ভ্যাগাবন্ডের চশমা
লিখেছেন লিখেছেন আহসান সাদী ০২ জুন, ২০১৪, ০৭:২৬:৫৫ সকাল
আমরা তিনজন বসা ছিলাম স্ট্রাটফোর্ড স্টেশনের সামনে। লন্ডনের খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যাস্ত একটি স্টেশন। গতবছরের গ্রীষ্মের ঘটনা এটি। এই টেশনের সামনে আমাদের বাংলাদেশের মতো নানান উটকো ঝামেলা আপনাকে বিরক্ত করবেই। কিছু নামুনা দেয়া উচিত।
১. ফকির (অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তবে বেশীরভাগই নেশাখোর)।
২. নানান কিসিমের চ্যারিটির লোকজন (চাঁদাবাজীর বেশ কাছাকাছিই বলা যায়, আপনার যত ব্যস্ততাই থাকুক তারা আপনাকে আটকে মোটামুটি কনভিন্স করে ফেলতে চাইবে। উত্তম পন্থা হলো খুবই উদাসীনভাবে অথবা ব্যাস্ত ভাব নিয়ে স্রেফ এড়িয়ে চলা)।
৩. বাইবেলের বাণী প্রচার করতে থাকা কিছু লোকজন (একটা লোকের গলার রগ ফুলিয়ে 'গড ইজ গ্রেট, গড ইজ গ্রেট' বলে চিৎকার করাটা আমার মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে)।
৪. লিফলেট বাহিনী (কতশত ধরণের লিফলেট যে বিলি হয় এখানে! জব, ইমিগ্রেশন কনসালটেন্সি, বাড়ী ভাড়া, ক্রেডিট কার্ড, রেস্টুরেন্টের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি)।
৫. ভ্যাগাবন্ড (এই শ্রেণীটা বেশ ইন্টারেস্টিং। এদের কেউ কেউ এসে গায়ে পড়ে কথা বলতে চাইবে, কেউ কেউ আবার খুবই চুপচাপ। আশাপাশের পৃথিবীর অস্তিত্বটা তাদের কাছে কোনো আগ্রহের বিষয় না। এদের সবার মধ্যে একটা বিষয় কমন, চোখের মধ্যে গভীর উদাসীনতা। তারা জীবনটা টেনে নিয়ে যেতে যেতে বেশ ক্লান্ত যেনো)।
শেষ শ্রেণীর প্রতিনিধি, হাসিখুশি দিলখোলা বৃটিশ সাদা এক মোটামুটি বৃদ্ধ লোক সেদিন আমাদের কাছে আসলো। জানতে চাইলো আমাদের কাছে লাইটার আছে কি না। আমরা না বলার পর চলে যাবে সেই সময় হিন্দিতে কী জানি বললো। সে ভেবেছে আমরা হয়তো ভারতীয়। আমি তাকে পেছন ফিরে ডাকলাম। বললাম 'তুমি কি হিন্দিতে কিছু বলেছো'? সে বললো 'হ্যাঁ'। জানতে চাইলাম তুমি হিন্দি জানো কীভাবে। সে বললো 'সিনেমা। আমি অমিতাভ বচ্চন, হেমা মালিনী, ধর্মেন্দ্র এদের কাছ থেকে শিখেছি'। এই কথা বলার সাথে সাথেই একটা পরিষ্কার হিন্দি বাক্যও সে বলে ফেললো এবং জানালো এটা 'শোলে' ছবির একটি ডায়ালগ। আমরা লোকটির কথায় আশ্চর্য হয়ে গেলাম। লোকটি জানালো সে নাকি একটা সময় প্রচুর হিন্দি সিনেমা দেখতো। অবাক হয়েই কি না, আমার বন্ধু বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলো, 'তুমি রাজ্জাক কে চেনো না'? আমি দিলাম ধমক। বললাম 'ভারতীয় অভিনেতাকে এভাবে চিনে ফেলেছে বলে কী রাজ্জাককেও চিনে ফেলবে নাকি, কী বোকার মতো প্রশ্ন!' আমাদের কথা শুনে লোকটি বললো 'রাজ্জাক, আমি ওকে চিনি'। আমি বললাম, 'তুমি কোন রাজ্জাকের কথা বলছো'? সে সাথে সাথে বলে উঠলো, 'রাজ্জাক, শাবানা, ববিতা... আমি সব চিনি'। আমাদের এবারে মুখ হা হয়ে যাবার পালা।
ঘটনাটা অনেককেই বলেছি। শ্রোতাদের অনেকে বেশ আপ্লুত হয়েছেন এবং রাজ্জাক-শাবানার মহান কর্মজীবনের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধাও অনুভব করেছেন। একটা আফসোসও ছিলো কমন, সেটা হলো, 'আজ আর বাংলা সিনেমার সেই দিনগুলো নেই'।
আরো বহুদিন পর হয়তো কোনো এক ভিনদেশী ভ্যাগাবন্ড বাংলাদেশের আওয়ামীলীগ-বিএনপি, হাস্যকর মন্ত্রীবৃন্দ এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বুদ্ধিজীবিদের স্মৃতিচারণ করবে। শ্রোতাগণ পরম শ্রদ্ধায় তাদের মহান কার্যকলাপের কথা মনে করে আফসোস করবেন। বলবেন, 'আজ আর বাংলাদেশের সেই দিনগুলো নেই'। সময়ের আবর্তে এরাই হয়ে উঠবেন নায়ক। মানুষও সব ভুলে এদেরকেই মাথায় তুলে রাখবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে বুঝিয়ে ফেলা হবে, এরাই ছিলো সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান, এরাই ছিলো নায়ক। তোমরা এদের নিয়ে গর্ব করো।
আমাদের দেশে মুসা ইব্রাহিমের পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে যাওয়াকে বিশাল সাফল্য হিসেবে মানা হয় (আমি ধরে নিলাম ফটোশপে নয়, উনি বাস্তবেই এই কর্ম সম্পাদন করেছেন)। স্কুলের পাঠ্যবইয়েও এটা অন্তর্ভুক্ত করা হলো। নতুন নায়ক তৈরী করা হলো।
কত না চমৎকার হতো যদি কেউ আমাদের চিনতে পারতো শরীয়তউল্লাহ বা তিতুমীরের দেশের লোক বলে। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বা জামাল নজরুল ইসলামের দেশের লোক বলে। অন্যেরা চিনবে কেনো, আমরা যে নিজেরাই এদেরকে চিনি না!
সারমর্মঃ আমরা একটা সময় রাজ্জাক-শাবানা নিয়ে নাচানাচি করে এদেরকে ভিনদেশী ভ্যাগাবন্ডের কাছে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছি। বর্তমান সময়ের মাথামোটা বুদ্ধিজীবি এবং পুতুল নায়কেদের নিয়ে আজ আমরা নাচানাচি করছি এবং এদেরকেও আমরা একটা উচ্চতায় তুলে ফেলবো। আমরা মনে হয় কখনোই রিয়েল হিরোদের রাস্তাটা দেখবো না। পড়ে রইবো সেখানেই যেখানে রয়ে গেছি হাজার বছর ধরে।
বিষয়: বিবিধ
১০৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন