নকল ও প্রশ্নপত্র ফাস - জাতির মেরুদন্ড শিক্ষা এখন হয়ে গেছে বাঁশ

লিখেছেন লিখেছেন এলিট ১৫ জুন, ২০১৪, ০৩:০৪:৪৬ রাত



দেশে নকল প্রতিরোধে কড়া আইন প্রচলিত রয়েছে। বিশ্বের একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে পরীক্ষায় নকল করার অপরাধে ১৬ বছরের কিশোরের জেল পর্যন্ত হতে পারে। এর পরেও নকলের কোন কমতি নেই। নিত্য নতুন কৌশলে ছাত্ররা নকল করেই যাচ্ছে। যে মেধা খরচ করে তারা নকল করে, তার অর্ধেক মেধা যদি লেখাপড়ার কাজে লাগাত তাহলে নকল ছাড়াই পরীক্ষায় পাশ করতে পারত। নকল বন্ধের এত ততপরতা থাকতেও নকল কেন বন্ধ হচ্ছে না?

এর সাথে আছে প্রশ্নপত্র ফাস হওয়া। এমন প্রশ্ন আগেও ফাস হোত। কিন্তু ইদানিং এটি মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। এটি প্রতিরোধে নেই তেমন কোন ব্যাবস্থা। আসলে প্রশ্নপত্র ফাস হওয়া বন্ধ করার ইচ্ছা কারো নেই। শিক্ষা বিষয়ক কর্তাব্যাক্তিরা তো দায়িত্ব অবেহেলা করছেনই, সেই সাথে জনগনও কেমন যেন খুশি। ফেসবুকে খোলামেলা ভাবে এই প্রশ্ন বিতরন হয়েছে। প্রশ্ন সরবরহকারী অনেকে যোগাযোগ করার জন্য তাদের মোবাইল নম্বরও দিয়েছে। বেআইনী কোন বস্ত যেমন মাদক দ্রব্য, অস্ত্র ইত্যাদি কিন্তু এত খোলামেলা ভাবে আদান প্রদান হয় না। ওদিকে প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রে খোলামেলা ভাবে আদান প্রদান কিভাবে সম্ভব হচ্ছে?

এসব কিছুর জন্য প্রথমে দায়ী আমাদের মানষিকতা, এরপরে আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা এবং সবশেষে কর্তাব্যাক্তিদের দায়িত্বের অবহেলা অথবা তাদের দুর্নীতি।

আমাদের মানষিকতাঃ আমাদের দেশের লোক সংখা অনেক বেশী। এই বেশী জনসংখা নিয়েও উন্নতির রাস্তায় চলা যায় এমনটা প্রমান করতে অনেকে চীনের উদাহরন দিয়ে থাকেন। কিন্তু উনারা জানেন না যে চীনর আয়তনে আমাদের চেয়ে প্রায় ৭০ গুন বড়। সারা দুনিয়ার লোকও যদি চীনে গিয়ে বসবাস করে তবে তাদের জনসংখার ঘনত্ব আমাদের সমান হবে না। অন্যদিকে, আমাদের জনসংখার ঘনত্ব চীনের সমান বানাতে হলে বাংলাদেশের লোকসংখা হতে হবে মাত্র ৩ কোটি। এগুলো আমার বানানো কোন কথা নয়। সরল অংকের হিসাব করলে আপনি নিজেই এটা বের করতে পারবেন।

আজীবন আমরা জনসংখার এই ঠেলাঠেলি দেখে অভ্যাস্থ। যাত্রী কয়েক লক্ষ, ট্রেনে সিট মাত্র কয়েক শত। বাসে সিট ৫০টি, ওদিকে যাত্রী কয়েক হাজার। একটি স্কুলে বা কলেজে ছাত্র ধারন ক্ষমতা এক হাজার, ওদিকে আগ্রহী ত্রিশ হাজার। চাকুরী আছে ১০টি , আবেদনকারী হাজারের উপরে। এভাবেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই যে অপরকে ধাক্কা মেরে ফেলে না দিলে সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না। এটাই আমরা শিখি, এটাই আমাদের মানুষিকতা।

শিক্ষা এর সাথে ভালো চাকুরী বা উজ্জ্বল ভবিশ্যতের ব্যাপারটা সরাসরি জড়িত। তাই শিক্ষার ব্যাপারে এই ঠেলাঠেলি সবচেয়ে বেশী। এটা শুরু হয় শিশুকাল ত্থেকেই। ছোট শিশুকে কোন স্কুলে চান্স পাইয়ে দিতে হবে, কোন নামকরা শিক্ষকের কাছে পড়াতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে সারাদিন দৌড়ঝাপ করতে ও লাখটাকা খরচ করতে বাবা মায়ের কোন ক্লান্তি নেই। জ়ীবন মানে যে কেমন যন্ত্রনা সেটা একজন শিক্ষাত্রী ওই শিশু বয়সেই বুঝতে পারে। পরীক্ষায় ভালো করতেই হবে। যেভাইবেই হোক। পদ্ধতি সৎ বা অসত, সেটা পরের কথা। আগে চাই সফলতা। যে মেধা দিয়ে পাশ করতে পারে না , সে নকল করে। প্রশ্নপত্র ফাস হলে গোপনে তা সংরহ করে। পাশ তাকে করতেই হবে। যেভাবেই হোক।

প্রশ্নপত্র ফাস হওয়াটা ভালো কোন বিষয় নয়, এটা সবাই জানে। কিন্তু এর পরেও অনেকেই মনে মনে খুশি। তারা পেয়েছেন পরীক্ষায় পাশ করার পরশ পাথর। এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করে নিজের কপাল নস্ট করতে কে চায়? এর চেয়ে গোপনে প্রশ্নপত্র পেয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করি। আর চুপ থাকি। বেশী কথা বললে হয়ত পরীক্ষা বাতিল হয়ে যেতে পারে। তখন তো আমরই ক্ষতি।

এ কারনেই, প্রশ্নপত্র ফাস হওয়াতে জনগনের মাঝে তেমন কোন আওয়াজ হয়নি। হ্যা, চেতনাধারী স্যার গুটি কয়েক অনুসারী নিয়ে আন্দোলনে বসে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এই আন্দোলন করেছেন যখন সব কিছু শেষ। প্রশ্ন ফাস হয়েছে, সবাই পরীক্ষা দিয়েছে, পরীক্ষা বাতিল হয়নি, সবাই ভালো ফলাফল করেছে। এর পরে স্যার আন্দোলনে নেমেছিলেন।

আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থাঃ শিক্ষা ব্যাবস্থার ত্রুটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে আমার অপর একটি লেখাতে (স্যার, প্রশ্ন কমন পড়ে নাই) । এখানে নতুন কিছু যোগ করছি। লেখা পড়ার উদ্দেশ্য হল, একজনকে শিক্ষিত করে তৈরি করা। এরপরে সেই লোকটি যে শিক্ষিত, সেটার একটা প্রমানপত্র দেওয়া হয় যাকে আমরা সার্টিফিকেট বলে জানি। যেমন গাড়ী চালানো শেখার পরে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয়। শুনতে অনেক খারাপ শোনাবে, হয়ত অনেকে কটু কথাও বলবেন । আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা আসলে “শিক্ষিত লোক” তৈরি করার জন্য নয়। আমাদের ব্যাবস্থাটা হল “ডিগ্রীধারী লোক” তৈরি করার। আমাদের লেখাপড়ার উদেশ্য হল ওই ডিগ্রী (সার্টিফিকেট) হাসিল করা, কোন কিছু শেখা নয়। বিষয়টা এমন - সবাই ওই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবার জন্য ছুটছে। গাড়ী চালানোটা কেউ শিখতে চাচ্ছে না, বা শিখতে পারছে না।

প্রতিটি ছাত্র ও শিক্ষকের মাথায় চিন্তা হল, কিভাবে ওই প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া যায় যেটা বছর শেষে প্রশ্নপত্রে থাকবে। ছাত্রদের সুবিধার জন্য শিক্ষকেরা বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন দাগিয়ে দেয়। অনেক শিক্ষক বিভিন্ন নোট লিখে দেয়। অমুক স্যারের নোট বা অমুক গাইড বই পড়ে মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসতে পারলেই ভালো নম্বর নিশ্চিত। বোর্ডের পরীক্ষায় এই বছর কোন প্রশ্ন আসবে সেটা মাঝারী অভিজ্ঞ শিক্ষকই নির্ভুল বলতে পারেন। আপনি যে কোন অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে ২০-২৫ টি প্রশ্ন দাগিয়ে নিয়ে আসুন। দেখবেন বোর্ড পরীক্ষায় সেগুলো থেকে অধিকাংশই পাবেন। কারন প্রশ্ন করার একটি ধরন রয়েছে যেটা শিক্ষকেরা অভিজ্ঞতার কারনে বুঝতে পারেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে ছাত্ররাও জেনে যায় কোন প্রশ্ন এবার পরীক্ষায় আসবে। সবাই যখন যানে যে কোন প্রশ্ন আসবে, তখন পরীক্ষার হলে ছাত্ররা নকল নিয়েই তো যাবে। তাছাড়া পরীক্ষার কয়েক দিন আগে হুবহু প্রশ্নটাই (ফাস হয়ে) পাওয়া গেলে তো কথাই নেই। নকলও নিতে হবে না। ওই কয়টা প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করলেই হল।

মোট কথা, সার্টিফিকেট পাওয়াটাই মুল কথা হওয়াতে সম্পুর্ন লেখাপড়াটা হয়ে গেছে পরীক্ষার উত্তর কেন্দ্রিক। কিছু শিখতে হবে না। পরীক্ষার প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়াটাই আসল। আনেকে হয়ত বলবেন, সারা বছর মানুষ লেখাপড়া অরে তো পরীক্ষায় পাশ করার জন্য। লেখা পড়া পরীক্ষা কেন্দ্রিক হবে, এটাই স্বাভাবিক। না, এটা আপনার ভুল ধারনা। সারা বছর লেখাপড়া করতে হয় শেখার জন্য। বছর শেষে কি শিখেছে সেটা যাচাই করার পদ্ধতিই হল পরীক্ষা। লেখা পড়ার উদ্দেশ্য পরীক্ষা নয়, উদ্দেশ্য হল শেখা। আমরা সম্পুর্ন ভুল পদ্ধতিতে চলছি।

কর্তা ব্যাক্তিদের দুর্নীতি ও অবহেলাঃ যেমন আমরা তেমনই আমাদের নেতারা। প্রশ্নপত্র ফাস হবার পরে কর্তাব্যাক্তিরা সেটাকে গুজব বলে উড়িয়ে দেন। এর পরে একদিন বলেন ওটা প্রশ্ন নয়, সাজেশন। এর পরে আরেকদিন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে তখন নিশ্চুপ থাকেন। কর্তা ব্যাক্তির এমন রহস্যময় আচরন দেখে প্রশ্ন ফাস কারী চক্র সাহস পেয়ে যায়। ও আচ্ছা, কর্তা তো আমাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নিবেন না। আমরা আমাদের কাজ করতে থাকি। জনগনও প্রশ্নপত্র পেয়ে গোপনে সংরহ করে চুপ করে বসে আছে। দু একটা সাংবাদ মাধ্যম একটু কাই কুই করেছে। এতে আর তেমন কি?

মোট কথা আমাদের সমাজে শিক্ষার সাথে জড়িত সর্ব স্তরের লোক, ছাত্র, অভিভাবক,শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, কর্তাব্যাক্তি - সবাই কোন না কোনভাবে এই নকল ও প্রশ্নপত্র ফাসের সাথে জড়িত। কেউ অন্যায় করছেন, কেউ অন্যায় সহ্য করছেন। আমাদের পায়ে আমরা নিজেরাই কুড়াল মাড়লে আমাদেরকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

বিষয়: বিবিধ

১৩৬০ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

234931
১৫ জুন ২০১৪ রাত ০৩:১৬
লাঠীপেটা লিখেছেন : যে ভাবে প্রশ্নপত্র ফাস এবং অবাধে পাশ করানু হয়েছে তাতে জাতী এই ধারনায় এক মন হয়েছে মেডাম জিয়া পরীক্ষা দিলে ও পাশ করতেন,
অবৈধ সরকার এবং অবৈধ ব্যর্থ শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবী করছি
234940
১৫ জুন ২০১৪ রাত ০৩:৩৭
সন্ধাতারা লিখেছেন : The education of Bangladesh is being destroyed intentionally for breaking the backbone.
234944
১৫ জুন ২০১৪ রাত ০৩:৫১
নোমান২৯ লিখেছেন : সুন্দর পোস্ট ।সহমত।ধন্যবাদ ।
রিকু-
বাঁশের জায়গায় পাটিপাতা(
) দিলে বেশ মানাত মনে হয় ???
235006
১৫ জুন ২০১৪ সকাল ১১:৩৩
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : অনেক দারুন এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। এগুলো ইস্টিকি করা দরকার কিন্তু....
235019
১৫ জুন ২০১৪ সকাল ১১:৫৯
হতভাগা লিখেছেন : এইসব ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা কর্মজীবনে কি রকম করে তা দেখার জন্য আমাদের আরও ৬-৭ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File