আন্তঃজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়ের ছক

লিখেছেন লিখেছেন এলিট ১৫ জুলাই, ২০১৩, ০৯:০২:২৫ রাত



রাজনীতি হল রাজার নীতি। সাধারন জনগনের এটা বোঝার সাধ্য হয়ে ওঠে না। নুন আর পান্তা যোগাড় করতেই দিন যায়, রাজনীতি বুঝবে কখন? রাজনীতি বোঝে ও করতে পারে তারা যাদের ফাউ টাকা ও সময় রয়েছে। নিজের পেট ভরা থাকলে তবেই তো অন্যের সঙ্গে রাজনীতি, গুটিবাজি ও দাবার চাল দেওয়া যায়।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গিকার ছিল এটি। অন্য অঙ্গিকার ভুলে গেলেও এটি তারা ভোলেনি এবং অবস্থা দেখে সবাই বুঝতে পেরেছে যে এই বিচার করাটাই তাদের গদিতে বসার অন্যতম উদ্দেশ্য। পচন ধরা রাজনীতিবিদের পাশাপাশি সারা দেশে এখনো ৪০% মানুষ আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক। আওয়ামী লীগ তাদেরকে কোনদিন কোন উপকার করেছে কিনা তা তারা জানেনা, জানতেও চায় না। তারা শুধু জানে জয় বাংলা। তারা শুধু জানে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে আওয়ামী ব্যানারে কোন কলাগাছ প্রার্থী হলেও তাকেই ভোট দিবে।

বাংলাদেশে গত ৬ মাস যাবত রাজনৈতিক অস্থিরতা, মারামারি, দাঙ্গা হাঙ্গামা এসবের মুল কারন মাত্র দুটি। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও তত্বাবধায়ক সরকার বাতিল। পরের বার আবার ক্ষমতায় আসতে গেলে এই দুটিতে কোন ছাড় দেওয়া চলবে না। আওয়ামী লীগ তাই সেই ছক মতন কাজ করছে - সেই সাথে ট্রাইবুনালও।

একটি কথা আমি বহুবার বলেছি - যে দেশে লক্ষ লোক শহিদ হয়েছে সেই দেশে কয়েক হাজার যুদ্ধাপরাধী থাকার কথা যারা সমাজের সব দলে ও শ্রেনীতে ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু যখন দেখা যায় একটি বিশেষ দলের ৭-৮ জনকে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সম্মুখীন তখন এই বিচারের নিরপেক্ষতা সহজেই বোঝা যায়। বোঝা যায় যে - এটা যুদ্ধাপরাধীর বিচার নয়, এটা বিরোধী দল দমনের বিচার। আওয়ামী লীগের মধ্যেই বড় পদে সনামধন্য রাজাকার রয়েছে। বিএনপি বড় দল কিন্তু এর অবকাঠামো নড়বড়ে ও এলোমেলো। ছোট দল হলেও জামায়াত এর অবকাঠামো অনেক গোছানো। জামায়াত নামক এই গাছটিকে চারা অবস্থায় কেটে ফেলতে না পারলে এই গাছ অচিরেই বটগাছ হয়ে যাবে। তাই সময় থাকতে থাকতেই এই যুদ্ধাপরাধীর বিচারের নামে চলছে বিরোধী দল দমন।

ট্রাইবুনালের নামঃ এই ট্রাইবুনালের নামের মধ্যেই বড় এক চালাকি রয়েছে। আপনার মহল্লাতে দেখবেন কোন একটি শাড়ীর বা কসমেটিকসের দোকানের নাম "আবুল ইন্টারন্যাশনাল"। ওই দোকানের কেউই দেশের বাইরের কেউ নয়, তারা আন্তঃজাতিক কোন ব্যাবসা করে না। মোট কথা তাদের দোকানের নাম নাম "ইন্টারন্যাশনাল" কিন্তু সেখানে ইন্টারন্যাশনাল বা আন্তঃজাতিক কিছুই নেই। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য যে ট্রাইবুনাল রয়েছে তার নাম সেরকম "আন্তঃজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল"। এখানে আন্তঃজাতিক কোন মামলার বিচার হয়না, আন্তঃজাতিক কোন ব্যাক্তি এই বিচার কার্যে নাক গলানো তো দুরের কথা , পর্যবেক্ষন করারই সুযোগ পায় না। এই ট্রাইবুনাল নামে আন্তঃজাতিক হলেও এতে আন্তঃজাতিক কিছুই নেই।

ট্রাইবুনালে মামলার নামঃ এই ট্রাইবুনালে যে সকল মামলা উপস্থাপন করা হয়েছে সেসব মামলাকে আমরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার বলে জানি। ভাষনে, টিভিতে, টক শোতে, সংবাদে, চায়ের দোকানের আলোচনায় - সব জায়গাতেই আমরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার বলেই শুনে থাকি। আসলে কাগজে কলমে এই সকল মামলার নাম "মানবতা বিরোধী অপরাধ" এর বিচার। সাধারন জনগনের এত গভীর ভাবে চিন্তা করার সময় হয়না। তাই অনেকে না বুঝেই তাল দিয়ে যায়। একটু ভেবে দেখুন যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী একেবারেই আলাদা। অনেকে মনে করেন, যারা যুদ্ধের সময় হত্যা, লুট ও ধর্ষন করে তারাই যুদ্ধাপরাধী। আসলে যুদ্ধে হেরে যাওয়া দলের বন্দী সদস্যকে যুদ্ধাপরাধী বলা হয়। যুদ্ধে জিতে যাওয়া দল যদি আরো বেশী হত্যা বা ধর্ষন করে তবুও তারা কখনো যুদ্ধাপরাধী হয় না। যুদ্ধাপরাধী সবসময় হেরে যাওয়া দলের সদস্য। হত্যা, লুট ও ধর্ষন এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ - তা সেগুলো যুদ্ধের সময় বা অন্য সময় যখনই হোক না কেন।

প্রচার করা হচ্ছে - আন্তঃজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে ।

আসলে হচ্ছে - আভ্যন্তরীন(দেশীয়) ট্রাইবুনালে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার।

তার মানে এই বিচার করা হচ্ছে ওই সব হত্যা লুট ও ধর্ষনের - এর সাথে যুদ্ধের কোন সম্পর্ক নেই। মজার ব্যাপার এই বিচার সাধারন আদালতেই করা যায়। নতুন করে নাটকীয় ট্রাইবুনাল বানানোর দরকার পড়ে না। কিন্তু এই ট্রাইবুনাল বানিয়ে দুটি কাজ হয়েছে। এক, জনগনকে বুঝ দেওয়া গেছে যে সরকার আলাদা এক ট্রাইবুনাল বানিয়ে বেশ কায়দা করে যুদ্ধাপরাধীর বিচার করছে, জাতীকে কলঙ্ক মুক্ত করছে। দুই, সাধারন আদালতে এই বিচার হলে আইনের বিভিন্ন মারপ্যাচে রায় ইচ্ছেমতন করা যেত না। আদালতের সেই বিচারক আওয়ামী লীগ পন্থী নাও হতে পারতেন। কিন্তু ট্রাইবুনালে সব নিজস্ব লোক - যা খুশি তাই রায় দেওয়া গেছে। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে স্কাইপী কেলেঙ্কারী ও ফেসবুকের মাধ্যমে জনগন তা জেনেও গেছে।

রায়ের ছকঃ মামলায় রায়ের একেবারে ছকে বাধা। কার অপরাধ কতটা গুরুতর বা কতটা প্রমানীত তা কোন বিষয় নয়। রায় আগে থেকেই প্রস্তত তা সাক্ষ্য প্রমান আর বিচার যাই হোক না কেন।

- প্রথমে রায় হল পলাতক বাচ্চু রাজাকারের। সে নাকি ২ টি হত্যার অপরাধী তার ফাসির রায় হল।

- কাদের মোল্লা, যে কিনা বন্দী। সে নাকি ৩৪৫টি হত্যার আসামী। তার হল যাবদজীবন কারাদন্ড।

- দেলোয়ার হোসাইন সায়ীদী, উনিও বন্দী। তিনি নাকি ২টি হত্যার অপরাধী। তার ফাসীর রায় হল।

- গোলাম আজম - রাজাকার হিসাবে তার বহুল পরিচিতি রয়েছে। তার হল যাবদজীবন কারাদন্ড (যদিও বয়সের বিবেচনায়)

রায়ের এই ছক দেখে বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ আসলে জামাতের এই নেতাদেরকে এই মুহুর্তে মেরে ফেলতে সাহস পাচ্ছে না (জনগনের ভয়ে)। কে যানে জনগন ক্ষেপে গেলে হীতে বীপরিত হতে পারে। তাই তারা সুকৌশলে এই রায়ের ছক বানিয়েছে। আসল ধটনা যাই হোক না কেন গত ২০ বছর ধরে গোলাম আজম, নিজামী সহ জামায়াত ই ইসলামকে রাজাকার হিসাবে এত বেশী প্রচার করা হয়েছে যে রাজাকার কথাটা বলতেই গোলাম আজম সহ জামাতের অনেকেরই ছবি চোখে ভাসে। কিন্তু দেলোয়ার হোসাইন ছিলেন আলাদা। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে নামকরা বক্তা। জামায়াতকে পছন্দ না করলেও সায়ীদীকে পছন্দ করত দেশের অধিকাংশ মানুষ। তাকে কিন্তু গ্রেফতার করা হয়েছিল একজন মওলানাকে অবমাননা করার দায়ে, পরে তাকে যুদ্ধাপরাধীর মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমেই তাকে যুদ্ধাপরাধী বললে জনগন তা মেনে নিত না।

বিশ্বব্যাপী এই ধরনের রাজনীতির খেলা অনেক পুরোনো আমল থেকে চলে আসছে। এসব বিষয়ে সবচেয়ে পারদর্শী হল ইহুদীরা। আমি নিজে কম বেশী ইহুদীর সাথে উঠা বসা করে দেখেছি। ওদের মুলনীতি হল - আপনাকে বিভিন্ন ভাবে এক ধরনের (মানষিক) চাপের উপরে রাখবে। আস্তে আস্তে এই চাপ বাড়তে থাকবে। আপনি যখন (রেগে) ফোস করে উঠবেন তখন সরি বলবে। কয়েকদিন ভালো থাকবে তারপরে আবার শুরু করবে সেই খেলা। আবার ধমক দিলে ঠান্ডা হবে।

এই একই পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগ কাজ করে যাচ্ছে। প্রথমে করেছে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার। দেখেছে, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পরেও যে দেশের মানুষ চোখের পানি ফেলেনি, সেই দেশের মানুষই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীর ফাসী হওয়াতে মিস্টি বিতরন করেছে। এর পরে এক মওলানাকে অবমাননার দায়ে সায়ীদীকে গ্রেফতার করে দেখেছে। এদেশের মানুষ নীরব। এর পরে তাকে বানিয়েছে যুদ্ধাপরাধী। মানুষ তখনো নীরব। এর পরে কাদের মোল্লাকে ৩৪৫ টি হত্যার জন্য দায়ী করেও ফাসীর রায় না দিয়ে শুরু করেছে শাহবাগ নাটক। দেশের জনগন প্রথম প্রথম শাহবাগে গা ভাসিয়েছে। এই সুযোগে সায়ীদীর গাসির রায় দিয়েছে। জনগন তখনো নীরব। হাঙ্গামা যা করার তা শিবির করেছে। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বেশী রাগ হল সায়ীদীর উপরে। তিনি তার বিভিন্ন বক্তব্যে আওয়ামি লীগের নামে অনেক কটুক্তি করেছেন যা এভাবে প্রকাশ্যে করতে আর কেউ সাহস পায়নি। আওয়ামী লীগের বিবেচনায় যে যত বড় রাজাকার হোক না কেন - তাদের টার্গেট সায়ীদী। এখন তারা তালে আছে সায়ীদীকে কিভাবে মেরে ফেলা যায়। সায়ীদিকে মারার পরেও যদি জনগন নীরব থাকে তবে বাকী নেতাদের (যারা রাজাকার হিসাবে সুপরিচিত) মারতে কোন বেগ পেতে হবে না। অনেকে তো বয়সের ভারে এমনিতেই অকেজো হয়ে গেছেন। আমাদের এখন শেষটা দেখা বাকি। আওয়ামী লীগ একের পরে এক রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে আর জনগন নীরব থাকে - নাকি সেই মুক্তিযুদ্ধের মতন জনগন তাদের শক্তি দেখিয়ে দিতে পারে।

বিষয়: বিবিধ

১৭৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File