আমার দেখা সাভার ট্রাজেডি ঃ কিছু বিশ্লেষণ
লিখেছেন লিখেছেন বইঘর ২০ মে, ২০১৩, ১২:৪০:২৭ রাত
২৪ এপ্রিল যথারীতি সকালের নাস্তা সেরে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। অন্যদিনের মতো এদিনও বাসা থেকে বের হওয়ার আগে টিভি চ্যানেলের শিরোণাম গুলোর দিকে নজর বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি টেলিভিশনের স্ক্রোলে দেখাচ্ছে, সাভারে রানা প্লাজা নামের একটি ভবন ধ্বসে পড়েছে, এ পর্যন্ত তিন জনের লাশ উদ্ধার, বহু হতাহত।
এটা দেখে খুব বেশি একটা কষ্ট হয়নি, কারণ এমন বহু ঘটনা আমাদের দেশে অহরহ ঘটে থাকে।
রিমোট টিপে অন্য একটি চ্যানেলে যাই, দিগন্ত টিভি। সেখানে দেখি সাভারে রানা প্লাজা নামের এক বহুতল ভবন ধ্বসে পড়েছে, ১৯ জনের লাশ উদ্ধার, বহু হতাহত। উদ্ধর কাজ চলছে, উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, ৠাব, পুলিশ সহ স্থানীয় লোকজন। আরো দু’একটি চ্যানেল ঘুরে দেখি একই খবর। তখন ব্যাপারটি বুঝতে আর বাকী রইলনা যে এটি একটি ভয়াবহ ঘটনা।
টিভি বন্ধ করে চলে গেলাম অফিসে। তবে এ ঘটনা দেখার কারণে অফিসে মন বসছিলোনা। একটু পর পর খবর শুনে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে বার বার চলে যাচ্ছিলাম টিভির পর্দায় আর দেখছিলাম লাশের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল সাভারে তো আমার এক ভক্ত আছে, দেখি তো একটু খোঁজ নিয়ে। ফোন করলাম, জানতে চাইলাম কি খবর, তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন- ‘আমি বলতে পারবোনা, এসে দেখে যান কী ভয়াবহ অবস্থা!’ আমার বুঝতে আর বাকি রইলনা।
এ দিন আর যাওয়ার সুযোগ হল না। পরদিন চললাম সভারের উদ্দেশ্যে, ততক্ষণে লাশের সংখ্যা দুইশ এর কাছাকাছি। গাবতলী যাওয়ার পর গাড়ি বন্ধ। হাজার হাজার মানুষ কেউ পায়ে হেটে, কেউ রিক্সা করে, কেউবা অন্য কোনো বাহনে ছুটে চলছে সাভারের উদ্দেশ্যে।
আমিও ছুটে চললাম পায়ে হেঁটে। কিছু দূর যাবার পর পুলিশের একটি গাড়িতে চড়ে বসলাম। একটানে চলে গেলাম ঘটনাস্থলে। গাড়ি থেকে নামার পর যা দেখলাম, সত্যিই তা বর্ণনা করার মতো নয়।
এ এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। এ যেন মৃত্যুপুরী। একের পর এক বের হয়ে আসছে লাশ। হাসপাতালের দিকে আহতদের স্রোত। তিল ধারণের ঠাঁই নেই হাসপাতালে। মাইকে ঘোষণা চলছে, ‘রক্ত লাগবে’। আহতদের বাঁচাতে ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা। অচেনা মানুষগুলো একে একে রক্ত দিয়ে যাচ্ছেন আহতদের জন্য। কেউ দু’হাত তুলে মুনাজাত করছেন সর্বশক্তিমান মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে।
স্বজনহারাদের বুকফাটা কান্নায় পুরো এলাকার বাতাস ভারি। শত শত মানুষ চাপা পড়ে আছে ধসে যাওয়া ভবনের নিচে। ছুটে গেলাম অধয় চন্দ্র হাইস্কুল মাঠে। সেখানেও একই অবস্থা। সারি সারি লাশ আর লাশ। স্বজনদের চিৎকারে ভারি হয়ে আসছে বাতাস। কান্না যেন তাদের থামছেনা, বেড়েই চলছে।
কেউ হারিয়েছেন মা, কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ হারিয়েছেন প্রিয় বোন। এখনো কত মানুষ ইট-পাথরের নীচে চাপা পড়ে আছে তার কোনো হিসাব নেই।
কে কাকে সান্ত্বনা দিবে! কতজনের জন্য কাঁদবে! সবাই ভাগ্যাহত, শোকাহত সবাই। কেউ স্বজন হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন প্রতিবেশী, বন্ধু বা পরিচিত জনকে। সাভারের বেশির ভাগ পরিবারেরই কেউ না কেউ হতাহত হয়েছেন। যেখানেই চোখ যায় শুধু কান্না আর কান্না। কাঁদছে গোটা সাভার। রানা প্লাজায় মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় গোটা সাভার এখন শোকাহত। কে কার স্বজন তার বাছবিচার নেই। যে যার মতো স্বেচ্ছায় পাশে দাঁড়িয়েছেন হতাহতদের।
উদ্ধার তৎপরতা, সাধারণ মানুষের সহমর্মিতা সরকারের যেকোনো বাহিনীর তৎপরতাকে ছাড়িয়ে গেছে। সবাই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে কখন দেখা মিলবে প্রিয় মানুষটির! কারো মা, বাবা, ভাই-বোন, অথবা স্বামী, স্ত্রী বা সন্তান আটকে পড়েছেন ভবনের মধ্যে। ঘটনাস্থলে দেখা হলো সোনিয়া বেগমের সাথে। তিনি পরিবারের সাতজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না। এক সাথে এতোজনকে না পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছেন। একবার ছুটে চলছেন হাসপাতালে আবার ফিরে আসেন ঘটনাস্থলে।
মোমেনা বেগম খুঁজছেন তার ছেলেকে। নূরজাহান বেগম খুঁজছেন তার মেয়ে নার্গিসকে। এমন বহু লোক খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার প্রিয়জনকে। এসব কিছু দেখার পর নিজের সাধ্য মতো কিছু কাজে শরিক হয়ে ফিরে আসি বাসায়। কিন্তু মনস্থির করতে পারছিলাম না, এ দৃশ্য দেখে। আল্লাহ যেন এমন ঘটনার আর পুণরাবৃত্তি না ঘটান। এমন দৃশ্য যেন আর আমাদের দেখতে না হয়।
সরকার ও বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর পরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সার্বিক খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন এবং পরের দিন শোক দিবসও ঘোষাণা করেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সব দলই শোক প্রকাশ করেছেন। তবে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- আমি শুনেছি, হরতাল সমর্থক বি এনপি এবং জামাত শিবিরের কিছু দুষ্কৃতিকারীরা ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে, ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটা কারণ হতে পারে।
মাননীয় মন্ত্রিকে বলতে চাই আপনি ইতিপূর্বে কখনো দেখেছেন যে কয়েকজন মানুষ একত্রে মিলে একটি ভবন টানাটানী করলে সেটি ধ্বসে পড়ে? যদি সত্যি এমনটি হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে জ্ঞানে, গুণে, স্বভাব চরিত্রে, গায়ের শক্তিতে এদেশের জামাত শিবির সবচেয়ে শক্তিশালী সুতরাং আপনার এদেশে আর থাকার কোনো দরকার নেই, চলে যান অন্যত্র কোথাও, তা না হলে শিবিরের দামাল ছেলেরা যে কোনো সময় আপনার বাড়ির দেয়াল ধরে নাড়াচাড়া শুরু করলে আপানি ও আপনার পরিবারসহ সবাই তার নিচে চাপা পড়ে যেতে পারেন, তখন উদ্ধার করার কেউ থাকবেনা।
আবার মহামান্য রাষ্ট্রপতি এদিনই শপথ গ্রহণ করে রানা প্লাজার পাশ দিয়েই চলে গেলেন জাতির পিতার কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে। এ টুকু সুযোগও তার হলো না শত শত মানুষের আর্তচিৎকারের পাশে দাঁড়িয়ে একটু সময় দেয়ার, সান্ত্বনা দেয়ার। কিইবা দরকার...
স্পেকট্রা, তাজরীন ফ্যাশন থেকে রানা প্লাজা
স্পেকট্রা, তাজরীন ফ্যাশন, রানা প্লাজা- এরপর কে? এমন প্রশ্ন এখন প্রতিটি নাগরিকের মুখে। গার্মেন্টশ্রমিকরা কি মানুষ নয়? তারা কি কুকুর-বিড়াল? এদের সাথে এমন আচরণ কেন করা হয়? এটুকু জানতে চাওয়ার অধিকারও কি আমাদের নেই? দারিদ্রের কষাঘাতে নিষ্পেষিত খেটে খাওয়া এ মানুষগুলোর জীবনের কি কোনোই মূল্য নেই? কেনো তাদের জীবনের দাম এতো সস্তা? সরকার কর্তৃক নিহতদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়েছে মাত্র বিশ হাজার টাকা! এমন হাস্যকার ব্যাপারটি না ঘটালেই কি হতো না? তারা কি কখনো পাবেনা তাদের জীবনের পূর্ণ নিশ্চয়তা। নাকি এভাবেই প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেশের উন্নয়নের চাকা সচল রেখে যাবেন আর নিজ জীবনের জন্য পাবেন মাত্র বিশ হাজার টাকা?
১১০ ঘণ্টা জীবনের স্বপ্ন দেখেও শেষ পর্যন্ত ছেলেটার মুখ আর দেখা হলো না শাহিনার!
কিন্তু কেন? সরকার বা কোম্পানি মালিকদের এ ব্যাপারে কোনোই দায়বদ্ধতা নেই কেন? ২০০৫ সাল থেকে ২০১৩ সালের ২৩ শে এপ্রিল পর্যন্ত ভবন ধ্বস ও অগ্নি কাণ্ডের মাধ্যমে নিহত হন ৭২৬ জন নিরীহ শ্রমিক। সর্বশেষ ২৪ এপ্রিল সাভার রানা প্লাজায় সরকারি হিসাব মতে সহাস্রাধিক লোক নিহত হন। এটা হলো সরকারি হিসাব। এর বাইরেও আরো বহু লোক রয়েছেন।
অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে গার্মেন্টশ্রমিকদের এভাবে মৃত্যু ঘটলেও এ ব্যপারে প্রতিরোধ মূলক কোনো কার্যক্রম না আছে সরকারের, না আছে ব্যবসায়ী মহলের। কোনো ট্রাজেডি ঘটলে সাথে সাথে তদন্ত কমিটি গঠিত হয় কিন্তু এ তদন্ত কমিটির কোনো ফলাফল সাধারণ জনগণ জানতে পারেনা। বরং তাদের নামে বরাদ্ধ কৃত টাকার লুটপাত ও তদন্ত কমিটির তথাকথিত তদন্তের মধ্য দিয়েই সব ধামাচাপা পড়ে যায়।
প্রতিটি ঘটনার পরই সরকার গার্মেন্টস বা ভবন মালিককে দোষারোপ করে বক্তব্য দিয়ে তাদের গ্রেফতার ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিলেও এ পর্যন্ত কোনো মালিককেই বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। এ ছাড়াও দুর্ঘটনার পর উদ্ধারসামগ্রীর অভাবে উদ্ধার কর্মিরা বার বার অসায়ত্বের কথা বলে আসছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার কোনোই পদক্ষেপ নেয় নি। শুধু পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়াধিন আছে এটাই শুনে আসছি। তা বাস্তবায়ন কবে হবে তাও জানা নেই সাধারণ মানুষের।
আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ
আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ। কলুর ছেলে কোটিপতি। এতো কিয়ামতের আলামত। কিয়ামতের অনেকগুলো আলামতের মধ্যে এ কয়েকটি হলো-
* নারীরা প্রকাশ্যে যিনা-ব্যাভিচারে লিপ্ত হবে।
* অট্রালিকা বিনির্মাণে নীচু শ্রেনীর লোকেরা প্রতিযোগিতা বরবে।
* নীচু স্তরের লোকেরা হবে জনসাধারণের মুখপাত্র।
* ইলামী আহকামের তাচ্ছিল্য করা হবে।
* বাদ্য ও ব্যভিচারকে হালাল মনে করা হবে।
* সুন্দরী নারীরা ছেলেদেরকে খারাপ পথে আহ্বান করবে।
* অযোগ্য লোকেরা দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে।
এ ছাড়াও আরো বহু বিষয় এমন রয়েছে যা বর্তমান সময়ে অহরহ ঘটে চলেছে। সচেতন পাঠন মহল আপনারা একটু ভেবে দেখুন তো এগুলোর কোনো একটি আলামত কি কলুর ছেলের মাঝে পাওয়া যায় কিনা?
যদি পাওয়া যায় তাহলে আমাদের কি করা উচিত? আফসোস, আমরা আমাদের নেতাকে নির্বাচন করতে বার বার ভুল করছি। যদি আমাদের শাসন-ব্যবস্থা কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক হয় তাহলে হয়তোবা আমরা এ জাতীয় অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে পারি। অন্যথায় এ অভিশাপ নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। অপঘাতে মরে থাকতে হবে পথের পাশে, জীবনের মূল্য নির্ধারিত হবে বিশ হাজার টাকা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এ জাতীয় অভিশাপ হতে রক্ষা করুন। আমীন।
-এস এম আমিনুল ইসলাম
বিষয়: বিবিধ
১৮৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন