জনগনকে বোকা বানাও ; কিন্তু বোকা মনে করো না
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০২:২৫:৪০ রাত
এমনিতেই যুদ্ধাপরাধী (মানবতা বিরোধী অপরাধ ) এর বিচার বিষয়টি আলোচিত, সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলেন দেলোয়ার হোসেন সায়ীদি। আমরা জন্ম থেকেই বিভক্ত একটা জাতি। কোন বিষয়ে, বিশেষ করে রাজনীতিতে আমরা একমত হতে পারিনা। সব কিছুরই পক্ষে বিপক্ষে থাকবেই। যদি না থাকে তাহলে সেটা আমরা জোর করে বানিয়ে নিব। কিন্তু সবাই মিলে একমত হওয়া যাবে না। রাজনৈতিক হাই কমান্ডেরা এটাই চায় এবং এটাই হয়ে আসছে যুগে যুগ ধরে।
সায়ীদি সাহেব রাজনীতিতে আসার আগে এমনকি পরেও তিনি ছিলেন একবাক্যে সবার জন্য আদর্শ বক্তা। মুসলমানেরা তো বটেই। অন্য ধর্মের অনুসারীরাও মুগ্ধ হয়ে তার ওয়াজ শুনতো। সর্বোচ্চ সংখক ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রির রেকর্ডটি সম্ভবত এখনো তারই অধীনে। যুদ্ধাপরাধী তো অনেক পরের কথা। তিনি যে খারাপ লোক, এমন কথাও কখনো শোনা যায়নি। তবে মাঝে মাঝে তার একটি বদনাম শোনা যেত। তিনি নিজে এত লেকচার দেন অথচ তার মেয়েরা নাকি বেপর্দায় চলাফেরা করে। এই প্রশ্নের উত্তর সায়ীদি সাহেব নিজেই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, একসময় তার দুঃখ ছিল, কেন তার কোন কন্যা সন্তান নেই। পরে সেই দুঃখ তার ঘুচে গেছে। কন্যা সন্তান থাকলে নিন্দুকের মুখ বন্ধ করা যেতো না। সায়ীদি সাহেবের কোন মেয়ে নেই, এতেই দেশব্যাপী রটে গেছে, তার মেয়েরা নাকি বেপর্দায় চলাফেরা করে। আর তার মেয়ে থাকলে তারা কি বলত আল্লাহ জানেন।
এই লোকটির জনপ্রিয়তা এত বেশী ছিল যে তাকে যুদ্ধাপরাধী বলে গ্রফতার করা যেতো না। কাজ়েই এখানে ফন্দি করা হয়েছে। উনাকে প্রথমে গ্রেফতার করা হয়েছে জনৈক হুজুরের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দেবার অপরাধে। এর পরে একসময় তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে আটক দেখানো হয়েছে। এই যুদ্ধাপরাধী কথাটার মধ্যেও আছে আরেক চালাকী। বাংলায় সবাইকে যুদ্ধাপরাধী বললেও আসলে কাগজে কলমে এটা হচ্ছে – মানবতা বিরোধী অপরাধী। যুদ্ধাপরাধী নয়। এই বিচার হয়েছে বা হচ্ছে যে টাইবুনালে, সেটার নাম – আন্তঃজাতিক অপরাধ ট্রাইবিনাল। এখানেও যুদ্ধাপরাধী বলে কিছু নেই। আবার ট্রাইবুনালের নামের মধ্যেও আছে বিশেষ কায়দা। আন্তঃজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নাম দিলেও এতে কিন্তু আন্তঃজাতিক কিছুই নেই। সবই খাটি দেশী।
এক কথায় বলতে গেলে, দেশে যেটা হচ্ছে তা হল - আন্তঃজাতিক নামের দেশীয় মানের আদালতে, মানবতা বিরোধী নামে, বিরোধী দলের লোকদেরকে যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে বিচার হচ্ছে।
এই বিচার কার হচ্ছে সে কথা বলতে বলতে দেশের অর্ধেক জনগন ক্লান্ত। দেশে যে দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী রাজাকার আছে যেটা হল আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগই, নিজের দলের কাউকে চোখে না দেখে যত রাজাকার খুজে পায় সব বিরোধী দলে। তাও আবার সায়ীদি সাহেবের মতন লোকও নাকি রাজাকার। তিনি নাকি ধর্ষন ও খুনের সাথে জড়িত। আগেই বলেছি যে আমরা একমত হতে পারিনা। দেশের অর্ধেক লোক যেমন উপরের কথাগুলো বারবার বলে ক্লান্ত। বাকী অর্ধেক লোক সেখানে , ফাসি চাই, দিতে হবে বলে ক্লান্ত। রাজাকার এর ফাসি সবাই চায়। কিন্তু যার ফাসি চাচ্ছে সে কি আদৌ রাজাকার নাকি রাজনীতির শিকার সেটা বোঝার চেস্টা তারা করেন না। যখনই আওয়ামী লীগের সমর্থনের ব্যাপারটা আসে, তখনই তারা বোকা বনে যান। চিন্তা ভাবনা করার শক্তি লোপ পায়। এরই সুযোগ নিয়ে জনগনকে বোকা বানাচ্ছে রাজনীতিবিদেরা। বছরের পর বছর।
সবচেয়ে বড় বোকা বানানো হয়েছে যেটা দিয়ে তা হল - শাহবাগের গনজাগরন মঞ্চ। যাদের মাথা থেকে এই আইডিয়া এসেছে, তারা সত্যই প্রসংসার দাবিদার। গুটি কয়েক তরুন জড়ো হল, ফাসি চাই আওয়াজ দিল, এর সাথে যোগ দিলেন জাফর ইকবাল। ব্যাস আওয়ামী মিডিয়া একেবারে হুমড়ী খেয়ে পড়ল। সাথে পেল বিরিয়ানি আর পুলিশ প্রহরা। শাহবাগ আসলে দেশের আপামর জনতার আন্দোলন নয়। শাহবাগ হচ্ছে আওয়ামী লীগের বানানো একটা প্লাটফর্ম। শাহবাগ একটা নাটক। আমার মতন নিম্নবুদ্ধি সম্পন্ন অধম যদি দেশের বাইরে বসেই শাহবাগ আন্দোলনের জন্মের দু-এক দিনের মধ্যেই এই নাটকটা বুঝতে পারে , তাহলে দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবি জাফর ইকবাল স্যার সেটা বোঝেন না? যে সব বুদ্ধিজীবি, তারকা, রাজনীতিবিদ, বিশিস্ট নাগরিক শাহবাগে গিয়ে “ফাসি চাই” বলে চিতকার করে এসেছেন – তারা এই নাটক বোঝেন না? হ্যা, সবাই জানে, সবাই বোঝে। জেনে বুঝেই জনগনকে বোকা বানায়।
আন্তঃজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে কাদের মোল্লার জাবত জীবন কারাদন্ড হয়েছিল। এর পরে কাদের মোল্লার আইনজীবিরা উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরূদ্ধে (সাজা মওকুফের) আপিল করে। সেই সময় সরকার পক্ষও সাজা বাড়ানোর আপিল করতে যায়। তখনই আইনের একটি ফাকা ধরা পড়ে। সেটা হল, আইনে রাস্ট্র পক্ষের আপিল করার সুযোগই নেই। এই আইন পরিবর্তন করাটা আওয়ামী লীগের পক্ষে খুবই সম্ভব ছিল। কিন্তু স্কাইপী কেলেঙ্কারী প্রকাশ হবার পরে এই যুধাপরাধীর বিচার বিষয়টা বিতর্কিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ আইন পরিবর্তন করে কাদের মোল্লাকে ফাসী দিলে, তাদের বিচারে নামে রাজনীতি বিষয়টা স্পস্ট হয়ে যেত। এজন্য একটাই উপায় ছিল, তা হল জনগনের আন্দোলন। জনগন যদি “ফাসী চাই” আন্দোলন করে তাহলে আওয়ামী লীগ, আইন পরিবর্তন করে ফাসী দেওয়া একটা সুযোগ পায়। এর জন্য জন্ম হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলন। এর পরবর্তীতে কাদের মোল্লার ফাসীর রায় ও ফাসি কার্যকরের ঘটনাটা সবাই জানে।
এতদিন জনগনকে এই যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে বোকা বানিয়ে এখন জনগনকে বোকা ভাবা শুরু করেছে। এই বোকা ভাবার বিষয়টা স্পস্ট হল সায়ীদি সাহেবের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে। এই রায় নিয়ে বিভিন্ন বিশিস্টজনের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া আছে। সবার মুল কথা হল, সুপ্রিম কোর্টের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু রায় মেনে নিতে পারছেন না। হা, আমারও সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আমারও শ্রদ্ধা আছে। আমি যেটা মেনে নিতে পারিনা সেটা হল, আওয়ামী লীগ দ্বারা জনগনকে বোকা বানানো।
সায়ীদি সাহেবের এই রায়ের সম্ভাব্য তিনটি পরিনতি ছিল। তাকে মুক্তি দেওয়া, ফাসি দেওয়া ও জাবতজীবন কারাদন্ড দেওয়া। সায়ীদি সাহেবকে মুক্তি দিলে দুটো সমস্যা। এক, এই কথার জবাব দিতে হবে যে এতদিন তাকে আটকে রেখে সারা দেশে এত হরতাল, অবরোধ ও খুনের কারন কেন তৈরি করলে? দুই, সায়ীদি সাহেব মুক্তি পেলেই, তার বক্তব্যের যে নতুন অডিও/ভিডিও প্রকাশ করবেন এবং তাতে আওয়ামী লীগের নামে যা বদনাম থাকবে তাতে গদি সামলানো দুস্কর হয়ে যাবে। অতএব, মুক্তি কখনোই নয়। ফাসি দিলে একটাই সমস্যা, আন্দোলোন শুরু হবে, সেই আন্দোলোনটা সরকার পতন আন্দোলনে রুপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই সবচেয়ে সুন্দর সমাধান হচ্ছে , সায়ীদি সাহেবকে জাবত জীবন কারাদন্ড দেওয়া। এর কিছু উপকারীতাও আছে
- আন্দোলোন হওয়াটা আপাতত বন্ধ করা গেছে।
- সায়ীদী সাহেবের মুখ (অডিও বক্তব্য) বন্ধ করা গেছে
- সবাইকে ফাসি দিচ্ছে না – অর্থাৎ তারা আইন মেনে চলছে, এটা বোঝানো গেছে
- বিএনপি কে বোঝানো গেছে জামায়াতের সাথে তাদের আতাত হয়েছে, (যাতে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবে)
এটা হল জনগনকে বোকা বানানো। এই বোকা বানিয়েই তারা ক্ষান্ত দেননি। তারা সেই ঘুমন্ত শাহবাগকে ঠেলে ঠুলে আবার জাগিয়েছে। যদিও জনগন আর ওদিকে ফিরেও দেখে না। কিন্তু শাবাগের নিয়মিত খাদেমেরা ওখানে বসে রাস্তা বন্ধ করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন। সেই শাহবাগের এক অংশের face-pot (মুখপাত্র) বলেছেন যে এই রায়ে তারা সন্তস্ট নন। আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে আতাত করে এই রায় দিয়েছে। ওদিকে একই কারনে শাহবাগের বিশিস্ট খাদেম আসিফ মহিউদ্দিন আওয়ামী লীগকে বেঈমানের দল বলছেন। সব কিছু দেখলে যেটা বোঝা যায় , তা হল – এবার শাহবাগের উদ্দেশ্য হল “আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের গোপন আতাত” এই কথাটি প্রতিস্টা করা। আগের বার শাহবাগের মিশন ছিল “ফাসী চাই” বলে আইন পরিবর্তনের দাবী জানানো। আগের বার তো শাহবাগ দেখিয়ে জনগনকে বোকা বানিয়েছিল। এবার ২০-৩০ জনকে শাহবাগে বসিয়ে রেখে জনগনকে বোকা মনে করছে।
“আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের গোপন আতাত” কথাটি প্রতিস্টা করে আওয়ামী লীগের কি লাভ? - একবার বিএনপি কে এই কথাটা বিশ্বাস করাতে পারলেই হয়েছে। তারা জামায়তের সঙ্গে ত্যাগ করবে। এতে করে জানায়াত ও বিএনপি এর মিলিত আন্দোলনের ঝুকি এড়ানো যাবে। আলাদাভাবে জামায়াত ও বিএনপি উভয়কে ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু একসাথে হলে একটু সমস্যা বটে।
কোন দলের অন্ধ সমর্থন বাদ দিয়ে প্রতিটি দলেরই দোষ-গুন বোঝার ও স্বীকার করে নেওয়ার মানষীকতা আমাদের মধ্য তৈরি না হলে – আমাদের সারা জীবন এমন বোকা বনেই যেতে হবে।
পাদটীকাঃ আপনারা যারা মনে করছেন যে এইসব বিচার ও রায় ইত্যাদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়, তাদের ধারনা সম্পুর্ন ভুল প্রমান করলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি বলেছেন, রায় দেবার আগে উনারা নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করেন। আমার লেখায় এতক্ষন যা লিখেছি এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে উনাদের বিবেক কি উত্তর দেয় সেটা বড্ড জানতে ইচ্ছা করে। উনার বক্তব্য (সুত্র সহ) নীচে দেওয়া হল -
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘আমরা রায় দেয়ার আগে আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করি। সেশনের পর সেশন আমরা এক সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।’ আপনারা কোনো অভিযোগের বিষয়ে প্রমাণ করতে না পারলেও যে আমরা রায় বিপক্ষে দিব, বিষয়টি তা নয়। রায় দেওয়ার আগে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে দেয়া হয়।
http://www.bdmonitor.net/newsdetail/detail/200/91219
বিষয়: বিবিধ
১৪৫৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রায়-য়ের নামে সাজানো বিষয় টা সবাই বুঝে,নিজেদের বিবেকের সাফাই যতই প্রকাশ করুক বিচারক সহ সংশ্লিষ্ট সবাই যে ননির পুতুল তা আর অজানা নয় কারো।
জন গনের সম্মিলিত প্রতিরোধ ছাড়া এ থেকে মুক্তির য়পায় নেই।
আল্লামা সাঈদী সহ সকল মজলুমদের নাজাত কামনার সাথে আপনাকেও সুন্দর পোস্টের জন্যে অনেক ধন্যবাদ ......।
মন্তব্য করতে লগইন করুন