দাম বেশী - কিনে খুশি

লিখেছেন লিখেছেন এলিট ০২ জুলাই, ২০১৪, ০৮:৩০:৩৪ সকাল



ক্রেতা ও বিক্রেতা সম্পর্কটি হাজার বছর ধরে বিভিন্ন মোড়কে চলে আসছে। এখনকার যুগে নিত্য নতুন পন্যের উদ্ভাবনের ফলে এই সম্পর্কেরও নতুন মাত্রা আসছে। এভাবেই চলছে সারা বিশ্বে। ক্রেতা ও বিক্রেতা আসলে দুই মেরুর মানুষ। বিক্রেতার একটি প্রবনতা থাকে বেশী লাভ করার আর ক্রেতার একটা প্রবনতা থাকে কম দামে পন্য কেনা।এই প্রবনতা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সব সমাজেই অল্প কিছু লোক থাকে বিক্রেতার কাতারে। বেশীর ভাগ লোকই ক্রেতা হয়। এজন্য ক্রেতাদের দল ভারী হয়। তাছাড়া বিক্রেতার ব্যাবসা, পুজি ইত্যাদি সবই নির্ভর করছে ক্রেতার উপরে। ক্রেতা না কিনলে বিক্রেতাকে তো সমস্যায় পড়তে হবে। এ কারনে - সারা বিশ্বে বিক্রেতারা সব সময় ক্রেতার কাছে এক প্রকারের সমর্পিত হয়ে থাকে। ব্যাবসা প্রতিস্টানে বলা হয় - কাস্টমার লক্ষী।

এতক্ষন বললাম স্বাভাবিক পদ্ধতির কথা। কিন্তু আমাদের মতন এই উলটো রাজার দেশের পদ্ধতি একেবারেই আলাদা। আমাদের বিক্রেতাদের অসততা, দুর্নীতি ইত্যাদি তো আছেই। এর সঙ্গে আরো আছে আমাদের ক্রেতাদের অদ্ভুত মানষিকতা। এসব উদ্ভুত কায়দা নিয়েই আজকের এই লেখাটা।

অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্নভাবে উচ্চমুল্যের ব্যাখ্য দিতে পারেন। পুথিগত কারন যতই থাকুক না কেন। আসলে উচ্চমুল্যের সবচেয়ে বড় কারন হল - ওই মুল্যে জিনিসটি কেনার মতন লোক রয়েছে। কেনার মতন লোক না থাকলে পন্যটির মুল্য অবশ্যই কমবে। যদি ওই পন্যটির মুল্য কমানো না যায় তাহলে এমনিতেই পন্যটি বাজার থেকে হারিয়ে যাবে। পত্র পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে - রমজানে, বাজারে নাকি আগুন দাম। আপনি নিজে বাজারের সামনে পাচ মিনিট দাড়িয়ে তামাশা দেখুন। বাজারে এত ভীড় যে দেখে মনে হচ্ছে বেশী দামে নয় বরং সব কিছু বিনা মুল্যে পাওয়া যাচ্ছে। এত লোক যখন ভীড় করে কিনতে পারছে তখন মুল্য বেশী হল কিভাবে? মুল্য তো ঠিকই আছে। মুল্য বেশী হলে তো ওখানে মাছিও পড়ত না।

হ্যা, মুল্য বেশী করার জন্য দায়ী হল মজুতকারীরা। তারা বিভিন্ন পন্য আটকে রেখে দাম বাড়ায়। এর পরে বিভিন্ন মওকা দেখে বাজারে ছেড়ে উচ্চমুল্যে বিক্রি করে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে - ওদের এই বেশী মুল্যে তো মানুষ কিনছে। ভীড় করে , মজা করে কিনছে। আমরা (জনগন) যেটা করি সেটা হল উচ্চমুল্যে বিক্রি হওয়া জিনিস কিনে নিয়ে আসি আর উচ্চমুল্যের জন্য মজুতদার, রাজনীতিবিদ এদের দোষ দিতে থাকি। আসল দোষী আমরা।

বিশ্বের অল্প যে কয়টা দেশ আমি দেখেছি, যে কয়টা জাতি দেখেছি তাদের সবারই একটা প্রবনতা আছে - সেটা হল সস্তায় ভালো জিনিস কেনা। বাজারে বড় করে বোর্ড টানানো থাকে - আজকে এই জিনিস সস্তায় দেওয়া হচ্ছে। তাদের কেনাকাটার পদ্ধতি আলাদা। তারা প্রথমে বাজারে যায়। দেখে কোনটার কেমন দাম। এর পরে দাম বুঝে বাজার করে। আমাদের পদ্ধতি সম্পুর্ন উলটো। আমবা বাসায় বসে সিদ্ধান্ত নেই , আজকে কি বাজার করব। একটা লিস্ট নিয়ে বাজারে যাই। আজকে কৈ মাছ আনতে হবে এটা বাসায় বসেই সিদ্ধান্ত নেই। বাজারে গিয়ে, দাম কম হলে খুশি হই। দাম বেশী হলে বাধ্য হয়ে কিনি। কিন্তু কৈ মাছ আমাকে নিতেই হবে।

বিশ্বে সবচেয়ে বড় খাদক জাতি আমেরিকা। মনে করি, গরুর মাংশের কেজি আমেরিকাতে ৭ ডলার। কোন একটি বিশেষ কারনে যদি এই মুল্য হটাত করে ১১ ডলার হয়ে যায়। সারা দেশের লোক একসাথে গরুর মাংশ কেনা বন্ধ করে দিবে। লক্ষ্য করুন, যে লোকটি ৭ ডলার দিতে পারে সে কিন্ত ১১ ডলারও দিতে পারে। কিন্তু তার পরেও সে গরুর মাংশ কিনবে না। কারন, পকেটে টাকা থাকলেই বেশী দামে জিনিস কেনাটা একটা বোকামী। ওদের কাছে অবৈধ টাকা নেই। তাছাড়া গরুর মাংশ না কিনে ক্রেতারা একটা নীরব প্রতিবাদ করে। আমি অনেকবার দেখেছি যে - এমন পরিস্থিতিতে, বিক্রেতা বাধ্য হয়ে দাম কমিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে খাদক জাতিরই এই অবস্থা। ভারতের মতন না খাওয়া জাতি হলে তো কথাই নেই। কেনা তো দুরের কথা, তাকিয়েও দেখবে না।

আমরা খাদক জাতি নই। আমরা হলাম রসনা বিলাসী। অর্থাৎ আমার খাবারটা পছন্দের আইটেম হতে হবে। রমজানের সময় আমাদের ছোলা, পেয়াজী, বেগুনী ইত্যাদি লাগবেই। এসব ছাড়া নাকি ইফতারী হয় না। নবর্ষের সময় ইলিশ মাছ লাগবেই। ৫০০ টাকার মাছের দাম ৫০০০ টাকা হয়েছে কিন্তু ইলিশ কেনা বন্ধ হয়নি। অন্য কোন দেশে হলে পান্তা-ইলিশের বদলে পান্তা-বোয়াল বা পান্তা-রুই খাওয়ার পদ্ধতি চালু হয়ে যেত। ইলিশ মাছের ধারে কাছেও কেউ যেত না। ইলিশ মাছের ব্যাবসায়ীদের মাথায় হাত পড়ত। তারা এমনিতেই দাম কমিয়ে দিত। এর পরের বছর ভুলেও ইলিশের মজুত করত না। মুল্য এমনিতেই কম থাকত।

মোট কথা - আমাদের পছন্দের জিনিস কেনা থেকে আমরা বিরত থাকতে পারি না। বেশী দাম দিয়ে হলেও কিনি। খাবারের বেলায় তো কথাই নেই। অথচ আমরা যদি একটিবার কেনা বন্ধ করে ঐ মজুত সম্প্রপদায়কে আমাদের ক্ষমতা দেখাতে পারি তাহলে ওরা এমনিতেই সোজা হয়ে যাবে। আমরা এই একটিবার কেনা বন্ধ করব না। আপনি কেনা বন্ধ করবেন - দেখবেন আপনার চোখের সামনে দিয়ে অন্যজনে চড়া দামি সেই জিনিসটি কিনে নিয়া যাচ্ছে। অবৈধ পয়সা - কিনতে অসুবিধা হয়না।

আরেকটি জনিস আমাদের মধ্যে আছে। সেটা হল আমরা বেশী দামে কিনতে পেরে গর্ববোধ করি। আমেরিকাতে যেতে হবে না ভারতেই দেখুন। বিভিন্ন পুজা-পার্বনে জামা কাপড়, গয়না ইত্যাদি মুল্যহ্রাস হয়। পুজা যত কাছে আসে, দাম তত কমে। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে এসব কিনতে। কোম্পানীও ভালো ব্যাবসা করে। ক্রেতারা ১০০০ টাকার জামা ৫০০ টাকায় কিনে বন্ধুদের গর্বভরে দেখায়। বলে - দেখেছিস কেমন জিতেছি? ওদিকে আমাদের দেশের পদ্ধতি একেবারে উলটো। ঈদের সময় জামা কাপড়ের দাম বাড়ে। ঈদ যত কাছে আসে, দাম তত বাড়ে। ৫০০ টাকার জামা ইদের আগের রাতে ১৫০০ টাকায় কিনে আমারা বেশ গর্ব বোধ করি। এই জিনিসটা অন্য দেশে করলে তাকে বোকামী বলে গন্য করা হয়।

আমাদের ক্রয় করার পদ্ধতি সম্পুর্ন আলাদা। আমরা দাম দেখে পন্য ক্রয় করি না। আমরা যেটি চাই সেটি ক্রয় করি, দাম যাই হোক না কেন। হটাত দাম বেড়ে গেলে আমরা কেনা বন্ধ করে প্রতিবাদ করতে পারি না। কারন আমরা কোন বিষয়ে একমত হতে পারিনা। তাই জনগন নিজের ক্ষমতা রাজনীতিবিদকে দেখাতে পারে না, মজুতকারীকেও দেখাতে পারে না। তাছাড়া আমাদের কাছে কেনার মতন টাকাও আছে। অমুক কিনতে পারে না, তমুক কিনতে পারে না সেটা তাদের সমস্যা। আমি তো কিনতে পারি - তাই বেশী দামে কিনি। এটাই হল আমাদের আদর্শ। বেশী দামে কিনে আমরা খুশি। আমরা গর্বিত।

বিষয়: বিবিধ

১৩৩৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

240855
০২ জুলাই ২০১৪ সকাল ১১:৫৬
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : আমরা খুশি। আমরা গর্বিত।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File