ক্রিকেট খেলার সমর্থক নাকি ঝামেলার আয়োজক ?

লিখেছেন লিখেছেন এলিট ০৫ মার্চ, ২০১৪, ০৯:৩৫:৪২ রাত



যে কোন ধরনের প্রতিযোগীতায় যদি দেশের কোন ব্যাক্তি বা দল জয়ী হয় তবে সেটা সেই দেশের সবার জন্য গৌরবের। এসব প্রতিযোগীতার মধ্যে সবচেয়ে বেশী আলোচিত হচ্ছে খেলাধুলা। বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারে যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি । বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড়ের তালিকায় নাম লিখিয়েছে এমন ক্রিকেটারও বাংলাদেশে আছে। এটা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য নিঃসন্দেহে অনেক বড় গৌরবের বিষয়। খেলায় হার জিত থাকে। আমরা সারা জীবন তো জিততে পারব না। কখনো জিতব, কখনো হারব। হার জিত যাই হোক না কেন, আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সাপোর্ট করব, আমাদের দেশীয় খেলোয়ারের ভক্ত হব, তাদের উতসাহ দিব, তাদের জয় নিয়ে উল্লাস করব, তাদের পরাজয়ে সাহস দিব – সর্বপরি দেশের এই মর্যাদাপুর্ন প্রাপ্তি রক্ষা করব। কিন্তু আশে পাশে এই ক্রিকেট এর সমর্থন এর কায়দা দেখে ওই লাইনটি মনে পড়ে যায়। “রেখেছ বাঙ্গালী করে, মানুষ করনি”।

আমাদের দেশের ক্রিকেটের সমর্থকেরা অনেক আগে থেকেই প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। বড় একটা সমর্থক দল ছিল পাকিস্তানের সমর্থক এবং এর চেয়ে ছোট একটা দল ছিল ভারতের সমর্থক । বাংলাদেশ কালেভদ্রে যখন ক্রিকেট খেলত তখন সবাই নিশ্চিত হার জেনেও, ভারত পাকিস্তান ভুলে গিয়ে সবাই বাংলাদেশ এর সমর্থন করত। এখন তো ক্রিকেটে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সাথে সমান কাতারে এসে দাড়িয়েছে। কাজেই এখন দেশের সবচেয়ে বড় সমর্থকের দল হল, বাংলাদেশের সমর্থক। ঠিকই তো, নিজের দেশের ছেলেরাই তো ভালো খেলছে, এখন মানুষ ভারত-পাকিস্তান সমর্থন করবে কোন দুঃখে? তবে যে সব খেলায় বাংলাদেশ খেলছে না সেই সব খেলায় আমরা আবার ভারত/পাকিস্তান হয়ে যাই। যেমন ভারত-নিউজিল্যান্ড এর খেলা হলে আমদের দেশে প্রচুর ভারত সমর্থক পাওয়া যায়। আবার পাকিস্তান-সাউথ আফ্রিকা খেলা হলেও দেশে প্রচুর পাকিস্তানের সমর্থক পাওয়া যায়। পাকিস্তান ও ভারতের এই সমর্থকদের দল দুটির পরিচয় সম্পুর্ন করতে হলে এইভাবে বলতে হবে –

- ভারতের সমর্থক এবং পাকিস্তান বিরোধী

- পাকিস্তানের সমর্থক ও ভারত বিরোধী

এদের সমর্থন যতটা জোরালো , তার চেয়ে বেশী জোরালো তাদের বিরোধীতা । নিজের সমর্থিত দল জিতলে যত খুশি হয় তার চেয়ে বেশী খুশি হয় বিরোধী দল হারলে। এই ধরনের সমর্থকের একটা বড় অংশ আছে যারা খেলা বা খেলোয়ার ইত্যাদি বিচার করে পাকিস্তান বা ভারত সমর্থন করে না। তারা সমর্থন করে সেই দেশকে। এজন্য কেউ এই দুটি দেশের যেটিকেই সমর্থন করুক না কেন বদনাম থেকে মুক্তি পায় না।

ক্রিকেটের সমর্থকদের কাছ থেকে এই ধরনের কথা শোনা যায়ঃ

- পাকিস্তান ৭১ সালে যা করেছে সেটার বদলা বাংলাদেশ অমুক ক্রিকেট ম্যাচে নিয়ে নিয়েছে

- ভারত আমাদের দেশের অমুক ক্ষতি করেছে সেটার জবাব বাংলাদেশ ওমুক খেলাতে দিয়েছে

- যারা এখনো পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থন করে তারা অমুক তমুক (অকথ্য গালি)

- যারা ভারত কলকে সমর্থন করে তারা ভারতের দালাল

- পাকিস্তান আমাদের সাথে ৭১ এ পারেনি এই ম্যাচেও পারবে না

- ভারত আমাদের সীমান্তে মানুষ মেরেছে তাই আমরা এই ম্যাচে তাদের হারিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি

সাধারন লোকের কথা আর কি বলব। অনেক বছর আগে, বাংলাদেশ প্রথম যেদিন পাকিস্থান ক্রিকেট দলকে হারালো সেদিন খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যতে ছিল যে আমরা এই ম্যাচে জিতে ৭১ এর বদলা নিয়েছি। আবার সম্প্রতি হারের পরে এটাও শোনা গেছে যে “ ৭১ এ হারিয়েছি, আবারও হারালাম।“ ঘুরে ফিরে সামান্য এক খেলার মধ্যে ৭১ কে টেনে এনে কি মুক্তিযুদ্ধেকে বড় করা হয় নাকি ছোট করা হয় সেটাই আমরা এখনো বুঝতে পারললাম না। তাই এই ধরনের ডায়লগ সব শ্রেনীতেই প্রচলিত রয়েছে আর বাংলাদেশের আবেগপ্রবন মানুষ এই ডায়লগ পছন্দও করে।

এই ধরনের যে কোন ডায়লগ একটু খেয়াল করে দেখুন। মুল কথাটাই হল “বদলা” ও শত্রুতা এক কথায় ঝামেলা। অর্থাৎ ক্রিকেট খেলাটা হচ্ছে শত্রুর সাথে আর জিতলেই বদলা নেওয়া হয়ে যাবে। ওদিকে হারলে সব হারাতে হবে। ভারতে সাথে একটা ম্যাচ জিতলে কি সীমান্তে এত লোককে অন্যায়ভাবে হত্যা করার প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যাবে? পাকিস্তানের সঙ্গে একটা ম্যাচ জিতলে কি ৭১ এ লক্ষ প্রানের বদলা হয়ে যাবে ? এভাবে কি আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করছি না?

কুস্তি বা মুস্টিযুদ্ধ আন্তঃজাতিক খেলা। এই খেলাতে একজন অপরজনকে মেরে মারাত্মক আহত করে ফেলে। কিন্তু তারা কেউই একে অপরকে শত্রু মনে করে না। শত্রু মনে করলে সেটা আর খেলা থাকে না, সেটা মারামারি হয়ে যায়। আমাদের ক্রিকেট খেলাটাও এই ধরনের চরমপন্থী সমর্থকেরা মারামারি বানিয়ে ফেলেছে। চীর শত্রু ভারত পাকিস্তান নিজেরা কোন ক্রিকেট ম্যাচ খেলেলে সেটার হার জিত নিয়ে সেই দেশের মানুষেরা “বদলা” টাইপের কোন কথা বার্তা বলে না। এ ধরনের কথা আমাদের দেশেই শোনা যায়। আমাদের যদি ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে এতই শত্রুতা থাকে তবে ওদের সাথে হাত মিলিয়ে মাঠে খেলার কি দরকার? শত্রুর সাথে আবার খেলা কি? খেলা তো হয় বন্ধুর সাথে।

সচিন টেন্ডুল্কার যখন ১০০ রান করে তখন যে প্রসংশার দাবিদার। যখন শহিদ আফ্রিদি ছক্কা মারে তখনো সে প্রশংশার দাবিদার। ভারত বা পাকিস্থানের সাথে শত্রুতা করার জন্য অনেক যায়গা আছে। কিন্তু খেলার মাঠ তো শত্রুতার যায়গা নয়। বরং এখানে খেলোয়াড়দের খেলা দেখে তাদের মুল্যায়ন করার যায়গা। তা না করে আমরা যেটা করছি সেটা হল – এই খেলা নিয়ে আমরা ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে শত্রুতা করছি। এই শত্রুতাবসত আমরা ভারত বা পাকিস্তানের একটা লোমও ছিড়তে পারিনা তাই রাগ মেটাতে নিজে বাংলাদেশী হয়ে অন্য বাংলাদেশী ভাইয়ের সঙ্গে শত্রুতা ও গালাগালি করছি। এই শত্রুতার একটাই কারন – একজন ভারত ও অপরজন পাকিস্তানের সমর্থক। এভাবে আমরা খেলার ছলে ঝামেলারই আয়োজন করছি।

বিষয়: বিবিধ

১২৪৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

187456
০৫ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:৪৭
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : সচিন টেন্ডুল্কার যখন ১০০ রান করে তখন যে প্রসংশার দাবিদার। যখন শহিদ আফ্রিদি ছক্কা মারে তখনো সে প্রশংশার দাবিদার। ভারত বা পাকিস্থানের সাথে শত্রুতা করার জন্য অনেক যায়গা আছে। কিন্তু খেলার মাঠ তো শত্রুতার যায়গা নয়। ধন্যবাদ
187461
০৫ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:৪৯
হতভাগা লিখেছেন : সামান্য একটা খেলাকে যারা যুদ্ধের সাথে তুলনা করে তারা আসলে যুদ্ধ আর খেলার মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারে না ।

পারবে কিভাবে? তারা তো ৭১ এ যুদ্ধে না গিয়ে ঘরে বসে ছিল / পালিয়ে গিয়েছিল ।
187462
০৫ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:৫১
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন :
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : সচিন টেন্ডুলকার যখন ১০০ রান করে তখন যে প্রসংশার দাবিদার। যখন শহিদ আফ্রিদি ছক্কা মারে তখনো সে প্রশংশার দাবিদার। ভারত বা পাকিস্থানের সাথে শত্রুতা করার জন্য অনেক যায়গা আছে। কিন্তু খেলার মাঠ তো শত্রুতার যায়গা নয়। ধন্যবাদ
187553
০৬ মার্চ ২০১৪ রাত ০১:৫৩
সজল আহমেদ লিখেছেন : শাহীন ভাইর সাথে সহমত।
187688
০৬ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:১৪
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : সবকিছুর ব্যাপারেই চরম আবেগী হয়ে যাওয়া আমাদের জাতীয় চারিত্রিক সমস্যা। বিষয়টি নিয়ে একটি সুন্দর আঙ্গিক পরিবেশন করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ Rose Rose

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File