শিক্ষার দাসত্ব
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ০৭ মার্চ, ২০১৯, ০৩:৪৯:৪২ দুপুর
মানব জাতির ইতিহাসের শুরু থেকেই "আক্রমন" ও "দেশ দখল" জিনিসটা চলে আসছে। একটি দেশ বা জাতি, আরেকটি দেশ বা জাতিকে বছরের পর বছর দখল করে রাখে। ইতিহাসের সবচেয়ে সফল দখলকারি হচ্ছে - ব্রিটিশ (ইংরেজ জাতি)। ওরা সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী নয়, যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী পারদর্শীও নয়। তবে, যে বিষয়টি তাদেরকে অন্য দখলদার জাতি থেকে আলাদা করে সেটা হল, একটি দেশ দখল করে (সম্পদ লুটে নিলেও) দেশটিকে নিজের দেশের মতন শাশন করেছে। আর এভাবেই, কিছুটা হলেও, তারা দেশের উন্নতি করে দিয়েছে।
ব্রিটিশেরা ভারত উপমহাদেশ (ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ) শাশন করেছে ১৯০ বছর। এর সময়ে তারা লুটে নিয়েছে এদেশের সম্পদ, মানুষের স্বাধীনতা ও আরো অনেক কিছু। অপরদিকে, তারা আমাদেরকে সামান্য কিছু দিয়েছেও। উচ্চশিক্ষার প্রচলন মুলত ব্রিটিশেরাই করে দেয়।
আমাদের দেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশ্ন করে, খাতা মুল্যায়ন করে, সার্টিফিকেট দেয়, কিন্তু পড়ায় না। ছাত্ররা কলেজে ভর্তি হয়ে লেখা পড়া করে আর বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক নির্ধারিত পরীক্ষা দেয়। এই পদ্ধতিকে অন্তর্ভুক্তি (affiliation) বলা হয়। ১৮৩৬ সালে, লন্ডনে স্থাপিত হয় University of London । সেটাই ছিল বিশ্বের প্রথম অন্তর্ভুক্তি পদ্ধতিতে লেখাপড়ার বাবস্থা। তখনকার সময়, সেটা ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের কারনেই শতগুন বেশী মানুষ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেল। নিজেদের দেশে এই নতুন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে ব্রিটিশেরা বসে থাকেনি। তাদের দখলে থাকা অন্যান্য দেশেও এই শিক্ষা বাবস্থা ছড়িয়ে দেয়েছে। ১৮৫০ সালে তারা অস্ট্রেলিয়াতে University of Sydney চালু করে। ১৮৫৭ সালে ভারতে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে - University of Mumbai, University of Madras এবং University of Calcutta। এগুলো সবই ওই অন্তর্ভুক্তি (affiliation) পদ্ধতিতে চলছে আর অনেক বেশী মানুষকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে।
দুঃখের বিষয়. ভারতবর্ষে প্রচলত শিক্ষা ব্যাবস্থা কখনোই ব্রিটেনের মতন ছিল না। সিলেবাস, শিক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতি এগুলো সবই আলাদা ছিল। সে সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শিক্ষার জন্য মানষিক এমনকি শাররিক চাপ দেওয়া। লেখাপড়ার সেই অত্যাচার, আমরা এখনো টিকিয়ে রেখেছি। আমাদের দেশে লেখাপড়ার চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকে
ঊপরের ছবিতে দেখুনঃ ১৯৪৮ সালে, ভারতের মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র, দেওয়ালের পেরেকের সাথে চুল বেধে নিয়ে বই পড়ছে যাতে যে ঘুমিয়ে না যায়। এমন লেখাপড়া সশ্রম কারাদন্ডের চেয়ে কম কিসে ?
প্রাশ্চাত্য সভ্যতার উন্নত দেশগুলির লোকের জন্য এটা বোঝা খুবই কঠিন - লেখাপড়া জিনিসটা কিভাবে অত্যাচারে পরিনত হয়। ইতিহাসের বেশিরভাগ জ্ঞানী-গুনী ওদের সমাজে জন্মেছে। ওদের দেশে কেউ এমন অত্যাচার সহ্য করে লেখাপড়া করেনি। লেখাপড়া করেছে একটা নির্দিস্ট পদ্দতি অনুসরন করে। যাতে মানুষ তার মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে পারে। এই কারনেই, উন্নত বিশ্বের শিক্ষার্থীরা সবখানে গিয়ে ভালো করে। ব্রিটিশেরা জানতো, লেখাপড়ার উদ্দেশ্য মানুষকে খাটানো বা অত্যাচার করা নয়। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য, মানুষকে শেখানো। তাহলে লেখাপড়া অত্যাচারে পরিনত হল কিভাবে?
এর কারন একটাই, দমিয়ে রাখা। আমাদেরকে ব্রিটিশেরা এমন শিক্ষিত বানিয়েছে যে, আমরা মুখস্ত করা, গুনগান করা আর দলিল বানানোতে ওস্তাদ। চিন্তাশক্তি বা সৃজনশীলতার দরকার নেই। ব্রিটিশের দরকার ছিল এমন এক শিক্ষিত জনগোস্টি, যাদের চিন্তা করার ক্ষমতা নেই, যারা চোখ বুজে আদেশ পালন করবে। এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী চিন্তা করতে পারলে তো আর তাদেরকে দমিয়ে রাখা যেতো না, ব্রিটিশেরা ভারতবর্ষকে আরো একশত বছর দখল করেও রাখতে পারতো না।
সেই দমিয়ে রাখা শিক্ষা ব্যাবস্থা সামান্য কিছু পরিবির্তন করে এখনো পুরো ভারত উপমহাদেশে চলছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা দেখুন। না বুঝে মুখস্ত কর, আর পরীক্ষার খাতায় লিখে আসো। নতুন কোন চিন্তা বা আইডিয়ার কোন মুল্য নেই। সকলেই বাজারের গাইড বই মুখস্ত করে, নিজের থেকে উত্তর লিখতে পারে না। আর লিখলেও সেটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রহনযোগ্য নয়। গরু রচনা মুখস্ত করেনি, এমন কোন শিক্ষিত মানুষ বাংলাদেশে আছে ? গরুর মতন একটি সাধারন ও সহজলভ্য প্রানী সবাই চিনে। লিখতে পড়তে জানে না, এমন একটি লোককে জিজ্ঞেস করুন - "গরু সম্পর্কে যা জানেন, বলুন"। লোকটি চিন্তা করে একে একে দশ-বারোটি বাক্য বলে ফেলবে। এটাই তো গরু রচনা। একজন নিরক্ষর লোকই যেখানে যায়গায় বসে (নিজে চিন্তা করে) গরু রচনা বলতে পারে, যেখানে আমরা শিক্ষিত বানাচ্ছি গরু রচনা মুখস্ত করিয়ে। এটা ধীরে ধীরে চিন্তা করার ক্ষমতা নস্ট করে দেবার একটা পদ্ধতি, একটা ষড়যন্ত্র ।
ষড়যন্ত্র - শব্দটা মানতে কস্ট হলে আরেকটু ভেতরে দেখুন। বাবার কাছে টাকা চেয়ে পত্র - এটা মুখস্ত করেনি এমন কতজন শিক্ষিত আছে বাংলাদেশ? ছেলে নিজে চিন্তা করে, নিজের মতন করে, বাবার কাছে চিঠি লিখবে, সেটাও হবে না। বইতে যেটা লেখা আছে, সেটা মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় লিখতে হবে। অর্থাৎ জোর করে চিন্তা করার ক্ষমতা নস্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এটা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কি?
আগে না হয় ব্রিটিশেরা ষড়যন্ত্র করেছে। এখন ষড়যন্ত্র করে কারা? আগেই বলেছি, এমন দাসত্বের শিক্ষার মুল করন হল, দমিয়ে রাখা। ব্রিটিশেরা যেমন আমাদেরকে দমিয়ে রেখে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছে। আমাদের সকল যুগের নেতারাও তেমনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। এজন্য এই শিক্ষা ব্যাবস্থাকে সঠিক শিক্ষা ব্যাবস্থায় রুপান্তরিত করে না। সেটা করলেই তো জনগন চিন্তা করতে শিখে যাবে আর তাহলে তাদেরকে দমন করা কঠিন হবে। সত্যজিত রায়ের ভাষায় - যত বেশী জানে, তত কম মানে। এই সত্যটি জেনেই, নেতারা আমাদেরকে এই দাসত্বর শিক্ষাতে বেধে রাখে আর তারা নিজেদের সন্তানকে লেখাপড়ার জন্য বিদেশে পাঠায়।
facebook.com/smelite
.
বিষয়: বিবিধ
১০৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন