বেঁধে রাখা শয়তান ও আমাদের গদবাঁধা বয়ান
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ০১ জুলাই, ২০১৪, ০৬:২১:৪৫ সন্ধ্যা
রমজান শুরু হবার আগে থেকেই এই ব্লগে, এই একটি বিষয়ে বেশ কয়েকটি লেখা পড়েছি। সবার মনে একটাই প্রশ্ন - রমজানে শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়, এর পরেও মানুষ পাপ কেন করে। অনেক ভাই এ বিষয়ে অনেক সুন্দর লেখা লিখেছিন। কিন্তু এখনো তেমনভাবে জোরালো কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। কোন কোন লেখাতে এমন কিছু হাস্যকর ব্যাখ্যা রয়েছে যে সেগুলো উত্তর দেবার বদলে আসলে বিষয়টি আরো জটিল করে তুলছে।
যেমন, কেউ লিখেছেন “শয়তান বেধে রাখা হলে কি হবে, সে তো কাজ করে আমাদের মনের উপর। অর্থাৎ রমজান মাসে বিনা বাধায় আমাদেরকে কুমন্ত্রনা দিতে পারে” । এটা যদি সত্য হয় তবে শয়তানকে অমন ফালতু বেধে রাখার (বন্দী করার) কি দরকার আর এটা প্রচার করারও বা কি দরকার?
কেউ লিখেছেন “জিন শয়তান আর মানুষ শয়তান আলাদা। রমজানে জিন শয়তান বেধে রাখা হয়”। এখানেও রয়েছে সমস্যা। আলাদা দুটি শয়তান কোথা থেকে এল। আর জিনদের শয়তান আটকে রেখে, শয়তান বন্দী রাখার কাহিনী মানুষকে কেন শোনানো হল?
এমন অনেক রকমের আলোচনায় ভরপুর লেখাগুলি। কিন্তু বিষয়টির পরিপুর্ন সমাধান আসলে পাওয়া যায়নি। আমরা কোন কিছু কোথাও পড়লে বা কারো মুখে শুনলে সেটা যাচাই করে দেখি না। এর ফলেই এমন হাস্যকর ব্যাখ্যা পড়ে/শুনে আমরা “সুবহানআল্লাহ” বলে মাথা নাড়াই।
রমজান মাসে শয়তান বেধে রাখা হয় এই কথা কে বলেছে?
আবু হুরায়রা কতৃক বর্নীত, আল্লাহর রাসুল বলেছেন “ যখন রমজান মাস শুরু হয় তখন জান্নাতের দরজাসমুহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমুহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানকে (শেকল দ্বারা) বেধে রাখা হয়। (বুখারী ৩১;১২৩)
এটা রাসুল (সাঃ) এর কথা, হাদিস। এই হাদিসের ভেতরে ঢুকে দেখার আগে একটি বিষয় ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে, মানুষ কেন পাপ করে।
মানুষ কেন পাপ করে?
অনেক ইসলাম পন্থী বন্ধুদের ধারনা - আমাদের সকল পাপের জন্য শয়তান দায়ী। আরো সহজ করে বলতে গেলে , “শয়তান না থাকলে আমরা কোন পাপ কাজ করতাম না”। এটি একটি ভুল ধারনা। আসলে পাপ করার ক্ষমতা দিয়েই মানুষকে তৈরি করা হয়েছে। ফেরেশতাদের পাপ করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু, মানুষ নিজে বুঝে, নিজের দোষেই পাপ করে। মানুষের সব পাপের জন্য শয়তান দায়ী নয়। শয়তান না থাকলে মানুষ পাপ করত না - এটা একটা ভুল ধারনা
তাহলে শয়তানের কাজ কি?
শয়তান মানুষকে যেটা দিতে পারে সেটা হল চিন্তা, পরামর্শ। মানুষ নিজেরই পাপ করার কথা চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে। শয়তান বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়ে ওই পাপ করতে মানুষকে উতসাহিত করে।
উদাহরনঃ রাস্তায় একটি মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেলেন। এতে বেশ পরিমানে টাকা রয়েছে আর রয়েছে এর মালিকের ঠিকানা, ফোন নম্বর। এই মানিব্যাগটি মালিককে ফিরিয়ে দেওয়াটা ভালো কাজ। আর ওটা রেখে দেওয়াটা পাপ। আপনি এটা মালিককে না দিয়ে নিজে রেখে দিতে পারেন, এই বুদ্ধি আপনার নিজের মাথাতেই আছে। কিন্তু আপনি এই পাপ করতে চান না। আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন মানিব্যাগটা আপনি এর মালিককে ফিরিয়ে দিবেন। এখানেই শুরু হল শয়তানের কাজ। সে আপনাকে অনেক বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে বোঝাতে চাইছে যে ওটা রেখে দেওয়াতাই আপনার জন্য ভালো। এমন অনেক লোক আছে যাদেরকে শয়তান পরামর্শ দিতে হবে না। এর আগেই তারা মানিব্যাগটি নিজের কাছে রেখে দিবে। আসলে শয়তান এমন লোককে পরামর্শ দেয় যে পাপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অর্থাৎ, পাপ মানুষ নিজের ইচ্ছেতেই করে। যে মানুষ পাপ না করার সিদ্ধান্ত নেয় - শয়তান তাকে পরামর্শ দিয়ে পাপ করতে উতসাহিত করে। কাজেই শয়তান না থাকলে পাপ কিছুটা কমত বটে কিন্তু পাপ করাটা বন্ধ হয়ে যেত না।
এবার ওই হাদিসটি দেখি
এই হাদিসে তিনটি তথ্য রয়েছে
- জান্নাতের দরজাসমুহ খোলা হয়
- জাহান্নামের দরজাসমুহ বন্ধ করা হয়
- শয়তান বেধে রাখা হয়
জান্নাত ও জাহান্নাম না জানি কত দূরে আছে। সেখানে দরজা খোলা থাকলে কি আর বন্ধ থাকলে কি? আমরা সেটা দেখতে পাই না, খোলা দরজা দিয়ে জান্নাতের সুবাসও আমাদের কাছে আসে না। আল্লাহর তৈরি জান্নাত ও জাহান্নাম এত অরক্ষিত নয় যে দরজা খোলা পেলেই, যে কেউ জান্নাতে ঢুকে যেতে পারবে। তাহলে এই দরজা খোলা/ বন্ধের দরকার কি?
এই দরজা খোলা অর্থ হল স্বাগত জানানো। আমরা যেমন কোন বন্ধুকে বলি - যখন কোন দরকার পড়বে আমাকে স্মরন করবে, তোমার জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা। এই কথার মানে কি? আমরা কি বন্ধুর জন্য ২৪ ঘন্টা ঘরের সদর দরজা খুলে রাখি? না, আমরা তা করি না। “দরজা খোলা” কথার অর্থ হল স্বাগত জানানো। অন্যদিকে দরজা বন্ধ কথাটির অর্থ নিরুতসাহিত করা বা বাধা দেওয়া।
শয়তান (শেকল দিয়ে) বেধে রাখা হয়। এই কথাটা শুনে হয়ত আপনার চোখের সামনে একটি দৃশ্য ভেসে উঠে। বড় বড় অনেকগুলি শেকল দিয়ে শয়তানের হাত, পা গলা ইত্যাদি বেধে রাখা হয়েছে। আর শয়তান অসহায় মুখ করে বসে আছে। মুলত এমন ভাবনার জন্যই আমরা ওই হাদিসটির অর্থ বুঝতে ভুল করি। আচ্ছা, আপনাকে যদি বলি “এই কম্পিউটারে ভাইরাস আছে” তখন কি আপনি মনে করেন যে এই ভাইরাস হচ্ছে ছোট ছোট কিলবিল করা প্রানী? মানুষের শরীরের ভাইরাস আর কম্পিউটার এর ভাইরাস এক জিনিস নয়। মানুষের শরীরের ভাইরাস হল ছোট প্রানী। আর কম্পিউটারে ভাইরাস হল (ক্ষতিকারক) ছোট প্রেগ্রাম বা সফটওয়ার। এমনিভাবেই শয়তান এর শেকল আমাদের চেনা জানা শেকলের মতন নয়। শয়তানকে বেধে রাখাটাও আমাদের চেনা জানা বেধে রাখার মতন নয়। এখানে “শয়তানকে বেধে রাখা হয়” কথাটির অর্থ হল - শয়তানের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়। বা স্থগিত করা হয়।
হাদিসটির অর্থ তাহলে এই দাড়ালো - যে রমজান মাসে মানুষকে জান্নাতে যাবার জন্য স্বাগত জানানো হয়। জাহান্নামে নিরুতসাহিত (বাধা) করা হয়। এছাড়া এই মাসে শয়তানের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়, অথবা স্থগিত করা হয়।
উপসংহারঃ মানুষ নিজে এমনিতেই পাপ করতে পারে। এর জন্য শয়তান লাগে না। তবে যে মানুষ পাপ না করার সিহান্ত নিয়েছে তাকে শয়তান পাপ করার জন্য পরামর্শ দেয়। শয়তান না থাকলে মানুষ পরামর্শ কম পেত, পাপ কম হোত। তার মানে এই নয় যে, শয়তান না থাকলে দুনিয়াতে পাপ বন্ধ হয়ে যেত। মানুষ নিজেই পাপ কাজ করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মে। এ কারনেই, রমজান মাসে শয়তানের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার ফলে বা স্থগিত করার ফলে পাপ কিছুটা কম হয়, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয় না।
বিষয়: বিবিধ
১৭৫৭ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই সুযোগ নেবার তওফিক দান করুন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
জাযাকাল্লাহ।
হুম, শয়তান মানুষকে চিন্তা-পরামর্শ দেয় এ বিষয়ে একমত।
মন্তব্য করতে লগইন করুন