লন্ডন টুকিটাকি

লিখেছেন লিখেছেন আহসান সাদী ০১ নভেম্বর, ২০১৩, ০৮:৪৫:৪১ সকাল

(লন্ডনে আমার আশপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে টুকটাক কিছু বলার জন্যে এই লেখা। এটা নিয়মিত লেখার আমার ইচ্ছে আছে। এটা অনেকটা ডায়েরির মতো হতে পারে। আশেপাশের কোনো বিষয় সম্পর্কে আমার ব্যাক্তিগত অনুভূতি, অভিজ্ঞতা কিংবা কোনো বিষয় আমার কাছে যেভাবে ধরা পড়বে, কেবল সেটুকুই নিজের মতো করে এখানে লেখার ইচ্ছে আছে। যেহেতু আমি কোনো গবেষনামূলক কিছু লিখবো না, এই লেখাকে তাই বেশ সহজ একটা বিবেচনায় গ্রহণ করা উচিত। প্রবাসে নিজের মতো করে কিছুটা সময় কাটানো, অনেক ফিৎনা থেকে বেঁচে থাকা, নিজেকে একটা কিছুতে ব্যাস্ত রাখা, মনের খোরাক মেটানো ইত্যাদি বহুবিধ উদ্দ্যেশ্যে এই টুকিটাকির শুরু। যদি কেউ এই টুকিটাকি পড়ে ফেলেন তাহলে মতামত আর পরামর্শ দেবেন, এইটুকু অনুরোধ রইলো। আল্লাহ কবুল করুন।)

১.

প্রথম যেদিন লন্ডন এসে পৌঁছাই সেদিনই বছরের প্রথম তুষারপাতটা শুরু হয়েছে। পৌঁছার আগে আমি এরকম একটা সম্ভাবনার কথা জানতাম। তুষারপাত দেখার শখটা আমার সেই শৈশব থেকেই। লন্ডন পৌঁছার পর তুষারপাত দেখতে পাবো এরকম মৃদু সম্ভাবনায় আলাদা একটা ঘোর আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো আমাকে। প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্যে দোহা থেকে লন্ডনের ফ্লাইট বেশ আগেই রওনা হয়ে যায়। নির্ধারিত সময়ের কয়েকঘন্টা আগেই আমাকে তাই লন্ডন এয়ারপোর্টে এসে বসে থাকতে হলো। টার্মিনালের গেটের বাইরে বসার জায়গা আছে। আমি বসে আছি। একটু দুরেই মূল দরজা। মানুষজন ঢুকছে আর বের হচ্ছে, অটোমেটিক দরজাটাও তাই একটু পরপর খুলে যাচ্ছে। বাইরে থেকে তীব্র ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা আসছে। ঠান্ডার মাত্রাটা তবু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো দরজাটা পার হয়ে একটু বাইরে যাই, দেখি কেমন ঠান্ডা এই দেশে। সাথে থাকা বিশাল আকৃতির ব্যগেটা ফেলে যেতে সাহস হচ্ছে না। ঠান্ডার তীব্রতা কত হতে পারে তার একটা অনুমান করার চেষ্টা চালাতে থাকলাম। আমার জীবনে এর আগে আমি তীব্র ঠান্ডা অনুভব করেছি দার্জিলিংয়ে। সে কী ঠান্ডা! মনে পড়ে আমরা বন্ধুরা হাত ও পায়ে মোজা, মাথায় উলের টুপি এবং গায়ে কয়েকধাপ ভারী কাপড় জড়িয়ে তারপর লেপের নিচে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। খুব ভারী একটা জ্যাকেট ছিলো আমার। দার্জিলিংয়ে শীতের ঝাপটাটা সামলাতে সেই জ্যকেট খুব কাজে এসেছিলো। আজও আমার পরনে সেই ভারি জ্যাকেটটা। খানিকটা রং জ্বলে গেছে, কিন্তু ঠান্ডা আটকানোর কাজে এখনও ভরসা করা যায়। দার্জিলিংয়ে তবু তো বরফ পড়েনি, এখানে বরফ পড়া ঠান্ডা তবে কত হবে কে জানে! বেশীক্ষণ আর বসে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম, ব্যাগের চিন্তা বাদ দিয়ে একটু বাইরে ঘুরেই আসি। ব্যাগ হারালে আর কী হবে, দরকারী কগজপত্র সব গলায় ঝুলানো ছোট ব্যাগটাতে তো আছেই, বড় ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড় আর এর ওর জন্যে টুকটাক জিনসপাতি। আমার আর তর সইলো না। এর মধ্যে কয়েকজনের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম বাইরে নাকি তুষারপাত চলছে। গলায় ঝুলানো ব্যগটা নিয়ে ঝট করে তাই বেরিয়ে পড়লাম। সেখানে প্রথম ঝাপটাটা গায়ে এসে লাগলো, তবে খুব বেশী কিছু বুঝতে পারিনি। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি সাদা তুষারের ছন্দময় পতনের দিকে। কয়েকমিনিট ঠান্ডার তীব্রতা অনুভব আর শুভ্র তুষারের মৃদুমন্দ পতনে বিমোহিত হয়ে রইলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার হাত নাড়াতে পারছি না। সাথে সাথেই খেয়াল করলাম মুখে কেউ সুঁইয়ের খোঁচা দিচ্ছে যেনো। ঠান্ডায় একদম বরফ হয়ে যাচ্ছি! ভিতরে চলে যাবার জন্যে ঘুরতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, পা-দুটো যেনো জমে গেছে একদম। ভয়ে শিউরে উঠলাম। ঠান্ডাকে এমন হালকাভাবে নেয়াটা উচিত হয়নি। কোনোরকম ভিতরে এসে বসে পড়লাম, আমার ফেলে যাওয়া বড় ব্যাগটার পাশে। ঠান্ডার তীব্রতা একপলকেই অনুভব করা যায় না। তিন-চার মিনিট বাইরে দাঁড়াতেই নিজে আস্ত বরফ হয়ে যাবার প্রায় কাছাকাছি চলে যাবার অভিজ্ঞতা লাভ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ঠান্ডা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করা চলবে না।

সেইদিন থেকে পরবর্তী দুইদিন চললো আমার বরফ উৎসব। হাত দিয়ে একদলা বরফ নিয়ে বল বানিয়ে বাচ্চাদের মতো এর ওর দিকে ছুঁড়ে মারার খেলাটা আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠলো। বরফঢাকা রাস্তায় আলাদা একটা হাটার স্টাইল রপ্ত করে ফেললাম। পায়ের গোড়ালী ফেলে নয়, প্রতিটা পদক্ষেপে ভর করতে হবে পায়ের আঙুলের দিকে, পায়ের পাতার সামনের দিকে। অন্যথায় পা পিছলে পড়াটা শতভাগ নিশ্চিত। লন্ডন নগরীটা আমার কাছে দেখা দিলো শুভ্র চাদর গায়ে। বাড়ীঘর, গাছপালা, রাস্তাঘাট সবকিছুই সাদা, শুভ্র। আমার কাছে অপরিচিত মনে হয়নি মোটেও। গল্প-উপন্যাস আর টেলিভিশনে তুষারঢাকা গাছপালা, ঘরবাড়ী দেখে এরকমই একটা কিছু আমার কল্পনায় আঁকা হয়ে ছিলো! এখন শুধু তা বস্তবে দেখছি। কল্পনায় সবকিছু খানিকটা অস্পষ্ট থাকে, বাস্তবে একদম স্পষ্ট, এই যা! সেই ছোটবেলা থেকে লালন করা তুষারপাত দেখার স্বপ্নটা যখন বাস্তবে ধরা দিয়েই ফেলেছে, তখন আর কী করা, মন ভরে উপভোগ করতে থাকলাম সেই অদ্ভুত শুভ্র সৌন্দর্য। আল্লাহর সৃষ্টি কত সুন্দর।

২.

বিদেশ বলতে আমার কাছে মনে হতো উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর বিশাল বিশাল রাস্তায় সাজানো আলো ঝলমলে নগরী। লন্ডনের ক্ষেত্রেও আমার কল্পনা এমনটাই ছিলো। এখানে আসার পর বড় নির্মভাবে আমার ভুলটা ভেঙে গেলো। কোথায় কী! লন্ডন মানেই তো দেখছি দুই-তিনতলা বাড়ী আর ছোট ছোট রাস্তাঘাটে মোড়ানো একটা নগরী। বাড়ীগুলো সব হয় লাল রঙ না হয় হলুদ রঙের। সবচাইতে হতাশাজনক ব্যপার হলো এই সব বাড়ীগুলোর কোনোটা পন্চাশ-একশ এমনকি দেড়শো বছর পুরনো (অনেকগুলো আবার দুইশো বছরেরও বেশী!)। কোথায় আমি ভাবলাম এখানে খুব আধুনিক নির্মানশৈলীর প্রদর্শনী দেখতে পাবো, বাড়ীগুলো হবে ঝকঝকে তকতকে, রকমারী গ্লাস আর এ্যলুমিনিয়ামে সাজানো থাকবে সবগুলো বিল্ডিং, এসে দেখি সেই ভিক্টোরিয়ান যুগের স্টাইলে সবগুলো বাড়ীঘর দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই মন খারাপ হয়ে যায়।

কয়েকবছর আগে কুয়ালালামপুর বেড়াতে গিয়েছিলাম। কুয়ালালামপুরে যখন পৌঁছাই তখন সম্ভবত স্থানীয় সময় রাত এগারোটা। এয়ারপোর্ট থেকে কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টারে আমাদের হোটেল পর্যন্ত আসছিলাম ট্যক্সি করে। রাতের আলো ঝলমল কুয়ালালামপুর সিটি আমার কাছে এখনও অবিশ্বাস্য মনে হয়। চোখ ধাঁধানো যাকে বলে,নগরীটা আমার কাছে সেরকমই মনে হয়েছিলো। আমার এক বন্ধু, সে লন্ডনে থাকে, মালয়েশিয়া সফরে আমাদের সাথে লন্ডন থেকে যোগ দেয়। আমাদের হোটেল থেকে একটু দূরে একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো। খোলা আকাশের নিচে কফি খাবার ব্যাবস্থা ছিলো সেখানে। আমরা সেই রেস্টুরেন্টে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করতাম। আমার বিলেতি বন্ধুটি সেখানে কথা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলো লন্ডন থেকে কুয়ালালামপুর নগরীটাই বেশী আকর্ষণীয়। তার কথাটা তখন আমি পুরোপুরি নিতে পারিনি। এখন আমি ধরতে পেরেছি বিষয়টা। ভিক্টোরিয়ান যুগে আটকে থাকার চেষ্টা অথবা বৃটিশদের কড়া ঐতিহ্যপ্রীতি এই নগরীটাকে সময়ের সাথে তার আউটলুক পরিবর্তন করতে দেয়নি। শতবর্শী প্রাচীন দালানগুলো বিষণ্ণতার একেকটা প্রতীক হয়ে যেনো দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলো ঘর আবার প্রায় একই ধরনের। পুরনো দালান দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে, এটা সত্য। আমি যখন হাওরে চাকরি করতাম, জলসুখার পরিত্যাক্ত জমিদারবাড়ীগুলোতে প্রায়ই ঘুরতে যেতাম। ফিফটি সিসি টু স্ট্রোক মোটরবাইক চালিয়ে হাওরের মাঠ-ঘাট পেরিয়ে সেইসব জমিদার বাড়ীগুলোতে ঘুরতে যেতে ভালোই লাগতো। লন্ডনে এসব পুরনো বাড়ীঘর দেখেও হয়তো ভালোই লাগতো আমার, কিন্তু এখানে এসব ঘরবাড়ী যে পরিত্যাক্ত না। এসব বাড়ীতে এখনও মানুষ দিব্যি বসবাস করে। করবে আরও অনেকদিন। এমন বিষণ্ন ঘরে মানুষজন বাস করছে এই বিষয়টা আমি এখনও ঠিক মেনে নিতে পারিনি।

বাড়ীঘরগুলো সম্পর্কে আমার কথাগুলো অবশ্য একটু একপেশে হয়ে গেছে। এখানে তাই উল্লেখ করা প্রয়োজন, লন্ডনের পুরোটাই এমন নয়। এটা কেবল আবাসিক এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমার কল্পনার 'বিদেশে'র চিত্রটাও এখানে বিদ্যমান। তবে সবকিছুর পরে এসব মন খারাপ করা ঘরবাড়ী, গুমোট আবহাওয়া এবং হাতেগোনা কয়েকটা জায়গা ছাড়া রাস্তাঘাটে মানুষের অস্বাভাবিক কম উপস্থিতি দেখে একটা 'মন খারাপ' 'মন খারাপ' ভাব চলে আসে চট করে। বিষণ্নতা এসে ভর করে। আমি জনবহুল বাংলাদেশের ভীড়-বাট্টায় বেড়ে উঠা এবং প্রখর রোদে পোড়া একজন মানুষ। এখানকার পরিবেশ আর আবহাওয়ার এমন বিষণ্ন রূপ আমার পছন্দ হবেই বা কেনো?

বিষয়: বিবিধ

১৩২৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File