মুজেজা, কারামত ও তাওহীদ
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:১৮:২৬ বিকাল
এই দুনিয়াতে নানা রকমের মানুষ আছে। একেক জনের একে স্বভাব, একেক ধরনের মানষিকতা । কিন্তু কিছু কিছু স্বভাব আছে যেটা সব মানুষের ভেতরেই কম বেশী আছে। তেমনই একটা স্বভাব হল, অস্বাভাবিক বা অসম্ভব কিছু দেখলেই সেটার প্রতি দুর্বল হয়ে যায়। যে এই অসম্ভব করে দেখায় তাকে নেতা, গুরু এমনকি ঈশ্বরও মনে করে। মানুষের এই সহজাত স্বভাবকে কাজে লাগাতেই নবী রাসুলদের মুজেজা দেওয়া হয়েছিল। নবী রাসুলদের কাছে আল্লাহ প্রদত্ত কিছু ক্ষমতা ছিল যার ফলে তারা কিছু আসম্ভব কাজ করে দেখাতে পারতেন, এটাকেই মুজেজা বলে।
ফল খাওয়ার পরে ছোট একটি বীজ ফেলে দেওয়া হয়। সেই বীজে নেই কো জীবন, নেই কোন প্রান। কিন্তু একটি বড় গাছ তৈরি হবার প্যকেজটি ওই ছোট ওই বীজের মধ্যে আছে। সেই বীজ মাটি চাপা দিয়ে তাতে পানি ঢাললে ধীরে ধীরে সেটা থেকে ছোট এক চারা গজায়। এই ছোট গাছটির জীবন আছে। শেকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে পানি সংগ্রহ করে, সুর্যের আলোতে নিজের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করে। দাত, মুখ, পাকস্তলি কিছুই নেই কিন্তু দিব্যি খাবার খেয়ে বেচে আছে। বেচে থাকতে, গাছের ফুসফুস লাগে না, মস্তিস্ক লাগে না। শীতকালে গাছের সব পাতা ঝরে পড়ে। মৃতপ্রায় সেই গাছে আবার নতুন পাতা গজায়, আবার ফুল ফোটে, আবার ফল ধরে। এসব দেখে আমাদের অবাক লাগে না। অথচ কোথাকার একটি গাছ রুকু দেবার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। আরে ভাই, গাছ জিনিসটি এমনিতেই তো কুদরত। এটা সোজা হয়ে দাড়াক, আর রুকু দিক আর সিজদা দিক, একই কথা।
মানুষের এই স্বভাবের জন্যই যুগে যুগে নবী রাসুলের কাছে মুজেজা দেওয়া হয়েছে। কোন নবী যদি অসম্ভব কিছু করে দেখাতে পারেন তাহলে তার অনেক ভক্ত জুটে যেত। অনেকেই তার ধর্মকে বিশাস করত, তাকে আল্লাহর মনোনীত নবী বলে মেনে নিত। অন্যান্য নবীদের ইতিহাস অনেক পুরাতন। তাই তাদের অনুসারীদের ব্যাপারে তেমন সুস্পস্টভাবে অনেক কিছুই জানা যায়নি। তবে সর্বশেষ নবী ও রাসুল (সাঃ) এর অনুসারীদের (সাহাবী) ব্যাপারে অনেক কিছু জানা গেছে। সেই সব শ্রেস্ট ঈমান সম্পন্ন সাহাবীদের নাম ইসলামের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে। এসব সাহাবীদের কেউই আমার জানা মতে রাসুল(সা) এর মুজেজা দেখে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেনি। তাদের প্রায় সবাই ঈমান এনেছেন কোরআনের বানী শুনে। যদিও ক্ষেত্র বিশেষে কোরআনকেও রাসুল (সা) এর মুজেজা বলা হয়।
আমার এই লেখাটার মুল উদ্দেশ্য হল, কারামত এর ব্যাবচ্ছেদ করা। জানা গেছে, নবী ও রাসুলের মতন এমন আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা ছিল বা আছে অনেক পীর বা দরবেশের। তারা অনেক রকমের অসম্ভব করে দেখাতে পারতেন বা পারেন বলে শোনা যায়। এমন একটি সবচেয়ে প্রচলিত কারামত হল, পানিতে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়া। এগুলো কতখানি সত্য সেই আলোচনায় না গিয়ে তর্কের খাতিরে সবকিছুকেই সত্য বলে মেনে নিচ্ছি। এখন প্রশ্ন হল, এমন একজন কারামত ওয়ালা পীর আমাদের কি কাজে আসতে পারে ?
আমরা আধুনিক যুগে স্কুল কলেজে পড়ি। আমাদের গুরু বা শিক্ষক আছেন। আমাদের পাঠ্যবই থেকে জ্ঞান লাভ করার জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। প্রাচীন আমলে স্কুল কলেজ ছিল না। ছিলনা তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কাজেই মানুষকে যে কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হলে একজন গুরুর স্মরনাপন্ন হতে হোত। একইভাবে ইসলামিক বিষয়ে জ্ঞানের জন্যও গুরু বা শিক্ষক ছিল। এই ধর্মীয় গুরুদেরকেই পীর বলা হোত। এখনকার যুগে এমন শিক্ষা প্রতিস্টহানেই ধর্মীয় শিক্ষক পাওয়া যায়। ইসলামের উপরে গবেষনা করার জন্য বড় বড় ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কাজেই আজকের যুগে পীরের দরকার নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, পীরদের ক্ষমতা হিসাবে যে কারামতের কথা বলা হয়, সেটা আসলে কোন কাজে লাগে? একজন গুরু বা শিক্ষক কতখানি যোগ্য সেটা বিচার করা যায় তার জ্ঞান দেখে। অসম্ভব কোন কাজ করে দেখাতে পারলে একজন ভালো শিক্ষক হয়ে যায় কিভাবে? কারামত জিনিসটা পীরের সঙ্গে যায়ই না।
কারামত জিনিসটা সেই ধরনের পীরের সঙ্গে যায় যাদেরকে আজকে আমরা চিনি। আজকের দিনে শ্লোগান বেরিয়েছে, যার পীর নেই তার পীর শয়তান। অর্থাৎ আপনার পীর থাকতেই হবে !! এই পীর কিন্তু কোন শিক্ষক নয়। এরা হল আল্লাহর ওলী। অর্থাৎ, আল্লাহর কাছের লোক, একেবারে সরাসরি যোগাযোগ। কোন বড় সাহেবকে খুশি করতে হলে যেমন তার পিওনকে হাত করতে হয়। তেমনি (ওদের ধারনামতে) আল্লাহকে খুশী করতে হলে এমন আল্লাহর ওলীদের মুরীদ হতে হয়। এরা ভক্তদেরকে নাকি একেবারে সরাসরি জান্নাতে নিয়ে যাবে। ওরা যে আল্লাহর কাছের লোক সেটা প্রমান করতে এদের কারামত দেখানো লাগে। দু-একটা আজব ভেলকী দেখাতে পারলেই হল, লাইন দিয়ে মানুষ হাজির হবে। ভেলকি না দেখাতে পারলেও ক্ষতি নেই। মুরিদেরা প্রচার করতে করতে মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে ফেলবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন আল্লাহর ওলী আমাদের কি কাজে লাগে? না আমি ভন্ড পীর বা ভন্ড ওলীর কথা বলছি না। ধরে নিলাম একজন বহুত কামেল বান্দা আছেন। তিনি আল্লাহর খাস বান্দা। হয়ত কিছু কারামতও দেখাতে পারেন। সবই মেনে নিলাম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি আমাদের কি কাজে আসতে পারেন?
তিনি আমাদের একটাই কাজে আসতে পারেন। সেটা হল, তিনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারেন। তবে সেই দোয়া কবুল হবে কিনা সেটা সম্পুর্ন আল্লাহর ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে। তাও আবার এই দোয়া তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পারেন। মৃত্যুর পরে তিনি বরং আপনার দোয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে যান। অর্থাৎ, তখন আপিনি তার জন্য দোয়া করতে পারেন। পীর, ওলী, কামেল, আলেম ইত্যাদি যত বড়ই হোক না কেন, যে রাসুল (সা) এর চেয়ে বড় নন। রাসুল (সা) নিজের কন্যাকে বলেছেন, তিনি পরোকালে তাকে কোন সাহায্য করতে পারবেন না। তিনি নিজের কন্যাকে সাহায্য করতে না পারলে আর কাকে সাহায্য করতে পারবেন? যেখানে রাসুল (সা) নিজেই অপারগ, সেখানে অন্য কেউ আরেকজনকে জান্নাতে কিভাবে নিয়ে যায়?
জান্নাতে আরেকজনকে নিয়ে যাওয়া তো দুরের কথা, হাসরের ময়দানে এমন পরিস্থিতি হবে যে নবী রাসুলেরাও আতঙ্কের মধ্যে থাকবে। মা তার নিজের সন্তানকেই চিনবে না। সেখানে কোথাকার কোন মুরীদকে কোন পীর জান্নাতে নিয়ে যাবে, বা নেওয়ার সুপারিশ করবে, এমন ডাহা মিথ্যা কথা লক্ষ লক্ষ লোক কিভাবে বিশ্বাস করে বসে আছে। কারন একটাই, আমরা কোরআন হাদিস থেকে ইসলাম না চিনে, ওমুকের বই পড়ে, তমুক কথা শুনে, ইসলাম চেনার চেস্টা করি।
ইসলামের মুল কথা হল তাওহিদ, আল্লাহর একত্ববাদ। এই তাওহীদের প্রচারের জন্য ; আল্লাহ, মানুষের মধ্যে থেকেই যুগে যুগে নবী ও রাসুল মনোনীত করেছেন। এমন মনোনীত সর্বশেষ নবী ও রাসুল। উনার মাধ্যমে আল্লাহ ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই ধর্মটি একটি পরিপুর্ন জীবন ব্যাবস্থা। এর মুল বই কোরআন, গাইড বই হাদিস। এই দুটি বই অনুসারে, ইসলাম ধর্মটিকে, আমরা কতখানি মেনে চলতে পারি তার উপরে নির্ভর করে আমাদের পরোকালের সফলতা। তবে সবচেয়ে প্রথম বিষয় হল, তাওহীদ, আল্লাহর একত্ববাদ। এর বিপরীত হল শিরক, অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতার সঙ্গে আর কাউকে অংশিদার করা। পীর বা আল্লাহর ওলীর মাধ্যমে পরোকালের মুক্তির কামনা বা আশা করাটা হল স্পস্ট শিরক। ইসলামে সবচেয়ে বড় অপরাধ হল শিরক। তওবা না করলে, শিরকের শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শিরক ও জাহান্নাম থেকে বাচান। আমীন।
আমার ফেসবুক ---------- এখানে
বিষয়: বিবিধ
২০৫৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যখন কোরান ও হাদীসানুযায়ী ধর্মের বানী ও শিক্ষাকে - ব্যবসা, সন্মান, প্রচার ও প্রসারের উপজীব্য করা হয়, আইন কানুন ও অন্যান্য বাধাঁ সামনে তুলে ধরা হয়, ধর্মের বিকল্প হিসাবে বিভিন্ন রকমের আশক্তি (সিনেমা, নাটক, ড্রাগ, পার্ক, ক্লাব, অবকাশ ইত্যাদি) সহজলভ্য করা হয় - তখন গনমানুষ ধর্মের সত্যিকার মেসেজ হতে দুরে সরে যেতে বাধ্য হয়।
আর হঠাৎ করে মানুষের উপর আসা বালা মুসিবত ও অসহায়ত্বের সময় সিস্টেমেটিক্যালী তথাকথিত পীর মুরিদকে সামনে তুলে ধরা হয় বলে আজকে আপনি আমি মুসলিম নামদারী মেসেজবিহীন গনমানুষকে লাইন ধরে পীর মুরিদের পেছনে ঘুরতে দেখি।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন