মুনাজাত ও ফরিয়াদে কিছুই হয় না! বিবিধ প্রসঙ্গ মাসুদ মজুমদার তারিখ: 16 May, 2013
লিখেছেন লিখেছেন মনসুর আহামেদ ১৬ মে, ২০১৩, ০৫:৩১:০২ সকাল
মহান সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টি পরিচালনায় স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় সব সময় ঘটান না। এটাই আদত বা স্বাভাবিক নিয়ম। স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে সেটাই কুদরত। বিজ্ঞান একটিকে ন্যাচার, অপরটিকে অ্যাবনরমালিটি হিসেবে বর্ণনা করেছে। এ জন্য অতিলৌকিক কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান করতে যায় না। সাভারে ভবনধসের ১৭ দিনের মাথায় রেশমা উদ্ধারে সবার মনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বিশ্বাসীরা এর ভেতর কুদরতের খেলা দেখছেন। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা হচ্ছেÑ অক্সিজেন ছিল, উচ্ছিষ্ট খাবার ছিল, বৃষ্টির পানি ছিল, ঘুমের সুযোগ ছিল, তাই প্রাণ বেঁচে গেছে। কোনো সাজানো ব্যাপার না থাকলে বিশ্বাসীরা এসব কার্যকারণ মেনেও বলবেনÑ আল্লাহ তাকে হেফাজত করেছেন বলেই প্রতিকূল পরিবেশেও কার্যকারণগুলো কাজ করেছে। বিশ্বাসী মনের এই তুষ্টিটুকুর ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না। তাই বিজ্ঞানের যুক্তি যেখানে গিয়ে শেষ হয়, কুদরতের কাজ সেখান থেকেই শুরু হয়। এটি সাংঘর্ষিক কিছু নয়। এটাই বিশ্বাসের ব্যাপ্তি। বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা।
শক্তির জয় স্বাভাবিক নিয়ম। দুর্বলের পরাজয় একই নিয়মের অংশ। অনেক সময় অসমযুদ্ধে শক্তির বিপরীতে সত্যের জয় হয়। ইতিহাসে সাড়াজাগানো সব ঘটনায় অসমযুদ্ধে শক্তির বিপরীতে সত্যের জয় হয়েছে। এসব জয়ের নেপথ্যে বিধাতার ইচ্ছাও সক্রিয় ছিল। তা ছাড়া সত্যের একটা নিজস্ব শক্তি আছে। কারবালার ঘটনায় অসম অবস্থানে ইমাম হোসেনের জয় হলে শক্তির জয় হতো না, কুদরতের জয় হতো। আবার কারবালার ঘটনায় বিশ্বাসের যে জয় হয়েছে সেটাই ছিল আল্লাহর কাছে পরীক্ষার বিষয়। পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসূল মিশন শেষ করে আক্ষরিক অর্থে বিজয় পাননি। তাদের এ বিজয় না পাওয়া নবীর মিশনের ব্যর্থতা নয়, আল্লাহর পরীক্ষার সফলতা। ফেরাউন-নমরুদ-হামান-কারুনরা শক্তিমানের প্রতীক। তাদের তুলনায় নবী-রাসূলরা ছিলেন সত্যের প্রতীক। শক্তির বিপরীতে সত্যের বিজয় দেয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ দু-চারবার কুদরতের ফয়সালা দিয়েছেন। অবশিষ্ট অনেক ক্ষেত্রে বিজয় শক্তিরই হয়েছে, সত্যের নয়। এর অর্থ এই নয়, আল্লাহ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুমিনদের, সেসব সঠিক নয়। দুনিয়াতে আল্লাহ-প্রদত্ত ভাঙা-গড়ার একটি চিরায়ত নিয়ম আছে। মৌলিক মানবীয় গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ নেতৃত্ব দেবে। ইসলামি নৈতিকতা থাকলে সেটা সোনায় সোহাগা হবে। পীর-আউলিয়া, আলেম-ওলামা ভালো মানুষ, তারা মৌলিক মানবীয় গুণাবলিসম্পন্ন না হলে তাদের ওপর নেতৃত্ব করবে দুনিয়াবি যোগ্যতাসম্পন্নরাÑ এটাও যোগ্যতার ফলাফল। এটা মেনেই সবাইকে অগ্রসর হওয়া উচিত।
এ পৃথিবীর সাথে পরকালীন জীবনের ধারণা যারা মিলিয়ে ভাববেন না, তারা জীবনের ও পৃথিবী সৃষ্টির কোনো উদ্দেশ্য ও উপসংহার খুঁজে পাবেন না। এ নিবন্ধে সেই সব অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে আলোচনা প্রাসঙ্গিক নয়। বাম রাজনীতির ঘোর কেটে যাওয়ার পর তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের একজন নবিস বা উৎসাহী ছাত্র হিসেবে ইহুদি-খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের নবুওতের কনসেপ্ট, কিতাবের বা অহির ধারণা, ফেরেশতার উপস্থিতি, পরকালীন ভাবনা, বেহেশত-দোজখের বর্ণনা, নবী-রাসূলের আগমনরীতি নিয়ে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করেছি। মনে হয়েছে বিশ্বাসের সংবেদনশীলতার বাইরে বেশ কিছু বিষয় প্রায় অভিন্ন। হজরত আদম-হাওয়া থেকে শুরু করে পৃথিবীর লয় বা কেয়ামত পর্যন্ত মৌলিক বিশ্বাসগুলোর এবং বিশ্বাসীদের মধ্যে দূরত্ব খুবই কম। বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের ভেতর সাদৃশ্য প্রচুর। আবার আন্তঃধর্ম বোঝাপড়ার জন্য একই সমতলে একটা সূচক তৈরি করলে সব ধার্মিকই যার যার বিশ্বাস নিয়েও একটি গ্রহণযোগ্য সত্যকে আত্মস্থ করে চলেন। সব ধর্মের সূচনা একত্ববাদের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিকৃতি ও স্রষ্টাকে ভুলে সৃষ্টির পূজার বিষয়টি ভক্তিবাদ ও সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব থেকে জন্ম নেয়া একটি সাধারণ বিচ্যুতি। সব ধর্মের মৌল চিন্তায় একত্ববাদের বাইরে কিছুই নেই। হজরত আদম আ: থেকে শেষ নবী পর্যন্ত সবাই এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে অভিন্ন সুরে কথা বলেছেন। মানুষ স্বভাবতই আনুগত্যবাদী। সময়ের ব্যবধানে অতি আনুগত্যবাদের উদর থেকে জন্ম নেয় বিচ্যুতি। এক আল্লাহর কথা ভুলে মূর্তি, পাহাড়-পর্বত ও বিভিন্ন জড় পদার্থকে বানিয়ে নেয়া হয়েছে স্রষ্টাকে পাওয়ার মাধ্যমও। মৃত্যুর পর নবীও পূজিত হয়েছেন। ত্রিত্ববাদের জন্মও অতিমাত্রার ভক্তিবাদ থেকে। তাই বলে ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যারা বিকৃতিতে জড়িয়ে যান তারা বুঝতে চান না তারা পথ হারিয়েছেন! এখন যারা একত্ববাদী কিন্তু নানা উপায়ে মূর্তি পূজা করেন, আগুন পূজা করেন, জড় বস্তুতে ভক্তি প্রদর্শন করেনÑ তারা নিজেদের ভাবেন মহান প্রগতিশীল এবং সংস্কৃতিমনস্ক। বাস্তবে মূর্তিপূজা, অগ্নি-উপাসকদের আগুনপূজার আনুষ্ঠানিকতা ও জড় বস্তুতে ভক্তিবাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন স্রষ্টাকে ভুলে সৃষ্টির পূজার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রাথমিক স্তর। এভাবেই মূর্তিপূজার প্রসার ঘটেছে।
এই কথাগুলো এ জন্য বলা যে, আমাদের নতুন প্রজন্মের ভেতর ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়, ধর্ম মানে সেকেলে, মতান্ধ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বোঝে না। আধুনিকতা কিংবা উত্তর-আধুনিকতা কাকে বলে তা-ও জানে না। মাদরাসায় পড়ার সুযোগ হয়নি। কথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কারণে অবস্থানটা কিছু সুবিধাজনক। আবার অসুবিধাজনকও। সুবিধাজনক এ জন্য যে, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব আত্মস্থ করার জন্য আধুনিক পরিসরটা বোঝা সহজ হয়েছে। তবে কুরআনের ওপর বেসিক ধারণার বাইরেও আরবি জানা এবং কুরআন বোঝার মতো মাদরাসাপড়–য়া হলে মূল আবেদনের ভাষাটা আত্মস্থ করা সহজ হতো। পৃথিবীর প্রধান দু’টি ধর্মগ্রন্থ পড়লে, তাদের ধর্মগুরুদের পোশাক-আশাক, জীবনযাপন ও চিন্তার পরিধি জানলে যেকোনো মানুষ যার যার বিশ্বাসকে আত্মপ্রত্যয়ের দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ পাবেন। বিশ্বাসের তারতম্যের ভেতরও একটা অভিন্ন অবস্থান খুঁজে পাওয়ার এই জায়গাটা এ যুগে খুবই দরকার। কারণ যুদ্ধটা ধর্মের বিরুদ্ধে অধর্মের। বিশ্বাসকে বড় ক্যানভাসে আত্মস্থ করাÑ এর নামই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা। ইসলাম এ শিক্ষাই দিতে চেয়েছে। ইসলাম জানিয়ে দেয় হেদায়াতের মালিক আল্লাহ। আল্লাহ চাইলে সবাইকে এক ধর্মের অনুসারী বানাতে পারতেন। তা করেননি পরীক্ষার জন্যÑ এটাও বান্দাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই জবরদস্তি করতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
জাতীয় ও দ্রোহের কবি নজরুলের ধর্মবিশ্বাস ও শ্রী চৈতন্যের বিশ্বাস এক নয়; কিন্তু তাদের চিন্তার ভেতর সামঞ্জস্য খুঁজতে গিয়ে একটা মিল পাবেন। তারা মানবিক। যিনি যেভাবে বুঝেছেন সেভাবেই সত্যের পূজারী। ধর্মবিশ্বাস থেকেই তাদের এই দু’টি গুণ জন্ম নিয়েছে। এটা ধর্র্মান্ধতার ফসল নয়।
নজরুলের শিশুসন্তান বুলবুল মারা যাওয়ার পর তিনি খোদার সাথে অভিমান করে কবিতা-গান রচনা করেছেন। যেমন আল্লামা ইকবাল মুসলিম জাতির গ্লানি ও পরাভব দেখে শেকওয়া রচনা করে নিন্দিত হলেও জওয়াবে শেকওয়া লিখে অমর হয়ে আছেন। এ যুগের তরুণেরা এ দু’টি বইয়ের অনুবাদ পড়ে সমৃদ্ধ হতে পারে।
ইকবাল যখন বলেন, নিজের খুদিকে এতটা উচ্চে নিয়ে যাও যাতে খোদা তোমার ভাগ্য নির্ধারণের সময় তোমার কাছে জানতে চায়Ñ বান্দা তুমি কী চাও। ইকবাল দর্শন ও সক্রেটিস চিন্তার একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মিলটা সত্যের একই সমতল থেকে এসেছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। অনেকের ধারণা সক্রেটিস অজানা নবী। কারণ তিনি মিথ্যা বলেননি। তার নীতিজ্ঞানও ছিল সত্যাশ্রয়ী। এসব জানা দরকার, না জানলে চিন্তার দৈন্য, বন্ধ্যত্ব ও হীনম্মন্যতা কাটবে না।
এত কথা বলার কারণ দু’টিÑ একজন স্নেহভাজন আল্লামা শফী সাহেবের দোয়া ফরিয়াদ ও মুনাজাত সম্পর্কে জানতে চান। তার জিজ্ঞাসা এর শক্তি কতটুকু। আমার জানা মতে, মুনাজাত হচ্ছে আল্লাহর কাছে বান্দার চাওয়া বা আকুতির বিষয়। আর অভিমানী বান্দার নালিশ ও অভিযোগ অনুযোগ হচ্ছে ফরিয়াদ। একজন বিশ্বাসী তথা ঈমানদার মানুষ একমাত্র আল্লাহর কাছেই চায়। কবি ফররুখের একটি বিখ্যাত কবিতায় বলা আছে, ‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া, তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া’Ñ এটা বিশ্বাসের ভিত্তি। তাই বিশ্বাসী মানুষ আল্লাহর কাছে দাবি জানায়, অনুযোগ করে। বিশ্বাসের দিক থেকে এটা ঈমানদারের সঠিক বৈশিষ্ট্য। হজরত আদম-হাওয়ার দোয়া কবুল হওয়ার মাধ্যমে দোয়ার শক্তির উদ্বোধন ও শয়তানের ওপর বিজয়ের সূচনা হয়। যারা এর পরের ইতিহাস ও দোয়ার শক্তির উৎস সন্ধান করতে চান তাদের বলব, শুধু কুরআন পড়লেই অসংখ্য নজির পাবেন। ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট বা বাইবেলের নতুন ও পুরনো সংস্করণ পড়লেও সত্যের একটা বক্ররেখা হলেও খুঁজে পাবেন। এর বাইরেও প্রধান ধর্মগুলোর মূল গ্রন্থ পড়ে অনেক সত্য, অর্ধসত্য ও বিশ্বাস খুঁজে পাওয়ার মতো উত্তর পাবেন। যারা উত্তর জেনেও বোবা শয়তান সাজবেন তাদের ব্যাপারে আমাদের কোনো কথা নেই। আমরা হজরত আদম আ:-এর ভুল স্বীকার ও ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গ টানতেই কথা বলেছি। কারণ সব ধার্মিক মন আদম-হাওয়া সম্পর্কে অকুণ্ঠভাবে বিশ্বাসী।
হজরত আদম আ: থেকে দোয়া ও ফরিয়াদই ঈমানের ও ঈমানদারের বিজয় এবং রহমতপ্রাপ্তিকে নিশ্চিত করেছে। শক্তির মোকাবেলায় দোয়া একমাত্র অবলম্বন নয়, সুন্নাহর রীতিও নয়। তবে দোয়া এবং দাওয়া অর্থাৎ ওষুধ সেবন করে সুন্নাহ পালন করতে হবে। এরপর আল্লাহর ওপর নির্ভরতা এনে দোয়া করতে হবে। যেমন উট বেঁধেই আল্লাহর ওপর ভরসা করার কথা বলা হয়েছে। শেষ নবীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় দোয়া ও সামর্থ্যানুযায়ী প্রতিবাদী ও প্রতিরোধ শক্তির সমন্বিত ধারায় এগিয়েছে। প্রতিটি প্রতিরোধ লড়াইয়ে বা যুদ্ধে মহানবী সা: প্রয়োজনীয়সংখ্যক কিংবা সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধব্যুহ রচনা করেছেন। সৈন্য সমাবেশ করেছেন। এর পরই আল্লাহর কাছে দোয়া করে সাহায্য চেয়েছেন। কিংবা অনুযোগ করেছেন। ফরিয়াদও করেছেন। মহানবী হওয়ার কারণে সব লড়াইয়ে তিনি বিজয় পাননি। কিন্তু যেকোনো পরাজয়কে তিনি মূল্যায়ন করে সাফল্য-ব্যর্থতার শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এটাই সুন্নাহ। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
আমাদের ইতিহাসজ্ঞান যদি প্রতারিত না করে কিংবা ভুল না হয় তাহলে প্রত্যেক নবী-রাসূল থেকে শুরু করে মহামানব ও মানবীরা সৃষ্টিকর্তার নির্ভরতাকে দোয়ার বাহনে তুলে বা ফরিয়াদের ভাষায় অজুহাত জানিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ করেই পথ চলেছেন। হজরত হাওয়া যাকে বাইবেলে ইভ বলা হয়েছে, হজরত মরিয়ম খ্রিষ্টানদের কাছে যিনি কিনা মেরি, হজরত হাজেরা বাইবেলের ভাষায় হাগারÑ এরা সবাই খোদানির্ভরতার জন্য ইতিহাস হয়ে আছেন। বান্দা তার প্রভুর কাছে দোয়া করে সাফল্য পায় এটা বিশ্বাসের ফল। ইতিহাস স্বীকৃতও বটে। কয়েকজন নবী যেমন হজরত ইব্রাহিম আ:, যাকে বাইবেলে আব্রাহাম, একইভাবে হজরত ইউনুস, হজরত নুহ, ইসমাইল, ইউসুফ, ঈসা, মুসা, দাউদ, সুলাইমান প্রত্যেককে হিব্রু ও আরামাইক ভাষায় ভিন্ন নামে কিংবদন্তি হিসেবে তুলে ধরেছে। তারা প্রতিটি প্রতিকূলতা জয় করেছেন মুনাজাত ও ফরিয়াদের মাধ্যমে। সেই সাথে প্রতিপক্ষের সাথে লড়েছেন সব সামর্থ্য দিয়ে। আমাদের প্রিয়নবীর পুরো জীবন আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও সর্বাত্মক শক্তি নিয়োজিত করে প্রতিরোধের প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়েছে, যা আগেই উল্লেখ করেছি।
অবিশ্বাসীদের কাছে মুনাজাত ও ফরিয়াদ অর্থহীন। এটা যে বিশ্বাসের মৌল বিষয় সেটা তারা জানে না। তারা ডুবে মরার আগমুহূর্ত পর্যন্ত শক্তির মদমত্ততায় আস্ফালন প্রদর্শন করে। নবী-রাসূল ছাড়াও ইতিহাসের সব বাঁকে সত্য-মিথ্যার লড়াইয়ে মুনাজাত ও ফরিয়াদই অপরিহার্য বিবেচিত হয়েছে। এটাকে শুধু দুর্বল ও অক্ষমের আহাজারি-রোনাজারি ভাবার কোনো কারণ নেই। এটা বিশ্বাসীদের জন্য রুটিন ওয়ার্কের মতোই।
স্মরণে পড়ে মওলানা ভাসানী আইয়ুব আমলে বক্তৃতা করতে না পেরে মুনাজাতের হাত তুলে ফরিয়াদ করে একটি সফল প্রতিবাদী জনসভা শেষ করেছিলেন। মজলুম জননেতা হিসেবে জনগণের পক্ষে তিনি বহুবার রাজপথে বিজয় পেয়েছেন। আল্লামা শফী সাহেবের মুনাজাত ও ফরিয়াদে সেই শক্তির উত্থান দেখছি। অবিশ্বাসীরা সব যুগেই এ সত্য অস্বীকার করেছে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সত্যেরই জয় হয়েছে। তা মুনাজাত ও ফরিয়াদের পথে একই সাথে শক্ত প্রতিরোধের মাধ্যমেই। ধর্মের নামে কুসংস্কার ও জঞ্জাল আলাদা জিনিস। এটা সব সত্যকে রুখে দেয়ার একটি শয়তানিপ্রক্রিয়া। শয়তানের এ প্রক্রিয়া আছে বলেই ধর্মীয় সংস্কারও প্রত্যেক ধর্মেই আছে। মার্টিন লুথার ৯৩ দফা সংস্কার প্রস্তাব করে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মের পুরোহিত হয়ে গেছেন। বাস্তবে তিনি খ্রিষ্টান ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সংস্কারকের ভূমিকা পালন করেছেন। তার প্রতিবাদ ছিল মূলত চারটি। পাদ্রিরা ইনডালজেন্স নামে একটি বেহেশতের মিথ্যা সার্টিফিকেট বিক্রি করে ভক্তদের প্রতারিত করত। তারা কাষ্ঠফলক বিক্রি করত এই বলে, এটা নিশ্চিত স্বর্গে পৌঁছাবে এবং কাঠটাকে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধের আদি কাঠ বলে মিথ্যা হলফ করত। তারা রক্ষিতা রেখে পাপাচারে জড়াত। তা ছাড়া পাদ্রি বা পোপরা ধর্মের নামে টোল আদায় করত।
আমাদের উপমহাদেশ তো বটেই, সমগ্র মুসলিম দুনিয়ায় যুগে যুগে সংস্কারক এসেছেন। আমরা শুধু ক’জন ইমাম ও কয়েক শ’ সামনের কাতারের সংস্কারকের নাম জানি। এই উপমহাদেশে শাহ ওয়ালীউল্লাহ থেকে শুরু করে অসংখ্য লড়াকু মানুষ সংস্কারের রাস্তা ধরে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন, পীর-মাশায়েখদের হাত ধরে সংস্কার আন্দোলন এখনো অব্যাহত আছে। আল্লামা শফীর ১৩ দফা ধারাবাহিক সংস্কার আন্দোলন এ সময়ের সংস্কার কর্মসূচি। সংস্কারকদের জীবনে জেলজুলুম একেবারেই স্বাভাবিক। প্রতিপক্ষের মিথ্যা প্রচারণা ও সাধারণ প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে রক্তাক্ত পথ পাড়ি দেয়াও নজিরবিহীন নয়। তার পরও এ পথই হেরার রাজতোরণ ছুঁয়ে চলার একমাত্র বিশ্বাসবিধৌত পথ। এ পথে সাময়িক প্রতিবন্ধকতা আসে, কোনো পরাজয় নেই। কারণ সত্যকে আপাতত দাবিয়ে রাখা যায়, শেষ পর্যন্ত প্রতিহত করা সম্ভব নয়। দোয়ার হাত ও ফরিয়াদের শক্তি এ কারণেই অস্ত্রশক্তির চেয়ে অধিকতর শক্তিমান এবং সেটা এই যুগেও সমানভাবে সত্যি।
তথ্য সূএে :digantaeditorial
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন