজ হলো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে সে প্রেসক্রিপশনের পূর্ণ প্রয়োগ। কিন্তু রাষ্ট্রজুড়ে সে প্রেসক্রিপশনের প্রয়োগে জরুরী হলো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বত্র জুড়ে ইসলামের বিজয়ে অঙ্গিকারবদ্ধ ব্যক্তিদের দখলদারি। নিছক নামায-রোযা-হজ-যাকাত বা ওয়াজ-নসিহতে সেটি কি সম্ভব? রাষ্ট্রই হলো মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। পাপ ও নেকী – উভয়ের বিস্তারে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিশাল। এমন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানকে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে রেখে ইসলামের বিজয় দূরে থাক,পরিপূর্ণ চর্চাও কি সম্ভব? তখন বরং পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ময়দানে ইসলামের পরাজয় শুরু হয়।

তথ্য সূএে: http://www.drfirozmahboobkamal.com/2011-02-26-19-32-39/718-road-map-for-islamic-revolution-.html

বিষয়: বিবিধ

১২৬৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File