বাউল বিভ্রাট এবং কিঞ্চিত অন্যান্য

লিখেছেন লিখেছেন আহসান সাদী ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৯:৩৪:৫৬ রাত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

১.

ফেসবুকের মারফতে জানতে পারলাম ফরিদা পারভীন নাকি বলেছেন শাহ আব্দুল করিম কোনো বাউলই না। এই মন্তব্যের জন্যে দেশের সুধীমহলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। খবরটা শুনে বিস্তারিত পড়ার আগ্রহ অনুভব করলাম। আগ্রহ তৈরী হবার একটা কারণ রয়েছে অবশ্য। একটা সময় ছিলো যখন আমি শাহ আব্দুল করিমের গানে ব্যপকভাবে আকৃষ্ট হয়ে ছিলাম। আগ্রহের তীব্রতা এতই বেশী ছিলো যে আমি একাধিকবার আব্দুল করিমের বাড়ীতে গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত পর্যন্ত করেছি। তার গানের বই সংগ্রহ করেছি এবং 'কালনীর ঢেউ' নামে আব্দুল করিমের লেখা গানের বইয়ে তার অটোগ্রাফ পর্যন্ত নিয়েছি। আব্দুল করিমের তখন শেষ সময়। কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি বইয়ের প্রথম পাতায় তার নামটা লিখে দিলেন এবং বইটা এখনও আমার সংগ্রহে আছে। কোথাও বাউল গানের আসর বসেছে শুনলেই উপস্থিত থাকার প্রবল চেষ্টা চালাতাম। মাতামাতিটা এটুকুতেই শেষ ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিস্ট ক্লাবের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। আব্দুল করিমের মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে পুরো ক্লাব নিয়ে উনার বাড়ীতে গিয়ে একটা সংবর্ধনাও দিয়ে এসেছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে যাবার প্রক্রিয়াটাও ছিলো অদ্ভুত। অনুষ্ঠানের আগের রাতে আমরা সবাই একটা নৌকায় চড়লাম। সারারাত নৌকায় কাটাবো, কালনী নদীতে ঘুরবো, এই হলো পরিকল্পনা। চাঁদনি রাতে আমরা সবাই সেই রাতটা নৌকায় কাটিয়ে সকালবেলা পৌঁছালাম আব্দুল করিমের বাড়ী। কুষ্টিয়ার লালনের আখড়াতেও বেড়াতে গিয়েছিলাম একবার। একটা একতারা কিনেছিলাম ফেরার সময়।

জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি একটা সময় ছিলো খুবই পথভ্রষ্ট। মিষ্টি প্রলেপ লাগানো যেকোনো কথায় তখন আমার বিশ্বাসের দরজা খুলে যেতো। বাউল বা আরো অনেক ভ্রান্ত বিষয় নিয়ে মাতামাতি ছিলো আমার। ফরিদা পারভীনের আলোচিত এই মন্তব্যের সংবাদে তাই আমার একসময়ের নষ্ট ভক্তিসংক্রান্ত কারণে ব্যপক আগ্রহ অনুভব করলাম।

বাংলানিউজ২৪ এর ৯ই সেপ্টেম্বরের বিনোদন পাতায় ছাপা ফরিদা পারভীনের ইন্টারভিউটা বিস্তারিত পড়ে আমি আক্ষরিক অর্থেই প্রচুর বিনোদন পেয়েছি। বিনোদন জগতের মানুষজন নিজের জীবন, বিশ্বাস, কাজ, কথা সবকিছু দিয়েই আমাদের বিনোদন সরবরাহ করে চলেন। বিনোদনের পাশাপশি খানিকটা আফসোস আর করুনাও কাজ করে।

মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করার পর মানব জন্মের উদ্দেশ্যের বিষয়টা যদি কেউ জানতে পারে তবে জীবনের প্রতিটা কাজে সতর্কভাবে পা ফেলবে এটা নিশ্চিত। একজন মুসলিম এজন্যই খুব সতর্ক। পাশাপাশি যারা জীবনটাকে কেবল এইপারেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন তারাও তাদের কাজের ক্ষেত্রে সতর্ক, তবে সেটা ভিন্ন পথে। ফরিদা পারভীনের সাক্ষাতকারে এই সতর্কতার বিষয়গুলো আলাদা করে চোখে লাগলো এবং আফসোস অনুভব করতে থাকলাম, ঠিক এমন সতর্কতারই তো প্রয়োজন একজন মুসলিম হিসেবে জীবনের দুই প্রান্তেই নিজেকে সমৃদ্ধ করার। লালনের গান লালন করার জন্যে, সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার জন্যে, লালনের গানের বিকৃতি রোধ করতে, গানের মহান পূর্বসূরীদের যথাযথ সম্মান প্রদান ইত্যাদি প্রসঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা আর উদ্বেগগুলো পড়ে কিছু বিষয় তীব্রভাবে মাথায় জট পাকাতে শুরু করলো। এই সতর্কতার জন্যে যেই 'ডেডিকেশান', সেটা কী কারনে আর এই 'ডেডিকেশান'টা আসলে কোন ক্ষেত্রে হওয়া উচিত ছিলো এই তুলনাটা খুব চোখে লাগলো।

২.

পরিকল্পনার কথা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান ফরিদা ফাউন্ডেশন নামে একটা প্লাটফর্ম তৈরী করার কথা যেখানে লালনের গান নিয়ে গবেষণা হবে, সংরক্ষণ করা হবে, লোকজ যন্ত্রাংশ নিয়ে কাজ হবে। সবমিলিয়ে সঙ্গীত বিষয়ক অনেক কর্মযজ্ঞ চলবে এমন একটি ফাউন্ডেশনের বাসনা তাঁর দীর্ঘদিনের। তিনি জানান, 'এটি একটি সুদূরপ্রসারী কাজ'। হায়, এমন গোছানো পরিকল্পনাটা দ্বীন শিক্ষা এবং এর বাস্তবায়নের জন্যেই তো হওয়া উচিত ছিলো। লালন চর্চায় এমন আত্মনিয়োগে কী প্রাপ্তি এই জীবনে আর পরকালে তা কেনো যে বুঝতে চান না আমাদের বিনোদন জগতের মানুষেরা!

তিনি বলেন, 'চলছে এখন সঙ্গীত সন্ত্রাস। ফিউশনের নামে কনফিউশন তৈরি করা হচ্ছে। নকল আর বিকৃতির মহোৎসব চলছে যেনো'। এই উদ্বেগ একজন ধার্মিকেরও থাকে। একজন ধার্মিক ব্যক্তি কোরআনের আয়াতের অর্থবিকৃতিতে এমন উদ্বেগ অনুভব করে, হাদীসের অপব্যখ্যায় এমন উদ্বেগ অনুভব করে। তিনি আরো বলেন, 'টেলিভিশনে গাওয়ার সময় অনেকে নামই মুখে নেয় না। আর যে কজন বলে তাদের বলার ভঙ্গি খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। ‘গাইছি লতার গান বা সন্ধ্যার গান’। যেখানে পুরো ভারতবর্ষ তাদেরকে ডাকে লতাজি, সন্ধ্যাজি নামে। সঠিকভাবে প্রাপ্য সম্মান দিতেও যেন বিরাট কষ্ট'। মহান পূর্বসুরীদের প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধাবোধ থেকেই এই অভিযোগটা এসেছে। হ্যাঁ, একজন মুসলিমও এভাবে তার মহান পূর্বসুরীদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাদের নাম নেয়ার সময় আমরা ক্ষেত্রবিশেষে 'রাদিআল্লাহু আনহুম' বা 'রাহিমাহুল্লাহ' সংযুক্ত করি। সংগীত বিষয়ে বিজ্ঞ ফরিদা পারভীন বলেছেন, 'সঙ্গীতে টিকে থাকতে হলে সবসময় শিক্ষার উপর থাকার বিকল্প নাই'। আহারে, একই কথা একজন বিজ্ঞ মুসলিমও বলবে, তবে এভাবে 'ইসলামে টিকে থাকতে হলে সবসময় শিক্ষার উপর থাকার বিকল্প নাই'।

শুদ্ধ সঙ্গীতের অশুদ্ধির জন্যে একশ্রেণীর লোককে অভিযুক্ত করে ফরিদা পারভীন বলেছেন, 'কুশিক্ষায় শিক্ষিতরাই আজ দেশের সংস্কৃতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে'। এই বিশেষ শ্রেণীকে দমানোর জন্যে প্রয়োজনে কঠোর হতেও দ্বিধা নেই তার। তিনি বলেন, 'শুদ্ধ সঙ্গীত রক্ষার জন্য সৌদীআরবে অপরাধের বিচারের মতো করে ওপেন মঞ্চ করা দরকার। সেখানে দাঁড়িয়ে বিকৃত গানের লোকদের হয় বয়কট করতে হবে নয়তো গুলি করে মেরে ফেলা উচিত'। এই অংশটা পড়ে একই সাথে বিনোদন আর আক্ষেপ অনুভব করতে থাকলাম। সঙ্গীতের মতো একটা বিষয়ের শুদ্ধতার জন্যে তিনি কিসাসের মতো একটা বিষয়কেও গ্রহণ করতে প্রস্তুত! আহারে। যেই ডেডিকেশন হওয়া উচিত 'ফর দ্যা সেক অফ আল্লাহ' সেই ডেডিকেশনটা পড়ে রইলো সঙ্গীতে। জীবনটা তাহলে কীসের জন্যে? জীবনের উদ্দেশ্যটা কি তবে কেবলই লালনগীতি?

একজন মুসলিম এমনটা মনে করে না। একজন মুসলিম জানে সে পৃথিবীতে এসেছে আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে। লালনগীতি বা বাউলগান কোনো ইবাদাত নয়। ইবাদাত কীভাবে করতে হয় তা আল্লাহ আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। কেউ যদি কুরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো কিছুকে ইবাদাত হিসেবে প্রচার করে একজন প্রকৃত মুসলিম তা নির্দিধায় প্রত্যাখ্যান করবে।

৩.

যেই মন্তব্যের জন্যে এই ইন্টারভিউটি এত আলোচিত হলো সেটা নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই। ফরিদা পারভীন বলেছেন, '...এখন আবার শুনি শাহ আবদুল করিমকে বাউল সম্রাট বলা হচ্ছে। আবদুল করিম তো বাউল-ই না'। শাহ আব্দুল করিম বাউল ছিলেন কি না এটা আমাদের কাছে কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ না। বাউল দর্শন বা আব্দুল করিমের গান এইগুলার কোনোটাই ইসলাম নয় বরং এইগুলো চরমভাবে ভ্রান্ত কিছু বিষয়। তবুও সমাজের অনেক লোক এসবে ইসলামের ফ্লেভার খুঁজেন। তাদের চোখ খুলে দিয়ে দেখানোর জন্যে জন্যে আব্দুল করিমের একটা গানের পুরোটা তুলে দিলাম।

জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে বল ওগো সাঁই

এ জীবনে যত দুঃখ কে দিয়াছে বল তাই।

দোষ করিলে বিচার আছে, সেই ব্যবস্থা রয়ে গেছে

দয়া চাইনা তোমার কাছে, আমরা উচিত বিচার চাই।

দোষী হলে বিচারে, সাজা দিবা তো পরে

এখন মারো অনাহারে, কোন বিচারে জানতে চাই।

এই কি তোমার বিবেচনা, কেউরে দিলা মাখন ছানা

কেউর মুখে অন্ন জোটেনা, ভাঙ্গা ঘরে ছানি নাই।

জানো শুধু ভোগবিলাস, জানো গরীবের সর্বনাশ

কেড়ে নেও শিশুর মুখের গ্রাস, মনে বড় দুঃখ পাই।

তোমার এসব ব্যবহারে, অনেকে মানে না তোমারে

কথায় কথায় তুচ্ছ করে- আগের ইজ্জত তোমার নাই।

রাখতে চাইলে নিজের মান, সমস্যার কর সমাধান

নিজের বিচার নিজেই কর, আদালতের দরকার নাই।

দয়াল বলে নাম যায় শোনা, কথায় কাজে মিল পড়েনা

তোমার মান তুমি বোঝনা, আমরা তো মান দিতেই চাই।

তুমি আমি এক হইলে, পাবে না কোন গোলমালে

বাউল আব্দুল করিম বলে, আমি তোমার গুণ গাই।



-গ্রন্থঃ কালনীর ঢেউ- শাহ আব্দুল করিম (পৃঃ ৯২, গান-১৩৩)

গানটি যেই বই থেকে টাইপ করেছিলাম, সেই বইয়েই রয়েছে আব্দুল করিমের অটোগ্রাফ। এই গানটা আমি আমার আরেকটা লেখায় ব্যবহার করেছি। এই লেখায় অন্য কোনো গান উল্লেখ করতে পারলে ভালো হতো কিন্তু আমার হাতের কাছে কোনো বই নেই। সব বই দেশে রেখে এসেছি তাই পুরনো লেখা থেকে এই গানটাই ব্যবহার করলাম। এই জঘন্য গানটি যারা পড়ে ফেলেছেন, তারা নিশ্চয় খুব সহজেই হিসেব করে ফেলতে পারছেন। আর বাউল দর্শন যে বাতিল একটা দর্শন এটা বোঝার জন্যে অনেক জ্ঞানী হবার প্রয়োজন পড়েনা। আব্দুল করিমকে নিয়ে ফরিদা পারভীনের মন্তব্যে তাই আমাদের কোনো ভাবান্তর নেই। কেউ একজন আসল বাউল হলেই কী আর নকল বাউল হলেই কী, আমাদের কাছে এর সবগুলো ভার্শনই বাতিল, ভ্রান্ত।

শাহ আব্দুল করিম অথবা লালন, যাদের এইপারের অধ্যায় অতীত হয়ে গেছে, তাদের নিয়ে কিছু মন্তব্য করছি না, আল্লাহ ভালো জানেন কিন্তু ফরিদা পারভীনদের জন্যে আমাদের আন্তরিক দোয়া থাকবে যেনো তারা সত্য বুঝতে পারেন। কত চমৎকার দক্ষতায় লালন দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ করে চলেছেন তিনি। এখন এই চমৎকার দক্ষতাটা যেনো নিজের ভুল শুধরে দ্বীন কায়েমে প্রয়োগ করতে পারেন এই প্রার্থনা থাকবে আমাদের।

ইন্টারভিউয়ের এক পর্যায়ে ফরিদা পারভীন বলেন, '...সবচেয়ে বড় বিষয় একজন রিকশাওয়ালা যেমন আমায় চেনেন, একজন সরকারি সচিবও চেনেন। আর মাঝামাঝি যারা আছেন তারাও অন্তত আমার নামটা জানেন। এটা আমার উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেষ করতে পারব না'। এই কথাগুলোতেই বেশী ভয় হয়। সবকিছুতে ইসলামী ফ্লেভার খোঁজা সাধারন মুসলিম এইসব কথার দ্বারা বাতিলকে জাস্টিফাই করে ফেলেন। আমাদের 'রাজনীতিবিদ' আর 'সুশীল সমাজ'ও সব কথার শেষে এভাবে আল্লাহর নাম নিয়ে, কোরআনের কোনো আয়াত উল্লেখ করে বা ইসলামের কোনো বিধান নিয়ে কথা বলে মানুষের সামনে নিজেদের কাজগুলোকে বৈধ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। এ ব্যাপারে ফরিদা পারভীনের এই ইন্টারভিউয়ে বলা একটা কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, 'কাক কাকের জায়গায় থাকা উচিত। ময়ূরপুচ্ছ পরে ময়ূর হওয়া যায় না' (উদাহরণ দেয়ার ক্ষেত্রে কাক নামক প্রাণীটা ইদানীং দেশের সুধীজনের কাছে বড় প্রিয় হয়ে উঠছে মনে হয়)। এই কথার সাথে আমি পুরোপুরি একমত। ভ্রান্ত কিছুকে হালাল প্রমাণের জন্যে ইসলামকে টেনে আনলে তা হালাল হয়ে যায় না। একজন মুসলিম এসব সাদাসিধে ভ্রান্ত কথায় যেনো সত্য আর বাতিলকে মিশিয়ে না ফেলেন, এমন প্রার্থনা থাকলো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করুন। আমীন।

বিষয়: বিবিধ

২৩০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File