১৩ দফাকে মধ্যযুগীয় বলার মানে ধর্মকে অস্বীকার করা-আল্লামা শাহ আহমদ শফী

লিখেছেন লিখেছেন অক্টোপাশ ১১ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:৪০:৪৪ বিকাল



হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, উপমহাদেশের অন্যতম ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম হাটহাজারীর মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) এবং বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সভাপতি শায়খুল হাদিস আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেছেন, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে সরকার এ দেশের কোটি কোটি মুসলমানের মনের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনের ভাষা বুঝতে না পারলে চরম মূল্য দিতে হবে।
তা ছাড়া হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ১৩ দফা দাবিকে মধ্যযুগীয় বলার মানে পুরো ইসলামকে অস্বীকার করার মতো। তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থই হলো ধর্মহীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে জাতিকে নাস্তিক বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নিজেদের নিরাপত্তা এবং শান্তির জন্য পর্দাসহকারে নারীদের কর্মক্ষেত্রে বা ঘর থেকে বের হতে কোনো বাধা নেই
বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক নয়া দিগন্তকে দেয়া সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন : মুহতারাম, আপনি এই বৃদ্ধ বয়সে এসে ইসলাম এবং ঈমান রক্ষার যে আন্দোলন শুরু করেছেন, এর পেছনে কিসের তাড়না?

আল্লামা শফী : মুসলমানদের ঈমান-আকিদা, নীতি-আদর্শ, কৃষ্টিকালচার, সঠিক ধর্মীয় বিধিবিধান ও অনুশাসনের সুরক্ষা এবং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মোকাবেলায় ওলামা-মাশায়েখ ও তৌহিদি জনতার সম্মিলিত কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যেই ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মহান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও নীতিকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত কয়েক বছর থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের দেশী-বিদেশী দুশমনরা এ দেশের সরলমনা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও কূটচাল চালিয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় নাস্তিক্যবাদিরা সম্প্রতি জাতীয় আবেগকে পুঁজি করে ইসলাম সম্পর্কে উদাসীন বা কম জ্ঞান রাখেন এমন কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করে শাহবাগ গণজাগরণের নাম দিয়ে প্রকাশ্য মাঠে নামিয়েছে। তারা শুধু আল্লাহ, রাসূল, ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেই থামেনি। সাথে সাথে আবহমান বাংলার রক্ষণশীল সামাজিক অনুশাসন ও সংস্কৃতির ওপরও আঘাত হানতে শুরু করেছে। তারা বিয়েবহির্ভূত ও ঘনিষ্ঠ অনাত্মীয় নারী-পুরুষের দৃষ্টিকটূ বিচরণ এবং রাস্তায় রাত যাপনের মতো ভয়াবহ সংস্কৃতি চালু করে। দাড়ি-টুপিধারী ও ইসলামি সংস্কৃতির প্রতি ওরা যেভাবে হামলে পড়ছে, তা অমুসলিম দেশেও সচরাচর দেখা যায় না।

আর ওলামায়ে কেরামের অন্যতম বিশেষ দায়িত্ব হচ্ছে- ইসলাম ও মুসলিমসমাজকে সব অনৈসলামিকতা ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাওয়া। তা ছাড়া আমাদের সব কর্মসূচিই ধর্মীয় স্বার্থ ছাড়াও দেশাত্মবোধক, শান্তিপূর্ণ এবং অরাজনৈতিক। আমার ব্যক্তিগত লাভালাভের কোনো বিষয় এখানে নেই। শুধু আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর ইজ্জত রক্ষার তাগিদেই আন্দোলনের এসব কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে।

প্রশ্ন : ৬ এপ্রিলের লংমার্চে সরকার বাধা দেবে না বললেও সরকার সমর্থকদের হরতাল এবং সরকারি গণজাগরণ মঞ্চের অবরোধেও লাখ লাখ তৌহিদি জনতার অংশগ্রহণকে কিভাবে দেখছেন?

আল্লামা শফী : আমি তো মানুষ বলি না, মূলত সেখানে ফেরেশতারা জমায়েত হয়েছিল। এত সুশৃঙ্খল আয়োজন, এত খানাপিনা এবং শত বাধা সত্ত্বেও কোত্থেকে যে নজিরবিহীন সংখ্যক মানুষের জমায়েত হয়েছে, তা সকলকে ভাবতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে ঈমান-আকিদাপূর্ণ গভীর আবেগের লুকিয়ে থাকা শক্তির বলেই লাখ লাখ লোকের সমাগম হয়েছে ঢাকায়। ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতা আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছে। নাস্তিক-মুরতাদদের দেখিয়ে দিয়েছে ইসলামের শক্তি ও সামর্থ্য।

লংমার্চের সবচেয়ে বড় যেই অর্জন সেটা হচ্ছে, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে আমরা জোরালো এই বার্তা পৌঁছাতে পেরেছি যে, দেশের ওলামা-মাশায়েখ ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ছোটখাটো মতভেদ থাকলেও ইসলামের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস ও কৃষ্টিকালচারের ওপর কোনো আঘাত এলে, সেক্ষেত্রে তারা দ্রুত সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে পড়েন। আমাদের অরাজনৈতিক কর্মসূচির পক্ষে দলমত নির্বিশেষে বিশাল জনগোষ্ঠীর জোরালো সমর্থন রয়েছে। সুতরাং যখনই ইসলাম ও মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাস ও কৃষ্টিকালচারের ওপর আঘাত আসবে, তখনই হেফাজতে ইসলাম তৎপর ভূমিকা রাখবে। আমি জোরালো আশাবাদী, হেফাজতে ইসলামের অরাজনৈতিক এই আন্দোলন দেশের ওলামা-মাশায়েখ স্থায়ীভাবে অব্যাহত রাখবেন। কিন্তু সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে দেশকে ধর্মহীনতা, নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারকে এখন নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। তারা কি দেশের ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মের পক্ষে থাকবে, নাকি গুটি কয়েক নাস্তিকের কথায় উঠবে-বসবে?

প্রশ্ন : হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ১৩ দফা দাবি নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। দাবি মানা হলে নারীদের কর্মেক্ষেত্রে উপস্থিতি সহ্য করা হবে না, এমন প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য?

আল্লামা শফী : নারী-পুরুষের দৃষ্টিকটূ অবাধ মেলামেশা বন্ধ করার দাবির অর্থ এই নয় যে, নারীরা কর্মক্ষেত্রে যেতে বা ঘর থেকে বের হতে পারবে না। আমাদের উদ্দেশ্য হলো নগ্নতা ও বেহায়াপনা বন্ধ করা। আমরা তো নারীর পক্ষেই বলছি। ইসলাম নারীর নিরাপত্তা এবং শান্তির জন্য হিজাব প্রথা বাধ্যতামূলক করেছে। কাজেই পর্দা সহকারে নারীরা কর্মক্ষেত্রে বা ঘর থেকে বের হতে তো কোনো বাধা নেই। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মে তো নারীর ন্যায্য অধিকারই নেই। শাহবাগে যেভাবে নারী-পুরুষের এক সাথে রাত্রিযাপন, অবস্থান এবং বেহায়াপনা হয়েছে, তা একটি জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। কাজেই আমাদের কথা পরিষ্কার যে, হিজাব বা শালীনতার সাথে নারীদের কর্মক্ষেত্রে যেতে কোনো বাধা নেই। নারী নীতির কুরআন-সুন্নাহবিরোধী ধারাগুলোই আমরা সংশোধনের কথা বলেছি। তা ছাড়া দেশে ভাস্কর্যের নামে আবক্ষ মানব বা জীবজন্তুর মূর্তি তৈরি এবং ফুল দিয়ে সেসবকে সম্মান প্রদর্শনের রেওয়াজ যে হারে শুরু হয়েছে, তা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে কখনও কাম্য হতে পারে না। ইসলামে মূর্তি তৈরি ও সম্মান প্রদর্শনকে স্পষ্টভাবে শিরক ঘোষণা করা হয়েছে। তবে আমরা কখনও প্রাণহীন শিল্পকর্মের বিরোধী নই। মোমবাতি প্রজ্বলন অগ্নিপূজক ও পশ্চিমাদের সংস্কৃতি। এটা এদেশে নতুন করে প্রচলনের জোর চেষ্টা চলছে। কাজেই আমাদের দাবি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো বা বিরোধিতার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন : একটা কথা বেশ আলোচিত হচ্ছে যে, হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকারের সমঝোতা হয়েছে এবং এরই ভিত্তিতে আপনারা শাপলা চত্বরে দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান নেননি। এ ব্যাপারে আন্দোলনের রাহবার হিসেবে আপনার বক্তব্য?

আল্লামা শফী : যদি সত্যি সত্যিই এমন কিছু শুনে থাকেন, তবে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। আমার পুরো জীবনটাই কেটেছে কুরআন-হাদিস ও ইসলামি শিক্ষার প্রচার-প্রসার, ঈমান-আকিদা রক্ষা, শিরক-বিদআত এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম হাটহাজারী পরিদর্শন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রায়ই সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, প্রতিনিধিদল ও বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব এসে থাকেন, অনেকে ব্যক্তি জীবনে সঠিক ইসলামি অনুশাসন পালনে দিকনির্দেশনা লাভ অথবা দোয়া নেয়ার জন্য আসেন। কাজেই আমাদের সাথে সরকারের সমঝোতার প্রশ্নই উঠে না। লংমার্চ ও মহাসমাবেশের সময়সূচি পূর্বনির্ধারিত ছিল এবং আমরা পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই যথা সময়ে শেষ করেছি।

প্রশ্ন : একজন মন্ত্রী বললেন দাবি বিবেচনা করা হচ্ছে, সরকারদলীয় এক নেতা বললেন দু-একটি ছাড়া সব দাবি মধ্যযুগীয়। আবার প্রধানমন্ত্রী বিদেশী সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেন। সরকারের এই অবস্থান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?

আল্লামা শফী : নিজেকে মুসলমান দাবি করে কেউ হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবিকে মধ্যযুগীয় বলতে পারেন না। ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে সরকার মূলত এদেশের কোটি কোটি মুসলমানের মনের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। সরকার ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি এবং কোটি কোটি মুসলমানের প্রত্যাশা ও দাবির প্রতি নজর না দিলে চরম ভুল করবে। তা ছাড়া ধর্ম অবমাননা রোধ এবং মুসলমানদের ঈমান-আকিদা ও ধর্মীয় অনুশাসনের সুরক্ষার তাগিদে হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ১৩ দফা দাবিকে মধ্যযুগীয় বলার মানে পুরো ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের নিয়ে বিদ্রুপ করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রশ্ন : সরকারি দলের প্রধান থেকে শুরু করে দলীয় নেতা-মন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি ১৩ দফা দাবি পূরণের ব্যাপারে আশাবাদী?

আল্লামা শফী : দাবি আমাদের পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ সরকার এসব দাবি পূরণ না করলে মুসলমানদের বিপক্ষে তাদের অবস্থান পরিষ্কার হবে। তবে খুব সহজে দাবি পূরণ হবে এমনটি আমরা আশা করি না। কোটি কোটি মুসলমান লাগাতার প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি পূরণে সরকারকে বাধ্য করবে।

প্রশ্ন : আপনারা সংবিধান থেকে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ তো এখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাহলে এই দাবি কিভাবে পূরণ হবে?

আল্লামা শফী : আল্লাহ, রাসূল সা: ও ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের উত্থাপিত ১৩ দফা দাবির প্রথম দাবিই হচ্ছে সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং কুরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করতে হবে। প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী। ধর্মনিরপেক্ষতার মানেই হচ্ছে ধর্মহীনতা, নাস্তিকতা। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ নাগরিকই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও সঙ্গত কারণেই এই দেশকে মুসলিম দেশ বলতে হবে। আর ইসলামি আইনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের স্ব স্ব ধর্মীয় রীতি পালন ও নিরাপত্তা বিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সুতরাং আমরা মনে করি, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে মূলত এই দেশকে ধর্মহীন তথা নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যার স্পষ্ট আলামত ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। সরকার যদি সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন না করে, তাহলে আমার পরিষ্কার কথা হলো ইনশাআল্লাহ ইসলাম ও মুসলিম জীবনধারা নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রতিবাদ-সংগ্রাম চলবেই।

প্রশ্ন : ব্লগারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিলেন?

আল্লামা শফী : দেখুন, আমাদের আন্দোলন ঢালাওভাবে সব ব্লগ বা ব্লগারের বিরুদ্ধে নয়। আমরা জানি, সাধারণ মুসলমান, ছাত্র-শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশাজীবীর অনেকেই ব্লগ লিখে থাকেন। আলেম ও মাদরাসা ছাত্রদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্লগার রয়েছেন। আমাদের আন্দোলন কেবল সেসব ব্লগারের বিরুদ্ধে, যারা মুক্ত চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার আড়ালে কোটি কোটি মানুষের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, প্রিয় নবী রাসূল সা:, পবিত্র কুরআন ও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা ও অবমাননায় জড়িত। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ছাড়াও দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে এবং সভ্যতা-ভব্যতা ও গণতন্ত্রের কোনো মাপকাঠিতেই এমন কুৎসা ও অবমাননা মেনে নেয়া যায় না। ওরা ইসলামের এমন জঘন্য অবমাননা করেছে, যা পশ্চিমা বিশ্বের কোনো অমুসলিমের মুখেও কখনও শোনা যায়নি। সুস্থ বিবেকের কোনো মুসলমানের পক্ষে এসবের সম্পূর্ণটা পড়ে দেখার সাধ্যও নেই। শুরু থেকেই আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা, ইসলামবিরোধী নারীনীতি ও ধর্মহীন শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে আসছি। কয়েক বছর যেতে না যেতেই বর্তমান সরকারের গৃহীত এসব নীতির মারাত্মক কুফল শুরু হয়ে গেছে।

প্রশ্ন : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে হেফাজতে ইসলামের সম্পর্কের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে?

আল্লামা শফী : হেফাজতে ইসলাম হচ্ছে, দ্বীনি ও ইসলাহি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে যায় এমন কোনো দাবি বা কর্মসূচি দেয়নি। ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারী নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহিতার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে আমরা যে ১৩টি দাবি উপস্থাপন করেছি, তাতেও কোনো রাজনৈতিক দলসংশ্লিষ্ট দাবির অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না। আমাদের দাবি ও প্রতিবাদ কর্মসূচি একান্তই ঈমান-আক্বিদা, ইসলাম ও নৈতিকতা সংশ্লিষ্ট।

যখন হেফাজতে ইসলামের ন্যায্য দাবিতে সারা দেশ উত্তাল, তখন ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক-ব্লগার ও তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা তাদের অন্যায় অবস্থানের সপক্ষে কোনো যুক্তি খুঁজে না পেয়ে হেফাজতে ইসলাম ও আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও জঙ্গিবাদের কল্পনাটক সাজিয়ে বিষোদ্গারমূলক বক্তব্য রাখছেন। অথচ প্রশাসনের কর্মকর্তা ও দেশী-বিদেশী পরিদর্শনকারীসহ দেশের কোটি কোটি তৌহিদি জনতা দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসা এবং হেফাজতে ইসলামের রাজনীতিমুক্ত শান্তিপূর্ণ অবস্থান ও দাবি সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রায় প্রতি দিনই আমাদের সাথে দেখা করছেন, আমাদের পড়ালেখার পরিবেশ, শৃঙ্খলা, শান্তিপূর্ণ অবস্থান এবং হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তারা সবাই আমাদের অরাজনৈতিক শান্তিপূর্ণ নীতির প্রশংসা করছেন। সুতরাং বিষয়টা এভাবে ভাবুন, যারা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের অবাধ্য হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে পারছে, তারা তাদের অপতৎপরতার প্রতিবন্ধক প্রতিবাদী ওলামা-মাশায়েখ ও হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিষোদ্গার বা অপপ্রচারে লিপ্ত হওয়াটা স্বাভাবিক।

আমি মনে করি, তাদের অপতৎপরতা ঢাকার জন্য যত মিথ্যাচার ও অপপ্রচারই তারা করুক, দেশের ইসলামপ্রিয় জনতা এতে মোটেও বিভ্রান্ত হবেন না। সাধারণ মানুষ এটা সহজেই উপলব্ধি করতে পারছেন। আমি আপনাদের মাধ্যমে সমালোচনাকারীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, তারা প্রমাণ করে দেখাক, হেফাজতে ইসলাম ও ওলামা-মাশায়েখের কোন দাবির সাথে জামায়াত সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

বিভিন্ন মিডিয়া, টিভি টকশোতে হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার কথা যা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। জামায়াত থেকে আমরা অর্থ নিচ্ছি বলে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, টাকা-পয়সা নিলে জামায়াত থেকে কেন, ক্ষমতাসীন বা ইসলামবিদ্বেষী মহল থেকেও তো নিতে পারতাম। আমরা ইসলামবিরোধী আগ্রাসন রোধ করার লক্ষ্যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে ময়দানে নেমেছি। দলমত নির্বিশেষে সব মুসলমান আমাদের সমর্থন করছেন। কোনো প্রলোভন কিংবা কোনো মোহে হেফাজতে ইসলাম বিক্রি হবে না।

প্রশ্ন : ব্লগারদের শাস্তি হলে হেফাজতে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যাবে, না সক্রিয় থাকবে?

আল্লামা শফী : মুসলমানদের ঈমান-আক্বিদা ও কৃষ্টি-কালচারের হেফাজত এবং এর বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মোকাবেলায় ওলামা-মাশায়েখ ও তৌহিদি জনতার সম্মিলিত কর্মপন্থা নির্ধারণ ও পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যেই ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। ইতঃপূর্বেও ধর্মহীন শিক্ষানীতি, হিজাব পালনে নারীদের বাধ্য করা যাবে না বলে হাইকোর্টের রায়, ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রতিষ্ঠা, সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের নীতি তুলে দেয়া, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ্ বাদ দেয়ার চেষ্টা, ঢালাওভাবে আলেম-ওলামা ও কওমি মাদরাসার সাথে জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অপপ্রচার, ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধের চেষ্টা, দাড়ি-টুপিধারীদের নিগ্রহ, হাইকোর্টে কুরআন সংশোধনের জন্য মামলা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ্, রাসূল, কুরআন ও ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য ও বিবৃতির বিরুদ্ধে আমরা সম্মিলিত প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি সফল হয়েছি, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো সফলতা না পেলেও বিরোধী ইসলাম তৎপরতা বাধাগ্রস্ত করতে পেরেছি।

প্রশ্ন : ইসলাম কি প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের মতোই একটি ধর্ম যা শুধুমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকবে?

আল্লামা শফী : ইসলাম অন্য ধর্মের মতো শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের ধর্ম নয়। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ং আল্লাহ মনোনীত করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত ইসলাম রাজনীতি কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে কারো মুখাপেক্ষী নয়। ইসলামি শরিয়তের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিয়াছাত বা রাজনীতিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। মদিনায় ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্রই তার প্রমাণ দেয়। ইসলাম শুধু নামাজ, রোজা ও জাকাতের মতো মৌলিক ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান ও নির্দেশনা রয়েছে। ধর্ম এবং রাজনীতি আলাদা এ কথা ঠিক নয়।

প্রশ্ন : চলমান আন্দোলন এবং হেফাজতে ইসলামের সর্বশেষ লক্ষ্য?

আল্লামা শফী : চলমান আন্দোলনে আমরা ১৩টি দাবি উত্থাপন করেছি। ইসলাম ও মুসলিম জীবনধারা নিরাপদ রাখা এবং সঠিক পথে পরিচালিত করাই এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য। ঈমান-আক্বিদা ও ইসলামবিরোধী কোনো তৎপরতা বা প্রতিকূলতা দেখা না দিলে মুসলমানদের মধ্যে সঠিক ইসলামি বিধিবিধান ও শান্তিশৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণের প্রচার এবং শিরক, বিদআতসহ সব ধর্মীয় কুসংস্কার সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক করার মধ্যেই হেফাজতে ইসলামের তৎপরতা সীমাবদ্ধ থাকবে।

প্রশ্ন : দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

আল্লামা শফী : আমাদের প্রধান দাবি হচ্ছে, সংবিধানে আল্লাহ্র ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর আইন পাস। পাশাপাশি ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন ব্লগ ও সাইটে মহান আল্লাহ্, রাসূল সা:, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব অবমাননাকর জঘন্য কটূ প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে, সেসব বন্ধ করে বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে জড়িত ব্লগ, ব্লগার ও পোস্টদাতাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা। পাঠ্যবইয়ের সব ধর্ম অবমাননাকর মন্তব্য ও উদ্ধৃতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে অবিলম্বে সংশোধনী প্রকাশ। সব অনাচার, ব্যভিচার ও অশ্লীলতা এবং নাটক-সিনেমা ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় নিদর্শন তথা দাড়ি-টুপি, হিজাব ও ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে অবমাননা রোধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দান। শিক্ষার সব স্তরে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি। আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের সব দাবিই দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি এবং সব নাগরিকই এতে একমত পোষণ করবেন বলে আমরা আশাবাদী। সরকার দেশ, জনগণ ও মুসলমানদের স্বার্থে আমাদের ন্যায্য দাবি মেনে নিলেই চলমান আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়। আমরা বার বারই বলে আসছি, আমরা ক্ষমতার অংশ হতে চাই না। জনসাধারণের ঈমান-আক্বিদা ও দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদেই আমাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি। এ কথাও বলতে চাই, ধর্মীয় ব্যাপারে যারা মূর্খ, তারাই হেফাজতে ইসলামের দাবি নিয়ে বিভ্রান্ত।

বিষয়: বিবিধ

১১৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File