ভাগ্য কি আগেই নির্ধারিত থাকে ? - ইসলাম কি বলে
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ১৪ মার্চ, ২০১৫, ০১:০৩:৫৫ রাত
এর আগেও একই বিষয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। তাতে আমার নিজের মতামত ব্যাক্ত করে যথাসাধ্য যুক্তি উপস্থাপন করেছি। আপনারা অনেকেই লেখাটির প্রশংশা করেছিলেন, স্বপক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। এজন্য আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অতি সম্প্রতি, আমার ওই লেখাটি পড়ে, একজন ভাই এ ব্যাপারে ইসলামে কি আছে সেটা জানতে চেয়েছেন। ইসলাম নিয়ে আমার লেখাগুলোতে আমি বেশিরভাগ সময়ই কোরআন ও হাদিসের উক্তি টেনে আনি না। কারন আমি ইসলামের নিয়ম কানুনের ব্যাপারে কিছু লিখি না এবং তার যোগ্যতাও আমার নেই। আমি সব লেখাতেই ইসলামের স্বপক্ষে যুক্তি পেশ করি। কোরআন ও হাদিসের ব্যখ্যা করার জন্য ইসলামিক শিক্ষিত লোক রয়েছেন। এর পরেও ওই ভাইয়ের প্রশ্নটা শুনে মনে হল একই প্রশ্ন অনেকের মনেই থাকতে পারে। তাই কিছু লেখার চেস্টা করছি।
এই প্রশ্নটি অনেক পুরাতন। ইসলামের অনেক আগে থেকেই প্রশ্নটি প্রচলিত আছে। ভাগ্য কি নির্ধারিত থাকে নাকি মানুষ ভাগ্য গড়তে পারে। এখনও এই প্রশ্নটি টেনে আনা হয়। এখনও আমরা এর জবাব খুজি ও বিভ্রান্ত হই। ভাগ্য হল নির্ধারিত ভবিশ্যত। এটা আগেই নির্ধারিত থাকে। সেই এটাও সত্য যে মানুষের কর্মও এই ভাগ্যের জন্য দায়ী। এক্ষেত্রে যে কারনে প্রশ্নটি আসে তা হল - একজন ব্যাক্তি যদি পাপ করে, সেটা আগেই নির্ধারিত থাকে। তাহলে ওই ব্যাক্তি দায়ী কেন বা পরোকালে তার সাজা হবে কেন? ভাগ্য আগেই নির্ধারিত থাকে - মানুষের কর্ম ভাগ্যের জন্য দায়ী। এই কথা দুটি পরস্পর বিরোধী কথা। এই দুই রকমের কথা একসাথে কিভাবে সত্য হয়? কোরআনে এই দুই পক্ষেই আয়াত আছে।
ভাগ্য নির্ধারিত থাকেঃ (আল-করআন)
- পৃথিবীতে বা ব্যাক্তিগতভাবে তোমাদের উপরে যে বিপর্যয় আসে আমি উহা সংগঠিত করিবার পুর্বে উহা লিপিবদ্ধ থাকে; আল্লাহর পক্ষে ইহা খুবই সহজ (৫৭;২২)
- অদৃশ্য কুঞ্জি (চাবি) তাঁহার নিকট রহিয়াছে, তিনি ব্যাতিত অন্য কেহ তাহা জানে না। জলে ও স্থলে যাহা কিছু আছে তাহা তিনি অবগত, তাঁহার অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্যকনাও অঙ্কুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুস্ক এমন কোন বস্তু নাই যাহা সুস্পস্ট কিতাবে নাই (৬;৫৯)
- আমারই নিকট আছে প্রত্যেক বস্তুর ভান্ডার এবং আমি উহা পরিজ্ঞাত পরিমানেই সরবরাহ করিয়া থাকি (১৫;২১)
- ...আল্লাহ যাহাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাহাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী , প্রজ্ঞাময়
- বল, হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ। তুমি যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান কর এবং যাহার নিকট হইতে ইচ্ছা ক্ষমতা কাড়িয়া লও; যাহাকে ইচ্ছা তুমি ইজ্জত দান কর, আর যাহাকে ইচ্ছা তুমি হীন কর। কল্যান তোমার হাতেই। নিশ্চয়ই তুমি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।
মানুষ কর্ম ও চেস্টায় ভাগ্য পরিবর্তন হয়ঃ (আল - কোরআন)
- ... এবং আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষন না উহারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে ...।(১৩;১১)
- ... কাহাকেও আমি প্রেথিত করিয়াছিলাম ভুগর্ভে এবং কাহাকেও করিয়াছিলাম নিমিজ্জিত। আল্লাহ তাহাদের প্রতি জুলুম করে নাই; তাহারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করিয়াছিল। (২৯;৪০)
- ... অতঃপর উহা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করল , ফলে তাহারা যাহা করিত তজ্জন্য আল্লাহ তাহাদেরকে স্বাদ গ্রহন করাইলেন ক্ষুধা ও ভীতি আচ্ছাদনের। (১৬;১২২)
- ... যে সতকর্ম করে সে নিজের কল্যানের জন্যই উহা করে এবং কেহ মন্দ কর্ম করিলে উহার প্রতিফল সে-ই ভোগ করিবে। তোমার প্রতিপালক তাঁহার বান্দাদের প্রতি জুলুম করেন না(৪১;৪৬)
- আমি তাহাকে পথের নির্দেশ দিয়াছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হইবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হইবে। (৭৬;৩)
- বল, সত্য তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে ; সুতরাং যাহার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক ও যাহার ইচ্ছা সত্য প্রত্যাখ্যান করুক ... (১৮;২৯)
- মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়াইয়া পড়ে ... (৩০;৪১)
কোরআনে একদিকে বলা আছে বিপর্যয় লিপিবদ্ধ থাকে, অন্যদিকে বলা আছে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় হয়। একদিকে বলা আছে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎ পথে পরিচালিত করেন, অন্যদিকে বলা আছে বিশ্বাস করুক বা নাই করুক। একদিকে বলা আছে যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান করেন, অন্যদিকে বলা আছে অস্বীকারকারীকে শাস্তি দেওয়ার কথা। দুই পক্ষেই কথা বলা আছে কোরআনে। কোরআনে যখন আছে, এই দুটি পক্ষই সত্য। এখন এই দুই পক্ষের সমন্বয় করতে হলে আমার যুক্তিতেই ফিরে আসতে হবে।
ভাগ্য হল নির্ধারিত ভবিশ্যত ও তার ফলাফল। এর সবই নির্ধারিত। ধরুন, আপনি এই মুহুর্তে একটি চেয়ারে বসে এই লেখা পড়ছেন। আগামী এক মিনিটে আপনি কি কি করতে পারেন এর সবই নির্ধারিত আছে। এটা নির্ধারিত আছে যে আপনি চেয়ার ছেড়ে অন্য কোন ঘরে যাবেন। এটা নির্ধারিতে আছে যে আপনি চেয়ারের হাতল ধরে নড়াবেন। এটা নির্ধারিত আছে যে আপনি গুন গুন করে গান গাইবেন। এটা নির্ধারিত আছে আপনি চোখ বন্ধ করে ধ্যান করবেন। এটা নির্ধারিত আছে আপনি মোবাইল ফোন ব্যাবহার করে কাউকে ফোন করবেন। যা যা করতে পারেন, তার সবই নির্ধারিত আছে। কনটা করার ফলাফল কি হবে সেটাও নির্ধারিত। তাহলে কি নির্ধারিত নেই? আপনি চেয়ারের এক ফুট উপরে শুন্যে ভেসে থাকবেন, সেটা নির্ধারিত নেই। আপনি চেয়ারকে চা খাওয়াবেন , এটা নির্ধারিত নেই। আপনি প্লাস্টিকের পানির বোতলকে স্বর্নের বানিয়ে ফেলবেন, এটা নির্ধারিত নেই। অর্থাৎ সে সব জিনিস আপনার পক্ষে করা অসম্ভব, তার কোনটাই নির্ধারিত নেই। আর যে সব আপনার দ্বারা করা সম্ভব - তার সবই নির্ধারিত আছে আপনার ভাগ্যে বা ভবিশ্যতে। আসলে নির্ধারিত আছে বলেই সেটা আপনি করতে পারছেন, নইলে সেই কাজটা করতেই পারতেন না। আপনি শুন্যে ভেসে থাকবেন এটা নির্ধারিত নেই, তাই এটা করতে পারেন না।
আশা করি "নির্ধারিত" জিনিসটা বোঝাতে পেরেছি। একজন লোককে আপনি চড় দিবেন সেটাও নির্ধারিত, আবার তাঁকে চুমু দিবেন সেটাও নির্ধারিত। এই দুই নির্ধারিত ভবিশ্যতের মধ্যে কোনটা বেছে নিবেন সেটা আপনার ব্যাপার। হাজার হাজার নির্ধারিত ভবিশ্যতের মধ্যে থেকে একটা বেছে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। আমাদেরকে সেই স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এই বেছে নিতে আল্লাহ আমাদেরকে বাধ্য করেন না। যেটা বেছে নিব, তার দোষ গুন সবই আমাদের নিজের। আল্লাহ আমাদেরকে বেছে নিতে বাধ্য করলে পরকালে কোন বিচারের দরকার হোত না। আমরা কোনটা বেছে নেই তার উপরেই তো আমাদের পাপ পুন্য নির্ভর করে। তার উপরেই বিচার হবে।
তবে এই কথার শেষে আর একটা কথা যোগ করতে হয়। সেটা হল, আল্লাহর ক্ষমতা, শক্তি , সন্মান যে কত বড় সেটা বোঝা বা বর্ননা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। শেষ বিচারের সময় শাস্তি থেকে বাচতে অনেকেই আল্লাহর নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নিজের দোষ লুকানোর চেস্ট করবে। কিন্তু কেউ যদি কোন সত্য অভিযোগ করতে পারে, তাহলে আল্লাহর সন্মানের কি অবস্থা হয় সেটা কি ভেবে দেখেছেন? একজন বান্দা যদি আল্লাহর সামনে নামে একটা সত্য অভিযোগ করতে পারে তবে আল্লাহ কেমন সর্বজ্ঞানী, পরম দয়ালু, সর্বশক্তিমান হলেন? জিনিসটা এমন হল যে, আল্লাহর বান্দা আল্লাহর ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন (নাউজুবিল্লাহ)। এমন কখনোই হবে না। কেউ কোন সত্য অভিযোগ করতে পারবে না, সেই সুযোগই তিনি দিবেন না। এই কথাগুলো এজন্য বলছি যে - শেষ বিচারের সময় আপনি যদি আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেন "আমি পাপ করেছি কারন আমার ভাগ্যে তুমি (আল্লাহ) পাপ লিখে রেখেছ"। এটা যদি সত্য অভিযোগ হয় তাহলে আল্লাহর সন্মান কোথায় থাকে? না, এমনটা কখনোই হবে না, আল্লাহর কাছে কোনদিন সত্য অভিযোগ নিয়ে যেতে পারবেন না। তিনি ভুল করেন না। "...আমার ভাগ্যে পাপ লিখেছ" এই অভিযোগটা মিথ্যা। কারন, আল্লাহ আপনার ভাগ্যে পাপ ও পুন্য দুটোই লিখে রেখেছেন। এর কোনটা বেছে নিবেন সেটা পুরোপুরি আপনার ব্যাপার। তবে আপনার উপরে পুরোটা ছেড়ে দিলেও, নিজের ইচ্ছায় আপনি কোনটা বেছে নিবেন সেটা তিনি আগেই জানেন।
সবকিছু জেনেও এই কাজ করার সুযোগ তিনি এজন্যই দিয়েছেন যেন শেষ বিচারের সময় আপনি "আমাকে তো সুযোগ দাওনি" এই কথাটা বলতে না পারেন।
ভাগ্য বা ভবিশ্যত নির্ধারিত থাকে। হাজার রকমের ভবিশ্যত ও তার ফলাফল নির্ধারিত থাকে। এর মধ্যে থেকে যে কোন একটা ইচ্ছামতন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। কোনটা বেছে নিবেন সেটা নির্ধারিত থাকে না। অর্থাৎ, কোনটা করবেন সেটা নির্ধারিত থাকে না। সেটা যদি নির্ধারিত থাকতো তাহলে পাপ ,পুন্য ব্যাপারটাই আসত না। যদিও আগেই আল্লাহ জানেন আপনি কোনটা করবেন। এত কিছু না বুঝে, যদি সহজ ইসলামিক বুঝ বুঝতে চান, তাহলে - ভাগ্যর উপর বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে। সেই সাথে চেস্টা ও দোয়া চালিয়ে যেতেও বলা হয়েছে। এখানেও কিন্তু দুই পক্ষই আছে।
---------- Find me on facebook
বিষয়: বিবিধ
৬৫২৯ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এ নিয়ে আমি যখন পড়েছিলাম ও বোঝার চেষ্টা করেছিলাম - তখন আমি এ ভাবে কনভিন্সড হয়েছিলাম যে - আমাদের ওলামায়ে কেরাম রা 'কদর' শব্দের যে বাংলা করেছেন 'ভাগ্য' - তা প্রাকটিক্যালী ভুল চয়েজ ছিল। অথচ আরবী ভাষায় কদরের অনুবাদ ভাগ্য ছাড়াও আরো অনেক গুলো শব্দ আছে, যেমন 'পরিচালন পদ্ধতি' ইন্টারনাল মেকানিজম, অদৃশ্য নিয়ন্ত্রনমূলক নিয়ামক ইত্যাদি। যদি আপনি ভাগ্যের পরিবর্তে অন্য যে শব্দ চ্যুজ করেন - তবে আপনার যুক্তির অসারতা প্রতিপন্ন হবে।
অর্থাৎ আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন - তিনি প্রতিটি সৃষ্টির জন্য 'কদর' সেট করে দিয়েছেন আর তার প্রতিটি সৃষ্টিই সেই কদর অনুযায়ী চলতে বাধ্য, এর কোন বত্যয় হবে না এবং আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতে হবে। উদাহরন স্বরূপ, ক্ষুধার্থ বাঘ হরিণ দেখলে খেতে চাইবে, মানুষের চোখ নারীর দিকে তাকাতে চাইবে, কোন কিছু হারালে মন খারাপ হবে, স্রষ্টার ব্যাপারে কৌতুহল থাকবে ইত্যাদি।
সো কদর - যার ভুল ট্রান্সলেশান হল ভাগ্য। বরং কদর বিহীন কোন সৃষ্টি নেই। এমন কি মানুষ যে সৃষ্টি কিংবা আবিষ্কার কিংবা উদ্ভাবন করে - তা সম্ভব হয় শুধু মাত্র আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুতে কদরের উপস্থিতি তথা ঐ সৃষ্টির ইন্টারন্যাল বৈশিষ্ট কিংবা গুনাগুন এর যথাযথ সংমিশ্রন, সংযোজন, বিয়োজন ইত্যাদি।
রাসূল (সা) বলেন-
আল্লাহর কসম-যিনি ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ্ নেই-তোমাদের মধ্যে একজন জান্নাতবাসীর মত কাজ করে- এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাত ব্যবধান থাকে, এ অবস্থায় তার ভাগ্য তার উপর প্রভাব বিস্তার করে বলে সে জাহান্নামবাসীর মত কাজ শুরু করে এবং তার ফলে তাতে প্রবেশ করে।
এবং তোমাদের মধ্যে অপর এক ব্যক্তি জাহান্নামীদের মত কাজ শুরু করে দেয়- এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে মাত্র এক হাত ব্যবধান থাকে, এ অবস্থায় তার ভাগ্য তার উপর প্রভাব বিস্তার করে বলে সে জান্নাতবাসীদের মত কাজ শুরু করে আর সে তাতে প্রবেশ করে।
(বুখারীঃ ৩২০৮, মুসলিমঃ ২৬৪৩)
বিতর্কটি হল - ভাগ্য (ভবিশ্যতে আমি কি করব) কি আল্লাহ নির্ধারন করে আমাদের উপরে চাপিয়ে দেন, নাকি আমিরা কি করব সেই সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নিতে পারি।
এই ব্যাপারটা আমার দুটি লেখাতে বিস্তারিত বলেছি। আপনি আমার কথা মানছেন না। আসলে আমি যাই বলি না কেন, আপনি সেটা মানবেন না। আপনার নিজস্ব একটি বুঝ আছে। সেই বুঝটি যুক্তিসহ পেশ করুন। আপনারটি সঠিক হলে সেটা অবশ্যই মেনে নিব।
তবে মনে রাখবেন - "ভাগ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমরা কাজ করি" এই কথাটা বলার আগে একটু চিন্তা করে দেখবেন - তাহলে আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত পাপের জন্য আমাদেরকে শাস্তি দেওয়াটা কি ন্যায় বিচার হয়? আল্লাহ নিশ্চয়ই অন্যায় বিচার করবেন না।
আমার বক্তব্য হলো- ঈমান বিলগাইব তথা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনা হলো ইসলামি আক্বীদার মূল স্পিরিট বা রূহ। গায়েবের ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে যা বলেছেন তা দ্বিধাহীনভাবে মেনে নেয়াই হল ঈমানের দাবী। তাকদিরের ব্যাপারে রাসূল যা বলেছেন তা পূর্বের মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে এবং হাদিসটাকে আপনি কিভাবে বুঝেন তা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হাদিসের ধারের কাছেও না গিয়ে উল্টো আমার নিজস্ব বুঝকে দোষারোপ করেছেন নিজের যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আবারও অনুরোধ রইল আপনার দেয়া যুক্তির আলোকে হাদিসটির একটা যুক্তিসংগত ব্যাখা দেয়ার জন্য। আশা করি আপনার যুক্তি মানতে তখন কোন আপত্তি থাকবে না। জাযাকাল্লাহু খাইরান।
আগে তো শুধু আপনার প্রশ্নই শুনেছি। কিন্তু আপনার বুঝটা স্পস্ট ছিল না। এবার স্পস্ট হল।
অদৃশ্যের প্রতি ঈমান , আল্লাহ ও তার রাসুলের কথা দ্বীধাহিনভাবে মেনে নেওয়া - এগুলো ইসলামের গোড়ার কথা। এসব বিষয়ে কোন মুসলমানের মতভেদ থাকে না। আমাদের মতভেদ অন্য জায়গায়। একই কথা, দুইজন দুই রকমের বুঝছি। যাই হোক, আপনার দেওয়া হাদিসটা দেখি।
... একজন জান্নাতবাসীর মত কাজ করে- এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাত ব্যবধান থাকে, এ অবস্থায় তার ভাগ্য তার উপর প্রভাব বিস্তার করে বলে সে জাহান্নামবাসীর মত কাজ শুরু করে এবং তার ফলে তাতে প্রবেশ করে।... (অংশবিশেষ)
হাদিসে যা লেখা আছে, হুবহু সেটাই বুঝছেন। তাহলে, "ওই ব্যাক্তি ও জান্নাতের মধ্যে এক হাত ব্যাবধান" কথাটির অর্থ আপনি কি বোঝেন? এর মানে কি লোকটি জান্নাত হতে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে? মোটেও তা নয়। এই কথাটির অর্থ হল - লোকটি জান্নাতে যাওয়ার জন্য (প্রায়) যোগ্য হয়ে গেছে। হাদিসে বলছে "এক হাত" কিন্তু আপনি বুঝছেন "যোগ্যতা"। এমন কেন বুঝলেন? কারন - জান্নাতের এক হাত দূরে কোন মানুষ দাড়াতে পারে না এটা আপনি জানেন। এটা আপনার ইসলামিক সাধারন জ্ঞান। "এক হাত ব্যাবধান" কথাটা ইসলামিক সাধারন জ্ঞানের বিরুদ্ধে যায়। অর্থাৎ - যা লেখা থাকে হুবহু সেটা না বুঝে, মাঝে মাঝে ইসলামের সাধারন জ্ঞান প্রয়োগ করে সঠিক অর্থটা বুঝতে হয়।
ঠিক তেমনি ইসলামের আরো দুটি সাধারন জ্ঞান হল "কোরআনে যা আছে তা সত্য" এবং "আল্লাহ সর্বোচ্চ ন্যায় বিচারক"। উল্লেখিত হাদিসে "ভাগ্য তার উপর প্রভাব বিস্তার করে" কথাটি এই দুই সাধারন জ্ঞানের বিপক্ষে যায়। কোন রকমের প্রভাবিত না হয়ে, মানুষ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এটা কোরআনে আছে। আবার ভাগ্য আমাদের কর্মকে প্রভাবিত করলে আখিরাতের বিচারটা ন্যায় বিচার হয় না। কাজেই "ভাগ্য তার উপর প্রভাব বিস্তার করে" কথাটির হুবহু অর্থ নয় - এর অন্য কোন অর্থ আছে।
ওই কথাটির অর্থ যাই থাকুক না কেন -ওই হাদিসে কিন্তু এটা বলেনি যে "লোকটি ভাগ্যদোষে জাহান্নামে চলে গেছে"। বলেছে লোকটি "জাহান্নামবাসীর মতন কাজ করে জাহান্নামে গেছে"। এই জাহান্নামী কাজ করার জন্য তার মাথায় কেউ বন্দুক ঠেকায় নি। সে নিজের ইচ্ছায় সেই কাজ করেছে। আমি আপনাকে এতক্ষন ধরে এই কথাটিই বলছি - মানুষ নিজের ইচ্ছায় কাজ করে। কি করবে সেটা আগে নির্ধারিত থাকে না। ওই লোকটি জান্নাতী কাজ করে জান্নাতে যাবে এটাও নির্ধারিত ছিল। লোকটি জাহান্নামী কাজ করে জাহান্নামে যাবে সেটাও নির্ধারিত ছিল। লোকটি নিজের ইচ্ছায় যেটা করবে, ফলাফলও তাই হবে।
সব শেষে - সুরা মায়িদা (আয়াত ২০-২৬) দেখুন। মুসা (আ) এর সাথীদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল যে আসন্ন যুদ্ধে তারা জয়লাভ করবে। যুদ্ধের আগে কয়েকজনের একটা দলকে পরিস্থিতি বুঝতে পাঠানো হল। তাদেরকে প্রতিপক্ষের লোকেরা এমন ভয় দেখালো যে, মুসা (আ) এর দল যুদ্ধ না করে পালিয়ে গেল। সেই দলটি আল্লাহর গজবে পতিত হয়ে ৪০ বছর ধরে পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে।
ভাগ্য যদি নির্ধারিত থাকে অর্থাৎ মানুষ কি করবে সেটা যদি (আল্লাহ কতৃক) নির্ধারিত থাকে তাহলে
প্রশ্নঃ এই দলটি কি করবে বলে আল্লাহ নির্ধারন করেছিলেন?
উত্তরঃ তারা যুদ্ধ করবে বলে নির্ধারন করেছিলেন (তারা তো যুদ্ধ করেনি, পালিয়াছে। আল্লাহর নির্ধারিত কাজের বাইরে কিভাবে গেল?)
উত্তরঃ তারা পালাবে বলে নির্ধারন করেছিলেন( ভাগ্যে যদি পালানো লেখা থাকে তাহলে যুদ্ধের জয় পরাজয় কিভাবে আসে? যুদ্ধই তো হবে না। তাহলে আল্লাহ কেন বললেন যে তারা যুদ্ধে জয়লাভ করবে। আল্লাহ তো ভুল বলেন না)
এখানেই আমার কথায় ফিরে যেতে হবে। তাদের ভাগ্যে যুদ্ধ ও পালানো দুটোই লেখা ছিল। এই দুটোরই ফলাফল যথাক্রমে জয়লাভ ও হারানো লেখা ছিল। তারা নিজেরা যেটা বেছে নিয়েছে, সেটাই পেয়েছে।
এভাবেই ভাগ্য নির্ধারিত থাকে। আমাদের হাজার রকমের কর্ম ও তার ফলাফল নির্ধারিত। এর থেকে আমরা নিজেরাই নিজের ইচ্ছায় বেছে নেই। কোনটা বেছে নিব সেটা নির্ধারিত নয়। তবে কোনটা বেছে নিব সেটা আল্লাহ আগে থেকেই জানেন। এই জ্ঞানটাই বিল গাইবি, অদৃশ্য বা অদেখার জ্ঞান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন