মাতাল এক স্বপ্নঘুড়ির ভোকাট্টা
লিখেছেন লিখেছেন আহসান সাদী ২৯ মার্চ, ২০১৩, ০৬:১৪:৩৩ সকাল
এক.
সকালে ঘর পরিষ্কার করার সময় হঠাৎ প্রায় বছরখানেক পুরনো পত্রিকার একটা খবরে চোখ আটকে গেলো। স্কটল্যান্ডের কলিন উইয়ার আর তাঁর স্ত্রী 'ইউরোমিলিয়নস' নামের একটা লটারী জিতেছেন যার মূল্যমান ১৬২ মিলিয়ন পাউন্ড। খবরটার আদ্যোপান্ত পড়লাম। মাত্র দুই পাউন্ড মূল্যের টিকিট কেটে ওই দম্পতি পেয়ে গেছেন ১৬২ মিলিয়ন পাউন্ড, বাংলাদেশী টাকায় যা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। স্কটল্যান্ডের মোটামুটি দরিদ্র এই দম্পতি একলাফে তাই উঠে গেলেন যুক্তরাজ্যের ধনীদের তালিকার ৪৩০তম অবস্থানে এবং সে সময় ফুটবলার ডেভিড বেকহ্যামের সম্পদের পরিমান ছিলো প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড!
যদি আমি হঠাৎ করে দুই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যাই তখন অত টাকা দিয়ে কী করবো, এমন একটা চিন্তা ঘুরতে লাগলো মাথার ভেতর। আফিসে গিয়ে প্রশ্ন করলাম আমার এক সহকর্মীকে,
- ভাই, হঠাৎ করে দুই হাজার কোটি টাকা পেয়ে গেলে কি করবেন আপনি?
- এটা কেমন কথা? অত টাকা পাবো কই?
- ধরেন পেয়ে গেলেন কোনোভাবে। কী করবেন তখন এটা বলেন, ভেবে-চিন্তে বলেন।
- ভাই আমার অত কিছু চিন্তা করার প্রয়োজন নাই। দুই হাজার কোটি টাকারও দরকার নাই, যদি এক কোটি টাকাও পাই তবে সিঙ্গাপুর যাবো। ছোট ছেলেটাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা নেবো। মাউন্ট এলিজাবেথে চিকিৎসা করাতে পারলে একটা সুযোগ হয়তো পাওয়া যাবে।
আমার এই সহকর্মীর চার বছর বয়সী ছেলেটার একটা কঠিন রোগ আছে। প্রতিমাসে তাকে রক্ত নিতে হয়। ছোট্ট শরীরটিতে নাকি নতুন রক্তের উৎপাদন হয় না। এভাবে ছেলেটাকে খুব বেশীদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না,ডাক্তার এরকমই বলে দিয়েছেন।
প্রশ্ন করলাম আফিস পিওন সুশান্তকে। তার উত্তরটা,
- আমি মনে হয় হার্টফেল করে ফেলবো স্যার।
উত্তর দেয়ার পর সে বিশাল চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলো। মোটামুটি সারাটা দিনই তার মাথায় দুই হাজার কোটি টাকার বিষয়টা ঘুরঘুর করতে থাকলো। বিকেলে এই বিষয়ে আরো কিছুক্ষণ আলাপ করতে চাইছিলো, ব্যস্ততার কারণে আর আলাপ এগোয়নি।
বেশ অনেকদিন আগে প্রায় এই ধরণের একটা প্রশ্ন করেছিলাম আমার ছোটবোনকে। সে তখন সম্ভবত স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি অথবা প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। আজকে ইউনিভার্সিটি জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো আমার ছোট বোনটির তখনকার সুচিন্তিত উত্তর,
- এক প্যাকেট মিমি চকোলেট কিনবো।
- আরো চিন্তা করে বল্। তোর কাছে কয়েক বস্তা ভর্তি শুধু টাকা। একটা মিমি চকোলেটের দাম তো মাত্র সাত টাকা।
- তাহলে আমি এক বক্স মিমি চকোলেট কিনবো।
- তাও তো মাত্র অল্প কয়টা টাকা লাগবে।
তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে অল্পের পরিমানটা দেখালাম। ছোটবোন এবার দুই হাত প্রসারিত করে বললো,
- তাহলে আমি এত্তটা মিমি চকোলেটের বক্স কিনবো। কিনে এনে ফ্রিজে রেখে দেবো।
অনেকগুলো মিমি চকোলেটের বক্স কিনতে পারার কল্পনায় অথবা তার সম্ভাবনায় আমার বোনের চোখ চিকচিক করছিলো আর বড়জোর ফুটতিনেক প্রসারিত ছোট্ট দুটি হাত বিশাল একটা পরিমাণ প্রকাশের সাথে সাথে একটা রেফ্রিজারেটরের প্রয়োজনীয়তাও প্রকাশ করছিলো। তার স্বপ্ন দেখার সেই শ্রেষ্ঠ সময়টাতে ইদানীংকালে নিম্নমধ্যবিত্তেরও মৌলিক চাহিদা হয়ে ওঠা একটা রেফ্রিজারেটর এবং অন্য অনেকগুলো নিত্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (যেমন টেলিভিশন) আমাদের বাসায় তখন ছিলো না।
দুই.
আমার বিশ্বভ্রমণের ইচ্ছে সেই ছোটবেলা থেকে। নানান দেশের নানান মানুষ, নানান সমাজ আর একেক দেশের আলাদা আলাদা সৌন্দর্যের মাঝে একজন পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়ানোর অদম্য ইচ্ছেটাকে পাথরচাপা দিয়ে বেশ সুখী হিসেবে বেঁচে থাকার চেষ্টা শৈশব থেকেই চর্চা করে আসছি। মাঝে মাঝে তাই কল্পনায় দেখি আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি দেশ থেকে দেশান্তরে, মগ্ন হয়ে গেছি নানান দেশের খাবার-দাবার চেখে দেখায়, মানুষের জীবন বৈচিত্রে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বিভিন্ন শহর-নগরের ব্যস্ততায়। মিশরের পিরামিডের পাশে, কায়রোর রাস্তায়, নীল নদের তীরে, ফোর হুইলার নিয়ে সাহারা মরুভূমিতে, নাইরোবির আনাচে-কানাচে, ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত আর জুলুল্যান্ডে, জোহানেসবার্গ- কেপটাউনে, মরিশাসের সাগরতীরে ঘুরে বেড়াই প্রতিনিয়ত, যখন ইচ্ছে হয় তখন। শুধুই কল্পনায়।
হঠাৎ কোথাও ঘুরতে যাবার প্রচন্ড ইচ্ছে হয় যখন, আধশোয়া হয়ে চোখদুটো আলতোভাবে বন্ধ করে রওনা দেই সেখানে। এভাবে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি বুয়েন্স আয়েরস, স্যন্টিয়েগো, আমাজন, রিও ডি জেনেইরো, আন্দিজ পর্বতমালা, পেরুর মাচুপিচ্চু, ক্যরিবীয়ান দ্বীপমালা, মেক্সিকো, কাউবয়দের মত ঘোড়ায় চড়ে টেক্সাসের মরুভূমি, গ্রান্ড ক্যনিয়ন, মন্ট্যানার পাহাড়, লস অ্যন্জেলেস, শিকাগো, ফ্লোরিডা, নিউ ইয়র্ক, ডিজনিল্যান্ড, বোস্টন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় নায়েগ্রা প্রপাত, মন্ট্রিল, আটোয়া ইত্যাদি। এভাবে কল্পনায় ঘুরতে ঘুরতে কেন যেনো মনে হতে থাকে আমি বুঝি সত্যি সত্যি চলে গেছি ওসব জায়গায়।
আমার বিশ্বভ্রমণ চলতেই থাকে। কখনো আমি ঢুকে পড়ি ইউরোপে। ম্যনচেস্টার, লিভারপুল, ডেভন হয়ে লন্ডন, তারপর যাই প্যরিস। টিভিতে দেখা প্যারিস আর অন্নদশংকর থেকে সুনীলের লেখা প্যারিসের উপর বিভিন্ন বই থেকে পাওয়া দৃশ্যকল্প ভেসে আসে আমার কল্পনায়। আমিও ঘুরতে থাকি নিশ্চিন্তে। প্যারিস কল্পনাতেও কিভাবে যেনো আমার ভালো লেগে যায়। লুক্সেমবার্গ, মোনাকো, রোম, ভিয়েনা, সিসিলি, আল্পস পর্বতমালা, মাদ্রিদ, বার্লিন, জিব্রালটার প্রণালী আমস্টার্ডাম হয়ে ঢুকে পড়ি ইস্তানবুল। ডেড সী, ভূমধ্যসাগর আর আরব মরুভূমি যেনো আমার কল্পনায় রঙ লাগায়। আমি ঘুরে বেড়াই মক্কায়, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্মৃতিবিজড়িত হেরা গুহায়, কাবা'য়, মদিনায় আয়েশা (রাঃ)'র ঘরে যেখানে রয়েছে রাসূল (সাঃ) এর কবর। আমি ঘুরি তায়েফে, পাহাড়-পর্বতের দেশ তায়েফ, সেখান থেকে শারজা, দুবাই, কাতার, পুরোটা এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিণ মেরু।
সত্যিকারের ভ্রমণের মতো তো আর নয়, তবুও কল্পনায় ওসব ভ্রমণ থেকে পাওয়া আনন্দ আমার কম না মোটেও। বাস্তবে যেহেতু ঘুরতে পারছি না, কল্পনা ছাড়া আমার আর কী গতি!
তিন.
আমার বিশ্বনাগরিক হবার যেই আস্ফালন মনের গভীরে ঝড় তুলে তা মেটানোর জন্য ভ্রমণ বিষয়ে লেখা বই পড়তে থাকি আর পটুয়া হয়ে মনের ক্যানভাসে পৃথিবীটাকে সাজাই। বড় সুন্দর সেই পৃথিবীটা। পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ যেমন আমার খুব প্রিয়, পৃথিবীর সকল ভ্রমণ সাহিত্যিকও আমার প্রিয়। তাদের চোখেই তো আমি এখন পর্যন্ত প্রায় পুরো পৃথিবীতে চষে বেড়িয়েছি। একেক জায়গা একেক লেখকের চোখে একেক ধরনের বৈচিত্রে অবলোকন করা যায়। যখন সত্যি সত্যি এমন কোনো জায়গায় আমি উপস্থিত হই যে জায়গা সম্পর্কে আমি আগেই বিভিন্নজনের লেখা কিছু ভ্রমণ কাহিনী পড়ে ফেলেছি, তখন বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করি আমার মাঝে অনেকগুলো চোখের অস্তিত্ব। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমি স্থানটাকে দেখতে পাই। জায়গাটা একেক লেখকের চোখে একেকভাবে যে দেখেছি আমি আগেই, তাদের বইয়ের মাধ্যমে।
দুই হাজার কোটি টাকার আসলে প্রয়োজন নেই, আমার এইসব কল্পনার কিছুটাও যদি ঘুরতে পারি তবেই স্বপ্নগুলো সত্যি হয়েছে বলে ধরে নেবো। উইয়ার দম্পতির দুই হাজার কোটি টাকার প্রাপ্তি আমার মনে প্রথমেই এসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো। পৃথিবীতে এমন অনেক সৌভাগ্যবান রয়েছেন যারা যাপন করছেন আমার কল্পনার সেই রঙিন জীবন। এরকম অসাধারণ জীবন কাটানোর ক্ষমতা থাকার পরেও এমনকি 'চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া'ও ঘুরতে নারাজ অনেকেই আছেন। সুযোগ থাকার পরেও কারো কারো এমন স্থিতি আমার মতো বিত্তহীনের বহুকষ্টে এবং প্রায়শই হুট করে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার মাঝে কোনোরকমে টিকে থাকা ভ্রমণপিপাসু চিত্তের পক্ষে ক্ষমার অযোগ্য রুচিসংকট অথবা নির্বোধের বিলাস বলে ভ্রম হয়।
বিষয়: সাহিত্য
১২০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন