যে শিক্ষা জীবন কেড়ে নেয়
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ৩০ জুলাই, ২০১৭, ০৬:৪৯:১২ সকাল
SSC অথবা HSC পাশ করে আমদের দেশের শিক্ষার্থীরা প্রাইমারী স্কুলের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাতে পাশই করতে পারে না (চান্স পাওয়া তো দুরের কথা)। এর পাশাপাশি, ধীরে ধীরে আরো একটি সমস্যা যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। সেটা হল, আত্মহত্যা। কুমিল্লা বোর্ডে ফলাফল বিপর্যয়ের কারনে নাকি ১১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের একজনের সুইসাইড নোট ফেসবুকে ঘুরছে।
গত বছরেও এক ছাত্রের সুইসাইড নোট ফেসবুকে ঘুরেছে। সবাই বিষয়টা জেনেছে, বুঝেছে, কিন্তু কেউই শিক্ষা নেয়নি। গতবছরে আত্মহত্যা করা ছাত্রটি কিন্তু ফেল করেনি। সে জিপিএ ৫ পায়নি। ওদিকে এই বছরের ছাত্রটির ফলাফল আমি জানিনা। হয়তো ফেল করেছে অথবা ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। তবে সুইসাইড নোটগুলিতে দুটি বিষয় কমন। এক, এরা বেশ গুছিয়ে লিখতে পারে। দুই, পরিবার, আত্মীয় প্রতিবেশী এদের দ্বারা সৃস্ট মানসিক চাপই সুইসাইডের কারন। সুইসাইড নোট তারা যেভাবে গুছিয়ে লিখছে তাতে বোঝা যায় তার ওইসব শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশী যোগ্য যারা নেপালের রাজধানী নেপচুন বলে কিংবা পিথাগোরাসকে সাহিত্যিক বানায়।
আমাদের দেশের শিশুদের মনে সেই ছোটবেলা থেকে একটি জিনিস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেটা হল, লেখাপড়া না করলে জীবনটা একেবারেই শেষ। প্রাইমারীর গোন্ডী পার হতেই শিশুরা শিখে ফেলে, ভালো রেজাল্ট না করলে জীবনটা শেষ। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে জীবন শেষ। ভালো সাবজেক্টে পড়তে না পাড়লে জীবনটা শেষ। ওরা যেটা শেখে, সেটাই করে। জীবনটা শেষ করে দেয়।
স্কুলে যারা প্রথম-দ্বিতীয় হয় ওরা তো অনেক বড় চাকরী করে। তারা যে সব প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে তার মালিক জীবনে কতবার প্রথম হয়েছে? সরকারী ভালো চাকরী করার জন্য বিসিএস পরীক্ষায় উত্তিন্ন হয়। এই বিসিএস এর জন্য কি স্কুল কলেজে প্রথম হওয়া লাগে? আমাদের সমাজে আরেকটি জিনিস প্রচলিত আছে, সেটা হল, ভালো সাবজেক্ট। ভালো রেজাল্ট না করলে ভালো সাবজেক্টে চান্স পাবে না। আসলে সাবজেক্টের কোন ভালো খারাপ নেই। ভালো খারাপের বিচার হয় ওই সাবজেক্টের উপরে দক্ষতার ভিত্তিতে।
একজন বাংলা সাহিত্যে লেখা পড়ে করে বাংলা সাহিত্যের উপরে ভালো দক্ষতা অর্জন করল। ওদিকে আরেকজন "রকেট সাইন্স" পড়ে তেমন কোন দক্ষতা অর্জন করতে পারলো না। কর্মজীবনে কার সফলতা বেশী হবে? আসলে মানুষের কর্মজীবনে সফলতা নির্ভর করে একটি বিষয়ে সে কতখানি দক্ষ তার উপরে। কোন সাবজেক্টে পড়েছে বা কত মার্ক পেয়েছে তার উপরে সফলতা আসে না।
এসব আমরা নিজেও বুঝি না, আমাদের শিক্ষার্থীরাও বোঝে না। সবাই আছে কে কার চেয়ে বেশী মার্ক নিয়ে পাশ করবে সেই প্রতিযোগীতায়। এখানেই শেষ নয়, যারা বেশী নম্বর পায় তারা কম নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থী ও তার পরিবারকে এত বেশী মানষিক চাপে রাখে যে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মতন ঘটনা ঘটে। ফেল করা বা কম নম্বর পাওয়া ছাত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে কেউ বলে না, এবার হয়নি তো কি হয়েছে, এর পরের বার হবে। আর না হলেও কিছু হবে না, তুমি যে কোন ভাবে এমন কোন দক্ষতা অর্জন কর যাতে তোমার কর্মজীবনে সফলতা আসে। লেখাপড়া ছাড়াও অনেক উপায় আছে দক্ষতা অর্জনের। জীবন অনেক বড়। সামান্য এক পরীক্ষার অকৃতকার্জ হওয়া নিয়ে জীবনের হারজিত এর ফয়সালা হয়ে যায় না। আর এই পরীক্ষার জন্য জীবন শেষ করে দেবার মত বড় বোকামী আর নেই।
অক্ষর জ্ঞান না থাকলে এই যুগে মানুষ অচল, এটা ঠিক। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত না হলেও বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা দিয়েও কেরিয়ার গড়া যায়। খেলাধুলা, গান-বাজনা, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে অনেকেই শুধু দেশ নয়, বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত হয়ে যায়। এর মুল কারনই হল, ওই বিষয়ে তার দক্ষতা। আমাদের বাংলা সাহিত্যের মুকুটধারী সম্রাট রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কেউই মেট্রিক পাশ করেনি। অথচ তাদের লেখা পড়ে মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহন করে। এর কারন, তাদের দক্ষতা।
প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই বিশেষ কোন দক্ষতা আছে। যে তার দক্ষতা চিনতে পারে এবং সেটাকে চর্চা করে বিকাশ করতে পারে, সেই হয় প্রতিষ্ঠিত। স্কুল কলেজে তার ফলাফল যাই হোক না কেন। আইনেস্টাইন বলেছেন - প্রত্যেকই কোন না কোন ক্ষেত্রে জিনিয়াস। তবে তুমি যদি একটি মাছের গাছে ওঠার দক্ষতা বিচার করতে বস, তাহলে মাছটি সারা জীবন নিজেকে বোকা ভেবে যাবে। বিষয়টি আসলেই এরকম। মাছের দক্ষতা সাতার কাটায় আর বানরে দক্ষতা গাছে ওঠায়। সবাই তার নিজ ক্ষেত্রে জিনিয়াস। মাছ নিজেকে বানরের সাথে তুলনা করলে হতাশ হবে, আশাহত হবে। আর সেটাই হয় আমাদের শিক্ষার্থী ও তাদের অবিভাবকদের।
নিজ দক্ষতা না বুঝে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা। এটা আত্মহত্যার একটা কারন। তবে আরো বড় কারন হল, স্বপ্নভঙ্গ। বেশী নম্বর পেলে না, তাহলে তো কিছুই করতে পারলে না, তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না, তোমার জীবনটাই বৃথা। এই ধরনের কথাবার্তা একজন মানুষের ভবিশ্যতের সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়। আর স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাচতে পারে না, আত্মহত্যা করে। এগুলোর পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসাবে কাজ করে আমাদের আত্মিয়, প্রতিবেশী ও বন্ধু বান্ধব। তারা বিভিন্নভাবে এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় - তোমার তো জীবনটাই শেষ। সমাজের এই অসুস্থতার একটা প্রতিকার হওয়া দরকার। সব বাবা মায়ের এটা বোঝা উচিত, যে লেখা পড়া তাদের সন্তানের জীবন কেড়ে নেয়, সেই লেখা পড়ার কি দরকার? যে বাবা মায়েরা অকৃতকার্জ হওয়াটা মেনে নিতে পারে না, তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করানোরও কোন দরকার নেই।
পরিশেষে আলভা এডিসনের কথা বলছি। তিনি ছিলেন ইতিহাসের সেরা আবিস্কারক। বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্যান, বৈদ্যুতিক মোটর, সিনেমা, ডায়নামা, আধুনিক মাইক্রোফোন, ফোনোগ্রাফ ইত্যাদি অনেক আবিস্কার আছে তার। তার নামে ১০৯৩ টি পেটেন্ট (আবিস্কারের রেজিস্ট্রেশন) রয়েছে। তিনি স্কুলে অমনোযোগী ছিলেন। লেখাপড়ার চেয়ে বেশী উদ্ভট চিন্তায় ব্যাস্ত থাকতেন। একদিন শিক্ষিকাকে প্রশ্ন করেছিলেন - ম্যাডাম, আমরা কি আকাশে উড়তে পারবো না? ম্যাডাম উত্তর দিলেন - না। এডিসন বললেন - কেন? ম্যাডামের উত্তর - কারন আমাদের ডানা নেই। এডিসন বললেন - কিন্তু ঘুড়ি তো আকাশে ওড়ে। ওর কিন্তু ডানা নেই। ওইদিন শিক্ষিকার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে যায়। এডিসনের মায়ের কাছে নালিশ যায় - তোমার ছেলে নিজে অমনোযোগী এবং স্কুলে লেখা পড়ায় ব্যঘাত ঘটায়। এডিসনকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এর পড়ে তার মা (ন্যান্সি ইলিয়ট) তাকে বাসায় লেখাপড়া করান। স্কুলে না যাবার কারন জানতে চাইলে শিশু এডিসনকে তার মা বলেছিলেন - স্কুলে যা পড়ায় তা তোমার শেখা হয়ে গেছে। ওখানে তোমার জন্য নতুন কিছু নেই। তাই তোমাকে বাসায় পড়াচ্ছি।
ওই কথাটি না বলে যদি এডিসনের মা বলতেন - তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ফাজিল কোথাকার। তোর দুস্টুমীর জন্য তোকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে। তাহলে এডিসন আত্মহত্যা করত না ঠিকই। কিন্তু বড় হয়ে এডিসন হয়ত কোন সামান্য চাকরীজীবি বা ব্যাসায়ী হতেন। ইতিহাসের সেরা আবিস্কারক হতে পারতেন না। শিক্ষার্থীদের জন্য আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্ন খুবই গুরুত্বপুর্ন। আর এটা তাকে সবচেয়ে বেশী দিতে পারে তার বাবা মা। আশা করব আমাদের বাব-মায়েরা একদিন এই বিষয়টি বুঝতে শিখবে। সেদিন আমাদের পুরো সমাজটাই সুন্দর হয়ে যাবে। আর অকালে এভাবে কোন শিক্ষার্থী প্রান হারাবে না।
আমার ফেসবুক ---------- এখানে
বিষয়: বিবিধ
১৬৬৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন