বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম অপহরণ, খেয়ালখুশি মতো আটক, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, কর্মক্ষেত্রে নাজুক পরিস্থিতি

লিখেছেন লিখেছেন অক্টোপাশ ২২ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:২৪:২৭ সকাল



বাংলাদেশে মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, অপহরণ, খেয়ালখুশি মতো আটক, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, কর্মক্ষেত্রে নাজুক পরিস্থিতি, দুর্বল শ্রমিক অধিকার। এসব ঘটনা এখনও চলছে। এগুলোর জন্য মানবাধিকার গ্রুপগুলো দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে দায়ী করছে। সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সমাবেশ করার ক্ষেত্র সীমিত করেছে। অনেক সাংবাদিকই ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ চর্চা করেন। তাদেরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভীতি প্রদর্শন করা হয় সরকারযন্ত্র থেকে। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে। ২০১২ সাল ভিত্তিক ওই রিপোর্টে বাংলাদেশ অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে ওই বছরে এদেশের মানবাধিকারের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র। তাতে উঠে এসেছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের খবর। বলা হয়েছে তাদের ঘাতকদের কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। বলা হয়েছে, প্রান্তিক গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে বৈষম্য রয়েছে। দীর্ঘ ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সহিংসতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এখনও বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা রয়ে গেছে। কিছু বেসরকারি সংস্থা তাদের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে বেশ কিছু আইনি ও আনুষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতার মুখে রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি ও তা থেকে দায়মুক্তি দেয়ার ঘটনা এখনও বড় একটি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। আইনের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাচ্ছে না কেউ। তাই সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ দায়মুক্তি পাওয়ার কারণে মানবাধিকার লংঘন করছে। এ কারণে নাগরিকদের অধিকারের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। আগের বছরের মতোই ২০১২ সালেও সরকার নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, সংবিধান ব্যক্তির জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু রিপোর্ট পাওয়া গেছে যে, সরকার অথবা তার এজেন্টরা খেয়ালখুশি মতো অথবা আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। সারা বছরে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে কতজন নিহত হলো তার মোট সংখ্যা প্রকাশ করেনি সরকার। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলেছেন, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সরকার শূন্য সহনশীলতা দেখাবে এবং এর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে। কিন্তু এসব মামলা তদন্তে ব্যাপক অর্থে কোন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। মিডিয়া ও স্থানীয় মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থাগুলোর মতো, কোন অপরাধেই শাস্তি দেয়া হয়নি। কিছু ঘটনা যেগুলোর অভিযোগ সরকার এনেছে সেক্ষেত্রে প্রশাসনিক শাস্তি দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের অনেককে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। ২০১১ সালে সরকার র‌্যাবের মানবাধিকার বিষয়ক অভিযোগগুলোর বিষয়ে তদন্তের জন্য অভ্যন্তরীণ একটি সেল গঠন করেছিল। কিন্তু পুরো বছরেও তাদের দ্বারা হত্যার অভিযোগগুলোর জন্য জড়িতদের বিচারের কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, মিডিয়া, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা এবং সরকারি তথ্যমতে ৭০ জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এসব সংস্থা বিশ্বাস করে এর মধ্যে ৪০টি হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী র‌্যাব। র‌্যাবের সমন্বয়ে গঠন করা যৌথ বাহিনীর হতে নিহত হয়েছেন আরও ৬ জন। এসব ঘটনা ঘটেছে ঘেরাও, গ্রেপ্তার ও অন্য আইনি অভিযানের সময়। মাঝেমধ্যেই সরকার এসব হত্যাকাণ্ডকে যথারীতি ‘ক্রসফায়ার কিলিং’ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা অথবা এনকাউন্টারে হত্যা হিসেবে অভিহিত করে। মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অধিকারের মতে, র‌্যাব নয় এমন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন ২৪ জন। ২০১১ সালে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ৩৩টি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম নিহত হয়েছেন যে সব কারণে তার একটি হলো জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও গার্মেন্ট প্রস্তুতকারকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় তিনি নিহত হয়ে থাকতে পারেন। অধিকার রিপোর্ট করেছে, ১০ই জুন বেতাগি চণ্ডিপুর পুলিশ স্টেশনে প্রতিবাদ বিক্ষোভের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব। পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে কিনা তা তদন্তের জন্য কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করেছিল। কিন্তু পুলিশ সেই তদন্তের ফল প্রকাশ করেনি। মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, পুরো বছরে নিরাপত্তা হেফাজতে নিহত হয়েছেন ১০১ জন। এর মধ্যে ৩৪ জন মারা গেছেন জেলে। বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে। অধিকারের মতে, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৬৯ জন। আহত হয়েছেন ১৭১৬১ জন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল হয়েছে ৩৮২টি। বিএনপিতে এমন ঘটনা ঘটেছে ১৪৬টি।

গুম

বছরজুড়ে র‌্যাব ও ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের মতো নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে গুম ও অপহরণের ঘটনা চলছেই। অধিকারের মতে, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে ২৪টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৩০টি। অধিকার অভিযোগ করেছে, এর মধ্যে ১০টি ঘটনায় র‌্যাব জড়িত। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, এই সংখ্যা ৫৬টি। ১৩ই জুন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে নিজ মাঠে কাজ করার সময় র‌্যাব-১২’র সদস্যরা গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদ নজরুল ইসলামকে। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কেন তারা নজরুলকে নিয়ে যাচ্ছেন। জবাবে নিজেদের তারা র‌্যাব-১২’র লোক এবং পরিচয়পত্র দেখিয়েছিল। নজরুল ইসলামকে স্থানীয় র‌্যাব অফিসে নেয়ার পর কেউ আর তাকে দেখতে পায়নি।

নির্যাতন, অমানবিকতা

সংবিধান ও আইন নির্যাতন, অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ নিষিদ্ধ করলেও নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা বিশেষ করে র‌্যাব ও পুলিশ নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের সময়। এক্ষেত্রে তারা হুমকি দেয়। প্রহার করে। বৈদ্যুতিক শক দেয়। অধিকারের মতে, নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কমপক্ষে ৭২ জনের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। এতে ৭ জন নিহত হয়েছেন। দায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন বা শাস্তি দেয়ার ঘটনা বিরল। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ২২শে এপ্রিল বিএনপির ছাত্রবিষয়ক একটি সংগঠনের নেতা এসএম মাহমুদুল হক টিটোর হাত সিলিংয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয় খুলনা পুলিশের ওসি এসএম কামরুজ্জামান। কিন্তু সরকার তাকে ‘ক্লোজিং’ নাম দিয়ে খুলনা পুলিশ স্টেশন থেকে অন্যত্র বদলি করে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আদালতে কোন অভিযোগ করা হয়নি। সারা বছর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা ১৩টি ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে।

জেলের অবস্থা

জেলের অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে থাকে অতিরিক্ত বন্দি। অপর্যাপ্ত সুবিধা। পয়ঃনিষ্কাশনের সঙ্কট আছে। মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা বলছে, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ত্বরান্বিত করে এ অবস্থা। অধিকারের মতে, ২০১২ সালে জেলে মারা গিয়েছেন ৫৮ জন বন্দি। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১০৫। ৪ঠা জুলাই বাংলাদেশ রাইফেলস বিদ্রোহের বিচার নিয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তথ্য পেয়েছে যে ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৪৭ জনের। এর মধ্যে কারও কারও মৃত্যু হয়েছে নির্যাতন ও অমানবিক আচরণে। মিডিয়া ও মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশের জেলখানাগুলোতে ৩৩৫৭০ জন বন্দি রাখার ব্যবস্থা আছে। সেখানে বন্দির সংখ্যা ৬৮৭০০। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ অভিযুক্ত। বাকিদের বিচার এখনও শুরু হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার

সংবিধানে খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার ও আটক রাখার বিষয়ে বিধিনিষেধ আছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে কোন ব্যক্তিকে কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার ও আটক করতে পারে। এক্ষেত্রে কোন ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ বা ওয়ারেন্টি দরকার হয় না। কিন্তু দেশজুড়ে বিরোধী দলের ডাকা হরতালের সময় ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রধান করে মোবাইল কোর্ট বসানোর সমালোচনা করেছেন আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা। ১২ই মার্চ বিরোধী দলের মহাসমাবেশের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা ৩২১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। মিডিয়া ও মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা বলেন, পুলিশ গ্রেপ্তার করে কতগুলো দিনমজুর, রিকশাচালক, হকার, পরিবহন কর্মীকে। তারা রাজনৈতিক কর্মী নন। নন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

সুষ্ঠু বিচারে প্রতিবন্ধকতা

আইন স্বাধীন বিচার বিভাগ অনুমোদন করে। কিন্তু সংবিধানের দীর্ঘদিনের একটি অস্থায়ী ধারা বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার ক্ষেত্রকে খর্ব করে। ওই ধারা অনুযায়ী, নিম্ন আদালত, বিচার বিভাগীয় নিয়োগ, বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের ক্ষতিপূরণ বিষয়গুলোর দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যারা অভিযুক্ত জামায়াতের সেসব নেতার আইনজীবীদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অথবা সরকারি কর্মকর্তারা ভীতি প্রদর্শন করে। মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা বলেন, বছরজুড়ে অনেক মামলায় বিবাদী পক্ষের কাছ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট, এটর্নি এবং আদালতের কর্মকর্তারা ঘুষ দাবি করেছেন। আইনে সুষ্ঠু বিচারের কথা বলা আছে। কিন্তু দুর্নীতি এবং দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কারণে তা সব সময় রক্ষা করা যাচ্ছে না। প্রসিকিউটর ও বিচারকদের দেয়া হচ্ছে কম বেতন। আদালতে তাদের প্রতি ঘণ্টার সম্মানী মাসে সর্বনিম্ন ৩০০০ টাকা এবং প্রতি ঘণ্টার জন্য অতিরিক্ত ২০০ টাকা। এর ফলে কেউ কেউ অন্য কোন দিক থেকে ঘুষ গ্রহণের চেষ্টা করে থাকতে পারেন। বিবাদীপক্ষকে নিরপরাধ ধরতে হয়। তাদের আপিল করার অধিকার আছে এবং সরকার কি প্রমাণ হাজির করছে তা তাদের দেখার অধিকার আছে। তাদের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনা হচ্ছে তার বিস্তারিত জানানোর কথা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে। এ বছরেই আদালত বাংলাদেশ রাইফেলসের বিদ্রোহীদের গণবিচার করে। বেশির ভাগ বিদ্রোহীর বিচার সম্পন্ন হয়েছে ২১শে অক্টোবর। ৫৯২৬ জন বিদ্রোহী চার মাস থেকে ৭ বছরের জেল খাটছে।

মত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা

মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে সংবিধান। কিন্তু অনেক সময়েই সরকার মুক্ত মত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। হয়রানির কারণে কোন কোন সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা নিজেরাই সেন্সর করে লেখেন। সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সমান দেখানো হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি হতে পারে তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন। এই আইনে ২০১২ সালে আদালত কাউকে শাস্তি দেয়নি। বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক এমপি এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ফেসবুকে মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সোহেল মোল্লা রাজ (ওরফে সোহেল রানা)। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দেন ত্রিশাল পুলিশ স্টেশনে। ওই পুলিশ স্টেশন থেকে মামলাটি যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ১৮ই মে পুলিশ সোহেলকে গ্রেপ্তার করে। তার শুনানি হয় ৯ই জুলাই। ওই বছরে সোহেল ময়মনসিংহ কারাকারে বন্দি ছিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অংশে বলা হয়, স্বাধীন মিডিয়া ছিল সক্রিয় এবং তারা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছে। তবুও সরকারের সমালোচনা করে মাঝেমধ্যে মিডিয়া সরকারের নেতিবাচক চাপের মুখোমুখি হয়েছে। একটি রেডিও ও একটি টেলিভিশন স্টেশনের মালিক সরকার। আইন অনুযায়ী দেশের একমাত্র টিরেস্ট্রিয়াল চ্যানেল হলো বাংলাদেশ টেলিভিশন। দেশের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ মানুষের বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখার সুবিধা নেই। জরিপ অনুযায়ী, শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ তথ্য পেয়ে থাকে টেলিভিশন থেকে। বিটিভি সমপ্রচার করে জাতীয় সংসদের অধিবেশন। সরকারি কর্মসূচি। তবে বিরোধীদের প্রচার এতে বিরল। সাধারণত ক্যাবল অপারেটররা সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করে। সব বেসরকারি চ্যানেলকে কোন চার্জ ছাড়াই সরকারের নির্বাচিত সংবাদবিষয়ক কর্মকাণ্ড ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রচারের সুযোগ দেয়া উচিত। প্রয়াত ফিকশন লেখক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘দেয়াল’-এর আলোচনা করা হয়েছে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে। ১৫ই মে হাই কোর্ট ওই উপন্যাসের তথ্যকে ভুল ও আপত্তিকর বলে ঘোষণা করে। তাকে ওই তথ্য সংশোধনের নির্দেশ দেয়। ২০১১ সালের নভেম্বরের আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট নির্দেশ দেয় ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি হাসিবুর রহমান বিলুকে নিরাপত্তা দিতে। তার প্রেক্ষিতে বগুড়া পুলিশ তার নিরাপত্তা বিধান করে। আওয়ামী লীগ দলীয় এক নেতার সঙ্গে দুর্নীতি নিয়ে উপ কমিশনার দ্বন্দ্বের খবর প্রকাশ করার কারণে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল। রাষ্ট্র ও অরাষ্ট্রীয় ব্যক্তিদের দ্বারা শারীরিক হামলা, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে সাংবাদিদের। অধিকার ও পর্যবেক্ষক গ্রুপগুলোর মতে, ২০১২ সালে হত্যা করা হয়েছে ৪ সাংবাদিককে। আহত হয়েছেন ১১৮ জন। হুমকি দেয়া হয়েছে ৫০ জনকে। হামলা হয়েছে ৬ জনের ওপর। অপমান করা হয়েছে ৪৩ জনকে। ১১ই জানুয়ারি অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা হত্যা করে মাছরাঙা টেলিভিশনের নিউজ এডিটর সাগর সরোয়ার ও এটিএন বাংলার রিপোর্টার, সাগরের স্ত্রী মেহেরুন রুনিকে। এই হত্যার প্রতিবাদ জানায় বিএফইউজে। ঘাতকের পরিচয় সম্পর্কে কিছু মিডিয়া আভাস দিয়ে শুরু করার পর ২৮শে ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট এমন রিপোর্ট প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। ১০ই অক্টোবর পুলিশ সন্দেহভাজন ৮ জনের নাম প্রকাশ করে। কিন্তু নিহতের পরিবার ও সহকর্মীরা এ বিষয়ে যে তথ্য হাজির করা হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করে। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকে হয়রানির মুখে পড়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশন। সরকারের কয়েকজন কর্মকর্তার ঘুষ দাবি ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য তাদেরকে এমন অবস্থায় পড়তে হয়। ১২ই জানুয়ারি ইটিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালাম এনবিআর থেকে ব্যাকডেটেড একটি চিঠি পান। তাতে বকেয়া কর ও জরিমানা হিসেবে ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। জুলাই মাসে এনবিআর সালামকে কর ফাঁকিবাজ হিসেবে অভিযুক্ত করে। এ মামলাটি বছরান্তেও চলছিল। এতে আরও বলা হয়, সরকারি পরোক্ষভাবে হুমকি ও হয়রান করে মিডিয়া সেন্সর করেছে। সাংবাদিকদের মতে, অনেকবার সরকারি কর্মকর্তারা বেসরসারি মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেলকে বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড ও তাদের বিবৃতি প্রকাশ না করতে বলেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১২ই মার্চ বিরোধী দলের মহাসমাবেশ সরাসরি সমপ্রচার না করতে অনানুষ্ঠানিক নির্দেশ দেয়া হয় ইটিভি, বাংলাভিশন, ইসলামিক টিভিকে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অপারেটরদের ওই তিনটি চ্যানেলের সমপ্রচার মহাসমাবেশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করতে বলে। সরকারের ভয়ে অনেক সাংবাদিক নিজেরাই সংবাদ সেন্সর করে প্রকাশ করেন। সরকারের সমালোচনা জনসাধারণের মধ্যে সাধারণ বিষয়। কিন্তু মিডিয়া, বিশেষ করে প্রিন্টমিডিয়া সরকারের বিজ্ঞাপনের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। এর ফলে মিডিয়াকে সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করতে হয়। আগের সরকারের মতো এই সরকারও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নতুন নতুন সমপ্রচার লাইসেন্স দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রত্যাখ্যান করা হয়।

শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা

জানুয়ারি মাসে বিএনপি ঢাকায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ১২ই মার্চ মহাসমাবেশ আহ্বান করে। ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ঘোষণা করে তারাও ওইদিন ঢাকায় একটি সমাবেশ করবে। জননিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের ফলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ১২ই মার্চ মানববন্ধন, প্রতিবাদ, সমাবেশ, অবস্থান, সভা নিষিদ্ধ করে। উপরন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা ঢাকামুখী গণপরিবহন প্রতিরোধ করে এবং ১১ই মার্চ ঢাকা শহরের ভিতরে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রিত করে। ১২ই মার্চ পুলিশ ৪০০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। ততক্ষণে পুলিশ বিরোধী দলকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)কে নিয়ে নির্মিত ব্যাঙ্গাত্মক ছবি ‘দ্য ইনোসেন্স অব মুসলিমস’ নিয়ে দেশজুড়ে বিভিন্ন গ্রুপ প্রতিবাদ বিক্ষোভের সিদ্ধান্ত নেয়। যতক্ষণ বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল ততক্ষণ পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বিক্ষোভ করার অনুমতি দিয়েছে, তারা কূটনৈতিক মিশনগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ২১শে সেপ্টেম্বর সরকার ১২ ইসলামী দলের দীর্ঘ পরিকল্পিত ২২শে সেপ্টেম্বরের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। ওই সমাবেশ থেকে দেশের রাষ্ট্রধর্মকে ইসলাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও ওই ভিডিওর নিন্দা জানানোর দাবি করার কথা ছিল। ওই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এর সদস্যরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। ফলে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। জামায়াতে ইসলামী দাবি করে, সরকার তাদের সমাবেশ ও র‌্যালি করতে দিচ্ছে না বছরজুড়ে। তারা আরও অভিযোগ করেন, সরকার জামায়াতের নেতাদের দলীয় প্রধান কার্যালয়ে যেতে দিচ্ছে না।

সূত্র: মানবজমিন

বিষয়: রাজনীতি

১১৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File