সাংস্কৃতিক অগ্রাসন নিয়েই কথা বললাম। ব্যাবসাটা কেউ দেখলাম না।

লিখেছেন লিখেছেন এলিট ১৬ মার্চ, ২০১৪, ১২:৪১:৪৩ রাত



সম্প্রতি T-20 এর উপলক্ষে এ আর রহমানের ও একনের কনসার্টে টিকিটের সর্বোচ্চ মুল্য ছিল ৭৫,০০০ টাকা, যা কিনা ৯০০ আমেরিকান ডলারের সমান। সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা, অর্থাৎ ২৫ ডলার।

এক নজরে, এশিয়ার অন্যান্য দেশে, এ আর রহমানের অন্যান্য কনসার্টে টিকিটের মুল্য দেখুন।

মালয়শিয়ায় - সর্বোচ্চ মুল্য ৪৫৫ ডলার, সর্বনিম্ন ৩০ ডলার

আরব আমিরাত (দুবাই) - সর্বোচ্চ মুল্য ২৭০ ডলার, সর্বনিম্ন ২৭ ডলার

সিঙ্গাপুর - সর্বোচ্চ মুল্য ২৩৫ ডলার, সর্বনিম্ন ৩০ ডলার

ভারত (কোলকাতা) - সর্বোচ্চ মুল্য ৮০ ডলার, সর্বনিম্ন ৫ ডলার

এই মুল্য তালিকা থেকে দুটি বিষয় স্পস্ট হল। এক, বাংলাদেশের এই কনসার্টটি এ আর রহমানের জীবনের সবচেয়ে ব্যায়বহুল (টিকিট এর মুল্য হিসাবে) কনসার্ট। দুই, বাংলাদেশের মানুষের এত টাকা যে তারা মালয়াশিয়া বা সিঙ্গাপুর এর চেয়ে কয়েক গুন বেশী মুল্যে টিকিট কিনতে পারে। ওদিকে নিজের দেশ ভারতের কোলকাতাতে তার টিকিটের সর্বোচ্চ মুল্য হয় ৫ হাজার রুপী এবং সর্বনিম্মন মুল্য মাত্র ৩০০ রুপী সুত্র এখানে। আমাদের দেশে টিকিটের মুল্য কোলকাতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপুর্ন হওয়ার কথা। সর্বনিম্ন ৫০০-১০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০-১৫ হজার টাকা হলে সামঞ্জস্য থাকত।

আমি নিজে এর আর রহমানের একজন একনিস্ট ভক্ত। তার শুধু হিন্দি নয়, তার তামিল গানের পুরো কালেকশন আমার শোনা আছে। কিন্তু হক কথা বলতেই হবে। এই লোকটি তার নিজের দেশে ৮০ ডলারের বেশী টিকিটের মুল্য করতে পারে না, অন্যান্য দেশে ৫০০ ডলারের বেশী টিকিটের মুল্য করতে পারে না। সেই লোকটি বাংলাদেশে এসে কনসার্ট করে যার টিকিটের মুল্য ৯০০ ডলার। এটি সম্ভব হয়েছে একমাত্র আমাদের এই দুর্নীতিগ্রস্থ অর্থ ব্যাবস্থার জন্য। আমাদের মানষিকতাও কিছুটা দায়ী। বেশী দাম দিয়ে কোন কিছু কেনা বাংলাদেশে বোকামী নয় বরং এটা একটা স্টাটাস এর পরিচিয় দেয়।

বিষয়টি নিয়ে হয়ত এত সমালোচন হতো না। বিষয়টি নিয়ে আসলে সাধারন মানুষকে ভাবতে শুরু করিয়াছে ওই দিনের বাংলাদেশের সঙ্গিত তারকারা। সবচেয়ে বড় ভুমিকা আইয়ুব বাচ্চুর। তিনি তার ক্ষোভ ওই স্টেজেই প্রকাশ করে দিয়েছেন। এর পরে ফেসবুকে নিজ নিজ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাহসান ও শাফিন আহমেদ। বিষয়টি সাংবাদিকদের নজরে আসে এবং তারা খোজ খবর নিয়ে রিপোর্টও করেন। অনেকে এই নিয়ে কলামও লিখেন। এই ব্লগেই মিনার রশিদ সাহেবের এই বিষয়ে একটি অসাধারন লেখা রয়েছে।

বাংলা ব্যান্ড তারকাদের গানে অনীহা প্রকাশ করার জন্য ওই দিনের দর্শকদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। কারন তারা ওই দিনে ভারতীয়/বিদেশী গান শোনা ও দেখার প্রস্তুতি নিয়েই সেখানে গিয়েছিল। এই দর্শকেরাই যখন এল আর বি বা মাইলসের অনুস্টানে যায় তখন তাদের আগ্রহের কমতি থাকে না। কিন্তু ওই দিন দর্শকদের মানষিক প্রস্তুতি ছিল আলাদা। দোষ আসলে আয়োজক ও এর সঙ্গে জড়িত ব্যাক্তিদের। তারা ওই অনুস্টানে তাদের ব্যাবসাকে টেনে নিয়ে আসাতেই যত সমস্যা তৈরি হয়েছে। ব্যাবসা কোথায় ও কিভাবে সেটা খুলে বলার আগে একটু বলে নেই যে এই ধরনের অনুস্টানে সাধারনত কি হয় এবং আমাদের এই অনুস্টানের সঙ্গে তার পার্থক্য কি।

এই ধরনের অনুস্টান সবাই, বিশেষ করে খেলাধুলা প্রেমিকেরা টিভিতে অনেকবার দেখেছেন। কোন একটা খেলা , যেমন অলিম্পিক, বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেট ইত্যাদি উদ্ভোদন। এগুলো গান বাজনার কোন অনুস্টান নয়। কোন ব্যান্ড শো বা কনসার্ট নয়। এসব অনুস্টানে সাধারনত আয়োজক দেশ তার নিজের শিল্প ও সাংস্কৃতি বিশ্বের কাছে তুলে ধরে। এই অনুস্টানে নাচ, গান, অভিনয়, কবিতা, শারিরিক কসরত ইত্যাদি অনেক কিছুই থাকরে পারে। আপনি যে কোন দেশের এমন একটি অনুস্টান দেখুন, দেখবেন ওতে তারা নিজের দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরেছে। এর মধ্যে অবশ্যই ওদের দেশীয় পোষাক রয়েছে। মেক্সিকো দেশটি আমেরিকার একেবারেই পাশে। ওদের দেশে এ ধরনের অনুস্টানে কিন্তু আমারিকার হলিউডের তারকাদের নিয়ে আসে না। নিয়ে আসলেও তাদের উপস্থিতি থাকে খুব অল্প পরিসরে, উতসাহ দেবার জন্যে।

আমাদের দেশে এই ধরনের অনুস্টানে দেখানো যেতে পারে আমাদের পোষাক লুঙ্গি ও শাড়ী। দেখানো যেতে পারে আলতা পায়ে হলুদ, লাল শাড়ী পড়ে কলস বা কুলা হাতে নাচ, গান। সংক্ষিপ্ত যাত্র, পালাগান, বাউল গান। ঢেকিতে ধান ভানা। নৌকা বাইচ এর অভিনয়। মাছ ধরার জাল, লাঙ্গল চালানো। ঠ্যালা গাড়ী, রিক্সা। লাটিম খেলা, মার্বেল খেলা, ডাঙ্গুলী খেলা, ঘুড়ী ওড়ানো। এই অনুস্টানে বিভিন্ন সাজসজ্জা ও অভিনয়ের মাধ্যমে আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে দেখানো যেতে পারে। আমাদের কি দেখানোর জিনিসের অভাব রয়েছে? তা না করে তারা যেটা আয়োজন করেছে সেটা আসলে একটা কনসার্ট। দেশীয় সাংস্কৃতি তুলে ধরার অনুস্টানে এ আর রহমান ও একন তো অনেক পরের কথা, বিদেশী ধাচে বাংলা গান গাওয়া এল আর বি বা মাইলসই তো থাকার কথা নয়। অনেকে আবার বলতে পারেন যে ওসব গ্রাম্য সংস্কৃতি দেখতে কে যাবে? হ্যা, এখানেই তো আমাদের দেশপ্রেম। আমরা অতি আধুনিক হয়ে নিজেরাই নিজেদের সংস্কৃতি পছন্দ করি না। এই সংস্কৃতি আবার বিশ্বের কাছে তুলে ধরব কেমনে করে। এজন্যই আমাদের দেশে ভারতীয় সংস্কৃতি দেখানো হয়। আসলে সেভাবে আকর্ষনীয় করে দেখানো গেলে সবকিছুই উপভোগ্য হবে। আমাদের দেশে যেখানে বিদ্যুতের সমস্যা আছে সেখানে দায় পড়ে মোমবাতীর আলোতে ছেলে মেয়েরা লেখা পড়া করে। ওদিকে উন্নত বিশ্বে ওই একই মোমবাতী জ্বালিয়ে দামী রেস্টুরেন্টে প্রেমীক প্রেমীকেরা রোমান্টিক নৈশভোজন করে। আকর্ষনীয় করে তোলাটাই কোন জিনিসকে উপভোগ্য করে তোলে। গামছার মতন দেখতে গ্রামিন চেকের পোষাক আমাদের দেশে একসময় বেশ চল ছিল। কারন একটাই - ওটাকে আকর্ষনীয় অরে তোলা হয়েছিল।

এই ধরনের অনুস্টানে বিদেশী অনেক অতিথীর সমাগম থাকে। আন্তঃজাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রতিনিধি থাকে। তাদের অনেকের ছোট বক্তব্য থাকে। আমাদের এই অনুস্টানে তা ছিল না। আমাদের অনুস্টানটি আসলে T-20 ছুতোয়, বাংলাদেশী শিল্পীদের উপস্থিতিতে ভারতীয় সঙ্গীত এর একটি কনসার্ট। যেখানে সংস্কৃতি প্রদর্শনের কোন ব্যাপার নেই। এখানে রয়েছে ব্যাবসা। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এমন অনুস্টান তো অন্য এক সময়ে করা যেত, একই ব্যাবসা হতো। এটাকে T-20 এর মধ্যে করে এই ভ্যাজাল করার কারন কি?

এখানেই আসল ব্যাবসায়িক বুদ্ধি। অন্য এক সময় এই অনুস্টানের আয়োজন করলে এর খরচটা দিতে হত নিজের পকেট থেকে। অনুস্টানে পর্যাপ্ত দর্শক না হলে ক্ষতি নিজেকেই ভোগ করতে হোত। এছাড়া এই অনুস্টানটা T-20 এর ভেতরে করে সঙ্গীত প্রেমীদের সঙ্গে ক্রীড়া প্রেমীদেরকেও দর্শকের কাতারে পাওয়া গেছে। আন্তঃজাতিক অনুস্টান বলে, টিকিটের উচ্চমুল্যও ধার্য্য করে গেছে। সব দিক থেকেই সুবিধা। আরেকটু, ভেঙ্গে বলছি। এই T-20 ট্রুনামেন্ট এর মুল আয়োজন করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট কাউন্সিল/ বোর্ড। এটা স্বায়ত্বশাশিত একটি সরকারী প্রতিস্টান। ওরা এই আয়োজনের অর্থ যোগান দেয় ঠিকই, কিন্তু আসলে আয়োজনটা করে তাদের কাছ থেকে আনুমোদন/ কন্টাক্ট পাওয়া কোন একটি প্রতিস্টান। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি বিল্ডিং বানাবে। তারা তো নিজেরা রড সিমেন্ট দিয়ে এটা বানাতে পারে না। তারা টেন্ডারের মাধ্যমে আগ্রহী ঠিকাদারকে এই কাজটি দেয়। এই অনুস্টানের বিষয়টিও তেমনি। এবার সেই প্রতিস্টানটি ক্রিকেট বোর্ডের অনুমতি নিয়েই এমন অনেস্টানের আয়োজন করেছে। এরা সবাই দলীয় লোক। এদের কোন বিষয়ে দ্বিমত হয় না। হলেও তা উপহারের গুনে উপশম হয়ে যায়। এখন ওই আয়োজক ব্যাবসায়ী প্রতিস্টান এই উদ্ভোদনী অনুস্টানের মধ্যে তার নিজস্ব ব্যাবসায়ীক কনসার্ট ঢুকিয়ে দিয়েছে। লাভ হলে তো ভালই। লস হলেও ক্ষতি নেই কারন টাকার যোগানদাতা তো ক্রিকেট বোর্ড, আর ব্যাবসাটি তাদের। লাভ হয়েছে ওই প্রতিস্টানটির। আর মোটা অংকের টাকা ভারতে চলে গেছে। ক্রিকেট বোর্ডের (সরকারের) কিছুই লাভ হয়নি। অনেক বলে ফেলেছি। এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশী কিছু বলা ঠিক হবে না।

পরিশাষে এটুকুই বলবঃ যাকেই দোষ দেই না কেন, দোষ আসলে আমাদের নিজেদেরই। আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি বিমুখ চরিত্র, আমাদের টাকার বড়াই, আমাদের দেশপ্রেমের অভাব সর্বপরি আমাদের দুর্নিতিগ্রস্থ মানষিকতা আমাদের সামনে এমন পরিস্থিতি হাজির করেছে। যেই দেশে ২১ এ ফেব্রুয়ারীতে বিভিন্ন মহল্লায় দেখা যায়, একটা ছোট শহিদ মিনার বানিয়ে এর পাশে জোরে জোরে হিন্দি গান বাজাচ্ছে, সেই দেশে একটি খেলার উদ্ভোদনী অনুস্টানে তো ভারতীয় শিল্পীরাই থাকবে। গোড়াতেই তো গলদ রয়েছে। আসলে, আমাদের স্বভাব ঠিক না হলে কিছুই ঠিক হবে না।

বিষয়: বিবিধ

১৪৭৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

192780
১৬ মার্চ ২০১৪ রাত ০১:২৭
আল্লাহর সন্তুষ্টি লিখেছেন :
এবার সেই প্রতিস্টানটি ক্রিকেট বোর্ডের অনুমতি নিয়েই এমন অনেস্টানের আয়োজন করেছে। এরা সবাই দলীয় লোক। এদের কোন বিষয়ে দ্বিমত হয় না। হলেও তা উপহারের গুনে উপশম হয়ে যায়। এখন ওই আয়োজক ব্যাবসায়ী প্রতিস্টান এই উদ্ভোদনী অনুস্টানের মধ্যে তার নিজস্ব ব্যাবসায়ীক কনসার্ট ঢুকিয়ে দিয়েছে। লাভ হলে তো ভালই। লস হলেও ক্ষতি নেই কারন টাকার যোগানদাতা তো ক্রিকেট বোর্ড, আর ব্যাবসাটি তাদের। লাভ হয়েছে ওই প্রতিস্টানটির। আর মোটা অংকের টাকা ভারতে চলে গেছে

192786
১৬ মার্চ ২০১৪ রাত ০১:৩৫
গেরিলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
193060
১৬ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৭
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : ভাল একটি তুলনা দিলেন। সমস্যা যেহেতু বাঙ্গাল তাই বাঙ্গালকেই পোহাতে হবে সব কিছু। আমাদের মাথায় পচন ধরেছে। আমরা আর যাই হউক স্বাধীনতার অর্থ বুঝিনা তেমন স্বাধীন থাকতে ও চাই না।
193157
১৬ মার্চ ২০১৪ রাত ০৮:৪৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File