একজনের ঝুটা, আরেক জনের শেফা

লিখেছেন লিখেছেন এলিট ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৩:২২:২৩ রাত



তাবলিগী জামায়াতের একটি অলিখিত নিয়ম আছে। সেটা হল তাদের সদস্যদের এক প্লেটে খেতে হবে। তাদের ভাষায় এমন খাওয়টা সুন্নত। অনেকের হয়ত বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। আমি নিজেও এমনভাবে তাবলীগ পন্থী মসজিদে দু-একবার ইফতার খেয়েছি। একটা বড় প্লেটে খাবার নিয়ে, একাধিক ব্যাক্তি ওই একই প্লেট থেকে খাওয়া হয়। শুখনো খাবার হলে তেমন সমস্যা না। কিন্তু তরকারী বা ঝোল ইত্যাদি এমনভাবে খাওয়াটা একটু অস্বভাবিক লাগে। এটা আরো বেশী অস্বভাবিক লাগে যখন সম্পুর্ন অচেনা লোকের সাথে এমন একই প্লেটে খেতে হয়। “এমনভাবে খাওয়া সুন্নত” এই কথা বলে অলিখিত নিয়মটিকে গ্রহনযোগ্য করা হয়। এর পরে মাঝে মাঝে এর সঙ্গে যোগ হয় বিশেষ উক্তি “একজনের ঝুটা , আরেকজনের শেফা” । এই কথাটা নিয়মিত তাবলীগি ভাইদের মুখস্ত থাকার কথা। কথাটির অর্থ হচ্ছে – আরেকজনের ঝুটা (এটো) এর মধ্যে রয়েছে অন্য জনের জন্য রোগমুক্তি । সহজ বাংলায় বললে, ঝুটা খেয়ে রোগমুক্ত হওয়া যায়।

তাবলিগী ভাইয়েরা আমার উপরে রাগ হওয়ার আগে একটা বিষয় স্পস্ট করতে চাই। এমন খাওয়াটা ভালো না খারাপ সেটা আমার আলোচনা নয়।, ঝুটা খেয়ে রোগমুক্তি হয় নাকি রোগ ছড়ায় সেটাও আমার আলোচনা নয়। এটা তাবলীগের নিয়ম, আপনারা অবশ্যই পালন করবেন। আমার সমস্যা হল মাত্র একটি যায়গায়

- এমন একসাথে বা এক থালায় খাওয়াকে সুন্নত বলা হচ্ছে কেন?

হাদিস ও সুন্নত কি? রাসুল (সা) এর কথা, কাজ ও সম্মতিকে হাদিস বলে। আর এই হাদিস অনুযায়ী আমরা যখন কোন কাজ করি সেট হল সুন্নত। রাসুল (সাঃ) পাপমুক্ত হলেও আমাদের মতন মানুষ ছিলেন। তার সব কথা ও কাজ লিপিবদ্ধ করা যায়নি। তিনি ঘুমাতেন, হাটতেন, দৌড়াতেন। এগুলো কি সুন্নত? না, উনার সব কাজ ও কথা সুন্নত নয়। সুন্নত হল সেগুলো, সেগুলোকে তিনি নিয়ম বানিয়েছেন।

বরাবরের মতন ছোট একটি গল্প বলছি। শুধুমাত্র ধনী শিশুরা পড়তে পারে এমন এক বিলাশ বহুল কিন্ডার গার্টেন স্কুলের শিশুদেরকে রচনা লিখতে দেওয়া হল – “একটি গরীব পরিবার”

একটা ছেলে এভাবে রচনা লিখল

- এক পরিবার ছিল খুব গরীব। বাবা গরীব মা গরীব, ভাই বোন সবাই গরীব। তাদের কাজের বুয়া গরীব, ড্রাইভার গরীব। বাগানের মালী গরীব। এমনকি দারোয়ানও গরীব। সবাই গরীব।

গরীব যে কি জিনিস সেই ধারনাটা এই ছেলেটির নেই। গরীবের যে বুয়া, ড্রাইভার ইত্যাদি থাকে না , সেটা যে জানে না। আমাদের অবস্থাটাও কিছুটা ওই ছেলেটির মতন। আমরা প্রযুক্তির স্বর্নযুগে বাস করছি। আমাদের ধারনাই নেই যে, দেড় হাজার বছর আগে রাসুল (সাঃ) এর আমলের মানুষ কত অনুন্নত জীবন জাপন করত। এজন্য আমরা মাঝে মাঝে ভুল ধারনা করি।

সেই যুগের মানুষের জীবন ব্যাবস্থা সম্পর্কে ধারনা করাটা আমাদের জন্য কঠিন। অত দূরে যেতে হবে না। এখনকার যুগের সাথে, মাত্র ৫০ বছর আগের যুগটাই তুলনা করে দেখুন। আপনার নিজের কমপক্ষে ২০-৩০ টি জামা আছে। জুতা আছে কমপক্ষে ৩-৫ জোড়া। ওদিকে ৫০ বছর আগে, আপনার মতন একই আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন একজনের কাছে ২-৩ টা জামা থাকত। জুতা হয়ত একটা থাকত, তাও আবার কোন বিশেষ দিনে পায়ে দিতো। ৫০ বছর আগে, সারা মহল্লাতে একটি টেলিফোন ছিল। এখন আপনার পকেটেই ২-৩ টা আছে। এভাবে ৫০ বছর আগের মানুষের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করলে বুঝতে পারবেন, আপনার মতন একই পরিমান টাকা পয়সার মালিক, আপনার চেয়ে অনেক নীম্নমানের জীবন জাপন করত। কারন তখন এমনভাবে এত কিছু সহজলভ্য ছিল না। তখন পরিবেশও ছিল ভিন্ন। এত কিছু তাদের লাগতই না। ২০ বছর আগেই তো ঢাকা শহরে, মোবাইল ফোনের মালিক নিজেকে গর্বিত মনে করত। বিভিন্ন ছুতোয় মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে উচু করে করে দেখাতো। আর এখন, রিকশা চালক লুঙ্গীর গিট থেকে মোবাইল বের করে কথা বলে।

এখন তো বিভিন্ন পার্টিতে প্লাস্টিকের প্লেট ও কাপ ব্যাবহার করা হয় যা একবার ব্যাবহার করে, ফেলে দিতে হয়। ৩০ বছর আগেও এটা ছিল ধারনার অতীত। আজকে ৪ সদস্যের এক পরিবারের বাসায় খুজলে অন্তত ৫০ টি থালা বাটি পাওয়া যাবে। কিন্তু দেড় হাজার বছর আগে তো মানুষের বাড়ীতে এত থালা বাটিও থাকতো না। হয়ত ৫ সদস্যের একটি পরিবারে ২ টি থালা আর একটি মাত্র পানির পাত্র থাকতো। তখনকার দিনের পরিবেশটাই এমন ছিল যে - সবার জন্য আলাদা করে একটি প্লেট, এটা কেউ চিন্তাই করতো না। এক প্লেটে একাধিক লোক খাবার খাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এক পানির পাত্রে মুখ লাগিয়ে একে একে সবাই পান করতো। চেনা অচেনা সবাই। সেই যুগে জন্মেছিলেন রাসুল (সা)। তিনি সবার জন্য আলাদা আলাদা প্লেটের ব্যাবস্থা করবেন কিভাবে।? সেই যুগে আমাদের মতন আধুনিক টয়লেট ছিল না। সবাই কিন্তু আড়ালে গিয়ে খোলা আকাশের নীচেই বাথরুম করতো। এটাও সেই যুগের পদ্ধতি। রাসুল (সা) তো আধুনিক টয়লেট ব্যাবহার করার সুযোগ পান নি।

এখন কথা হচ্ছে, অনুন্নত জীবনযাত্রার কারনে রাসুল (সা) ও তার আশে পাশের সবাই একই থালাতে খাবার খেয়েছেন। এটা যদি সুন্নত হয় তাহলে একই পানির বোতলে মুখ লাগিয়ে সবাই পানি পান করাটা সুন্নত হবে না কেন? খোলা আকাশের নীচে বাথরূম করাটা সুন্নত হবে না কেন? এগুলোর কোনটাই সুন্নত নয়। কারন, সেই যুগে, মানুষ এভাবেই জীবন জাপন করত। এই নিয়ম রাসুল (সা) বানান নি।

এবার দেখি কোরআন ও হাদিসে কি বলে –

সুরা নুর, আয়াত ৬১

---- তোমরা একত্রে আহার কর অথবা আলাদাভাবে আহার কর তাহাতে তোমাদের জন্য কোন অপরাধ নেই ---- (অংশবিশেষ)


এখানে কিন্তু দুটি বিষয় স্পস্ট হয়।

- “একত্রে আহার কর” কথাটার অর্থ “এক প্লেটে আহার করা” নাও হতে পারে। সবাই একসাথে বসে আলাদা প্লেটে খাওয়াটাও কিন্তু “একত্রে আহার”

- যদি এটা এক প্লেটে খাবারে কথা বলাও হয় তবুও এটা নিয়ম হয় না – কারন এখানে বলা আছে একত্রে বা আলাদাভাবে, কোনটাতেই অপরাধ নেই। যেটা ইচ্ছা কর। অর্থাৎ, একত্রে খাওয়াটা নিয়ম নয়।

তিরমিজি – ৪২৩৩ , ইকরাস ইবনে ধু’আব দ্বারা বর্নীত

একবার আমাদের সামনে এক বড় থালাতে অনেক পরিমানে “থারিদ” (কোন এক খাদ্য) ও মাংশর টুকরো আনা হল। আমি আমার হাতকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে থালের বিভিন্ন অংশ থেকে খাবার হাতে নিতে লাগলাম। কিন্তু আল্লাহর রাসুল (সা) কেবল উনার সামনে থেকেই খাবার নিতে লাগলেন। তিনি (রাসুল) বাম হাত দিয়ে আমার হাত ধরলেন থামিয়ে দিয়ে বললেন “ইকরাস, এক যায়গা থেকে খাও, কারন সব একই ধরনের খাবার” । এর পরে আমাদের সামনে আরো এক থালাতে বিভিন্ন ধরনের খেজুর আনা হল। এবং আমি আমার সামনে থেকে খেতে লাগলাম। যদিও রাসুল (সা) এর হাত থালার এদিক সেদিক ঘুরতে লাগল। তিনি (রাসুল) বললেন “ইকরাস, সেখান থেকে ইচ্ছা খাও, কারন এখানে সব একই ধরনের খাবার নয়”।


বড় এই হাদিসটি বুঝতে একটু কস্ট হতে পারে। ঘটনাটা সহজ ভাষায় বললে হয়ত একটু সুবিধা হবে। সাহাবী ইকরাস, রাসুল(সা) এর সাথে থাকা অবস্থায় উনাদের সামনে বড় থালাতে করে কিছু খাবার (মুলত মাংশ) আনা হল। পুরো থালায় একই খাবার। সেই থালাটি ঘিরে উনারা বসে ছিলেন। থালার যে অংশটা রাসুল(সা) এর হাতের কাছে ছিল, সেখান থেকেই তিনি (রাসুল) খাবার খাচ্ছিলেন। ওদিকে ইকরাস একবার প্লেটের এখান থেকে, একবার ওখান থেকে এভাবে খাচ্ছিলেন। রাসুল(সা) তার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলেলেন “পুরো থালাতে তো একই খাবার – একবার এখান থেকে, একবার ওখান থেকে না খেয়ে, এক যায়গা থেকে খাও”। এর পরে বিভিন্ন খেজুর এর একটি থালা আনা হলে, সতর্ক হয়ে ইকরাস এক যায়গা থেকে খেতে লাগলেন। কিন্তু রাসুল (স) এবার থালার বিভিন্ন যায়গা থেকে খেতে লাগলেন। রাসুল (সা) ইকরাসকে বললেন, এবার থালার বিভিন্ন যায়গা থেকে খাও কারন এবার তো থালায় বিভিন্ন ধরনের খেজুর। কাজেই থালার সব প্রান্ত থেকে আলাদা আলাদা ধরনের খেজুর নিয়ে খাও।

এই হাদিসে কিন্তু বলা নেই যে, সবাই এক থালায় খেতে হবে। বরং এক থালায় খেলেও খাওয়ার সময় ভদ্রতা শেখানো হয়েছে। সারা প্লেটে যখন একই খাবার তখন এক প্রান্ত থেকে খেলেই তো হয়। যখন বিভিন্ন খাবার থাকবে, তখন প্লেটের বিভিন্ন অংশ থেকে খাওয়া যেতে পারে।

একই থালায় খাবার খাওয়াটা ছিল তখনকার যুগের মানুষের জীবনযাত্রার অংশ। সেই যূগের মানুষ হয়ে রাসুল(সা) নিজেও এমন করতেন। এছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। রাসুল (সা) এর কাজ ছিল ইসলাম প্রতিস্টা করা। ম্যানামাইল এর ফ্যাক্টারী বানিয়ে সবার হাতে একটি করে প্লেট ধরিয়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দৈনন্দিন জীবন যাত্রার অন্যান্য কাজের মতন এক প্লেটে খাওয়াটাও ছিল রাসুলের (সা) জীবনযাত্রার অংশ। এটা তার বানানো কোন নিয়ম নয়। তাই এটা কোন সুন্নত নয়। তাছাড়া কোরআনে বলা আছে “এক সাথে বা আলাদাভাবে আহার কর”। অর্থাৎ যেটা ইচ্ছা। এক প্লেট খাওয়াটা তাবলীগ জামায়াতের নিয়ম। এটা রাসুলের নিয়ম (সুন্নত) নয়।

এর পরেও অতিভক্ত কেউ, এক প্লেটে খাবার খাওয়াটাকে সুন্নত বানাতে চাইলে তাকে ঠেকানোর সাধ্য আমার নেই। তবে তাকে অনুরোধ করব, তিনি যেন আরো দুটি সুন্নত (!) এক বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খাওয়া ও খোলা আকাশের নীচে বাথরুম করাটা শুরু করেন।

বিষয়: বিবিধ

১৪৮৭ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

263490
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৪:৩৮
কাহাফ লিখেছেন : "অন্যের ঝুটা খাওয়া রোগ মুক্তির উপায়," বহুল প্রচলিত একটা জাল হাদিস।তাবলীগ জামাতের এক সাথে খাওয়া নিয়ে দলিলভিত্তিক সুন্দর আলোচনা হয়েছে,তবে ভালবাসার চুড়ান্ত প্রকাশ হিসেবে মানুষ প্রিয় জনের অনেক অগ্রহনীয় অনুসরণ করে-একে ভালবাসার দিক দিয়েই দেখতে হবে শুধু।
263509
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:০৩
আরাফাত হোসাইন লিখেছেন : অতি চমৎকার
263562
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:১৮
আবু আশফাক লিখেছেন : যু্ক্তিপূর্ণ পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
263577
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২:৩৫
ইয়াফি লিখেছেন : সুন্দর যুক্তিপূর্ণ আলোচনা! ধন্যবাদ
264077
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:০০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
আরবি রান্নায় ঝোল ব্যাবহৃত হয়না বললেই চলে তাই সেই ধরনের খাওয়ার এক থালা থেকে খাওয়া যায়। আমাদের রান্নায় ভিন্নভিন্ন থালায় খাওয়া ভাল। অবশ্য আমরাও মুরি মাখা বা চানাবুট ্র মত খাবার এক গামলা থেকেই খেয়ে থাকি।
264213
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:০৬
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File