গল্প :: ফুলতলা
লিখেছেন লিখেছেন বইঘর ০১ মে, ২০১৩, ০৯:২১:১৬ রাত
- তোমার নাম কী?
- ফুলতলা।
- আমার সাথে যাবে?
- কোথায়?
- আমার বাসায়। আমার দুটো মেয়ে আছে। তোমার বোন। ওদের সাথে খেলবে, বেড়াবে।
মিজানের সাথে এভাবেই শাহবাগ মোড়ে পরিচয় হয় মেয়েটির। দশ কি বারো বছর বয়স। লিকলিকে কালো, বড় বড় চোখ। অসম্ভব মায়াবি মুখাবয়ব। ঘাড় বেয়ে পড়া ধুলোমাখা উষ্কখুষ্ক চুলের ছোট্ট মেয়েটি সেখানে ফুল বিক্রি করছিল।
সিগন্যাল পড়লেই তার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। পারলে এক রকম জোর করেই ফুলের মালা কিংবা ফুল ধরিয়ে দেয় ক্রেতার হাতে। কেউ ধমক দেয়, কেউ চেয়ে চেয়ে দেখে, কেউ আগ্রহের সাথে ফুল কেনে, কেউবা আবার এদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় মগ্ন হয়ে যায়।
ফুলতলা রাজি হয়ে যায়। মিজানের সাথে তার কালো গাড়িতে করে চলে আসে মিজানের বাসায়। মিজানের স্ত্রী দুলদুল মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়। নাম পরিচয়হীন এমন মেয়েকে কেন সে বাড়িতে নিয়ে এল এ জন্য মিজানকে কিছুটা মন্দ বলে। তবে মিজানের মেয়ে দীপ্তি ও দিবা ফুলতলাকে পেয়ে ভীষণ খুশি।
দুলদুল ফুলতলাকে কোথায় থাকে, কে কে আছেÑ এমন নানাবিধ প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলে। যদিও অনেক দিন ধরে একটি কাজের লোকের অভাবে তার ত্রাহি ত্রাহী অবস্থা। সেদিক থেকে চিন্তা করলে তার সোনায় সোহাগাই হয়েছে বলতে হবে।
ঘরের পেছনের দিকের বারান্দার সাথে সার্ভেন্ট বাথরুম। ফুলতলাকে সেদিকে নিয়ে বাথরুমটি দেখিয়ে দিল দুলদুল। কিভাবে সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে গা পরিষ্কার করতে হবে, কিভাবে শ্যাম্পু করতে হবে সব বুঝিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ডিরেকশন দিয়ে ফুলতলাকে গোসল করাল ।
ফুলতলাও মহা আনন্দে সাবান-শ্যাম্পু পেয়ে ইচ্ছেমতো গোসল করল। গোসল করে বের হয়ে আসতেই তার চেহারা চেঞ্জ হয়ে গেল।
যা-ই হোক, তেল, ক্রিম, লোশন, পাউডার সবই দেওয়া হলো তাকে। এবার শুরু হলো খাবার পর্ব। রুটি, ভাজি, ডিম দিয়ে নাশতা সারল বিকেলের। নতুন জামাও পেল। দীপ্তির একটা পুরনো জামা আপাতত তাকে দেওয়া হলো। এবার সুযোগ করে দেওয়া হলো দীপ্তি ও দিবার সাথে খেলা করার। দীপ্তির বয়স নয় আর দিবার ছয়।
সুতরাং ফুলতলার সাথে খেলতে বা ফুলতলার তাদের সাথে এডজাস্ট হতে কোনো সমস্যাই হলো না।
কখনো লুকোচুরি কিংবা পুতুল খেলা, কখনো বারান্দায় বসে ছড়া আবৃতি কিংবা গান করা- এসব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল তারা।
অবশ্য এর মধ্যে দুলদুল কয়েকবার বকুনি দিয়েছে তাদের, কিন্তু কে শোনে কার কথা। তারা তাদের মতো করেই খেলে চলছে। বাচ্চারা বড়দের বকুনি বেশিক্ষণ মনে রাখতে পারে না।
রাতে টিভি দেখা, খাওয়াদাওয়া করা ও থালাবাসন পরিষ্কার করা এসব পর্ব শেষ করে মেঝেতে ঘুমুতে যায় ফুলতলা।
কখন যে দুচোখের পাতা ভারি হয়ে চোখ বুজে আসে বুঝতে পারে না সে। সামনে দেখতে পায় বিরাট একটা বাঘ তাকে বলছে, তুমি কে?
ফুলতলা বলল, আমি ফুলতলা।
- আমার পিঠে চড়বে, তোমাকে এ বন ঘুরে দেখাব।
- না, তোমার সাথে ঘুরব না, যদি তুমি রাগ করো তাহলে আমার কী হবে?
এমন সময় ঘুম ভেঙে যায় ফুলতলার। নাশতার টেবিলে রকমারি নাশতা, চা ইত্যাদি দিয়ে নাশতা সারল ঘরের সবাই। ফুলতলাও বাদ গেল না, সেও ডাইনিং টেবিলে বসে সবার সাথেই নাশতা সারল।
ফুলতলাকে এত ভালো লাগছে দেখে মনেই হচ্ছে না সে বাইরের কেউ, মনে হচ্ছে এ সংসারেরই একজন। নাশতা খাওয়া হলে মিজান মেয়েদের নিয়ে গাড়িতে করে স্কুলে দিতে গেল।
ফুলতলাকে নিয়ে দুলদুল কাজে লেগে গেল। ফ্রিজ থেকে একটা বড় রুই মাছ বের করে ফুলতলাকে কাটতে দিল। ফুলতলা এটা কাটতে পারবে না বলে অপারগতা প্রকাশ করে। দুলদুল ফুলতলাকে দেখিয়ে দিল কিভাবে মাছটি কাটতে হবে। ফুলতলা সাধ্যমতো সুন্দর করে মাছটি কেটে দিল।
এরপর মাছ ধোয়ার পালা ও রান্নাবান্নার অন্যান্য কাজ শুরু করে দিল। অনেকক্ষণ কাজ করতে করতে ফুলতলা হাঁপিয়ে উঠল। দুলদুল সেটা আঁচ করতে পেরে ড্রইংরুমে টিভিটা ছেড়ে দিল।
কোন চ্যানেল দেখবে জিজ্ঞেস করতেই ফুলতলা বলল, নাটক দেখবে। দুলদুল নাটক হচ্ছে এমন চ্যানেল টিউন করে রান্না ঘরে চলে গেল। অবশ্য ইতিমধ্যে রান্নাবান্নার কাজও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ফুলতলাকে বলে দুলদুল বেডরুমে চলে গেল। কেউ এলে তাকে বলে যেন দরজা খোলে, সে ব্যাপারে সতর্ক করে গেল।
দুপুর দুটার দিকে মিজান বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় ফিরল। এসে দেখে পুরো বাসা ফিটফাট। সবকিছু পরিপাটি গোছানো। একটু অন্য রকম।
মিজান বুঝতে পারল এটা নিশ্চয়ই ফুলতলার কাজ। তবু সে জোরে ডেকে ডেকে বলল, এত সুন্দর করে ঘর কে গোছাল।
দুলদুল বলল, তোমার ফুলতলা গুছিয়েছে।
ওর মধ্যে একটা বড় রকমের গোছানো গুণ রয়েছে। আমাকে কিছুই বলতে হয়নি। সে নিজ থেকেই ওগুলো করেছে।
মিজান আবার হাসি হাসি মুখ নিয়ে ফুলতলাকে বলল, কি রে, তোর সব পছন্দ হয়েছে তো। তোর জন্য সালোয়ার-কামিজ নিয়ে এসেছি, নে এটা নিয়ে পরে আয়, দেখি তোকে কেমন দেখায়।
অপূর্ব লাগছে ফুলতলাকে। মনে হচ্ছে দিবা ও দীপ্তির আরেকটি বোন।
-দুলদুল, কোথায় গেলা? এসো, খুব ক্ষুধা পেয়েছে, তাড়াতাড়ি খাবার দাও।
-দিচ্ছি, দু মিনিট অপেক্ষা করো।
দুপুরে আয়েশ করে সবাই খেল। পোলাও রান্না হয়েছে। বিশেষ করে ফুলতলার জন্য। ওর হাসিমাখা অসম্ভব মায়াবি মুখ দেখলে যে কেউ মায়ায় পড়ে যাবে।
সবাই দুপুরে শরীরটাকে এলিয়ে দিতে বিছানায় চলে গেল। ফুলতলা চলে গেল রান্নাঘরে। পাশের বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ কথা বলল। ভাব করল। অতঃপর মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল রান্নাঘরে।
দিবা ও দীপ্তি চুপিচুপি এসে ফুলতলাকে ডেকে তুলল। বলল তাদের সাথে খেলা করতে, আব্বু আম্মু ঘুমিয়েছে। চল ড্রইং রুমে গিয়ে খেলা করি। ড্রইং রুমে গিয়ে তারা খেলা করতে লাগল। ফুলতলা যা বলে তাই শোনে দিবা আর দীপ্তি। তার ডিরেকশনেই চলল খেলাধুলা।
তারপর রংপেনসিল নিয়ে চলল কতক্ষণ আকাঁজোকা। খেলতে খেলতে যখন দিবা, দীপ্তি টায়ার্ড হয়ে গেল, তখন ফুলতলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল শোবার ঘরে।
শেষ বিকেলের দিকে ঘুম থেকে উঠল মিজান। দুলদুল আতঙ্কভরা চোখমুখ নিয়ে মিজানকে বলল, ফুলতলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে দরজা খুলে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। তবে কিছু নিয়ে যায়নি। সবই ঠিক আছে। তার পরনে ছিল নতুন জামা কাপড়, সেটা পরেই চলে গেছে।
শুনে মিজান একটা ধাক্কা খেল। হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। কী করবে বুঝতে পারছে না। মাথাটা ভনভন করতে লাগল। চিন্তা করল কোনো ভুল করেছে কি না, যার জন্য মন খারাপ করে ফুলতলা চলে গেছে। নাকি ওরা এভাবেই যায় তাও বুঝতে পারছে না।
দুলদুলকে বলল শান্ত হতে। বলল, দেখি কী করা যায়। শার্ট-প্যান্ট ও স্লিপারটা পায়ে গুঁজে গাড়ি নিয়ে দুই মেয়েসহ বেরিয়ে পড়ল। ঠিক যেখানে ফুলতলাকে পেয়েছিল শাহবাগের মোড়ের সেখানে গেল।
এসে ঠিকই পেয়ে গেল ফুলতলাকে। অবাক হলো মিজান। উত্তরা থেকে কিভাবে এখানে এল সে!
তারপর ভাবল, পথে পথে যাদের দিন কাটে তারা পথ ভোলে না। মিজানের কোনো রাগ হলো না। নিজেকে সামলে ফুলতলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল দিবা-দীপ্তির হাত ধরে।
ফুলতলা বসেছিল ফুটপাতে। তাদের দেখে উঠে দাঁড়াল। বলল, স্যার আইছেন, খুব ইচ্ছা করছেলে আপনাদের বাসায় থাকমু। কিন্তু মন টেকলে না। কী করমু স্যার, মন না টেকলে থাহা যায়? আপনি আমারে অনেক ভালোবাসছেন। নতুন জামা কিন্না দেছেন। দুইডা বোন দেছিলেন, ভালো খাইতে দেছেন, টিলিভিশন দেখতে দেছেন। কিন্তু মোর রাস্তাই ভালো, রাস্তাই ভালো লাগে, ফুল বেচতেই ভালো লাগে। আপনাগো লাইগ্যা মায়া লাগে, কিন্তু মুই যামু না।
তারপর যতবার, যত দিন ওই পথ দিয়ে মিজান, দুলদুল বা দিবা-দীপ্তি যায় তৃষ্ণার্ত দুচোখ খুঁজে বেড়ায় প্রিয় ফুলতলাকে।
কখনো ফুলতলার দেখা মেলে, কথা হয়। কখনো দূরে দেখা যায় ফুল বিক্রির জন্য ছোটাছুটি করছে। আবার কখনো দেখা মেলে না, ভারাক্রান্ত হয় মন।
- এস এম আমিনুল ইসলাম
বিষয়: বিবিধ
১৫৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন