আম এবং আমার আমকাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন আহসান সাদী ১৮ জুন, ২০১৩, ০২:৪৬:৫৫ রাত
মানুষের আবেগ আছে। বাংলাদেশীরা এই আবেগের চর্চাটা মনে হয় একটু বেশীই করে। প্রসঙ্গ যখন স্বদেশ তখন আবেগটা আমাদের বোধকে ঠেকিয়ে প্রায় অন্ধ করে ফেলে। আমরা তাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাথে একমত হয়ে বিশ্বাস করে ফেলি 'সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি'। আমার দেশ অন্য সবগুলো দেশের চাইতে প্রিয় হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সকল দেশের চাইতে সেরা, এমনটা ভাবা অতি আবেগপ্রসূত, সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে কেবল আমাদের বাংলাদেশীদের এককভাবে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের দেশাত্মবোধক গানের মূল কথাই হলো 'আমার দেশটাই সেরা'। মানুষের চিন্তা, বুদ্ধি, বিবেচনাবোধ, যুক্তি ইত্যাদি ব্যবহার করলে একজন মানুষ একজন বিশ্বনাগরিক হতে পারে। আমি সিলেটের লোক। সিলেটের জাফলং দেশবিখ্যাত। জাফলংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আসলেই আসাধারণ। নদীর স্বচ্ছ পানি এবং এর আশপাশে বিশাল পাহাড়শ্রেণী, এদুটোর মিশেলে এক অপরূপ সৌন্দর্য জাফলংয়ের। কিন্তু এই পাহাড়গুলো আমাদের দেশের পাহাড় নয়। এর সবগুলোই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের দখলে। পাহাড়গুলোর সৌন্দর্যের ছটা আমরা ঠিকই উপভোগ করছি। ভারতের দখলে থাকা পাহাড়শ্রেণী ব্যকগ্রাউন্ডে আছে বলেই জাফলং এত সুন্দর। মূল কথা হচ্ছে একটা দেশ কখনোই বাকী সবগুলো দেশের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। প্রাসঙ্গিকভাবে বলে ফেলা যায় একটা জাতিও অন্য সবগুলো জাতির চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। রাজনৈতিক সীমারেখা আমাদের তৈরী, ইসলামে তাই কোনো সম্প্রদায় বা কোনো জাতিকে বাকীদের থেকে শ্রেষ্ঠ বলে না। পৃথিবী একটাই যেটি আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং আমরা সবাই আল্লাহর সৃষ্টি। কোনো জাতীয়তাবাদের স্থান ইসলামে নেই।
যেটা হয়, তা হলো প্রত্যেক এলাকার একেকটা আলাদা বৈশিষ্ট থাকে। স্কুলে সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে পড়েছি, 'আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়েই আমাদের পরিবেশ'। এই চারপাশের সবকিছুর বৈচিত্রের কারণে অথবা পরিবেশগত তারতম্যের জন্যেই একেক এলাকার একেক রকম বৈশিষ্ট। আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের পরিবেশটাই এমন যেই পরিবেশে আম নামের অসম্ভব সুস্বাদু একটা ফল সম্ভবত তার শ্রেষ্ঠ স্বাদটা তৈরী করে নিতে পারে। আমের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ। মিষ্টি আমের সাথে আমার সম্পর্ক, বিচ্ছেদ, অপেক্ষা এবং আম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে কিছু কথা, এসবকিছুই এই লেখার মূল বিষয়বস্তু। এতক্ষন যা ছিলো তা কেবল ভূমিকা।
ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে আমার এক বন্ধুর কাছে তার মা কুরিয়ারে করে আম পাঠাতেন। বন্ধুর নাম সুমন। তাঁর বাড়ী নওগাঁ। তাদের বাড়ীতে আমের গাছ আছে বেশ কয়েকটা। আমের সিজনে তাঁর মা ছেলেকে আম পাঠাতেন। সে থাকতো হলে। প্রথম প্রথম মায়ের পাঠানো সেই আমগুলির একটা ভাগ পেতো ক্লাসের মেয়েরা। সুমনের সাথে আমার তখনও 'বাড়ী থেকে আসা আম' খাওয়ানোর মতো সুসম্পর্ক তৈরী হয়নি। সেই পর্যায়ে সম্পর্কটা হবার পর একবার আমি তার রুমে অবস্থান করছিলাম। তখন আমের সিজন। তার রুমে আম ছিলো, মাত্র আগের দিন এসে পৌঁছেছে এবং সেবারই আমি প্রথম আমের ভাগ পাই। সেই শুরু। আম নামের ফলটা যে এত সুস্বাদু হতে পারে, সাতকরার দেশের ছেলে আমার এমন ধারণা ইতিপূর্বে ছিলোই না। আম আমি আগেও খেয়েছি। কিন্তু এমন স্বাদ আগে কখনো পাই নি। এরপর যতবারই সুমনের জন্যে আম এসেছে, সুমনের বান্ধবী অথবা অন্য কারও ভাগ্যে জুটুক আর নাই জুটুক, আমার আম খাওয়াটা বন্ধ হয়নি। আমাকে আম খাওয়ানোটা তার একটা দায়িত্বের মতো হয়ে গিয়েছিলো। প্রসঙ্গক্রমে বলা উচিত, পরবর্তীতে আমি সুমনের নওগাঁর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। তাঁর, তার পরিবার এবং বন্ধুদের আতিথেয়তাটা ছিলো তাদের এলাকার আমের মতোই মিষ্টি। এখন আমের সময়। সুমন থাকে সুদূর কানাডায়। সেখানে আমের স্বাদ কেমন জানি না। সে তার গ্রামের বাড়ীর আমের স্বাদটা কি এখনও অনুভব করে? জিজ্ঞেস করা হয়নি।
মিলনের বাড়ী রাজশাহী। সুমনের মাধ্যমে আমি আমের প্রেমে পড়ার কিছুদিনের মধ্যেই আমের আরেক সরবরাহকারী হিসেবে মিলনের আবির্ভাব। তার কাহিনীও একই। রাজশাহী থেকে তার মা আম পাঠাতেন। প্রতি বছরই তার মেসে আম খাবার দাওয়াত থাকতো। আমরা আদর করে তার মেসের নাম দিয়েছিলাম পিরামিড। একবার আমরা বন্ধুরা সবাই এবং আমাদের ডিপার্টমেন্টের কিছু প্রিয় বড় ভাইয়েরা মিলনের থেকে আমের দাওয়াত পেলাম। সাবই দলবেধে পিরামিডে গেলাম। প্রচুর আম ছিলো সেদিন। যখন আনুষ্ঠানিকভাবে আম পরিবেশন করা হলো তখন পর্যন্ত সবাই আমরা বেশ ভদ্রতার সাথে বসে ছিলাম। বড় ভাইরা আছেন তাই আমরা এবং ছোটভাইদের সাথে থাকায় বড় ভাইরাও বেশ গোছানো একটা ব্যাবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম। আমে কামড় বসানোর সাথে সাথে সবার মাথা খুলে গেলো। আমরা সবাই ছিলাম অর্থনীতির ছাত্র। সীমিত সংখ্যক আম থেকে বেনিফিট ম্যক্সিমাইজেশনের শ্রেষ্ঠ উপায় হলো শেষ হয়ে যাবার আগে যতটা বেশী সম্ভব খেয়ে ফেলা। এই সহজ ফর্মূলা ডিপার্টমেন্টের ভালো ছাত্র আশরাফ ভাই মনে হয় বুঝতে পেরেছিলেন সবার আগে। ভদ্রতার ব্যাপারটা তাই সাময়িকভাবে তুলে রেখে আশরাফ ভাই তার বেনিফিট ম্যক্সিমাইজ করলেন। আমরা দূর্বল ছাত্ররা কিছু বুঝে উঠার আগেই আবিষ্কার করলাম আমের প্লেট খালি আর খোসার প্লেট পূর্ণ। সর্বোচ্চ মার্কস পেয়েছেন আশরাফ ভাই। পিরামিডের সেদিনের আম উৎসবটা স্মৃতিতে একটা মধুর সংযোজন ছিলো। ইউনিভার্সিটির চমৎকার সময়গুলো মনে হলে মিলনের আয়োজনে সেই আম উৎসবটাও মনে আসে।
বড় ভাইয়ার সাথে আমের গল্প করছিলাম। উনিও আমের ভক্ত। তখন আমরা দুই ভাই দেশেই ছিলাম। ভাইয়ের পরামর্শে রাজশাহী থেকে আম কিনে আনার সিদ্ধান্ত হলো। বাজারে রাজশাহীর আম পাওয়া যায় কিন্তু ফরমালিন আতংকে তা চেখে দেখাটা ছিলো বিপজ্জনক। ফোন দিলাম মিলনকে। মিলনদের পরিচিত আমের বাগান আছে। সে তার এক কাজিনকে বলে আমাদের জন্যে এক মণ আম পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলো। আমরা কুরিয়ার করে টাকা পাঠালাম। যথাসময়ে আম চলে আসলো। শুরু হলো বাসায় আম উৎসব। ল্যাংড়া আর গোপলভোগ। এই দুইধরণের আম খাওয়া হয়েছে বেশী। এভাবে বছর দুই চললো। আমাদের আমের চাহিদা মেটাতে ছাত্রজীবন শেষ হবার পরেও মিলন ভুমিকা রেখেছিলো। মুখে সবসময় একটা অসম্ভব মিস্টি হাসি মিলনের চরিত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এমন মিষ্টি হাসি ছেলেদের খুব কমই দেখা যায়। এরকম একটা ছেলেকে বন্ধুরা আদর করে 'গরিলা' বলে ডাকতাম। কারো নাম বিকৃত করাটা অনেক বড় অন্যায়। না বুঝে এমন কিছু ছাত্রজীবনে আমাদের চর্চায় ছিলো। আল্লাহ ক্ষমা করুন। রাজশাহীর আমের মতোই মিষ্টি হাসির একটা মানুষকে গরিলা নামক দুর্ধর্ষ একটা প্রাণীর নামে ডাকার কাহিনীটা ভিন্ন। সেটা আজকের আলোচ্য নয়।
লন্ডনে আমার একটা আনন্দের বিষয় হলো যুবায়ের ভাইয়ের সাথে রাতে ঘুরতে বের হওয়া। এই বড় ভাইয়ের গাড়িতে চড়ে রাত-বিরাতে লন্ডনের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো হয় প্রায়ই। এরকমই একদিন এক বাসায় রাতে খাওয়ার দাওয়াত পেয়ে গেলাম। খাবার শেষে সেখানে আম খেতে দেয়া হলো। কী মিষ্টি আম। দেশ ছেড়ে আসার পর প্রথম আম খাওয়া। আম খেতে খেতে আম বিষয়ে আমার মিষ্টি অভিজ্ঞতাগুলো সেদিন যুবায়ের ভাইয়ের সাথে শেয়ার করলাম। এর দিন দুই পরে একদিন যুবায়ের ভাই ফোন করে উনার বাসায় যাবার জন্যে বললেন। আমের দাওয়াত ছিলো সেটা। আমার আমপ্রীতি জানতে পেরে তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে অনেকগুলো আম কিনে এনেছিলেন। লন্ডনে পাকিস্তানি আমের বেশ কদর। যুবায়ের ভাই তা'ই কিনেছিলেন। আমি বেশ আয়েশ করেই আম খেতে বসি। প্রচুর আম খাওয়া হলো। আমগুলো অবশ্যই মিষ্টি ছিলো। এ নিয়ে দুই বাসায় আমার আম খাওয়া হলো এবং দুই জায়গায়ই আমের স্বাদ ছিলো বেশ মিষ্টি। তবু কেনো যেনো রাজশাহী বা নওগাঁর আমের সাথে কোনো তুলনাই করতে পারলাম না।
আমি জানি আমার দেশ সবার সেরা নয়। আমি বিশ্বাস করি কোনো দেশই বাকী সবগুলো দেশের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। কেবল পরিবেশগত তারতম্যের জন্যে একেক এলাকার আলাদা বৈশিষ্ট থাকে। আমাদের রাজশাজী-নওগাঁর আমের যেই স্বাদ সেই স্বাদ যে সবখানেই পাবো এমনটা হবার কথা না। আমরা মানুষ, তবু নিজেদের ভালোটা খুঁজতে পছন্দ করি। সেই ভালোলাগার জায়গা থেকে তাই আমি বলতে চাই আমাদের দেশের আম (পড়ুন ফরমালিন মুক্ত আম) নিশ্চয়ই সবার সেরা। আমার হয়তো ভুল হতে পারে। হয়তো এর চাইতে সুস্বাদু আমের দেখা আমি এখনও পাইনি। হয়তো আমাদের দেশের আমের চাইতেও কয়েকগুন বেশী সুস্বাদু আম পৃথিবীর কোথাও না কোথাও পাওয়া যায়। তবে আমি খুব করে চাইবো যেনো এমনটা সত্যি না হয়। আমার অত্যন্ত পছন্দের এই ফলের শ্রেষ্ঠ সংস্করণটা আমি ছাড়া অন্য অনেক লোক খেতে পারছে এমনটা কেনো যেনো মেনে নিতে পারি না।
বিষয়: বিবিধ
২০৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন