উল্টোপথ
লিখেছেন লিখেছেন আহসান সাদী ০৫ এপ্রিল, ২০১৩, ০৬:২০:২৬ সকাল
একটা সংক্ষিপ্ত কথোপকথন যখন এমন,
- 'দোস্ত নতুন একটা হোন্ডা কিনলাম, বাজাজ ডিসকভার ১৫০'।
- 'ইয়ামাহা এফ.জেড. হোন্ডা কিনলেই পারতি, এটাই এখন বেস্ট'।
আমরা খুব একটা অবাক হই না। আশপাশে এমন আলাপ আমাদের খুবই পরিচিত। আমাদের দেশে সব ধরনের মটরসাইকেলকে 'হোন্ডা' নামে ডাকার একটা অদ্ভুত নিয়ম চালু আছে। অনেক স্থানীয়, এমনকি জাতীয় দৈনিকের শিরোনামেও মটরসাইকেল মহড়াকে 'হোন্ডা মহড়া' বলা মোটামুটি স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের দেশে পাওয়া যায় এমন মোটামুটি সব ধরণের মটরসাইকেলকে আমরা হোন্ডা গ্রুপের বাহন বলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি কিন্তু কোনো কিছুকে নিজ নামে না ডেকে ভূলবশত অন্য নামে ডাকা, এমন ত্রুটি নিঃসন্দেহে অনাকাঙ্খিত কিন্তু খুব একটা ক্ষতিকর নয়। আমাদের কানে একটু বেমানান লাগে, এইটুকুই সম্ভবত।
আমাদের দেশে এবং ভারত-পাকিস্তানেও মাজার, মানত, উরস ইত্যাদি কিছু বিষয় খুব উৎফুল্লভাবে কিছুশ্রেণীর মানুষ ইসলামের অংশ বলে চালিয়ে নিতে চায়, এটা নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর। এসব আচার-অনুষ্ঠান, কায়দা-কানুন আর ঢং কোনোভাবেই যে ইসলামের অংশ নয় বরং সম্পূর্ণ বিপরীত, কেউ যদি ইসলামকে জীবন বিধান হিসেবে মেনে নেয় অর্থাৎ যদি মুসলিম হয়, তাকে এই বিষয়টাও মেনে নিতে হবে। মহাপবিত্র উরস শরীফ, ওরস পাক-এ শাহ চন্দ্রপূরী, মাইজভান্ডারীর ওরশ, এইসব হলো শিরক। এসব কাজকে তাই ইসলামের খেদমত করা বা ইবাদাত মনে করা ইসলাম না জানার পরিণাম হিসেবে ভাবা যেতে পারে। নিঃসন্দেহে এসব ইসলাম নয়।
একদিন দরগায়ে হযরত শাহজালাল (রঃ) প্রাঙ্গণে আসরের সালাতের সময় আবিষ্কার করলাম, যত লোক মসজিদে নাময পড়েছেন সেই সময় প্রাঙ্গণে তার চাইতে বেশী লোক বিচরণ করছে। একপাশে সালাত চলছে আর অনদিকে কেউ তাবিজ কিনছে, কেউ শিরনী-মোমবাতি, অনেকে বিশেষ লাল-হলুদ রঙের ফিতা কিনে হাতে বাঁধছে, কেউ 'মাজারে'র দেয়ালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে এক জীবনে যা যা চাওয়ার তা চেয়ে নিতে ব্যস্ত, কেউ কেউ আবার বিশাল ডেকচিতে 'দান' করছে। সবার জীবনেই অনেক সমস্যা। বাবা শাহজালালই এখন তাদের একমাত্র ভরসা (নাউজুবিল্লাহ)। শাহপরানের মাজারেও একই অবস্থা। তিনি হলেন গরম বাবা। সকল অনুসারীগণ গরম বাবার মাজার জিয়ারত করার সাহস পান না। হালকা কোনো ভূল ত্রুটি হলেই নির্ঘাৎ কঠিন শাস্তি, সেই মাজারের নিয়মকানুনও তাই আলাদা। মাজার থেকে ফেরার সময় শরীরের পেছনের অংশ বাবার দিকে থাকলে বিরাট বেয়াদবি হয়, নামতে হবে তাই মাজারের দিকে মুখ দিয়ে, উল্টো হয়ে; এমন নিয়ম ছিলো একসময়, এখনও আছে কি না জানিনা। আমার পরিচিতদের থেকে জানলাম চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারের অবস্থা নাকি আরো শোচনীয়। দিল্লিতে নিজামুদ্দিনের মাজার দেখেছি, সেখানে পুরোপুরি সকল ধর্মের মিলনমেলা টাইপ অবস্থা। কাওয়ালী গান, তসবীহ, পাগড়ী, সিঁদুর পরা মহিলা সবমিলে একটা জম্পেশ ককটেল।
মূলত এসব 'মাজার ইন্ডাস্ট্রি' টিকে আছে প্রচুর মনভূলানো আর লোভনীয় শর্টকাটের ওপর। আপনি সুদ খান, দূর্নীতি করেন, চুরি করেন, কোনো সমস্যা নেই কিন্তু মাজারে দান করলে সব পাপ কাটা যায়। সকল পাপী মানুষেরই একটা মানসিক 'সাপোর্টের' প্রয়োজন হয়। প্রায় কোনো মানুষই নিজেকে খারাপ মনে করে, নিজেকে খারাপ জেনে শান্তিতে বাঁচতে পারে না। অপরাধবোধটা খুব জ্বালায়। তাই মানুষকে এটা জানতে হয় যে সে একজন খারাপ লোক না। দূর্নীতি, চুরি, সুদ এসব তো ভালো উদ্দেশ্যে করা হয়েছে এই সত্যায়নটা যদি কেউ করে দেয় তাহলে মনটা হালকা হয়। এই জায়েজ ঘোষনা করার কাজটা করার মাধ্যমেই 'মাজার শিল্প' আজ এক বিশাল অর্থের উৎস। শান্তির আশায় নতুবা ধর্মের এত কঠিন কঠিন রাস্তায় না গিয়ে কোনো চিপা বা শর্টকাটের মাধ্যমে যদি বেহেস্ত আর দুনিয়া দুটোই 'সিস্টেম' করা যায় তবে খারাপ কী! কী অদ্ভুত আমাদের চিন্তাগুলো!
শিরক বিষয়টা যে হেলাফেলা করার মতো নয় এই বোধটা না জন্মানোর কারণে আমাদের এমন বিপর্যয়। আমাদের ছোটবেলায় ইসলাম শেখাটা মুখস্তের ওপর দিয়েই যায়। আমরা শিখি বিভিন্ন ওয়াক্তের সালাতের আরবী নিয়্যত, শেখা হয়না আল্লাহর পরিচয় আর আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ। আমরা তাই শিরক কত ভয়াবহ ব্যপার আর কীভাবে আমরা আমাদের অজান্তেই শিরক করে ফেলি, এসব সম্পর্কে জানতেও পারি না। আমাদের উপর আল্লাহর অধিকার সম্পর্কে কোনো ধারণা আমাদের থাকে না তাই আল্লাহর অধিকার আমরা প্রতিদিন নষ্ট করছি বিপুল উৎসাহের সাথে, নেচে-গেয়ে, গাঁজার ধোঁয়ায়। এভাবেই বিভ্রান্ত মানুষ পথ হারিয়ে তলিয়ে যায় কোনো এক গভীর খাদের একদম তলানীতে, সরে যায় ইসলাম থেকে অনেক অনেক দূরে।
আল্লাহ আমাদের হিদায়াত দান করুন, আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১১৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন