পরোকালে সুপারিশ - আসলে কতটুকু কাজে দিবে ?
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ১৫ অক্টোবর, ২০১৩, ০৭:১৭:৪৪ সকাল
আমরা সবাই জানি যে হাসরের ময়দানে রাসুল (সাঃ) সুপারিশ করার অনুমতি পাবেন এবং করবেন। ধীরে ধীরে এই বিশ্বাস পীরের উপরে গিয়ে পড়েছে। পীরতন্ত্রকে সমর্থন করার জন্য অনেকে কোরআনের আয়াতের আশ্রয় নেয়। কোরআনে বলা আছে যে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। এই কথা থেকে পীরের মুরিদগন আশা করছেন যে তাদের পীরেরা সুপারিশ করার সুযোগ পাবেন। এবং এই সুপারিশে তারা বেহেস্তে চলে যাবেন। এছাড়া উম্মতদের জন্য রাসুল (সাঃ) এর সুপারিশ তো আছেই। এতে বেহেস্তে যাওয়া আরো সহজ হবে।
শুধু পীরের মুরিদ নয়, আমরা অনেকেই "সুপারিশ" কথাটি বুঝতে ভুল করি। এর কারন হল আমাদের সমাজে সুপারিশ এর অপব্যাবহার। যেমন "চাদা" শব্দটির অর্থ "অনুদান"। এর মানে দয়া করে কিছু দেওয়া। কিন্তু আমাদের সমাজে "চাদাবাজি" কিন্তু ডাকাতির মতন একটা বিষয় হয়ে দড়িয়েছে। ঠিক তেমনি সুপারিশ বলতে আমরা যেটা বুঝি সেটা হল অনুরোধ করে অযোগ্য লোককে কিছু পাইয়ে দেওয়া। আমার সঠিক যোগ্যতা নেই, কিন্তু আমার প্রভাবশালী মামা বড় সাহেবকে ফোন করে আমাকে চাকরী পাইয়ে দিলেন। এটাকে সুপারিশ বলে। আর এক ধরনের সুপারিশ রয়েছে। সেটা হল, আমি অধিকার বঞ্চিত, প্রভাবশালী কোন ব্যাক্তি উপরের কর্মকর্তাকে অনুরোধ করে সেই অধিকার ফিরিয়ে দিল। যেমন, আমাকে সন্দেহের বসে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। প্রভাবশালী মামা ফোন করে বলে দিলেন, ওকে ছেড়ে দিন , ভালো ছেলে। পুলিশ আমাকে ছেড়ে দিল। লক্ষ্য করুন সুপারিশ জিনিসটি দুটি ক্ষেত্রে ব্যাবহার হয়। অযোগ্য লোককে কোন কিছু পাইয়ে দিতে বা যোগ্য লোককে তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে।
হাসরের ময়দানে বিচারপতি হলেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজেই। উনি সুপারিশ শুনে অযোগ্য কাউকে বেহেস্তে নিবেন না। তাই সুপারিশ এ কোন কাজ হবে না। আবার যোগ্য কাউকে বেহেস্ত থেকে বঞ্চিত করবেন না। তাই সুপারিশের কোন দরকার নেই। তার মানে আমরা সুপারিশ বলেতে যা বুঝি তা আল্লাহর সামনে চলে না। ওদিকে আবার হাদিসে এমনকি কোরআনেও হাসরের ময়দানে সুপারিশের কথা বলা আছে। এখানে প্রশ্ন হল, সেই সুপারিশ আসলে কি?
প্রথমে বুঝতে হবে আল্লাহ বেহেস্ত কাদেরকে দিবেন। রাসুল (সাঃ) বলেছেন "আমার সারা জীবনের আমল (কর্ম) আমাকে বেহেস্তে নিতে পারত না যদি আল্লাহর রহমত আমাকে মুড়ে না রাখত।" উনার মতন সর্বশ্রেস্ট মানুষ এর কর্মই বেহেস্তে যাবার জন্য যথেস্ট নয়, আমরা তো কিছুই না। জ়েনে রাখুন আল্লাহ রহমত (দয়া) করে আমাদের বেহেস্ত দিবেন। কিন্তু ওই দয়াটা তিনি শুধুমাত্র তাদের জন্য করবেন যারা আল্লাহর হুকুম (বর্তমানে ইসলাম) মেনে চলেছে। আমাদের সৎকর্ম (পুন্য/নেকী) আমাদের বেহেস্তে যাবার বিনিময় নয়, বরং আল্লাহর রহমত পাবার মাধ্যম। সেই রহমতই আমাদেরকে বেহেস্তে নিয়ে যাবে। এই রহমত আর অন্য কোন ভাবে পাওয়া যায় কি? রাসুল (সাঃ) তার কন্যা ফাতিমা (রাঃ) কে বলেছেন "তুমি আমার কাছে দুনিয়াতে যা কিছু চাও (অর্থ সম্পদ ইত্যাদি) আমি তা সাধ্যমতন দিতে চেস্টা করব। কিন্তু পরোকালে তোমাকে কিছু দেবার ক্ষমতা আমার হবে না।" এখানে লক্ষ্যনীয় হচ্ছে যে রাসুল (সাঃ) তার নিজের মেয়েকে হাসরের ময়দানে সাহায্য করতে পারবেন না, সেখানে অন্যকে (উম্মত) কিভাবে সাহায্য করবেন? অতএব এটা স্পস্ট যে বেহেস্তে যেতে হলে আল্লাহর রহমত অর্জ়ন করতে হবে। এই রহমত পাবার মাধ্যম হল ইমান ও আমল (সৎকর্ম)। কেউ সুপারিশ করে কাউকে রক্ষা করবে এমন হবে না।
হাসরের ময়দান - এ এক ভয়বাহ অবস্থা। মানুষ এমন বিপদে কখনো পড়েনি। লাখো কোটি মানুষ কবর থেকে উঠে উলঙ্গ অবস্থায় লাইন দিয়ে দাড়িয়ে থাকবে। এত ভয়বাহ পরিস্থিতি যে কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় পাবে না। মানুষ এমন বিপদে থাকবে যে মা তার নিজের ছেলেকে চেনার সময় ও সুযোগ পাবে না। ক্ষুধা তৃষ্নাতে মানষ কস্ট পাবে। সুর্য খুব কাছাকাছি থাকবে। মানুষ তার আমল অনুযায়ী, কেউ হাটু সমান, কেউ কোমর সমান, কেঊ গলা সমান ঘামের মধ্যে ডুবে থাকবে। এভাবেই থাকবে লক্ষ লক্ষ বছর। সবাই দাঁড়িয়ে থাকবে শেষ বিচার শুরু হওয়ার আশায়। অসীম অনন্তকাল। সময় আর ফুরায় না। মানুষ এতটা অতীস্ট হয়ে যাবে যে মনে করবে ফলাফল যাই হোক না কেন বিচার শুরু হলে অন্তত এই পরিস্থিতি থেকে বেচে যাই। এই পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাছে "বিচার শুরু করুন" এই অনুরোধ করার সাহস কারো হবে না। সবাই আদম (আঃ) এর থেকে শুরু করে সকল নবী রাসুলের কাছে বলবে "দয়া করে আল্লাহর কাছে বিচার শুরুর অনুরোধ করুন"। কিন্তু কেউই সাহস পাবে না। শেষ পর্যন্ত রাসুল (সাঃ) সেই অনুরোধ করার সাহস করবেন (এটাই প্রথম সুপারিশ)। উনি আকাশের এক উজ্জল ঘরে (মকামে মাহমুদ) আল্লাহর কাছে সিজদায় পতিত হবেন ও অনেক কান্না কাটি করতে থাকবেন। এর পরে আল্লাহ উনাকে বিচার শুরু হচ্ছে তা জানাবেন।
শেষ বিচার বলে কথা তাও আবার সেই বিচারের বিচারক আল্লাহ নিজেই। কোন রকমের ছলনা, কায়দা, আইনের ফাকা দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া, উকিল মোক্তারের চালাকি ইত্যাদি কিছুই থাকবে না। দোষী ব্যাক্তি কোন অভিযোগ অস্বীকার করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে সেই ঘটনা দেখানো হবে। দেহের অঙ্গ প্রতঙ্গ সাক্ষী দিবে। সে এক ভয়বাহ বিচার। পাপ ও পুন্য পরিমাপের দাড়িপাল্লা থাকবে। এতে পরিমাপ করে নির্ধারন করা হবে যে কে বেহেস্তে ও কে দোযখে যাবে। এর পরে দোযখের উপরে অবস্থিত পুল (সেতু) পার হয়ে বেহেস্তবাসী বেহেস্তে প্রবেশ করবে আর দোযখবাসী ওই পুল থকে দোযখে পড়ে যাবে।
সবাই জান্নাত ও জাহান্নামে যাবার পরে দেখা যাবে অনেক সংখক মুসলমান তখনো জাহান্নামে রয়েছে। রাসুল (সাঃ) এর সুপারিশ আবার শুরু হবে। প্রথমে জোরদার ঈমান আছে কিন্তু অল্প পাপ করা মুসলমান জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে। এর পরেও অনেক মুসলমান জাহান্নামে থাকবে। এর পরে আবার সুপারিশ করা হবে। তখন আর একটু কম ঈমান রয়েছে এমন লোককে মুক্তি দেওয়া হবে। এভাবে বার বার মুক্ত করে ধীরে ধীরে অনেক পর্যায়ের পরে সবশেষে নুন্যতম ইমানদার মুসলমানকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। এমন মনে করবেন না যে বিষয়টি একদিনে হয়ে যাবে। রাসুল (সাঃ) এর সুপারিশ এর পরে আল্লাহ একজন মুসলমানকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন। এমন হতে পারে যে ইতিমধ্যে জাহান্নামে সেই লোকটির কয়েক কোটি বছর থাকা হয়ে গেছে। আসলে রাসুল (সাঃ) এর সুপারিশে মুক্ত হওয়ার আগেই জাহান্নাবাসীরা লক্ষ কোটি বছর জাহান্নামে থেকে তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করে ফেলবে
অনেকে বলেন একজন কোরআনে হাফেজ ১০ জনের জন্য ও একজন শহিদ ৭০ জনের জন্য সুপারিশ করতে পারবেন। কথা সত্য। কিন্তু সেই সুপারিশ পেতে হলেও একটা নুন্যতম যোগ্যতা লাগে। এই সুপারিশে কাজ হবে নুন্যতম ঈমান আছে এমন বান্দাদের জন্য এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছুটা শাস্তি ভোগ করার পরে। এটা এমন নয় যে একজন হাফেজ দশটি ফ্রী টিকিটে দশজন আত্মিয়কে জান্নাতে ঢুকাতে পারবেন। বিভিন্ন নবীর অনেক ঘনিস্ট আত্মীয় রয়েছে যারদেরকে নবীরা জান্নাতে নিতে পারবেন না। নুন্যতম ঈমান কাকে বলে এর সংগাটা ব্যাপক। সহজে বলতে গেলে বাংলাদেশে এমন লোক ১০%-২০% এর বেশী হবে না। নুন্যতম ইমানদার লোকেরা যখন বিভিন্ন পাপের জন্য জাহান্নামে যায় তখন ওই ধরনের সুপারিশে রক্ষা পাবে। গনহারে সবার জন্য সুপারিশ প্রযোজ্য নয়। অনেক বলেন দরুদ পাঠকারী রাসুল(সাঃ) এর সাফায়াত পাবে। দরুদ পাঠ করাটাও কিন্তু একটা যোগ্যতা, একটা আমল। ওদিকে আপনি নামাজ না পড়ে সারাদিন দুরুদ পড়লেও কিন্তু সাফায়েত হবে না। মোট কথা সুপারিশ, সাফায়াত এসব আসলে একজন অযোগ্য ব্যাক্তিকে জান্নাতে নিতে পারে না। একজন যোগ্য ব্যাক্তিকে জান্নাতে যেতে কিছুটা সাহায্য করতে পারে।
মুলকথা - জান্নাতে আল্লাহর রহমত নিয়ে যেতে হবে। সেই রহমত পাবার মাধ্যম ঈমান ও আমল। পরোকালে অনুরোধ বা সুপারিশ করে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। রাসুল (সাঃ) সুপারিশ করবেন শুধুমাত্র ঈমানদার ব্যাক্তির জন্য তাও আবার বিচারের সময় নয় - শাস্তি ভোগ করার পরে। তার সুপারিশ এর পরে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে পেতে জাহান্নামে লক্ষ কোটি বছর পার হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা - ঈমান নেই, বা নামাজ় পড়ে না, বা শিরক বা কুফুরী করে এমন ব্যাক্তির জন্য সুপারিশে হবে না। সুপারিশ ওই ব্যাক্তির জন্য যে ইমানদার মুসলমান , নামাজ পড়ে কিন্তু ছোট বড় পাপ করেছে। আর একটা কথা - আপনার পীর যত বড় কামেল বান্দা হোক না কেন সে রাসুল (সাঃ) এর চেয়ে বড় নয়। যেখানে রাসুল (সাঃ) নিজেই রক্ষা করতে পারবে না সেখানে সেই পীর কি পারবে তা বুঝতে আশা করি কস্ট হবে না।
বিষয়: বিবিধ
৩৪৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন