কাবা ঘর ও সাফা-মারওয়া পাহাড়কে ঘিরে আধা শিক্ষিত মানুষের অশ্লীল গল্পের রহস্য উন্মোচন

লিখেছেন লিখেছেন এলিট ১৯ মার্চ, ২০১৪, ১২:১৩:১৫ রাত



আগেও অনেক লেখাতে অনেকবার বলেছি যে আমরা আসলে নামে মুসলমান কাজে নই। ইসলামের মুল বিষয়গুলি পালন করা ও মেনে চলা বাদ দিয়ে আমরা পড়ে আছি কোথায় কোন ঘুটিনাটি অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে। সেদিন একজনের কাছে শুনলাম যে কাবা ঘর নাকি মা হাজেরা (রাঃ) অর্থাৎ ইব্রাহীব (আঃ) এর স্ত্রীর কবরের উপরে নির্মিত। পীরের কবর পুজা জায়াজ বানানোর স্বপক্ষে এটা ছিল তার যুক্তি। আবার সহ ব্লগার “আধা শিক্ষিত মানুষ” এর একটি লেখা ( লেখাটি দেখুন ) থেকে আরো নতুন একটি জনিস জানলাম। কাবা ঘরের কাছে জেনা করেতে যাচ্ছিল এমন দুজন নারী পুরুষকে নাকি সাফা ও মারওয়া নামক দুটি পাহাড়ে রুপান্তরিত করেছেন সয়ং আল্লাহ। কালে কালে এমন আরো কত কি শুনব। আমরা কাজের মুসলমান হলে এসব ঘটনা প্রথমেই তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিতাম। আমরা তো নামের মুসলমান তাই এটা নিয়ে গবেষনা করছি।

ইসলামের অনুসারীর প্রথম বিষয় হল আকিদা (বিশ্বাস) । এই বিশ্বাসটি ইসলাম বিরোধী হলে, ফলশ্রুতিতে সবকিছুই ইসলাম বিরোধী হয়ে যায়। এই বিশ্বাস হতে হবে অনড়।

- কেউ এসে যদি আপনাকে বলে যে অমুক পাড়ার এক অভিজাত চেহারা খালাম্মা আসলে পতিতার ব্যাবসা করে। তার বাসায় ১০ জন পতিতা আছে।

আপনি হয়ত বলবেন, “করলে করুক। আমার এতে কি? এসব দেখার কাজ প্রশাশনের, আমার না”

- কেউ এসে যদি বলে, আপনাদের পাড়ার এক খালাম্মা এই ব্যাবসা করে।

আপনি বলবেন, “বলেন কি? দাড়ান, খোজ খবর নিয়ে দেখি। এলাকায় এসব চলবে না“

- কেউ এসে যদি বলে, আপনার নিজের খালা (মায়ের বোন) এই ব্যাবসা করে।

আপনি বলবেন “ওই মিয়া, এসব ফালতু খবর কোথা থেকে পান?, ভালোয় ভালোয় মাইর খাওয়ার আগে এখান থেকে চলে যান” । আপনি কিন্তু বিষয়টির সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন না বরং ওই লোকটির উপরে মেজাজ খারাপ হবে।

- কেউ যদি এসে বলে , আপনার মা এই ব্যাবসা করেন।

আপনি কিছু জানা বোঝার আগেই ওই লোকটির গালে এমন চড় লাগাবেন যেন তার দাত ভেঙ্গে যায়। বিষয়টি জানা, বোঝা, সত্যতা যাচাই ইত্যাদি অনেক পরের কথা। ওই লোকটি এই কথাটা বলার সাহস পেল কিভাবে সেটাই তখন আপনার প্রশ্ন।

এর একটাই কারন। আপনি আপনার মায়ের নামের ছেলে নন। আপনি কাজের ছেলে, সত্যিকারের ছেলে। ইসলামের প্রতি আমাদের বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসা হতে হবে এমন। নিজের মায়ের মতন ইসলামকে ভালোবাসতে না পারলেও অন্তত খালার মতন ভালোবাসতে হবে। তা না করে আমাদেরকে কেউ ইসলামের নামে মনগড়া একটি কথা বললে আমরা মনে করি , কে জানে হয়ত সত্য হতেও পারে। অনেকে এখানে থেমে যায় অনেকে আবার গবেষনা করে। আমরা বুক ফুলিয়ে এটা বলতে পারি যে, আমার মা এবং আমার খালা অমন নয়। কিন্তু বুক ফুলিয়ে এটা বলতে পারি না যে আমার ইসলাম অমন নয়। এজন্যই আমরা নামের মুসসলমান। কাজের মুসলমান হলে ওই সমস্ত মানুষের মনগড়া কথা মনেই থেকে যেত মুখে বলার সাহস পেত না।

আরেকটি কথা, মায়ের সুযোগ্য সন্তান, মাকে ভিক্তি করে, মায়ের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করে। মায়ের বিয়ের আগে কয়জন বান্ধবী ছিল, ম কোন স্কুলে পড়েছে, ইত্যাদি ইতিহাস জানাটা অপ্রয়োজনীয়। এভাবেই ইসলামের আগের আমলে কাবা ঘরে কি হয়েছে তার পাশে কে কি করেছে সেটা আমাদের না জানলেও চলবে। ইসলামের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধ্বা ও দায়ীত্ব পালনটাই আসল কথা।

যাই হোক, প্রশ্ন যখন উঠেই গেছে, অপ্রয়োজনীয় হলেও এটার উত্তর দিতে হবে। আসলে এখানে কোন প্রশ্ন নেই। এখানে ওই যুবক যুবতির গল্পটি সত্য প্রমানের জন্য কোরআনের একটি আয়াত (বাকারা ১৫৮) এর রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে। এবং সবশেষে প্রশ্ন করা হয়েছে যে গল্পটি যদি সত্য না হবে তাহলে আল্লাহ এই কথা কেন বললেন -

-------- ওই পাহাড়ের মাঝে তাওয়াফ (যাওয়া আসা) করাতে কোন দোষ (পাপ) নেই ---------

গল্পটি বানোয়াট - যুক্তি ১

আল্লাহ ইব্রাহীম (আঃ) কে আদেশ দিয়েছিলেন তার স্ত্রীকে ( হাজেরা) ও শিশুপুত্র (ইসমাইল) কে নির্জন এলাকা সাফা ও মারওয়া পাহাডের কাছে রেখে আসতে। এক সময় পানির পিপাসায় কাতর সন্তানের জন্য পানির খোজে মা হাজেরা (রাঃ) ওই দুই পাহাড়ে কয়েকবার ওঠানামা করেন। তার আশা ছিল যে উচুতে দাঁড়িয়ে হয়ত রুরের কোন ভ্রমনকারীকে দেখতে পাবেন। শেষ পর্যন্ত না পেয়ে ফিরে এসে দেখেন যে আল্লাহর রহমতে শিশু ইসমাইল (আঃ) এর পাশে মাটি /বালি ভেদ করে পানি উঠে আসছে। এটাই জমজম কুপ। এর অনেক পরে ইসমাইল (আঃ) এর বাল্যকালে আল্লাহ ইব্রাহীম (আঃ) কে কাবা ঘর বানানোর যায়গা দেখিয়ে দেন যা ছিল জমজম কুয়ার খুব আছে। এর পরে ওখানে কাবা ঘর বানানো হয়। ওখান লোক বসতি, কাবা ঘরের চারিদিকে ঘোরা ইত্যাদি আরো অনেক পরে শুরু হয়েছিল। মোট কথা, কাবা ঘর বানানোর আগেই ওই পাহাড় ওখানে ছিল। কাজেই কাবা ঘরের পাশে জেনা করতে যাওয়া ওই দুই যুবক যুবতিকে পাহাড় বানানো হয়েছে এই গল্পটা বানোয়াট।

গল্পটী বানোয়াট, যুক্তি ২

ইব্রাহীম (আঃ) কাবাঘর বানিয়ে, কাবা ঘরে কি করতে হবে সেটা মানুষকে শিখিয়ে দিয়ে নিজে তো পরপারে চলে গেলেন। কিন্তু মানুষ তো সেই শিক্ষা আর ধরে রাখতে পারেনি। উনার কয়েক হাজার বছর পরে রাসুল (সাঃ) এর আমলে কাবা ঘরের মধ্যে ৩৬০টি মুর্তি ছিল। এর আগে মানুষ কাবা ঘর নিয়ে আরো কি করত তা আল্লাহই জানেন। যারা কাবা ঘরের মধ্যে মুর্তি পুজা করত তাদের পক্ষে কাবা ঘরের পাশে জেনা করা বিচিত্র কি? তারা হয়ত এমন করে দেবতাদের খুশী করত। বর্তমান বিশ্বে ৪ হাজার এর বেশী ধর্ম রয়েছে। অনেক ধর্মে জেনা করে দেবতাকে খুশি করার পদ্ধতি এখনও চালু রয়েছে। সেই আমলে রাসুল (সাঃ) কে রীতিমতন কয়েকটি যুদ্ধ করতে হয়েছে কাবা ঘর থেকে সেই মুর্তিগুলি অপসারন করার জন্য। কাবা ঘরের পাশে কি করা যাবে আর কি করা যাবে না সেটাও তো তিনিই শিখিয়েছেন। হাজার বছর ধরে যারা কাবা ঘরকে অপবিত্র করে রাখল তাদেরকে আল্লাহ কোন শাস্তি দিলেন না। যত শাস্তি পেল ওই দুই যুবক যুবতী যারা আসলে কাবা ঘরের পাশে কিছুই করেনি বরং একজন বয়স্ক লোকের কথা মেনে নিয়ে কাবা ঘরের পবিত্রতা রক্ষার জন্য জেনা করতে দূরে সরে গিয়েছে। এটা বানোয়াট গল্প।

আল্লাহ কেন “দেষের নয়” এই কথা বলেছেন

আল্লাহ, ইব্রাহীম (আঃ) কে হজ্জের নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এই নিয়ম অনুযায়ী তখন মানুষ হজ্জ করত যার মধ্যে ওই পাহার দুটিতে ওঠা নামা করাও ছিল। ইব্রাহীম (আঃ) এর মৃত্যুর পরে ধীরে ধীর এসব শিক্ষা হারিয়ে যায়। এক সময় মুর্তি পুজারীরা ওই দুই পাহাড়ে তাদের দেবতা ইসাফ ও নাইলার মুর্তি স্থাপন করে। মুর্তি পুজারীরা ওই দুই দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে ওই পাহাড়ে ওঠা নামা করত। রাসুল (সাঃ) এর আমলে আরববাসীরা এটা জানত। হজ্জের নিয়ম নতুন করে শিখতে গিয়ে মানুষ তখন দেখল যে, এটা ওই মুর্তি পুজারীদের মতন পাহাড়ে ওঠা নামা করতে বলা হচ্ছে । তাদের এই সন্দেহ দূর করতেই ওই আয়াতে “দোষের নয়” এই কথা বলা আছে। আসলে মুর্তিপুজারীরা ওই পাহাড়ে উঠা নামা করার আগেই হজ্জ ছিল। সেই হজ্জের মধ্যে ওই পাহাড় দুটির মধ্যে ওঠা নামার পদ্ধতি ছিল। (সুত্র দেখুন)

পরিশেষেঃ

এই ধরনের বানোয়াট গল্প ও বেকায়দা প্রশ্ন যার কাছ থকেই শুনেন না কেন এগুলোর মুল কারিগির কিন্তু ইসলামের শত্রুরা। তাদের কাছ থেকেই এগুলো ছড়ায়। এসব প্রশ্ন শুনে আমরা এমনিতেই দুর্বল হয়ে যাই আর এই প্রশ্নের সাথে যদি কোরআনের আয়াত ঢুকিয়ে দিতে পারে তাহলে তো আমরা একেবারে পরাজিত হয়ে যাই। আমাদের ইসলামের প্রতি ভালোবাসার অভাব ও আমাদের অজ্ঞতার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ইসলামের শত্রুদের মোকাবেলা সম্ভব নয়।

বিষয়: বিবিধ

৩০৩২ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

194413
১৯ মার্চ ২০১৪ রাত ১২:৪৪
পলাশ৭৫ লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
194444
১৯ মার্চ ২০১৪ রাত ০২:১৭
বাকপ্রবাস লিখেছেন : ভাল
194449
১৯ মার্চ ২০১৪ রাত ০২:২৮
নানা ভাই লিখেছেন : বুঝাই যায় ব্লগার আধা শিক্ষিত মানুষ জাল হাদিস এর চালান দিয়েছেন। ধন্যবাদ এলিট আপনার লেখার জন্য।
আরো ইনফরমেশনের জন্য http://en.wikipedia.org/wiki/Al-Safa_and_Al-Marwah
এবং
http://en.wikipedia.org/wiki/Abraham_in_Islam
দিলাম।
194481
১৯ মার্চ ২০১৪ রাত ০৩:৫৬
মোহাম্মদ নূর উদ্দীন লিখেছেন : ব্লগার আধা-শিক্ষিত মানুষের ইসলামের প্রতি ঈমানের কোন ঘাটতি আছে বলে মনে হয়না । ঐ কাহিনিটি উনি নিজেও বিশ্বাস করেছেন এমনটি মনে হয়না । আমার যেটা মনে হয়েছে - উনার কাছে কাহিনিটি এতটা হাস্যকর মনে হয়েছে যে হাসতে হাসতে কাহিনি নিয়ে ব্লগে এসে হাজির এবং সবার সাথে ঐ বেকুবের গল্প শেয়ার করা ।
কিন্তু হেডলাইন বা লিখার কিছু পরিবর্তন আনলে এতটি বিপর্যয় দেখা দিত বলে মনে হয়না । তবে আমার মনে হয় এসব পৌরনিক কল্প সামনে না আনাই ভাল । তাতে নাপাক জাতের লোকেরা সমালোচনা বা খোচা মারার একটি ঢিল হাতের নাগালেই পেয়ে যায় ।
194496
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ০৫:১৫
হাকালুকি লিখেছেন : এই জন্য ইতো বেচারা আধা শিক্ষিত মানুষ, আপনার মত পুরো শিক্ষিত একজন মানুষের কাছ থেকে আমি অশিক্ষিত মানুষ আসল কাহিনী জানলাম । তবে না জেনে এরকম একটা কাবা শরীফ সংশ্লিষ্ট বিষয় এভাবে উনার লিখা ঠিক হয়নি এটা আমি অশিক্ষিত মানুষ এখন বুঝতে পারছি ।
194497
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ০৫:১৭
সাদাচোখে লিখেছেন : ধন্যবাদ।
অজানা জানলাম।
194551
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ০৯:৪৭
egypt12 লিখেছেন : জেনে ভালো লাগলো...এমন ভালো পোস্ট চাই
194570
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:১৩
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : উনার বক্তব্য হয়তো ভুল বিশ্বাস হতে, উদ্দেশ্যমূলক নয়। আশা করি উনার ভুল ভাঙবে।
194601
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১১:০৪
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : উনার বক্তব্য হয়তো ভুল বিশ্বাস হতে, উদ্দেশ্যমূলক নয়। আশা করি উনার ভুল ভাঙবে।
১০
194927
১৯ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:৩০
সূর্যের পাশে হারিকেন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া, সুন্দর যুক্তির মাধ্যমে বিষয়টাকে স্পষ্ট করে দেয়ার জন্য। যাজাকাল্লাহু খাইর। আল্লাহ যেন আপানকে সিরাতুল মুস্তাক্বীমের উপর রাখেন, আপনার জ্ঞান আরও বাড়িয়ে দেন Praying Praying

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File