মালাউন গন্তব্য
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ০৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:৪১:০৬ সকাল
সম্প্রতি একজন মন্ত্রীর উক্তি – মালাউনের বাচ্চারা বাড়াবাড়ি করছে। দেশের নেতাদের সংযত হয়ে কথা বলার অভ্যাস কম। তবে এই উক্তিটি একেবারে সীমা অতিক্রম করে গেছে। দেশে গনতন্ত্র থাকলে, এই কথা বলার পরে, এখনো আর মন্ত্রী থাকতে পারতেন না। গনতন্ত্রের কথা আর কি বলব। দেশে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, তাতে দেশটি যে স্বাধীন দেশ সেটাই বিশ্বাস করতে কস্ট হয়। মনে আছে সেই সাতক্ষীরার ১৩ বছরের হিন্দু কিশোরী পুর্নিমার কথা? মেয়েটির ঘরেই তাকে গনধর্ষন করা হয়। পুর্নীমার মা ধর্ষকদেরকে বলেছিল – “বাবারা, তোমরা একজন একজন করে যাও, আমার মেয়েটি ছোট, ও মরে যাবে”। এটা তো কোন স্বাধীন দেশে হবার কথা না। এমন হয় যুদ্ধ চলছে এমন দেশে। সম্প্রতি আবার পুজা নামের ৫ বছরের একটি হিন্দু মেয়ে ধর্ষনের শিকার হয়েছে। অতটুকু একটি মেয়েকে যে ধর্ষন করা যায়, এই আইডিয়াটা যার মাথায় আসে, তাকে তো মমি বানিয়ে যাদুঘরে রাখা দরকার। যেন যুগে যুগে সবাই দেখতে পারে – এমন জানোয়ারও মানুষের বেশে থাকে।
এমন নিন্দনীয় ঘটনার পরে দোষীদের শাস্তি চেয়ে, তাদেরকে তিরস্কার করে অনেকে অনেক কথা বলেন। সেই সাথে এটাও শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত। অনেকে তো আবেগে এও বলে ফেলেন, “এদেশে হিন্দু হয়ে জন্মানোটা অভিশাপ”। দেশের মুসলমানের সংখা হিন্দুর চেয়ে দশগুন বেশী। কাজেই সাধারন হিসাবে, অমন দশজন জানয়ারের মধ্যে নয়জনই মুসলমান হবে, একজন হবে হিন্দু। অর্থাৎ, কোন হিন্দুকে অত্যাচারকারি ওই খারাপ লোকটি যে মুসলমান হবে তার সম্ভাবনা ৯০%। তার মানে কি এটা বলা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে খারাপ লোক বেশী? না, বলা যায় না। কারন, খারাপ , ভালো, চোর, বদমাইশ, ভদ্রলোক সবই মুসলমানদের মধ্যে বেশী। কারন তারা সংখায় বেশী। একজন হিন্দু দুস্কৃতিকারীর কথা বলছি। পরিমলের কথা মনে আছে নিশ্চই। তিনি সেই শিক্ষক যিনি ছাত্রিদেরকে ধর্ষনের রেকর্ড তৈরি করেছিলেন। সবাই তাকে তিরস্কার করেছে, সবাই তার বিচার চেয়েছে। কিন্তু কেউ কে এই কথা বলেছে, হায় হায়, হিন্দু এই লোকটি এতগুলো মুসলমান মেয়ের সর্বনাশ করল। না, বোকার মতন এই কথা কেউ বলেনি। কারন এখানে হিন্দু-মুসলমান জিনিসটাই নেই। এখানে আছে নারীলোভী একজন মানুষ ও তার শিকার নারীরা। সে মেয়েদেরকে ধর্ম দেখে ধর্ষন করেনি। ঠিক একইভাবে, যেসব জানোয়ারেরা হিন্দু কিশোরী, শিশুদেরকে ধর্ষন করে, তারা ধর্ম দেখে এটা করে না। তারা দেখে সুযোগ। তারা দেখে দুর্বলতা।
৫ বছরের মেয়ে পূজা ধর্ষনের খবর পেয়ে অনেক হিন্দু ভাইয়েরা – এদেশে হিন্দুদের বাস করা দুঃস্কর, হিন্দু হয়ে জন্মানো একটা অভিশাপ, এমন মন্তব্য করছেন। “শিশু ধর্ষন” এই কথাটা লিখে গুগলে সার্চ করে দেখুন। দেখবেন কতগুলো মুসলমান মেয়ে, মানুষ নামধারী কিছু জানোয়ারের হাতে ধর্ষিতা হয়েছে তার খবরটাও আপনি জানেন না। ওদিকে পুজার খবরে একেবারে বাজার গরম। শিশু ধর্ষনের মতন এমন অমানুষিক কার্জকলাপ দেখে সত্যই যদি আপনার মন কাদে, সত্যইও যদি প্রতিবাদে আপনার রক্ত গরম হয়, তবে তো সেটা সবসময়ই হবার কথা। বেছে বেছে, হিন্দু ধর্ষনে আপনি প্রতিবাদি কিন্তু মুসলমান ধর্ষনে আপনি নিরব কেন? এর প্রধান কারন হল, হিন্দু অত্যাচার এর খবরটা ঊদ্দেশ্যমুলকভাবে আপনার চোখের সামনে বেশী দেখানো হয়।
বলছিলাম, এসব দুঃস্কৃতিকারীরা হিন্দু মুসলমান দেখে না। তারা দেখে সুযোগ আর দুর্বলতা। আমার পরিচিত যত হিন্দু মানুষ আছে, যত হিন্দু বন্ধু আছে, তাদের কেউই নিরাপত্তা হীনিতায় কোনদিন ভুগেছে, এমন কখনো দেখিনি। তাদের পরিবারের কোন মেয়েকে নিয়ে যদি কোন মুসলমান কটুক্তি করে অথবা শুধু খারাপ চোখে তাকায়, তাহলে বাড়ি মেরে সেই মুসলমানের মাথা ফাটাতে পারে তারা। দেশের মন্ত্রী, সচিব, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, তারকা, কোথায় হিন্দু কম আছে? হিন্দু মন্ত্রী টাকার বস্তা নিয়ে ধরা খেয়ে দিব্যে মন্ত্রী পদে বহাল থেকেছেন। দেশের প্রধান বিচারপতি একজন হিন্দু। তিনি কলমের খোচায় প্রাত্বন মন্ত্রিদেরকে ফাসিতে ঝুলিয়েছেন। দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা যাদের হাতে তাদের বেশিভাগই হিন্দু। এসব হিন্দুরা কে, কবে, কোথায় অত্যাচারিত হয়েছেন? আসলে যেসব হিন্দুরা অত্যাচারিত, তাদের দোষ হল, তারা দরিদ্র এবং ক্ষমতাহীন। এদেশে দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন হওয়াটা অভিশাপ। একজন হিন্দু অত্যাচারিত হয়েছে শুনেই, এদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়, হিন্দু হয়ে জন্মানোটা অভিশাপ, এমন ধরনা করাটা বোকামী।
মালাউন (ملعون) আরবী শন্দ, যার অর্থ অভিশপ্ত। কোন মানূষই অভিশপ্ত নয়, তবে বর্তমানে আমরা সকল ধর্মের মানুষ মিলে একটা অভিশপ্ত গন্তব্যার দিকে যাচ্ছি। সেই গন্তব্যটা হল – ধর্মীয় দাঙ্গা। খুচিয়ে খুচিয়ে এই দাঙ্গা না বাধানো পর্যন্ত ওরা থামবে না। বিশেষ একটি গোস্টির জন্য, দেশে ইসলামীক সন্ত্রাসী আছে, এই জিনিসটা প্রমান করার খুবই জরুরী। মন্দির ভেঙ্গে, ইসলামিক দলের দোষ দিয়েছে। অথচ ধরা পড়েছে দলীয় বা ভাড়াটা সন্ত্রাসীরা। যে দেশে ব্লগার কি তাই কেউ চনতো না, সেই দেশে ব্লগারদের দিয়ে ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করা হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে, দাঙ্গা হয়নি। ইসলাম বিরোধী ব্লগারদের খুন করা হয়েছে, ইসলাম পন্থীদের ঘারে দোষ চাপানো যায়নি। প্রায় দুই ডজন বিদেশী নাগরিক হত্যা করা হয়েছে, খুনীরা কেউই মাদ্রাসার ছাত্র না। এবার শুরু খেলার দ্বিতীয় অধ্যায়। এখন শুরু হয়েছে হিন্দুদেরকে খোচানো। মন্দির ভাঙ্গা, ধর্ষন, মন্ত্রীর কটুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে এমন একটা অবস্থা করা হচ্ছে যেন হিন্দুরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এটা করতে পারলে মুসলমানেরাও এক কদম এগিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়বে। ব্যাস, হয়ে গেল মুসলমান সন্ত্রাসী, হয়ে গেল ইসলামিক জঙ্গি।
এই নোংরা রাজনীতি বন্ধের, বা অকেজো করার, একটাই উপায়। সেটা হল হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি। কোন কিছুর মধ্যেই ধর্মকে ঢোকানো যাবে না। আমরা সবাই অত্যাচারিদের পাশে আছি, থাকব। আমরা সবাই দঃস্কৃতিকারীর বিপক্ষে আছি, থাকব। সন্ত্রাসীর বিচার চাই, চাইব। এই ক্ষেত্রে শুধু একটি জিনিসই দেখতে হবে। সেটা হল, অন্যয় এর পক্ষে ও বিপক্ষে। কে কোন ধর্মের, সেটা দেখতে গেলেই ওই ফাঁদে আমাদের পা পড়ে যাবে। একজন অত্যাচারিত হিন্দুর পাশে যদি বাংলাদেশী হিসাবে দাঁড়ান, আপনার সাথে আছে পুরো বাংলাদেশ। কিন্তু তার পাশে যদি হিন্দু হিসাবে দাঁড়ান, তাহলে আপনার সাথে কেবল হিন্দুদেরকেই পাবেন। আর দলে ভারী মুসলমানদেরকে পাবেন আপনার বিপক্ষে (যদিও তারা সন্ত্রাসীদের পক্ষে নয়)। এখন আপনিই চিন্তা করুন, হিন্দু মুসলমান মিলে মিশে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবেন, নাকি ওদেরকে সুযোগ করে দিতে একে অন্যের (ধর্মের) বিরুদ্ধে লাগবেন? এই ধর্মীয় বিভেদ সৃস্টি করে আমাদেরকে শাশন করার অতি পুরাতন রাজনীতি এটা। ঠিক এভাবেই কিন্তু ইংরেজরা, ভারতবর্ষে হাজার বছরের ধর্মীয় সম্প্রীতি নস্ট করে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধিয়েছে, যার খেসারত ভারতকে এখনো দিতে হচ্ছে। দোহাই আপনার, এই ফাঁদে পা দিবেন না।
আমার ফেসবুক ---------- এখানে
বিষয়: বিবিধ
১৮১৮ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যথার্থ বলেছেন, সহমত
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
মন্তব্য করতে লগইন করুন