প্রজন্মঃ আবেগীয় বিবর্তনের পান্ডুলিপি

লিখেছেন লিখেছেন আহসান সাদী ১১ নভেম্বর, ২০১৩, ১১:৩৫:২১ রাত

১.

খুব বেশীদিন আগের কথা না। আকাশী নীলের স্কুল ইউনিফর্ম পরে ক্লাস ওয়ানের ছোট্ট মেয়েটা তার ভাইয়ের সাথে স্কুল থেকে বের হলো। স্কুলের সামনে তিনটা দোকান আছে, দৈনন্দিন এটা-সেটা পাওয়া যায় দোকানগুলোয়। পিচ্চি মেয়েটা প্লাস্টিকের একটা খেলনা রেডিও কিনবে। দিন'দুই আগের পরিকল্পনা। মেয়েটির ছোট্ট হাতে একটা চকচকে পাঁচ টাকার নোট। খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে নোটটা। দোকানদারের কাছে খেলনাটা চাইলো। প্লাস্টিকের একটা সস্তা খেলনা, দেখতে রেডিওর মতো। সময়টা মোবাইল ফোনের যুগ ছিলো না তাই খেলনা আইফোন বাজারে পাওয়ার কথা না, খেলনা রেডিওটা তাই একটা ক্লাস ওয়ান পড়ুয়া মেয়ের কাছে তখন যথেষ্ট আকর্ষণীয় কিছুই ছিলো। দোকানদারের মুখটা ছিলো হাসিহাসি। খেলনা রেডিও হাতে পেয়ে মেয়েটি দাম জানতে চাইলো। দোকানদার ভদ্রলোক হাসিমুখে জবাব দিলেন, 'এটার দাম তিন টাকা'। মেয়েটি গেলো ঘাবড়ে। তার হাতে আছে পাঁচ টাকার নোট, দোকানদার চাইলো তিন টাকা! এখন কী উপায়! ছোট্ট মেয়েটা কেবল এটুকুই বুঝতে পারছে, পাঁচ আর তিন সংখ্যা দুটো সমান নয়। এবার তাহলে রেডিওটা কেনা হবে কীভাবে! মেয়েটি দোকানদারকে অনুনয় করে বললো, 'আপনি পাঁচ টাকা রেখে দেন না'।

ঘটনাটা আমার সামনে ঘটেছিলো। সেই যখন স্কুলে পড়তাম, তখন। মেয়েটি আমার ছোটবোন। আমি তার কয়েক ক্লাস উপরে পড়তাম। স্কুল থেকে একসাথেই ফিরতাম আমরা। আমি এবং আমার ছোট দুই বোন। বাসায় ফিরে দুই-তিন টাকা দামের সস্তা প্লাস্টিকের খেলনাগুলো নিয়ে খেলতে বসতাম আমরা তিনজন। প্লাস্টিকের সস্তা খেলনা আর ছোট দুই বোনের সাথে রান্নাবাটি খেলা আমার সোনালী শৈশবের একটা উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। খেলনা রেডিওর ঘটনাটা ছিলো সেই সোনালী দিনের কয়েকটা মুহূর্ত। আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে যেনো এই সেদিনের ঘটনা। হাত বাড়ালেই ধরতে পারা যায় এমন কাছের কোনো অতীত যেনো।

সময় থেমে থাকেনি। প্লাস্টিকের রেডিওর সেই ঘটনাটা আজ থেকে অনেক অনেক দূরে। আজ সেই ছোট্ট মেয়েটা অনেক বড়। আজ সে একটা ফুটফুটে মেয়ের মা। সন্তান ভুমিষ্ঠ হবার আগের দিন ফোনে আলাপ হয়েছিলো। আমার বোন জানালো সে ভীত নয়। আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সে সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে। সন্তান জন্ম দেয়ার সময় যদি মারাও যায় তবুও সে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর সন্তুষ্ট। বোকা শৈশবে তিন টাকা দাম শুনে ঘবড়ে যাওয়া সেই ছোট্ট মেয়েটা হঠাৎ করে আজ কেমন শক্ত আর সাহসী হয়ে উঠেছে! আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আল্লাহ তাকে আর তার সন্তানকে হেফাজত করুন।

২.

সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তার জগৎটা দখল করে নেয় হাজারো জটিলতা, হাজারো প্রয়োজন আর হাজারো দায়িত্ব। প্রবাসের কঠিন দিনগুলোতে ইদানীং প্রায়ই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে কাটানো আমার শৈশবের সহজ-সরল জীবন আর সহজিয়া চিন্তাভাবনাগুলোকে খুব অনুভব করি। আমি মনে করি জীবনকে সাজাতে প্রয়োজন কেবল সহজ একটা 'লাইফস্টাইল' আর খুব সহজ-সরল চিন্তাভাবনার। আমার ছোটবোনের মা হওয়াটা আমার চিন্তার অনেকগুলো জানালা খুলে দিয়েছে যেনো। সেই সাথে খুলে দিয়েছে কিছু কোমল অনুভূতির দরজাও।

বয়সের ব্যাবধান খুব বেশী ছিলো না। আমার ছোটবোনের শৈশবটা আমি এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই। যখনই স্মৃতিতে তার শৈশবটা দেখি মনে হয় আরো কত আদর করা বাকী রয়ে গেছে তাকে। মনে হয় এইতো সেদিন কারও ওপর রাগ করে গাল ফুলিয়ে বসে আছে, আমি তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছি। তার রাগ আরও বাড়ছে। উচিত ছিলো তখন তাকে একটু আদর করা। আমি নিজেও যে তখন শৈশব পার করছি। অতটুকু বোঝার বয়স তো আমার হয়নি তখনও। উপস্থিত সময়ে কেবল তাকে আরো ক্ষেপানোতেই কৃতিত্ব অনুভব করতাম। বোনের সাথে আমার যুগল স্মৃতিটা তাই কেবল একসাথে খেলাধুলা, গল্প করা, হাসি-কান্না, রাগ-অভিমান আর বেশকিছু ঝগড়াঝাটিতে পূর্ণ একটা পান্ডুলিপি যেনো। সেখানে আদর, মমতা, স্নেহ, প্রশ্রয়, আশ্রয় ইত্যাদি বিষয়গুলো মনে হয় একটু কমই ছিলো। তার সাথে আমার বয়সের ব্যাবধান কম হবার কারণেই হয়তো চাওয়া-পাওয়া বিষয়ক অনুভূতিগুলোর আধিক্য ছিলো। এখন যখন শৈশবের একেকটা ঘটনা মনে পড়ে তখন মনে হয় আরো কত বেশী আদর তার প্রাপ্য ছিলো, আরো কতো বেশী স্নেহ তাকে করা যেতো, আরো কতো কান্না তার মুছে দেয়া যেতো! চাইলেই আমি এখন আর সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারবো না। বাকী রয়ে যাওয়া আদরগুলো আর করতে পারবো না।

ফোনে যখন আমার বোনের নবজাতক সন্তানের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম তখন মনে হলো আমি একটা দারুন সুযোগ পেয়ে গেছি। শৈশব জুড়ে ছোটবোনের প্রতি বাকী রয়ে যাওয়া আদরগুলো পুষিয়ে দেয়ার একটা দারুন সুযোগ। নবজাতক এই মেয়েটির মাঝেই তো আমি আমার বড় হয়ে যাওয়া বোনের সেই বোকা শৈশবকে ফিরে পেতে পারি। এই নবজাতকের জন্মের দিনটা থেকেই তাই আমি অপেক্ষা করে আছি। আমার অনেকদিনের বয়ে বেড়ানো আদরের বোঝাটা নামিয়ে দেয়ার অপেক্ষা। মনকে কিছুটা হালকা করার অপেক্ষা। মনের ভেতরে জমা হয়ে থাকা স্নেহ, মমতা, প্রশ্রয়, আশ্রয় ইত্যাদি সবকিছুতে এই শিশুটিকে একদম ভরিয়ে দিয়ে নিজে একটু হালকা হতে চাই এখন। আল্লাহ আমার অপেক্ষাটা সহজ করে দিন।

৩.

মানুষের সম্পর্কগুলোর তীব্রতা পরিমাপ করা সম্ভবত সম্ভব না। অনেক আগে আমি আমার মায়ের কাছে জানতে চাইতাম, কে উনার কাছে বেশী প্রিয়, আমি, নাকি উনার মা। আমি খুব চিন্তা করতাম এই বিষয়ে। আমার মা মাঝখানে, তার একপাশে আমার নানী, একপাশে আমি। কে আমার মায়ের কাছে বেশী প্রিয়? আমি কোনো জবাব পেতাম না। মায়ের কাছে প্রশ্নটা করার পর তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলেন নি। তবে আমার বুদ্ধিমতী মা উত্তরের অনিশ্চয়তার সাথে একটা অনুসিদ্ধান্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, '...আমি শুনেছি মায়ার গতি নিম্নমুখী'। আমার নানীর কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, 'কে বেশী প্রিয়, আপনার মেয়ে নাকি আপনার নাতি'? আমার সহজ-সরল নানীর সোজাসাপ্টা উত্তর ছিলো, 'আমার কাছে সবাই সমান'!

আমার বোনের সন্তান জন্ম নেয়ার পর আমার মায়ের সাথে ফোনে আলাপ করছিলাম। আমার মা আমার বোনের সাথেই ছিলেন, ঢাকার একটি ক্লিনিকে। ফোন দেয়ার উদ্দেশ্য ছিলো নবজাতক আর আমার বোনের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নেয়া। মায়ের সাথে আলাপ করেই বুঝলাম উনি খুব ক্লান্ত। সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করতে হয়েছে অনেকবার। রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। আমার প্রশ্নগুলো নিমিষেই বদলে গেলো। আমি আমার মায়ের বিস্তারিত জানতে শুরু করে দিলাম। ঘুম হয়েছে কি না, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কি না ইত্যাদি। একটু আশ্বস্ত হতেই জানতে চাইলাম বোনের ব্যাপারে। সে এখন ঘুমে, ডাক্তার আসবে একটু পরেই। ভালো আছে, জানলাম। তারপর আমি জানতে চাইলাম নবজাতক সন্তানের ব্যপারে।

আমার উদ্বেগ বা আগ্রহের ক্রমটা পাল্টে গেলো কীভাবে তার কিছুটা আমি মনে হয় বুঝতে পারছি। তবু অনেক বিষয় এখনও আমার কাছে পরিষ্কার না। বেশী পরিষ্কার হবার কোনো প্রয়োজনও নেই অবশ্য।

এসব বিষয় মাথায় এলেই শ্রদ্ধেয় এনাম আংকেলের একটা কথা খুব বেশী মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, 'মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাগুলো মানুষের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার একেকটা সাবসেট'। কথাটা হাজারো প্রশ্নের বড় জুৎসই একটা জবাব যেনো।

বিষয়: বিবিধ

১৩৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File