বেকায়দা প্রশ্নের কায়দামতন উত্তর - পর্ব ০১
লিখেছেন লিখেছেন এলিট ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৪:৫৯:০৩ রাত
যে কোন ধর্মের অনুসারীকে, বিশেষ করে মুসলমানকে নানান প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়। এসব প্রশ্নকারীর বেশির ভাগ আসলে উত্তর জানার জন্য প্রশ্ন করেন না। তারা এই ধরনের প্রশ্ন করেন উত্তরদাতাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। তাদের চেস্টা থাকে এসব প্রশ্ন করে উত্তরদাতাকে ইসলাম নিয়ে সন্দেহের মধ্যে ফেলা। এতে সহজেই ঈমান দুর্বল করা যায়। যুগে যুগে অনেক আলেম ও জ্ঞানী ব্যাক্তিরা এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আমি আলেম নই, জ্ঞানীও নই। আমি শুধু ইমানদার ও যুক্তিবাদি হওয়ার চেস্টা করেছি মাত্র।
আমার এই লেখায় ওমন কিছু বেকায়দা প্রশ্নের উত্তর আমার নিজের ভাষায় দেওয়া আছে। আমার অবশ্যই ভুল হতে পারে। সেই ভুলগুলি যুক্তি সহকারে ধরিয়ে দিবেন আশা করি। বেকায়দা প্রশ্নের উত্তরে কিছু খুজে না পেয়ে অনেক মুসলমান ভাইয়েরা কিছুটা হতাশ হয়ে যায়। তাদের সেই হতশা দূর করতে, নোনা সমুদ্রে কয়েক ফোটা মিস্টি পানি ফেলার মতনই ক্ষুদ্র আমার এই প্রচেস্টা। আপনার কাছে খটকা লাগে এমন কোন নতুন প্রশ্ন থাকলে আমাকে জানান। যদি সেটি আমার সামর্থের ভেতরে হয় তবে উত্তর দেওয়ার চেস্টা করব।
সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়, তাহলে আমি পাপ করলে আমার দোষ কোথায়? আমার বিচার হবে কেন?
এটি সবচেয়ে পুরাতন একটি প্রশ্ন। আমি এই প্রশ্ন ও এর উত্তর অনেকবার শুনেছি। উত্তরে বলা হয়, “সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হলেও আল্লাহ আমাদেরকে বিবেক দিয়েছে। ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন। কাজেই মন্দ কাজ করলে তার দায়ভার আমাদেরকেই নিতে হবে।“ এখানে কিন্তু উত্তরটি অসম্পুর্ন থেকে যায়। কারন আল্লাহ আমাদেরকে যে বিবেক বা ক্ষমতা দিয়েছেন, তা দিয়ে কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা কিছু করতে পারি না। আমি মন্দ কাজ করলেও অবশ্যই সেটিও আল্লাহর ইচ্ছাতেই করি। এখানে আমার দোষ কোথায়?
অসম্পুর্ন এই উত্তরটি সম্পুর্ন করতে গেলে আল্লাহর ইচ্ছা ও অনিচ্ছা যে আসলে কি সেটা যানতে হবে। একটি উদাহরন দিলে বিষয়টি স্পস্ট হবে। আপনার হাতে যে কোন একটি কলম নিন। এবার ভাবুন সেই কলমটি দিয়ে আপনি কি কি করতে পারেন। ওটা দিয়ে কিছু লিখতে পারেন, ওটা ভেঙ্গে ফেলতে পারেন, ওটা দিয়ে আপনার কম্পিউটার এর স্ক্রীন খোচা দিয়ে নস্ট করতে পারেন, ওটা দিয়ে আপানার সামনে বসা কোন লোককে আহত করতে পারেন, ওটা (কলমটা) কাউকে দান করতে পারেন ইত্যাদি। এরকম হাজারো কাজ আপনি ওই কলমটি দিয়ে করতে পারেন। এবার ভাবুন ওই কলমটি দিয়ে আপনি কি করতে পারেন না। ওটা গায়েব করতে পারেন না, ওটাকে পাথর বানাতে পারেন না, ওটা দিয়ে বহু দুরের কোন লোককে আহত করতে পারেন না, ওটকে বড় বা ছোট করতে পারেন না। ইত্যাদি অনেক কিছু পারেন না।
আপনি যে কাজগুলো করতে পারেন সেগুলোই আসলে আল্লাহর ইচ্ছা। যে কাজগুলো করতে পারেন না, সেগুলো আল্লাহর অনিচ্ছা। আল্লাহর অনিচ্ছা রয়েছে বলেই কাজগুলো আমাদের জন্য অসম্ভব। কলমটি পাথরের বানিয়ে ফেলবেন, এটি আল্লাহর ইচ্ছা নয়। কলমটি দিয়ে আপনি কিছু লিখবেন এটা আল্লাহর ইচ্ছা, আবার কলমটি দিয়ে কোন ব্যাক্তিকে আহত করবেন সেটিও আল্লাহর ইচ্ছা। এর কোন ইচ্ছা গ্রহন করতে আল্লাহ আমাদের বাধ্য করেন নি। আল্লাহ আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। আমরা যেই ইচ্ছা গ্রহন করব এটার জন্য আমরাই দায়ী। আল্লাহ আমাদের বাধ্য না করে স্বাধীনতা দিয়েছেন এ কারনেই আমাদের বিচার করা হবে। বাধ্য করলে বিচার হোত না।
যে মুসলিম পরিবারে জন্মেছে সে পরিবার থেকেই সুযোগ সুবিধা পেয়ে সহজে মুসলমান হতে পেরেছে। অপরদিকে অমুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া লোকটি সেই সুযোগ না পেয়ে অমুসলিম হয়েছে। ওদিকে আবার পরকালে অমুসলিম বেহেস্তে যেতে পারবে না। এখানে একজনকে বেশী সুযোগ ও অপরজনকে কম সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। জন্মের উপরে তো সেই ব্যাক্তির হাত নেই। এখানে সুবিচার কিভাবে হল?
প্রথমে বুঝতে হবে মুসলমান কাকে বলে। মুসলমান পরিবারে জন্মালেই সেউ মুসলমান হয় না। মুসলমানের খাতায় নাম লেখাতে গেলে সর্বনীম্ন যেটা থাকতে হবে সেটা হল একমাত্র (আবারো বলছি - একমাত্র) আল্লাহর প্রতি ইবাদত (উপাশনা) , আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ও কোরআনের বানীর প্রতি পুর্ন বিশ্বাস এবং এর সঙ্গে পাচ ওয়াক্ত নামাজ। এটা হল মুসলমান হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা। এবার আপনি বিচার করুন মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া কতজন মুসলমান আছে।
উপরের কাজগুলি না করা একজন মুসল্মান পরিবারের সন্তান ও একজন অমুসলিম এর মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। আল্লাহ বেহেস্ত ও দোযখের ফয়সালা জন্ম অনুসারে করবেন না। তিনি করবেন আমাদের ইবাদত অনুসারে।
৫০ বছর বয়সী কোন অমুসলিম ব্যাক্তি যদি মুসলমান হয় তখন তার পুর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। অপরদিকে ৫০ বছর বয়সী একজন জন্মগত মুসলমান কিন্তু পাপের বোঝা থেকে এত সহজে মুক্তি পাচ্ছে না। কাজেই জন্মগত মুসুলমান এর জন্য মুসলমান হওয়া সহজ হলেও পাপমুক্তি কঠিন। ওপরদিকে অমুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া লোকটির জন্য সমাজ-ধর্ম ত্যাগ করা কঠিন হলেও পাপমুক্তি সহজ। এখানে উভয়কেই দুই ধরনের সুযোগ দিয়ে সুবিচার করা হয়েছে।
রিজিকের মালিক আল্লাহ। তাহলে কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ছে আবার কেউ না খেয়ে মারা যাচ্ছে কেন? তাছাড়া রিজিকের মালিক আল্লাহ হলে আমাদেরকে রোজগার করে খেতে হয় কেন? ঘরে বসে আল্লাহর নাম নিলে তো খাবার জুটছে না।
খাদ্য প্রানীদেহে শক্তি যোগায়, বাচিয়ে রাখে। এই খাদ্য কিন্তু আসে যে কোন জীবদেহ থেকে। খাবার খেতে হলে অবশ্যই কোন জীব (প্রানী বা উদ্ভিদ) খেতে হবে। এই জীব কিন্তু আল্লাহর তৈরি। গবেষনাগারে হয়ত স্বর্ন বা হীরা তৈরি করা যায় কিন্তু খাদ্য তৈরি করা যায়না। জীব ও জীবন আল্লাহরই দান।
মানুষ একমাত্র প্রানী যে না খেয়ে মারা যায়। অন্য প্রানীরা বন্দী না থাকলে তাদের খাবার ঠিকই খুজে নেয়। নিজের এলাকায় খাবার না পেলে দলে দলে হাজার কিলোমিটার দূরে পাড়ি জমায়। খাবারের জন্য প্রথমে বাঘ একটি হরিন ধরে। এরপরে নিজের যতটুকু লাগে ততটুকু নিয়ে বাকিটুকু ফেলে চলে যায়। এর পরে শেয়াল খায় এবং বাকিটুকু রেখে চলে যায়। এরপরে শকুন খায় ও বাকিটুকু রেখে চলে যায়। এর পরে পোকা মাকড় খায়। যার যতটুকু লাগে সেটুকু খেয়ে বাকিটুকু ফেলে রাখে অন্য প্রানীর জন্য। মানুষের মধ্যে এই পদ্ধতি নেই। আমরা একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগীতা করি। একজন মানুষ হাজারো, লাখো মানুষের খাবার আটকে রাখে। কাজেই আল্লাহর দেওয়া রিজিক সবার হাতে পৌছায় না। মানুষের এই দুর্দশার কারন মানুষ নিজেই। একজন আরেকজনের খাবার আটকে রাখে বলেই আমাদেরকে ওই খাবারের অংশবিশেষ নিতে গেলে কিছু বিনিময় দিতে হয়। সেই বিনিময় টাকা কিংবা শ্রম। কাজ করলে টাকা পাওয়া যায়। সেই টাকায় আটকে রাখা খাবারের কিছু অংশ কিনে আনা যায়। খাবার আটকে রাখার পদ্ধতি না থাকলে কারোরই খাবারের অভাব হোত না। এছাড়াও আরেকটি সমস্যা আমাদের আছে। সেটি হল আমরা পশুপাখীর মতন সহজে দেশত্যাগ করতে পারি না। এক্ষেত্রেও রয়েছে আটকে রাখার পদ্ধতি। আমরা দেশের বর্ডার আটকে রাখি যাতে করে অন্য দেশের কেউ না ঢুকতে পারে। আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়া দিয়েছেন ও আমাদের খাবার দুনিয়াতে ছড়িয়ে রয়েছে। আমারা সেই খাবার ও সীমানা আটকে রেখে এই অসম বন্টন তৈরি করেছি।
ইসলামে ৪টি বিয়ে জায়েজ করা হয়েছে কেন।
ইসলাম পরিপুর্ন জীবন বিধান। একজন মুসলিম জীবনে কিভাবে চলবে তার খুটিনাটি আদেশ নিষেধ রয়েছে ইসলামে। এতে ৪টি বিয়ে জায়েজ করা হয়েছে, বাধ্যতামুলক নয়। অন্য ধর্মে কয়টি বিয়ে করবে তার কোন সীমানা দেওয়া নেই। কাকে বিয়ে করা বৈধ সেটাও স্পস্ট বলা নেই। এর জন্য অমুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন কায়দায় বহুবিবাহ দেখা যায়। যেমন, দুই বোন এক স্বামীর ঘর করছে, মা ও মেয়ে এক স্বামীর ঘর করছে, ভাগনী মামাকে বিয়ে করছে (ভারতের তামিল নাড়ুতে), চার ভাই মিলে এক মেয়েকে বিয়ে করছে (নেপালে)। ৩৭ জন বউয়ের সাথে একসাথে ঘর করে ভারতে এক ব্যাক্তি বিশ্ব রেকর্ড করেছে। ইসলাম যেহেতু জীবন ব্যাবস্থা, সেহেতু কাকে বিয়ে করা যাবে এবং কতগুলো বিয়ে করা যাবে এর স্পস্ট নির্দেশ রয়েছে। চারটি বিয়ে করতে কেউ বাধ্য নন। তাছাড়া স্ত্রীদের মধ্যে সমতা বিধান করার কথাও বলা আছে। তা না হলে রয়েছে পরোকালে শাস্তি। দুই স্ত্রীর মধ্যে সমতা বিধান করাই কঠিন সেখানে চারটে বিয়ে করা মানে নিজেকে আরো বিপদে ফেলা। পরোকালে শাস্তি বাড়ানোর পথ সুগম করা। এদিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, ইসলামে ৪টি বিয়ের অনুমতি থাকলেও আসলে একাধিক বিয়ে করতে নিরুতসাহিত (পরোক্ষভাবে নিষেধ) করা হয়েছে।
রাসুল (সাঃ) এর বক্ষ উন্মোচন করে ফেরেশতা উনার হৃদয় পরিস্কার করেছে। পাপ পুন্য থাকে যে হৃদয়ে সেটা কিন্তু বুকে নয়। সেটা থাকে মস্তিস্কে। তাহলে মাথা খুলে মগজ পরিস্কার না করে কেন বুক খুলে হৃতপিন্ড পরিস্কার করলে? তাছাড়া রাসুল (সাঃ) তো নিঃস্পাপ ছিলেন। তার হৃদয় পরিস্কার করতে হলো কেন?
বক্ষ উন্মোচনের ধটনা ঘটে মেরাজের সময়, যখন রাসুল (সাঃ) আল্লাহর সাথে সাক্ষ্যাত করতে গিয়েছিলেন। আল্লাহর মর্যাদা এত বেশী যে রাসুল (সাঃ) এর মতন নিঃস্পাপ আল্লাহর প্রিয় বান্দাও হৃদয় পরিস্কার করা ছাড়া তার কাছে যেতে পারে না। আপনার হাত পা যতই পরিস্কার থাকুক, অযু না করে কিন্তু নামাজ পড়া যায় না। নামাজ আল্লাহর ইবাদত মাত্র। যেখানে আল্লাহর সাথে সাক্ষ্যাত এর জন্য হৃদয় পরিস্কার করতে হবে এটাই স্বাভাবিক।
আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার মালিক। উনি চাইলেই সেটি হয়ে যায়। তাহলে উনি যদি চান তাহলে হৃদয় এমনিতেই পরিস্কার হয়ে যাবে। দেহ থেকে খুলে হৃদয় বের করতে হবে না। এর পরেও ফেরেস্তারা এটি করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য একটাই, আমাদেরকে দেখানো বা জানানো। আল্লাহ চাইলেন আর এমনিতেই হৃদয় পরিস্কার হয়ে গেল। এটা আমাদের জন্য বুঝতে কস্ট হোত। তাই আমাদেরকে দেখাতে দেহ খোলার এই ব্যাবস্থা। রাসুল (সাঃ) এর আমলে মানুষের ধারনে ছিল যে হৃদয় মানুষের বুকে থাকে। কাজেই তখন যদি মাথার মগজ খোলা হোত তবে এটা রসুল (সাঃ) আরব বাসীকে বোঝাতে পারতেন না। এমনিতেই মেরাজের ঘটনা তারা বিশ্বাস করেনি। সেখানে তিনি যদি বলতেন “আমার মাথার মগজ খুলে হৃদয় পরিস্কার করেছে” তাহলে সবাই এটি নিয়ে হাসাহাসি করত। তিনি যখন বুক খোলার কথা বলেছেন তখন অনেকের কাছে বিষয়টি সঠিক মনে হয়েছে।
আল্লাহ চাইলেই, আমাদের যে কোন অঙ্গ খুলে বা না খুলে হৃদয় পরিস্কার করতে পারেন। বুক খুলে হৃদয় পরিস্কার করাটা আমাদেরকে দেখানো, জানানো ও বোঝানোর জন্য।
বিষয়: বিবিধ
২৩৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন