কোনটা সেরা জিহাদ? অন্যায়ের বিরুদ্ধে নাকি নিজের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ২৩ মে, ২০১৫, ০৩:১৩:৪৪ রাত
মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার হওয়া শব্দ সম্ভবত - জিহাদ । এই জিনিসটি প্রায় সবাই অপব্যাখ্যা করে। এক ধরনের উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী ইসলামের নামে গলা কেটে ইসলামকে কলুষিত করে সেটার নাম দেয় জিহাদ। এই দেখে ইহুদি নাসারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে জিহাদ নাম দেয়। আরেক শ্রেনীর ফতোয়াবাজ সন্ত্রাসীদের মনোরঞ্জনের জন্য মেয়েদের পাঠানোকে "যৌন জিহাদ" নাম দিয়ে হালাল করার চেস্টা করে। এই জিহাদের নাম দিয়েই সন্ত্রাসীরা আত্মঘাতী বোমারু তৈরি করে। এতক্ষন তো বললাম দুস্ট লকের কথা। ভাল লোকেরাও অন্যায় দেখে চুপ থেকে নিজের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে দায় সারে। সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে জিহাদের অপব্যাখ্যা ও অপব্যাবহার।
জিহাদ কথাটির অর্থ "struggle" অথবা "resisting". অর্থাৎ, সংগ্রাম বা প্রতিরোধ। জিহাদ হল ইসলাম রক্ষায় সংগ্রাম বা প্রতিরোধ। সেই সংগ্রাম প্রয়োজনে যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। আমরা যেমন বলি "জীবন সংগ্রাম"। এর অর্থ কিন্তু মারামারি নয়। জীবন সংগ্রাম হল ভালোভাবে বেচে থাকার চেস্টা। ঠিক তেমনি ভাল মুসলিম হওয়ার চেস্টাই ও ইসলামকে রক্ষা করাটাই হল ইসলামী সংগ্রাম - জিহাদ। এলাকাতে মদ ও জুয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। যুবক ছেলেরা এই ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফেলছে। ভালো মুসলিম তখনই সেই এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে। একজন নয়, সবাই মিলে করবে। এমন করাটা ইসলামে ফরজ। এজন্য কাউকে লাঠি হাতে ধরতে হবে না। ওই আয়োজকদের কাছে গিয়ে জুয়া ও মদের আসর বন্ধ করতে বললেই হবে। মুসলমান হিসাবে আপনার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু ওই আয়োজক যদি ভালো কথায় না শোনে এবং এর পরেও জুয়ার আসর চালিয়ে যায় তাহলে মুসলমানেরা যথসাধ্য বল প্রয়োগ করবে। তখন প্রয়োজনে লাঠি হাতে নিবে। উদ্দেশ্য, ইসলামের রক্ষা ও প্রতিরোধ করার সংগ্রাম। এটাই তখন জিহাদ হবে। আমাদের দেশে ওই বল প্রয়োগের সময় অর্থাৎ জিহাদের সময় সবাইকে খুজে পাওয়া যায় না।
তেমনিভাবে এলাকার বাইরে, শহরব্যাপী বা দেশব্যাপী কোন অন্যায় হয় এবং সেই অন্যায়ের পেছনে কোন বড় শক্তি থাকে তখন আমাদের জিহাদের উতসাহ হারিয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন বড় বড় মাজার আছে যেখানে লাখো লোকে জড়ো হয়ে শিরকী করে। দেশে অনেক তাবিজ দেওয়া হুজুর আছে যারা জানেই না তাবিজ শিরকী। এছাড়া পাথরে ভাগ্য পরিবর্তন, পানি পড়া, মুখ দেখে ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া এসব তো আছেই। দেশে অনেক আদম ব্যাপারী আছে যারা মানুষের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাঁকে সাগরে মরতে পাঠায়। দুর্নীতি, চাদাবাজী, সুদ, ঘুষ, অপহরণ, খুন, গুম ইত্যাদি তো লেগেই আছে। মাদকের ছোবলে ধংশ হয়ে যাচ্ছে যুব সমাজ। রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত করার ও ক্ষমতা আকড়ে ধরে রাখার লড়াই যাতে ভোগান্তি হয় সাধারন জনগনের, প্রান হারায় হাজার মানুষ। অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন এগুলোর সাথে ইসলামের কি সম্পর্ক? হ্যাঁ, সম্পর্ক আছে। এতক্ষন যেগুলো বললাম সেগুলো কি ইসলামে বৈধ না অবৈধ? অবৈধ মদ ও জুয়া ঠেকানোর জন্য সংগ্রাম করতে পারলে অন্য অবৈধ কাজ ঠেকানোর জন্য কেন নয়? এমন ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা আমাদের জন্য ফরজ। এটা আমাদের জিহাদ। মনে রাখতে হবে জিহাদ হল সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যদি বিনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায় তাহলে ভালো। তা না হলে প্রয়োজনে লাঠি হাতে নিতে হবে।
এমন ধরনের জিহাদ সহজ নয়। বড় শক্তি আছে ওসব অন্যায়ের পেছনে। কাজেই আপনাকে বড় শক্তির বিরুদ্ধে নামতে হবে। রয়েছে সমুহ বিপদের সম্ভাবনা। এজন্যই বেশীরভাগ মুসলিম এই জিহাদ পরিত্যাগ করেন। তবে একশ্রেনীর লোক এই জিহাদ পরিত্যাগ করার জন্য ইসলামিক যুক্তিও পেশ করেন। মুলত তাদের কথা চিন্তা করেই আমার এই লেখা। তেনারা ধার্মিক, ও শান্ত স্বাভাবের। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করাটা তাদের স্বভাবে নেই। তারা ঘর, কর্মস্থল ও মসজিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের ভাষায় জিহাদ হল নিজের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ। এটা হল বড় জিহাদ। আর, প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করাটা, ছোট জিহাদ।
কথাটা খুব ভালভাবে বুঝুনঃ যে লোকটার খারাপ কাজ করতে ইচ্ছা হল এবং অনেক কস্টে নিজেকে দমন করল - সে করল বড় জিহাদ। ওদিকে প্রানের মায়া ত্যাগ করে, নিজের আপনজন ত্যাগ করে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধে করে আহত হয়ে আসল যে লোকটি - সে করল ছোট জিহাদ । কথাটা কি বুঝেছেন? যে লোকটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আহত হয়ে এলো, তারটা হল ছোট জিহাদ। আর ওদিকে, আপনি ইন্টারনেটে পর্ন না দেখে ইন্টারনেটেই কোরআন তেলওয়াত বা ওয়াজ মাহফিল দেখলেন - আপনারটা হয়ে গেল বড় জিহাদ। এটা কেমন কথা হল? কথাটা সম্পুর্ন অযৈক্তিক।
আমাদের সমাজে একটি হাদিস প্রচলিত আছে - নিজের কু প্রবিত্তির সাথে জিহাদ করা সবচে বড় জিহাদ। এটা কতখানি সঠিক হাদিস তা আমি জানি না। কিন্তু কোরআনের বানী ও অন্য সহী হাদিসের কথা এর বিরুদ্ধে যায়।
- গৃহে উপবিস্ট মুসলমান, যাদের কোন সঙ্গত ওযর নেই এবং ঐ মুসলমান যারা জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর পথে জেহাদ করে, - সমান নয়। যারা জান মাল দ্বারা জেহাদ করে, আল্লাহ তাদের পদমর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন গৃহে উপবিস্টদের তুলনায় এবং প্রত্যেকের সাথে আল্লাহ কল্যানের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ মুজাহেদনকে উপবিস্টদের উপর মহান প্রতিদানে শ্রেস্ট করেছেন। আল কোরআন (৪:৯৫)
- জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসুল (সা) মানুষের মধ্যে শ্রেস্ট কারা? তিনি উত্তর দিলেন, "যারা আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করে" (সহী বুখারী ৪/৪৫)
- আমর ইবনে আবসাহ কতৃক বর্ণিত - "আমি রাসুল (সা) এর কাছে আসলাম ও জিজ্ঞেস করলাম , হে আল্লাহর রাসুল, কোন জিহাদ সবচেয়ে সেরা? তিনি বললেন যেখানে রক্তপাত হয় আর ঘোড়া আহত হয়"। (ইনবে মাজাহ ২৭৯৪)
একেবারে স্পস্ট করে বলা আছে যে জান ও মাল নিয়ে জিহাদ উত্তম। রক্তপাতের কথাও বলা আছে। মুলত রাসুল (সা) এর আমল ও তার কয়েকশত বছর পর পর্যন্ত জিহাদ শব্দটি যুদ্ধ হিসাবেই ব্যাবহার করা হতো। মনের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ, এই ধারনাটা আবিস্কার হয়েছে ১১০০ সালের পরে। ইসলামিক পন্ডিতদের আবিস্কার এটা। পণ্ডিতেরা হয়ত ঠিকই বলেছিলেন- কিন্তু আমরা বুঝতে ভুল করেছি।
একজন লোক, জিহাদে যাওয়ার আগে নিজে চিন্তা করেই যায়। তার মনে এই চিন্তা আসে - "ওখানে গিয়ে কি হবে?, অন্য সবাই মরতে গেলে আমিও কি মরতে যাব? জিহাদে না গিয়ে ঘরে বসে পরিবারের সাথে সময় দেই"। এই সব চিন্তাকে পরাজিত করেই একজন জিহাদের ময়দানে যায়। তার জিহাদের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা ওই চিন্তা। এগুলোই কু-প্রবৃত্তি। সেই কু-প্রবৃত্তিকে পরাজিত করাটাই আসলে জিহাদের বড় অংশ। জিহাদের মাঠে গিয়েও তার কু-প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। বারবার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেই কু-প্রবৃত্তিকে পরাজিত করেই আমৃত্যু যুদ্ধ করে জিহাদীরা। এভাবে চিন্তা করেই হয়ত ইসলামিক পণ্ডিতেরা নিজের মনের সাথে জিহাদকে বড় করে দেখিয়েছেন। কিন্তু নিজের মনের সাথে জিহাদের অর্থ এই নয় যে ঘরে বসে থাকতে হবে।
আমরা কু-প্রবৃত্তি বলতে যা বুঝি তা হল খারাপ কাজ করার প্রবনতা। এর সাথে জিহাদের কোন সম্পর্ক নেই। মনের কু-প্রবিত্তি ঠেকানোটা কোন জিহাদ নয়। জিহাদ হল ইসলাম টিকিয়ে রাখার জন্য, রক্ষা করার জন্য ও অন্যায়ের খতম করার জন্য কঠোর সংগ্রাম ও প্রতিরোধ। এই সংগ্রাম বিভিন্নভাবে হতে পারে। সঙ্গত কারনেই এমন সংগ্রাম হয় শক্তিশালী কোন প্রতিপক্ষের সাথে। তাই বিপদের আশঙ্কায় এই সংগ্রামে করতে বাঁধা দেয় আমাদের মন। মনের সেই বাধাকে পরাজিত করেই শুরু করতে হয় জিহাদ। মনের এই বাধাকে পরাজিত করাটা জিহাদের একটি অংশ। নিজের কু-প্রবৃত্তি বিরুদ্ধে জিহাদ বড় আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ ছোট - এমন কথা ইসলামে নেই।
সুত্রঃ http://wikiislam.net/wiki/Lesser_vs_Greater_Jihad
আমার ফেসবুক ---------- এখানে
বিষয়: বিবিধ
৩৮০১ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
একবার পড়লাম! যথেস্ট গুরুগম্ভীর লিখা! শেষের দিকটা ঠিকভাবে বুঝি নি সময় নিয়ে আবার পড়বো ইনশা আল্লাহ!
শুকরিয়া !
হ্যাঁ, লেখাটি একটু কঠিন হয়ে গেছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আল্লামা ইকবাল শতবর্ষ আগে একটি কথা বলেছিলেন যে মুসলিম দের মধ্যে যখন থেকে জিহাদ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার পতন ও তখন থেকে হয়েছে।
আরেকটি কথা হলঃ বর্তমান দুনিয়ায় ইসলাম কুফরী শক্তির আঘাতে জর্জরিত, আহত ও নিষ্পেষীত। এই মুহুর্তে নফসের জিহাদকে বড় বলে প্রচার করা ও প্রকৃত যুদ্ধে না যাওয়া বা সহায়তা না করা বা বিরোধীতা করা শয়তানী চক্রান্তের ফসল। ধন্যবাদ।
অসাধারণ লেখা ও বিশ্লেষণ। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
যাহোক, ইসলামের শত্রুরা ‘জিহাদের যত (অপ)ব্যাখ্যাই করুক, এক বর্ণনা অনুযায়ী, যারা জিহাদে শহীদ হবে, তারা তো শেষ বিচারের দিন ‘রক্তাক্ত পোশাকেই উঠে দাঁড়াবে, কিন্তু আমাদের এই ‘জিহাদে আকবর’ ব্যাখ্যাওয়ালারা তখন রক্তাক্ত পোশাক পাবে কোথায়?
রাসূলে করিম একবার এক জিহাদ থেকে ফিরার পথে বলেছিলেন ‘ বড় জিহাদের দিকে ফিরে চলেছি’। হ্যাঁ, সত্য। তবে এর কারণ ছিল। ব্যাখ্যাও রয়েছে। তবে আজকের দিনে অনেকের ‘লেকচার শুনলে ভয় লাগে, যেন জিহাদ অর্থ ‘ক্রাইম! ম্যাসাকার! অবশ্য ইসলামের শত্রুরা এ লেবেল লাগিয়ে দিতে চেষ্টার ক্রুটি করছে না। জিহাদ অর্থ এটা যেমন ঠিক, জিহাদ অর্থ ‘সম্মুখ সমর, এটাও ঠিক! নিজের চরিত্র, নৈতিকতা রক্ষা যেমন জিহাদ, তেমনি জীবন, পরিবার, সম্পদ, ধর্ম – উম্মাহ- দেশ তথা অস্তিত্ব রক্ষায় যে সংগ্রাম- সেটাও জিহাদ!
নিজের অস্তিত্বই যদি না থাকে, নীতি কথা আর চরিত্র রক্ষার তো প্রশ্নই আসবে না, নয় কি!
মন্তব্য করতে লগইন করুন