নগরজীবনের সন্ন্যাসবাদ

লিখেছেন লিখেছেন আত্মসমর্পিত ০৭ জুন, ২০১৩, ০৫:৫০:২৩ সকাল

بسم الله الرحمن الرحيم

১) একজন আকুল পিতা তার সন্তানের কার্যক্রম বহির্ভূত অতিরিক্ত কর্মকান্ড সম্বন্ধে অভিযোগ করছিলেন। তিনি বলেন: আমার ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত সলাত পড়ে এবং তার এহেন কোন বদঅভ্যাস নেই যা আমাকে দুশ্চিন্তিত করবে। কিন্তু সে বাসায় দেরীতে ফিরে আর পারিবারিক কর্মকান্ডের দায়দায়িত্বে নিয়োজিত নয়। সে কলেজে পড়ে কিন্তু পড়াশোনা করে না বললেই চলে। বাসায় সে ইন্টারনেট চ্যাটিং এ অপরিচিত বন্ধুদের সাথে আলাপরত থাকে। তারপর ঐ পিতা বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন: সে একজন ব্যতিক্রম ধরনের সন্ন্যাসী। একজন কর্পোরেট সন্ন্যাসী।

এই ধরনের অভিযোগ আজকের দিনে অনেক পিতা আর স্ত্রীর মস্তিষ্কে প্রতিনিয়ত তাড়িত হচ্ছে। বয়স্ক ব্যক্তিদেরও ইন্টারনেট, পত্রিকা, টিভি সিরিয়াল আর খেলাধুলায় প্রবল আসক্তি। তারা পারিবারিক কর্মকান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা পরিবারের সাথে কথা বলতে ও বিস্বাদ বোধ করে; তাদের বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের স্রোতে তাড়িত হওয়ার কারনে।

২) একজন মুসলিম সক্রিয়ভাবে অনেক বিষয়ে সংযুক্ত থাকার কথা। সে গৃহে একাধারে পিতা, স্বামী আর সন্তান। সে তার প্রতিবেশীর প্রতি সাহায্যপরায়ণ। সে তার আত্মীয়স্বজনকে দেখতে যায়, এই মর্মে বার্তা পাঠানোর পরিবর্তে যে "আল্লাহ আপনাকে দ্রুত আরোগ্যতা দান করুন"। সে তার সন্তানদের বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেয়। সে তার মায়ের সাথে থাকে আর কথা বলে। তদুপরি সে সময় বের করে নেয় দ্বীন-দাওয়াহ আর দুনিয়ার জন্য। আপনি তাকে দেখবেন মাসজিদের সামনের কাতারে আর পাবেন খুবই সৎ আর সফল ব্যবসায়ীদের মধ্যে।সে আয়ও করে আর ব্যয়ও করে। সে তাহাজ্জুদের জন্য রাত জাগে আবার পরিবারের সাথে বাইরে ঘুরতেও যায়।

৩) একজন কর্পোরেট সন্ন্যাসী আলাদা কোন দূরবর্তী মঠে অবস্থান করে না বরং ব্যস্ত নগরজীবনেই তার বসবাস। সে গৃহে ফিরে আর সেখানে অবস্থানও করে কিন্তু একজন [নগদপ্রদানকারী] অতিথির ন্যায় যে তার অবস্থানের জন্য ভাড়া দেয় আর পারিবারিক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকে। সে বাসার আসবাবের ন্যায় গৃহে অবস্থান করে; ঘরোয়া কোন প্রয়োজন আর ডাকে সাড়া দেয়া ব্যতীত। প্রাচীন সন্ন্যাসীরা ধন-সম্পদের মোহ থেকে দূরে থাকলেও কর্পোরেট সন্ন্যাসীরা সম্পদ আর ক্যারিয়ার এই দুইয়ের তাড়া করে ফিরে। সে তার অধিকাংশ সময়ই হয় ভ্রমনে নয় বাহুল্য আলাপচারিতা তথা বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি অথবা বিনোদনে ব্যস্ত। একটা রিপোর্টে এসেছে, মেট্রোপলিটন নগরীতে বসবাসকারী একজন ব্যক্তি তার পরিবারকে সময় দেয় দৈনিক আধ ঘন্টা। তাদের কেউ কেউ পরিবারের সাথে কথা বলার ফুরসত পায় না। তারা যখন বাসা থেকে বেরোয় তখন তাদের সন্তানরা থাকে ঘুমে। আর তারা যখন ফিরে তখনও সন্তানরা ঘুমে।

তিন বেডের প্রশস্ত একটা বাসা, বাচ্চাদের ন্যুনতম শিক্ষা আর খাদ্যের সংস্থানের জন্য মানুষ দুনিয়ার যে দাসত্বে নিজেকে আবদ্ধ করেছে সেই উপলব্ধিটুকুর ফুরসত ও তার মেলে না। এরচেয়ে সংকীর্ণ জীবন আর কি হতে পারে? আর এহেন মানুষের উদ্ধত হওয়াও কি আত্ম-বিদ্রুপ ব্যতীত আর কি? আর এটাই হচ্ছে আধুনিক নগরজীবনের সন্ন্যাসবাদ।

৪) ইসলাম যখন একজন ব্যক্তিকে চার বিবাহের অনুমতি প্রদান করে অর্থ্যাৎ এটা আশা করে ঐ ব্যক্তি চারটি পরিবার চালানোর সমপরিমান যোগ্যতাও রাখে। এটা আরও আশা করা হয় যে ঐ ব্যক্তি যথেষ্ট পরিমান সময় আর মনোযোগ তার সকল পরিবারের প্রতি দিতে সমর্থ হবে। এর অর্থ সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তি সমাজকে দেয়ার মত সময় বের করে নিবে। ব্যস্ততা মানে এই নয় যে 'আমার হাতে সময় নেই' কিন্তু এই অর্থও হতে পারে 'আমি এই কাজ, ব্যক্তি কিংবা দায়িত্বকে প্রাধান্য দিব না...'।

ইসলামে সন্ন্যাসবাদের কোন স্থান নেই। ইসলাম মানুষকে সামাজিক জীবনযাপনেই উদ্ধুব্ধ করে। স্মরণ করা উচিত সেই হাদীসটি: "তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম যে তার পরিবারের প্রতি উত্তম"। [মুসনাদে আহমাদ]

উপরোল্লিখিত বিষয়সমূহ আধুনিক সন্ন্যাসবাদেরই রূপক চিত্র। এই বিষয়ে আরো গভীর আর প্রশস্ত কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো। এখন অনেক ধরনের সন্ন্যাসবাদ বেড়ে উঠেছে, আমাদের নবতর জীবনপদ্ধতির কারনে। যেহেতু আমাদের অনেকেই বিভিন্ন ধরনের কার্যবিধিতে জড়িয়ে পড়েছি তাই ভাল আর মন্দ যাচাইয়ে সমর্থ হই না। আমরা পরিবর্তনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে কার্পণ্যবোধ করি না। এই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে নগরজীবনের ইঁদুরদৌড়ের কারনে যেখানে সকলেই তাদের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে বিস্মৃত আর সাফল্য, বেতন, বন্ধুমহল আর বিনোদনের প্রতিযোগিতায় মত্ত।

৫) আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনুল কারীমে বলেন:

"আল্লাহ তোমাদের জন্যে তোমাদেরই শ্রেণী থেকে জোড়া পয়দা করেছেন এবং তোমাদের যুগল থেকে তোমাদেরকে পুত্র ও পৌত্রাদি দিয়েছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছেন। অতএব তারা কি মিথ্যা বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে? "[সুরা নাহল:৭২]

অথচ লোকজন ঘরের বাইরে সুখ আর শান্তি খোঁজে ফেরে। তারা শান্তি খোঁজে বিকিকিনি কেন্দ্রসমূহে, ব্যায়ামাগারে, ঘুরে বেড়ানো, বন্ধুমহলে আর যোগ-ব্যায়াম কিংবা মেডিটেশান ইত্যাদিতে।

এখন আমরা দেখি আধুনিক নগরজীবনের কিছু সন্ন্যাসকেন্দের দিকে:

সাইবার ওয়ার্ল্ড [ভার্চুয়াল রিয়েলটি]:

এটাই অনুমিত যে তরুণরা তাদের সর্বাধিক সময় ব্যয় করে সাইবার নগরীর লেনসমূহে ঘুরে। এখানে তারা বন্ধু খোঁজা থেকে শুরু করে পাত্রী খোঁজা, বিনোদন-আনন্দ আর শান্তি খোঁজে। অনেকেই এভাবে আরো বেশী একাকী হয়ে পড়ে।

ব্যায়াম আর মেডিটেশান:

যদি আমরা আমাদের গৃহে আনন্দ লাভ করতে না পারি কিংবা অন্তর্নিহিত সুখ না থাকে কিংবা গৃহে সময় কাটানোর ফুরসত না পাই তাহলে শত শত পুশ-আপস আর চেইন আপস কিংবা ঘন্টার পর ঘন্টা মেডিটেশান করে কেবল আমাদের হতাশার গিটসমুহকে দৃঢ় করবে কখনো শান্তি লাভ করা যাবে না।

বিনোদন:

মূলতঃ এই বিনোদন হচ্ছে আমাদের সাময়িক ব্যথা উপশমকারী। এটা আমাদের পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধতা কিংবা শান্তি দেয় না কেবল আমাদের ব্যথাসমূহ সাময়িকভাবে ভুলিয়ে রাখে। অধিকাংশ তরুণই মুভিতে আসক্ত আর তারা দৈনিক কমপক্ষে একটি মুভি দেখে। তারা তাদেরকে কল্পনার রাজ্যের বাসিন্দা ভাবতে শুরু করে। নিজে বিবাহ করা কিংবা পরিবার গঠনের পরিবর্তে তারা অপরের পরিবারকে পর্দায় দেখতে ভালবাসছে। তারা নিজ স্ত্রীর সাথে বৈধ আনন্দ করার পরিবর্তে অপর যুগলের রোমাঞ্চ পর্দায় দেখতে ভালবাসে। তারা বাস্তবতাবিবর্জিত কল্পনার জীবনধারন করে। আর এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে খেলাধুলা নিয়ে অতিমাত্রিক বাড়াবাড়ি। আর সাথে আছে কম্পিউটার গেমসে আসক্তি।

শিক্ষা:

অনেকেই হয়তো আতঁকে উঠেছেন। শিক্ষার আবার কি কুফল। তরুণদের এটা চিন্তা করতে বাধ্য করা হচ্ছে যে শিক্ষাই সফলতা অর্জনের একমাত্র পথ। অনেকেই তাদের বইপুস্তকে এতই নিমজ্জিত যে তাদের তারুণ্যের বড় একটা অংশ বিবিধ অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি দ্বারা আবদ্ধ থাকে। তদুপরি ধর্মনিরপেক্ষ, নৈতিকতা বিবর্জিত সহশিক্ষার কথা নাই বা বললাম। আর পরীক্ষার অজুহাত আর পড়াশুনার অজুহাতে তরুণরা লিপ্ত হচ্ছে না এমন অপরাধ কমই আছে। এটা স্বেচ্ছাচারিতার একটা দ্বার। তথাপি এই ধরনের পড়াশুনা তাদেরকে পরিবার ও সমাজবিচ্ছিন্ন ও করছে; আর আধুনিক সন্ন্যাসবাদের উপকরণে পরিণত করছে।

এই তালিকা চাইলেই অনেক দীর্ঘায়িত করা যায়; আপনার ব্যক্তিগত উপলব্ধিতেই তা ধরা পড়বে। আমাদের দেখতে হবে আমরা কি এই সকল সন্ন্যাসবাদের কোনটিতে জড়িয়ে পড়েছি কিনা। যদি জড়িয়ে পড়েন তবে আজি পদত্যাগপত্র জমা দিন আর বাস্তবতার নিকটবর্তী জীবনে নিজেকে সংযুক্ত করুন; সত্যিকারের জীবন।

আল্লাহ্ তা'আলা আমাদের দুনিয়া আর আখিরাতে কল্যান দান করুন। আমীন।

[মূল ধারনা: নিসার নাদিয়াওয়ালা, বক্তা-পিস টিভি]

বিষয়: বিবিধ

১৫৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File