স্বাধীনতা বিরোধীর স্বরূপ
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ১২ জুন, ২০১৪, ১২:৩৮:০২ রাত
অনেক আগে টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবলের উপরে নির্মীত এক রম্য নাটক (ফাউল) দেখেছিলাম। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের যুবকটি হল আর্জেন্টিনার একনিস্ট ভক্ত। সহজ বাংলায়, আর্জেন্টিনা বলতে পাগল। বাড়ির ছাদে আর্জেন্টিনার পতাকার টানানো। পতাকার রঙ এর সাথে রঙ মিলিয়ে জামা কাপড় পড়া, ব্রাজিলের পতাকার রঙ হলুদকে অপছন্দ করা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের আচরন ছিল তার। এছাড়া বাকপটু হওয়াতে, ফুটবল বিষয়ক বন্ধুদের তর্কতেও সে থাকত অপরাজিত। একদিন তাকে একজন জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা এত যে আর্জেন্টিনা বলে মুখে ফেনা তোল, বল তো আর্জেন্টিনা কোন গ্রুপে খেলছে?”। একটু ভেবে সে উত্তর দিল “দূর মিয়া। আর্জেন্টিনা গ্রুপে খেলবে কেন? আর্জেন্টিনা কি গ্রুপিং করে নাকি?”বিশ্বকাপ ফুটবল খেলাতে যে দলগুলিকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা হয় এই বিষয়টিই সে জানে না। তার মানে সে বিশকাপ খেলাটাই ভালোভাবে বোঝে না। কিন্তু ওদিকে সারাদিন আর্জেন্টিনা বলে লাফাচ্ছে আর ব্রাজিলের বদনাম করছে।
এবার মুল প্রসঙ্গে আসি। আমরা এমন একটি ব্যাতিক্রম জাতি যারা স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম এই দুটি শব্দের অর্থ জানিনা। না জেনেই, না বুঝেই ওই আর্জেন্টিনার সমর্থকের মতন লাফাই। বিষয়টার ভয়বাহতা আন্দাজ করতে পারছেনে কিনা জানিনা। আমাদের মধ্যে সততার অভাব রয়েছে, কিন্তু আমরা সবাই জানি যে সততা কি জিনিস। ওদিকে আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব তো রয়েছেই, সেই সাথে দেশপ্রেম কি জিনিস সেটাও আমরা জানিনা।
দেশপ্রেমঃ দেশটিকে ও দেশের প্রত্যাকটি মানুষকে নিজের মনে করা।
উদাহরনঃ আপনি যখন কোন আত্বীয় বা বন্ধুর দোকানে কোন পন্য কিনতে যান তখন এমন হয় যে আপনি একটি পন্য পছন্দ করেছেন কিন্তু বিক্রেতা বলছে যে এটা ভালো নয়, অন্য একটি নিন। এমনও হয় যে, আপনি যা ধারনা করেছেন তার চেয়ে কম দামে পন্যটি আপনি কিনতে পেরেছেন। কোন পরিচিত দোকানের নিয়মিত ক্রেতা হলেও আপনি এমন সুবিধা পেতে পারেন। এর একটাই কারন - আপনি ওই বিক্রেতার আপন জন। সে আপনাকে ঠকাবে না। এই আপনিই হয়ত অপরিচিত কোন দোকানে ঠকে যেতে পারেন। কারন সেই বিক্রেতা আপনার কেউ নয়। দেশপ্রেম হল দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে আপন মনে করা। দেশপ্রেম রয়েছে এমন জাতি, দেশের সবাইকে আপন মনে করে। পুরো দেশটিই তার পরিবার। কাউকে ঠকায় না।
আমাদের দেশে বন্যার সময় মজুত করে বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে পাশের দেশ ভারতেই বন্যার সময় ব্যাবসায়ীরা মানুষের সুবিধার জন্য জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেয়। পুরো দেশই তাদের পরিবার। সবাই আপন। একবার চিন্তা করে দেখুন আমাদের মাঝে যদি দেশপ্রেমের সামান্য বোধ থাকত তবে আমরা ঘুষ, জালিয়াতি, দুর্নীতি এসব এভাবে করতে পারতাম না। কারন কার সঙ্গে করব, সবাই তো আমার আপন।
স্বাধীনতাঃ অন্যের স্বাধীনতার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে (বা অন্যের ক্ষতি না করে) নিজের যা ইচ্ছা সেটা করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে।
উদাহরনঃ এক ব্যাক্তি তার নিজের কেনা যায়গায় বাড়ি করতে গেল। এলাকার মস্তান চাদাবাজ এসে হাজির। তাদেরকে লক্ষ টাকা চাদা না দিলে বাড়ি তো দুরের কথা জান রক্ষা করাই কঠিন। একজন আপন মনে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে রাতে অন্ধকার গলি দিয়ে শর্ট কাট হেটে বাসায় ফিরছে। পথে ছিনতাইকারী ধরতে পারে, সব কিছু কেড়ে নিতে পারে। এমনকি রাস্তায় পুলিশ দেখলে জিজ্ঞেস করতে পারে যে এত রাতে বাইরে কেন। সন্তোসজনক জবাব না দিতে পারলে ধরে নিয়ে যেতে পারে। বিনা দোষে বন্দী করলেও, ছাড়িয়ে আনতে টাকা লাগতে পারে। কাউকে এ ব্যাপারে নালিশ করলে সে বলবে “এত রাতে অন্ধকার গলিতে কেন গিয়েছিলে?” নিজের পেনশনের টাকা শেষ বয়েসে কয়েকটা জুতা ক্ষয় করে , ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে পারলে অনেকে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। কোন অফিসের ফাইল ছাড়িয়ে আনতে গেলে কত টাকা ঘুষ দিতে হবে সেটার একটা বাজেটা করেই একজন সেই অফিসে ধর্না দেয়। দেশে এমন অনেক মেয়ে আছে যে বখাটে ছেলেদের অত্যাচারা স্কুলে যাওয়া, লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে।
উপরের উদাহরনের মতন এমন হাজারো কাজ আছে যা আমরা বাধ্য হয়ে করছি। আমরা ইচ্ছে হলেই এসব থেকে মুক্ত হতে পারি না। আমাদের স্বাধীনতা নেই। অন্ধকার গলিতে হেটে আপনি বাসায় ফিরবেন, এটা আপনার অধিকার, আপনার স্বাধীনতা। পরাধীনতার শেকলে আমরা এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে এখন ওই অন্ধকারে হেটে যাওয়াটাই দোষের। উন্নত বিশ্বের পুলিশ এই কথা জিজ্ঞেস করতেই পারবে না “এত রাতে এখানে কি?” কারন এটা জ়িজ্ঞেস করলে আপনার স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। পুলিশ যদি আপনাকে সন্দেহ করে তবে এসে কুশলাদি জিজ্ঞেস করবে, কোন অসুবিধা আছে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করবে, আপনার পরিচয়পত্র দেখতে চাইবে। এরপরে কথায় কথায় জ়েনে নিবে আপনি কোথায় যাচ্ছেন ।
উন্নত বিশ্বে, আপনার কপাল মন্দ হলে “এই ব্যাটা, এত রাতে এখানে কি?” এমন ব্যাবহার হয়ত কোন সাধারন অভদ্র মানুষের কাছ থেকে পেতে পারেন। কিন্তু এমন অভদ্র পুলিশ বাহিনীতে থাকে না।
এতক্ষন বললাম দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আসল রূপ। এবার দেখুন আমাদের দেশে এর অবস্থা।
সারারাত বাংলা বা হিন্দি গান বাজিয়ে ২১ এ ফেব্রুয়ারীতে সকালে গিয়ে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে আসাটা হল দেশপ্রেম। সারা বছর জিন্সের প্যান্ট পড়ে বার্গার ও পিজা খেয়ে , পহেলা বৈশাখে রমনার বটমুলে পান্তা ইলিশ খাওয়াটা দেশপ্রেম। স্বাধীনতা দিবসে বা বিজয় দিবসে সবাই মিলে দাঁড়িয়ে জাতিয় সঙ্গিত গেয়ে বা পতাকা বানিয়ে বিশ্বরেকর্ড করাটা দেশপ্রেম। এছাড়া কিছু ডায়লগ কেন্দ্রিক দেশপ্রেম রয়েছে যেমন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, শহিদের রক্ত, রাজাকার নির্মুল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইত্যাদি। গত বছর আবার আরো কিছু দেশপ্রেম যোগ হয়েছে যেমন শাহবাগ এর মোড়ে “ফাসী চাই” আন্দোলনে যোগ দেওয়া। নব্য এই দেশপ্রেমে মোমবাতিও বেশ বড় ভুমিকা রেখেছে।
আমাদের দেশপ্রেম এর তো তাও রকমফের রয়েছে। স্বাধীনতার একটাই বিষয়, তা হল যুদ্ধ করে পাকিস্থান থেকে আলাদা হয়ে গেছি। আগে ছিলাম পাকিস্থানের অধীনে, এখন আমরা স্বাধীন। ব্যাস এর বেশী আর স্বাধীনতার বোধ আমাদের নেই। বাড়তি একটু বোধ আবশ্য আমাদের আছে, যেটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে। সেটা হল - ওই যুদ্ধে আমাদের ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। অনেক কুলাঙ্গার আবার এই যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। তারা রাজাকার। ওরা পাকিস্তানীদের সাথে মিলে আমাদের দেশের লোক হত্যা করেছে, আমাদের দেশের নারী ধর্ষন করেছে। ওরা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। ওরা এখনো ঘাপটি মেরে আমাদের আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ওরা স্বাধীনতা বিরোধী।
আমরা দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা কথা দুটির আসল অর্থ বুঝিনা। কাজেই এই ভুল দেশপ্রেম ও ভুল স্বাধীনতার বুঝ আমাদেরকে প্রায় অর্ধশত বছর আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
হ্যা, স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল এমন অনেক লোক ছিল। তাদের সবাই রাজাকার নয়। অনেকে ছিল যে নিতান্ত নিরীহ লোক, কিন্তু দেশ বিভক্ত হোক এটা সে চায়নি। এমন একজন লোক নীতিগত ভাবে পাকিস্থানের সমর্থক হলেও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না পাকিস্তানীদের বর্বরতায় সামিল হওয়া বা সাহায্য করা। পাকিস্তানীদের বর্বরতায় সামিল হয়েছিল তারা, যারা খারাপ লোক। যারা এসব করে অভ্যস্ত অথবা এতকাল সুযোগের অভাবে করতে পারেনি। এই সব খারাপ লোকেরা পাকিস্তান আমলে মানুষেকে হত্যা, ধর্ষন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুযোগ পেয়ে আরো বেশী করেছে। এরাই বা এদের মতন লোকেরাই এই বাংলাদেশ হত্যা, ধর্ষন ইত্যাদি করেছে।
স্বাধীনতা বিরোধী হল ছিনতাইকারী, যে আপনাকে স্বাধীনভাবে রাস্তায় চলতে দিচ্ছে না। সেই পুলিশ আফিসার যে অকারনে কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সেই ঘুষখোর কর্মকর্তা যে আপনার ফাইল আটকে রেখেছে। স্বাধীনতা বিরোধী হল সেই চাদাবাজ যে আপনাকে বাড়ি বানাতে দিচ্ছে না। সেই বখাটে যুবক যে কোন মেয়েকে স্বাধীনভাবে স্কুলে যেতে দিচ্ছে না। স্বাধীনতা বিরোধী হল, যারা খুন ধর্ষন ইত্যাদি করে যাচ্ছে। যারা এসব খারাপ লোককে দমন করতে পারলেও, দমন না করে প্রশ্রয় দিচ্ছে। যারা অপরাধীকে ইচ্ছে করে শাস্তি দিচ্ছে না। স্বাধীনতা বিরোধী হল, যারা সংবাদ মাধ্যমকে স্বাধীনভাবে সত্য প্রকাশ করতে দিচ্ছে না।
স্বাধীনতা বিরোধী হল ওই সব খারাপ লোক যারা পদে পদে বিভিন্ন ভাবে আপনার স্বাধীনতায় ব্যাঘাত ঘটায়। ওরা আপনাকে স্বাধীনভাবে বাচতে দেয় না। ওদিকে, একজন ব্যাক্তি কোন রাজনোতিক দল এর কর্মী বা সমর্থক সেটা দেখে আমরা বিচার করি কে স্বাধীনতা বিরোধী আর কে স্বাধীনতার চেতনাধারী। এমন অদ্ভুত বিচার করার মতন একমাত্র দেশ বাংলাদেশ। কবি যথার্তই বলেছেন - এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবে নাকো তুমি।
বিষয়: বিবিধ
১২৮৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন