লন্ডন টুকিটাকি (২) (আর বলার কিছু ছিলো না)

লিখেছেন লিখেছেন আহসান সাদী ০৪ নভেম্বর, ২০১৩, ০৫:০৫:৪১ সকাল

১.

সেদিন এক লোক, আমার বয়সী হবে হয়তো, 'are you free brov' বলতেই তার দিকে চোখ তুলে তাকালাম। এখানে 'brov' এর জায়গায় 'mate' বেশী চলে। হঠাৎ করে কেউ 'brov' (brother এর অতি সংক্ষেপ কথ্য রূপ) বলাতে একটু অন্যরকম লাগলো। তাকিয়ে দেখি এক দাড়িওয়ালা ছেলে। কাছে এসে সালাম দিলো। আমি বুঝে নিলাম তার 'brov' বলে সম্বোধনের কারণটা। তার শার্টের মধ্যে একটা ব্যাজ লাগানো। সেখানে লেখা 'Free Palestine'। জিজ্ঞেস করলাম 'তুমি কি ফিলিস্তিনি'? সে বললো, ' আমি আলজেরিয়ান'।

- 'এই ব্যাজ কোথায় পেলে?

- বিশ্বাস করবে না ব্রাভ, এক সাদা লোক এটা পরে হাটছিলো। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম কোথায় পেলে এটা। সে বললো তুমি চাও নাকি? আমি বললাম, আছে নাকি? সে পকেট থেকে আমাকে বের করে দিলো এই ব্যাজ।

আমি বললাম,

- ওয়াও!

আমি যেখানে পার্টটাইম কাজ করি, সেখানে হরেক দেশের মানুষজনের দেখা পাওয়া যায়। যতটা পারি আলাপ করার চেষ্টা করি। আমার ভালোই লাগে। সেই ছেলেটার সাথে বেশ অনেকক্ষণ আলাপ করলাম। জানতে চাইলাম, 'আলজেরিয়ার ভাষা তো আরবী, তো সেই আরবীটা কি গালফের আরবীর চাইতে আলাদা নাকি'। সে বললো 'উচ্চারণে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও ভাষা একই'। তারপর কথার প্রসঙ্গ ধরে সে আরো কিছু অসাধারণ কথা মোটামুটি একশ্বাসে বলে গেলো। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকলাম। সে যা বললো তা মোটামুটি এরকম,

''দেখো ভাই কত লজ্জার একটা বিষয়, আমাদের ভাষা এক, আদর্শ এক, উদ্দেশ্য এক কিন্তু আমরা 'ইউনাইটেড' নই। অথচ ইউরোপিয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্য না আছে ভাষার মিল, না আছে আদর্শগত মিল, বরং তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করেই কাটিয়ে এসেছে এতকাল, কেবল অর্থনৈতিক ফায়দার জন্যেই আজ তারা 'ইউনাইটেড'। কত বড় লজ্জা আমাদের। আমরা মুসলিম হয়েও 'ইউনাইটেড' নই।''

তার কথাগুলো মাথায় ঢুকে গেলো। বড় করুণ এক সত্য এক ঝটকায় বলে গেলো ছেলেটা!

জানতে চাইলো আমার দেশ কোনটা। বললাম, 'বাংলাদেশ, চেনো নাকি'?

সে সাথে সাথেই বলে উঠলো, 'কিতা খবর ভাই, বালা নি। আমি বাংলা মাততাম ফারি'। এবার আমি আরেকদফা অবাক হলাম। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে লন্ডনে অনেক বিদেশী মানুষজন বাংলা টুকটাক শেখার চেষ্টা করে থাকে এবং তারা অনেকে জানেও না যে তারা যা শিখেছে এটা বাংলা নয়, নিখাঁদ সিলেটি। আমি মুগ্ধ কন্ঠে জানতে চাইলাম, 'তুমি কীভাবে এমনটা বলতে পারলে'। সে জানালো, ' আমি হোয়াইট চ্যাপেলে চার বছর ছিলাম'। এটা শুনে আমিও বুঝে গেলাম কেনো সে বাংলা (আসলে সিলেটি) বলতে পারে। কেউ যদি সিলেটি ভাষাকে হোয়াইট চ্যাপেল বা আশপাশ এলাকার প্রধান ভাষা হিসেবে বলে ফেলে তবে সেই কথাটা একটুও ভুল হবার কথা নয়।

সেই ছেলেটার প্রায় নিখুঁত উচ্চারণের সিলেটি শুনে আমি একচোট প্রশংসা করে দিলাম। প্রশংসায় গদগদ হয়ে সে আমাকে আরেকটা সম্পূর্ণ বাক্য শুনিয়ে দিলো এবং অবশ্যই তা সিলেটি ভাষায়, 'আমি বিয়া খরতাম ভাইসাব' (আমি বিয়ে করতে চাই ভাইজান)। আমি বললাম, 'কথাটার মানে তুমি জানো'? তার ঝটপট উত্তর 'I wanna get married এবং আমি শিগগিরই বিয়ে করতে যাচ্ছি'! অকপটে ঘোষনাটা দিলো নাম না জানা সেই আলজেরীয় ছেলেটা।

আমার আর কিছু বলার ছিলো না!

২.

বেশ ক'দিন আগে একটা ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সেটা ছিলো এমন,

পার্টটাইম কাজ করি। গতকাল কাজের ফাঁকে হঠাৎ করে কীভাবে জানি আমার প্যান্টটা ছিঁড়ে গেলো। বড় বেকায়দা অবস্থা। যাইহোক, কাজ শেষে সুপারভাইজার ড্যানিয়েলের সাথে গল্প করছিলাম। একপর্যায়ে তাকে আমার প্যান্ট ছিঁড়ে যাবার ঘটনাটা বললাম। বলতে গিয়েই ঠিক জায়গামতো এসে আবিষ্কার করলাম 'ছিঁড়ে যাওয়া' এই কথাটার ইংরেজী আমি জানি না। কথাটা তাই ছিলো অনেকটা এমন, 'তুমি কি জানো ড্যনিয়েল, আজ কী হয়েছে! আমি কাজ করছিলাম এবং হঠাৎ করেই আমার ট্রাউজার্স...' এই বলেই আমি আবিষ্কার করলাম ছিঁড়ে যাওয়া কথাটা আমার ভোকাবোলারিতে নেই। ঠিক সেই মুহুর্তে কাছাকাছি কিছু একটা বলে এবং সেই সাথে হাতের ইশারার মিশেলে ছিঁড়ে যাওয়া পরিস্থিতিটা সামলাতে পেরেছিলাম।

প্যান্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় যেমন বেকায়দায় পড়েছিলাম, সেই ঘটনাটা বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও খুব একটা কম বেকায়দায় পড়িনি।

প্রাসঙ্গিক কথা: এযাবৎ আমার পরিধেয় বস্ত্রসমূহের মধ্যে বিশ্বস্ততার মাপকাঠিতে লুঙ্গির অবস্থান সবার উপরে!


যাইহোক, লুঙ্গির বিষয়টা যখন এসেই গেলো, তখন একটা ঘটনা লিখে ফেলা যায়।

সেদিন রাতে বাসায় অলস সময় কাটাচ্ছিলাম। আমার এক বন্ধু বাসায় এসেছে দেখা করতে। আমি শুয়ে শুয়ে গল্প করছিলাম। বন্ধুটি আমার এক ছোট ভাইকে আশ্বাস দিয়েছিলো সেন্ট্রাল লন্ডন ঘুরিয়ে দেখাবে। প্রস্তাব করলো আমাকে যাওয়ার জন্যে। একটু ক্লান্ত লাগছিলো। শুয়ে শুয়ে তাই কেবল গালগল্প করছিলাম, ইচ্ছে ছিলো তারা বিদায় নিলেই ঘুমিয়ে পড়বো। আমি একদম লুঙ্গি পরে পাকাপাকি ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে তাদের বিদায়ের অপেক্ষা করছি। অতএব না বলে দিলাম। বন্ধুটি জানালো নতুন মার্সিডিজ কিনেছে, অন্তত যেনো নিচে এসে গাড়ীটা একপলক দেখে আসি। আমি রাজি হলাম। নিচে কেবল গাড়ীটা দেখতে যাবো, লুঙ্গী পরেই বের হয়ে গেলাম। গাড়ীর পাশে যেতেই আমার বন্ধুটি গাড়ীর চাবি বাড়িয়ে বললো, 'চালাবি নাকি'। নতুন গাড়ীটা দেখে আমার ভেতরটাও চনমনিয়ে উঠলো। তার পুরনো মার্সিডিজ নিয়ে এই সেদিনও একটা ছোট্ট এ্যক্সিডেন্ট করলাম, আজ সে আবার নতুন গাড়ীটা চালানোর প্রস্তাব দিচ্ছে! আমি আর দ্বিতীয় চিন্তা করিনি। চাবি হাতে নিয়েই গাড়ী স্টার্ট দিলাম। আর ঘুমানো হলোনা। চলে গেলাম সেন্ট্রাল লন্ডন, লুঙ্গি পরেই। ঘুরলাম অভিজাত চেলসি আর সেন্ট্রাল লন্ডনে। দুয়েকটা ছবিও তুললাম।

লুঙ্গী পরে চেলসি ব্রীজের সামনে তোলা একটা ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছিলাম। বন্ধুরা দেখে খুব মজা পেয়েছিলো। বন্ধুদের মজা পাওয়ার তীব্রতাটা টের পেলাম কিছুদিন পর। একটা নোটিফিকেশন পেলাম ফেসবুকে। দেখলাম আমার এক বন্ধু তার প্রোফাইলে ছবিটা শেয়ার করে দিয়েছে। মন্তব্যে লিখেছে, 'সাবাশ বাংগালী'!

এবারেও আমার আর কিছু বলার ছিলো না!!

বিষয়: বিবিধ

১৩৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File