২১শে এপ্রিলের একান্ত অনুভূতি: যে বেদনার শেষ নেই!
লিখেছেন লিখেছেন সালমা ২১ এপ্রিল, ২০১৪, ০৪:৫৩:১২ বিকাল
আজ ২৬শে মার্চ ১৯৯৮, সন্ধ্যা ৭.৫০মিনিট! বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষা, কষ্ট ও ক্লেশের আঘাত শেষে, আমার কোল জুড়ে এলো চাঁদের মত ফুট ফুটে এক পুত্র সন্তান। মুহূর্তে মা হবার সব কষ্ট ভুলে গিয়ে বাচ্চার আদরণীয় মুখটি আমাকে আনন্দময় করে তুলল। বাচ্চাটিকে দেখছি আর ভাবছি, আমি মা হয়েছি! সত্যিই আমি মা হয়েছি! প্রথম সন্তানের মা হবার সে এক অন্য রকম অনুভূতি, যা আমি লিখে বুঝাতে পারব না। বাচ্চাটি দেখতে খুবই মায়াবী, পুরো শরীর পশমে ভরা। হাসি হাসি চেহারা, তাকালে মনে হয় মুখ জুরে চাপ দাড়ি, হলুদ ফরসা গায়ের রং, মায়াবী চাহনি, সব মিলিয়ে এক অসাধারণ সুন্দর বাচ্চা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
বাচ্চা পেয়ে তো ভীষণ খুশি হয়েছি, তখন খুব ইচ্ছা করছিল আমার সেই খুশিটি যদি বাচ্চার বাবার সাথে শেয়ার করতে পারতাম! ইচ্ছে করছিল বাচ্চাটিকে এক সঙ্গে দু-জনে বসেই দেখব, আর শেয়ার করব প্রথম মা-বাবা হওয়ার অনুভূতি। তা আর হল না, কেননা তিনি প্রবাসে! কল্পনার জগতে কোলে বাচ্চা নিয়ে আপন মনে এসব নিয়ে একাকী ভাবতে রইলাম। হঠাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজে, ভেঙে দিল মধুর কল্পনার জগত। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেক কষ্টে সে কাঁদছে। আমার মা কে ডাক দিলাম, তিনি দৌড়ে এলো জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? বললাম, দেখেন তো কেমন কষ্ট করে সে কাঁদছে! মা বললেন, দেখ প্রস্রাব করেছে কিনা। পরীক্ষা করে দেখলাম হ্যাঁ তাই, প্রস্রাব করছে। মা হেসে বললেন, তোমার ছেলে ভিজে জায়গায় থাকতে পছন্দ করছে না বলে কান্না করেছে। মায়ের কথায় যুক্তি আছে, আমার ও তাই মনে হলো। তারপরও ওর কান্নাটা আমার কাছে যেন অন্য রকম মনে হলো। মাকে আবারো বুঝিয়ে বললাম ও যখন কান্না করে তখন দেখতে অন্য রকম মনে হচ্ছিল, সে যেন অনেক কষ্ট করে কাঁদছিল! মা আবারো হেসে বলল! তুমি প্রথম মা হয়েছ তাই তোমার এমনটি মনে হচ্ছে। আমিও ভাবলাম তাই হবে।
আমরা ছয় ভাই-বোন, তাই আমার চেয়ে মায়ের অভিজ্ঞতা বেশিই হবে। এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। আবার চলে গেলাম ভাবনার জগতে, এবার ভাবছি, সন্তানের বাবাকে কিভাবে জানাব খবরটি! চিঠি লিখব, নাকি ফ্যাক্স করব। তখনও বাসায় ফোন ছিল না। তাছাড়া ফোনে জানাতে হলে আমাকে যেতে হবে রাস্তার মাথায় ফোনের দোকানে। অন্য কাউকে পাঠিয়ে এই সংবাদ দেওয়া সম্ভব ছিল কিন্তু আমার ইচ্ছা হচ্ছিল আমার মুখেই তাকে সু-সংবাদ শুনাই। এই মুহূর্তে তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা তখনকার পরিবেশ ও সুবিধা আজকের মত ছিলনা। এভাবে ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে গেল, কিভাবে একটি লম্বা রাত পার হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। সকালে বাচ্চা আবারও কান্না করতে থাকল; তার কান্না শুনে আমার মা বোন নানী দৌড়ে এলো। বলল দেখ প্রস্রাব করছে কিনা! ছোট বোনটি তল্লাশি করে বলল, আপা সে প্রস্রাব করেছে। শুনে সবাই পুনরায় হেসে উঠে বলল, আমাদের ছেলেটা খুব লক্ষ্মী হয়েছে, তাই প্রস্রাব করলেই কান্না করে। সবাই এটা নিয়ে হাসা হাসি করছে!
আজ দেশের স্বাধীনতা দিবস! ছোট ভাইবোনেরা আলোচনা করছিল, নবজাতকের নাম ‘স্বাধীন’ রাখা হবে। ভাবলাম শুনতে খারাপ লাগবে না, তবে বাচ্চার পিতা পত্রের মাধ্যমে কন্যা ও পুত্রের জন্য একটি করে নাম বাছাই করে আগেই পাঠিয়েছিল। কাউকে বলা হয়নি, সে নাম গুলোর প্রভাব কেমন হবে চিন্তায় আবারো মগ্ন হলাম। সকালে শ্বশুর বাড়ীতে কাউকে পাঠিয়ে খবর পাঠানো সম্ভব হয়নি, স্বাধীনতা দিবসের দিনে সকালে গাড়ীতে চড়লে, নতুন মুসিবতে পড়তে হয়! আধা মাইল অন্তর অন্তর রাস্তায় গাড়ী আটকিয়ে স্বাধীনতার বকশিশ তোলা হয়। সম্ভবত তখন থেকেই দেশে স্বাধীনতার নাম ভাঙ্গিয়ে দেশে প্রকাশ্য চাঁদাবাজির যাত্রা শুরু হয়! ভাবলাম আজ সকালে কাউকে পাঠিয়ে শ্বশুড় বাড়ীতে খবর পৌঁছাতে হবে, কিন্তু তার কান্নার আচরণে আমার স্বপ্নগুলো যে গুলিয়ে আসছিল। বাচ্চাটি ডাক্তারের দেওয়া তারিখের আগে জন্মেছে। তাই অগ্রিম প্রস্তুতি কেউ নিতে পারেনি, তার জন্ম সংবাদ গ্রামের বাড়ীতে গেলে, খুশীতে অনেকই চলে আসবে, হবে মহা ধুমধাম।
চিন্তা করছি, বিদেশী কোম্পানিতে আমার একটা ভাল চাকুরী ছিল। আমি যে কোন পোশাক দেখলে, হুবহু সেটার মত করে স্যাম্পল কাটতে পারি। যত জটিল পোশাক হউক না কেন, তা হুবহু কাটতে পারাটা আমার হাতের নস্যি ছিল! সকল ধরনের পোশাক, জটিল আকৃতির জ্যাকেট সহ সবটাই শতভাগ নিপুণতার সহিত কাটতে পারতাম। এই গুন আমি মায়ের নিকট থেকেই পেয়েছিলাম। বর্তমানে এই গুন অর্জন করতে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হয়, ডিগ্রিও পাওয়া যায়। একটি বিদেশী বায়িং হাউস আমার এই যোগ্যতাকে লুফে নিয়েছিল। বহু বেতন ও সকল প্রকার সুবিধা সহ চাকুরী করতাম। পোশাক শিল্পে আমার পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোম্পানির লাভ লোকসান এই যায়গা থেকেই নির্ধারিত হয়। আমার অব্যাহত সাফল্যের কারণে, প্রতি ছয় মাস অন্তর প্রমোশন মিলত। খুবই আধুনিক মন মস্তিষ্কের ছিলাম। বিয়ের আগেই স্বামীর শর্ত ছিল, চাকুরী ছাড়তে হবে। তাই আগে চাকুরী ছেড়েছি, তারপর বিয়ে করেছি। বিয়ের পরও এই চাকুরীর অফার দীর্ঘদিন ঝুলেছিল! স্বামীকে অনুরোধ করা হয়েছিল যাতে করে দৈনিক চার ঘণ্টার জন্য হলেও চাকুরীটা করি। স্বামী এটাতে আগ্রহী ছিলেন না! তাঁর কথা প্রয়োজনে তুমি নিজে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোল তারপরও চাকুরী নয়।
আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমাকে খুব পছন্দ করত। গ্রামের বাড়ীতে গেলে, মহা হই হুল্লোড় ও মেজবান বসে যেত। আমি যতবার যখনই বাড়িতে যেতাম, সেই রাত্রে শাশুড়ি গ্রামের সকল ভাবীদের দাওয়াত করতেন। এতে আমার পরিচিতি বেড়ে যায়, আমার পরিচিতির সুবাদে অনেক বেকার যুবক-যুবতীদের চাকুরী দিতে পেরেছি। শহরে বড় হয়েছি, দীর্ঘদিন চাকুরী করেছি, নিজে অন্তঃসত্ত্বা, তাই শাশুড়ি আমাকে আমার বাবা-মায়ের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন। চাকুরী ছেড়ে দিলেও আমার কাছে খারাপ লাগত না, চেষ্টা করতাম সঠিক সময়ে নামাজ পড়তে, বই পড়তে, কুরআন পড়তে। ইসলাম সম্পর্কে আগে বিস্তারিত ধারনা ছিলনা, স্বামীর মাধ্যমেই জানতে শুরু করলাম। বিয়ের পরে তিনি যে কাজটি প্রথমে করলেন, তা ছিল; আমার জনতা ব্যাংকের একাউন্ট বন্ধ করে, সুদের লাভগুলো গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে, মূল টাকাটা আলাদা করে ইসলামী ব্যাংকে রাখা। দীর্ঘদিনের জমানো টাকার লাভটা এভাবে চলে যাবে ভাবিনি! তখন চিন্তা করতাম মানুষটা কেমন জানি! এখন বুঝতে শিখেছি কাজটা উত্তম ছিল। বিনিময়ে তিনি সেই লাভের দ্বিগুণ টাকা আমাকে নগদ বকশিশ দিয়েছেন! সন্ধ্যা হলেই পুরানো বান্ধবীদের কেউ না কেউ এসে যেত। এভাবে সে দিন গুলো কেটে যেত। তারপরও আজকের এই সুন্দর একটি দিনে খুশীটা ভাগাভাগি করার জন্য স্বামীর অভাব খুব অনুভব করছিলাম!
থেমে থেমে তার কান্না যথারীতি চলছিল, তৃতীয় দিন নজর করে দেখলাম বাচ্চার পেট ফুলে গিয়েছে। মা-বাবা দুজনকেই ডাকলাম, তারা দেখার পর ডাক্তারের কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। ডাক্তার সব কিছু চেকআপ করে বললেন শিশু হাসপাতালে যেতে। শিশু হাসপাতালে যখন পৌঁছি তখন রাত তিন টা। এতবড় হাসপাতালে কোন মতে একজন ডাক্তার খোঁজে পেলাম। ডাক্তার তার মত করে চিকিৎসা শুরু করলেন। প্রচুর রক্ত নেওয়া হল, আমরা সবাই পুরোদিন অপেক্ষায় রইলাম। প্রতিটি মুহূর্ত আশা করতাম, কখন আমার কলিজার টুকরা সুস্থ হয়ে উঠবে, সেও আমাকে গলা জড়িয়ে ধরবে। বিকাল নাগাদ ডাক্তারেরা সকল পরীক্ষা গুলো বিশ্লেষণ করে জানাল, আমার বাচ্চার একটি কিডনিই নাই! সেটাও সমস্যা ছিলনা, সমস্যাটা হল তার প্রস্রাবের রাস্তায় একটা পর্দা বাধা হয়ে আছে। এ কারণে সে ভাল করে প্রস্রাব করতে পারে না, যখন প্রস্রাবের বেগ হয়, তখন তার খুব ব্যথা হয়, তাই সে প্রস্রাবের আগে কান্না করে! এই পর্দাটি সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করা যাবে, তাহলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। তারা বলল, সার্জারি শিশু হাসপাতালে সম্ভব, এবার শুরু হলো আমার অপেক্ষার পালা। কখন হবে সার্জারি, কখন আমার মোনা-মনি সুস্থ হবে, কখন তাকে বাসায় নিয়ে আসতে পারব।
দিন যায়, রাত যায় ডাক্তার একটার পর একটা পরীক্ষা করছে, এসব করতে করতে আমার মূল্যবান ১৫ টি দিন নষ্ট করে দিল! অবশেষে ডাক্তারেরা কোন সার্জারি তো করল না বরং আমাকে বলা হল চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সেখানে ভর্তি হলাম, আবার নতুন করে শুরু করল রাজ্যের পরীক্ষা, এসব পরীক্ষাগুলো প্রচুর টাকার বিনিময়ে বাহির থেকে করাতে হচ্ছিল। এক একটি পরীক্ষার রেজাল্ট পেতে কয়েকদিন লেগে যেত। সুঁই ঢুকাতে ঢুকাতে বাচ্চার কচি শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেল! আবার নতুন পরীক্ষা, এভাবে কয়েকদিন পরে সিদ্ধান্ত আসল, ডাক্তারেরা মেডিক্যাল বোর্ডে বসবে। তারপর বিস্তারিত জানতে পারব কখন সার্জারি হবে। আবারো অপেক্ষার পালা, সর্বত্র এক দায়সারা গোছের কর্তব্য। আপদ কালিন সেবা হিসেবে, তার প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে একটি টিউব ঢুকিয়ে প্রস্রাব বের করার ব্যবস্থা করল। এতে তার ব্যথা আরো বেড়ে গেল। কেউ কেউ পরামর্শ দিল, যে ডাক্তার মেডিক্যালে দেখে, তারা চেম্বারেও বসেন, যদি ভাল ফি দিয়ে চেম্বারে দেখা করি, তাহলে মেডিক্যালের কাজ দ্রুত হবে!
ততদিনে বাচ্চাটি আমার গালে হাত দিয়ে তার কষ্টের কথা জানাতে শিখেছে। শক্ত করে আমার চুল ধরে কাছে টানতে শিখেছে। আমার বুঝতে কষ্ট হত না এটা তার মনের কথা জানানোর একটা প্রক্রিয়া। ডাক্তারের পিছনে ছুটা সে কি এক মহা লড়াইয়ের মত। বুঝতে পারলাম ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরাই এখানে জলদি সুযোগ পেয়ে থাকেন। কোরবানির দিন এসে গেল, ডাক্তারদের গ্রামে যেতে হবে। শত শত রোগী, যে যেভাবে আছে, তারা সেভাবে পরে রইল, আমিও বুঝতে পারলাম এই যাত্রায়ও অপারেশন হবেনা। বস্তুত হয়নি, ঈদের পরে ডাক্তার কেউ আসল, কেউ আসল না, যথারীতি আবারে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হল। ডাক্তারদের পকেটে যথারীতি টাকা যেতে থাকলেও প্রতিবাদের সুযোগ নাই। কেননা সন্তান তো আমার, আমারই কলিজা ছিদ্র হয়েছে, তাই এই জুলুম আমাকে মেনে নিতেই হবে। এক টানা এত দিন চট্টগ্রাম মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে থাকা কতটা কষ্টের তা আমি ভাষায় বুঝাতে পারব না। দেশের পরিস্থিতি ভাল ছিল না। এক টানা অনেক দিন হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। বন্দর টিলা থেকে মেডিক্যালে প্রত্যহ আসা যাওয়া চরম কষ্টকর, তখনও আমি সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি। ইতিমধ্যে এই খবর আমার বিদেশী কোম্পানির কর্মকর্তাদের কানে যায়। এক বছরের বেশী আগে চাকুরী ছাড়লেও, তাদের বদান্যতা বোধে কোন কার্পণ্য ছিল না। আমার সন্তানকে দেখার জন্য যখন সকাল সন্ধ্যায় বিদেশীদের আগমন দেখল, তখন ডাক্তারদের টনক নড়ল! তারা আর গড়িমসি না করে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিল।
অপারেশনের সিদ্ধান্ত যখন ফাইনাল, সেদিনই বাচ্চার শরীরে জন্ডিস দেখা গেল। নতুন সমস্যা, নতুন ভোগান্তি। ফলে ইনকিউবেটরে তাপ দেবার প্রয়োজন হল। এত যাতনা ভোগের পরে নতুন জন্ডিসে সন্তানের শরীর হলুদ হতে লাগল। সেদিন প্রথম সে আমার সাথে হেসেছিল, দীর্ঘক্ষণ আমার মুখের পানে তাকিয়েছিল, আমার নাক ধরার চেষ্টা করছিল, মুখমণ্ডলে হাত রাখার প্রচেষ্টা ছিল। দীর্ঘ দিন আরাম করতে পারিনি, অনেক রাত ঘুমোতে পারিনি, তবে আজকের রাতটি আমার কাছে ভিন্ন ধরনের লাগল কেননা আজই আমার অবুঝ সন্তানটি তার মাকে চিনে নিতে পেরেছে। রাত্রির শেষ প্রহর, তাকে ইনকিউবেটরে ঢুকিয়ে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছি। বাহিরে প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড় চলছে। ঘন ঘন বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর আওয়াজে পুরো মেডিক্যাল বার বার কেঁপে উঠছিল। আরাম করার জন্য আজকে একটু সময় পেয়েছিলাম কিন্তু কাল বৈশাখীর ভয়ানক আচরণ আমাকে বাধাগ্রস্ত করছিল।
ক্ষণিকের জন্য একটু তন্দ্রা পেয়েছিল; স্বপ্নে দেখলাম আমার সন্তানটি আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই তন্দ্রা ছুটে গেল, দৌড়ে ইনকিউবেটর থেকে তাকে বের করলাম, দেখলাম সে প্রায় নিথর নিস্তব্ধ! একবার চোখ মেলে তাকাল, মুখে পানি দিলাম, সম্ভবত পানি টুকু গিলে নিল, অনুধাবন করার জন্য তার মুখে আমার শাহাদাত আঙ্গুল দিলাম, আঙ্গুলে হালকা করে কামড় বসাল এবং মাথাটি একদিকে কাত হয়ে গেল! মনে হল সে সম্ভবত আমার শেষ বারের সান্নিধ্যটুকু আশা করেছিল। আমি শুধু তার মুখ পানে তাকিয়েই রইলাম। নিশ্চিত বুঝতে পারলাম সে আর কোনদিন মাথা সোজা করবে না, কান্না করে বারে বারে বিরক্ত করবে না! এত কাছ থেকে কোন আপনজনের মৃত্যু কোনদিন দেখিনি! বোবা কান্নায় থমকে দাড়িয়ে আছি; মা পাশেই ছিল, তিনি নাতির লাশটি গ্রহণ করলেন। রাত্রে মেডিক্যালে কোন পুরুষ থাকতে পারেনা, তাই আত্মীয় স্বজন কেউ এখনও তার মৃত্যু সংবাদ পায়নি। কালবৈশাখী এড়িয়ে কারো পক্ষে বের হওয়া সম্ভব নয়। ডাক্তারেরা অপারেশনে দেরী করলেও, লাশের ছাড়পত্র দিতে দেরী করল না! সকাল হলেও বাহিরে ঘোর কাল অন্ধকার, বিজলীর চমকে রাস্তা দেখা যায়। ১৯৯৮ সালের ২১শে এপ্রিলের ভয়ঙ্কর এক কালো সকালে বিজলীর চমকের সাহায্য নিয়ে যখন আমি মেডিক্যাল থেকে অনিশ্চিত গন্তব্যে বের হলাম, তখন আমার পিছনে ডাক্তারেরা, আমার পথ পানে তাকিয়ে রইল!
বিষয়: বিবিধ
২৫১৬ বার পঠিত, ৩৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দোয়া করি বাচ্চাটাকে আপনার জাঁন্নাতের উছিলা করে দিন।
জাযাকাল্লাহ খায়ের
গত ২২.১২.২০১৩ তরিখে আমরাও অমাদের সোনামুনিকে হারিয়েছি। আমি অনেকবার লিখব ভেবেছি কিন্তু লিখতে পারিনি। বুক ফেটে কান্না চলে আসে।আল্লাহ তায়ালা আমাদের ধৈর্য্য ধরার তাওফিত দিন। আমীন।
সহানুভূতি জানাই- দোয়া করি-
যদিও পুরুষের পক্ষে এ কষ্ট বুঝতে পারা সম্ভব-ই নয়!
আমার আম্মা আমার তিন ভাই-বোনকে শৈশবেই বিদায় দিয়েছিলেন- প্রথমজনও তার মধ্যে!
বাকিদের সবার বড় আমি, তাই অন্য দুজন তো ...
৬৭বছর বয়সে তাঁর নিজের নিজের বিদায়ের আগ পর্যন্ত আম্মা সেসব স্মৃতিচারণ করতেন খুব স্বাভাবিকভাবে- যেন গতকালের ঘটনা- অন্য কোন মায়ের! তিনি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না.. আল্লাহতায়ালার ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকার ব্যাপারে অসাধারণ সহনশীল ছিলেন তিনি
শিশুসন্তানহারা সকল মু'মীনা মায়ের জন্য আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রতিশ্রুত সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন!(আমীন)
তারা কোন অবস্থাতেই কারো বিরক্তের কারণ হবেনা। এদের একেক জনের চেহারা হবে অতীব সুন্দর, যে চেহারার মাধুর্যতা দুনিয়ার কোন মানুষ কোনকালে দেখেনি। তাদের পোশাক হবে মণি মুক্তা খচিত এবং পোশাকী অলংকার থেকে আলোক রশ্মির বিচ্চুরণ ঘটবে। এদের একজনের সৌন্দর্য অন্যজনের মত হবেনা, ফলে জান্নাতি মানুষ তাদের নিয়ে গর্ব অহংকার করবে।
এরা এভাবে জান্নাতে বসবাস কারণ হল, দুনিয়ার তারা এমন কোন ভাল কাজ করেনি যদ্বারা তারা জান্নাতের দাবীদার হতে পারবে, আবার এমন কোন অন্যায় কাজ করেনি যদ্বারা তারা জাহান্নামে যাবে, এটা মহান প্রভু আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া।
যে সব মাসুম সন্তানের পিতা-মাতা মুসলিম হবে, সে সব পিতা মাতাকে বিপদ থেকে উদ্ধারে এসব মাসুম সন্তান সেদিন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করবে। তারা বলবে, 'প্রভু দুনিয়াতে যারা আমার পিতা-মাতা ছিল তাদেরকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন'। পরিচয়ের পরে এই মাসুম সন্তান গুলো আল্লাহর কাছে 'গোঁ' ধরে বলবে, হয়তো জান্নাতে আমার সাথে আমার পিতা-মাতাকে রাখুন নয়তো আমাকেও তাদের সাথে রাখুন।
আল্লাহ সেদিন সে সব সন্তানের আবদার কবুল করবেন এবং পিতা-মাতা সহ সবাইকে জান্নাতে দাখিল করবেন।
জান্নাতে মুসলিম পিতার সন্তানগুলো অন্য ধরনের মর্যাদার অধিকারী হবেন, কেননা তাদের পিতা মাতা আল্লাহর দয়ার কারণে জান্নাতের অধিকারী হয়েছেন। আল্লাহ সকল মাসুম বাচ্চাদের পিতা-মাতাকে রহম করুন এবং তার বর্ণিত মর্যাদায় সমাসীন করুন। আমিন।
এটাই হোক জীবনের শেষ ভরসা। আল্লাহ অবশ্যই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন।
আপনি সুপথে/ইসলামের ছায়াতলে আসার জন্য যে ত্যাগ শিকার করেছেন, যে কুরবানী দিয়েছেন তাতেও মহান আল্লাহ খুশি হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতে উত্তম যাজা দিবেন, ইনশাআল্লাহ।
আমার জন্যও দুয়া করবেন - শ্রদ্ধেয়া বোন।
..
..
কিছু এরকম (অমানুষ) মার্কা ডাক্তারের অবিজ্ঞতা আমারও আছে। আল্লাহ্ যেন তাদের বুঝার তৌফিক দেন। খুব কষ্ট লাগলো।
আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন, আমীন।
আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন, আমীন।
আল্লাহ যেন তাকে বেহেশতে নসীব করেন। এবং আপনাদের দুজনকে তার সঙ্গী করে দেন জান্নাতে।
আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন, আমীন।
আমার মনে হয় ঘটনাটি আমি পরিচিত এক জনের কাছে শুনেছিলাম। আল্লাহতায়লা আপনাদের সবর দিন।
আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন, আমীন।
কেবল আল্লাহর সৃষ্টির উপর হাত দিতে পারে ঐ পেশার মানুষেরা। আল্লাহ তাদেরকে কতবড় স্মমান দিয়েছেন। আর কিছু অমানুষ তা ধরে রাখতে পারে না।
আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন, আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন